অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো



বিভূতি-পাদ (অধ্যায় ৩): যোগসূত্রের তৃতীয় অধ্যায়ের নাম বিভূতিপাদ। এখানে পতঞ্জলি ব্যাখ্যা করেছেন যোগের গভীরতম অনুশীলন—ধারণা, ধ্যান ও সমাধি—এবং তাদের সম্মিলিত প্রয়োগ, যাকে বলা হয় সম্যম (saṃyama)—সম্পর্কে।

ধারণা মানে মনকে এক বিন্দুতে স্থির রাখা। ধ্যান মানে সেই মনোসংযোগের ধারাবাহিক প্রবাহ, যেখানে মন একাগ্র হয়ে থাকে। সমাধি মানে ধ্যানের গভীরতম স্তর, যেখানে ধ্যানী ও ধ্যেয় একাকার হয়ে যায়।

এই তিনটি ধাপ—ধারণা, ধ্যান ও সমাধি—যখন একত্রে সাধিত হয়, তখন সেটিই সম্যম (সূত্র ৩.১–৩.৫)। সম্যমের প্রয়োগে যোগী চিত্তের সূক্ষ্ম স্তরগুলিতে প্রবেশ করতে পারেন, ফলে নানা বিভূতি বা সিদ্ধি প্রকাশ পায়—যেমন অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের জ্ঞান, অন্যের মন পাঠ, সূক্ষ্ম বা বিশাল বস্তুর উপলব্ধি, অদৃশ্য জানা ইত্যাদি (সূত্র ৩.১৬ ও পরবর্তী সূত্রসমূহে উল্লিখিত)।

তবে পতঞ্জলি স্পষ্ট সতর্কবাণী দিয়েছেন—এই বিভূতিগুলি যোগীর মূল লক্ষ্য নয়, বরং সমাধির পথে উপসর্গ মাত্র। এগুলোর প্রতি আসক্তি জন্মালে মন আবার বন্ধনে জড়িয়ে যায়। সূত্রে বলা হয়েছে—এই ক্ষমতাগুলিতে আসক্ত হলে যোগী পতিত হয় (৩.৩৭, ৩.৫০)।

সম্যমের প্রকৃত ফল হলো অন্তঃশুদ্ধি, অর্থাৎ মন সম্পূর্ণ পরিষ্কার, অহংমুক্ত ও স্থির হওয়া; সূক্ষ্ম বৈরাগ্য, অর্থাৎ সব ক্ষমতা ও আনন্দের ঊর্ধ্বে উদাসীনতা; এবং এই অবস্থাতেই যোগী নির্বীজ সমাধি-র উপযুক্ত হয়ে ওঠে—যেখানে মন সম্পূর্ণ বীজহীন, কর্ম ও ক্লেশের সমস্ত অবশিষ্টও বিলীন।

নির্বীজ সমাধি যোগসূত্রে বর্ণিত যোগের চূড়ান্ত ও সর্বোচ্চ স্তর, যেখানে মন সম্পূর্ণভাবে শান্ত, বীজহীন এবং আত্মস্বরূপে নিবিষ্ট হয়।

‘নির্বীজ’ মানে যেখানে কোনো বীজ নেই। এখানে ‘বীজ’ বলতে বোঝানো হয়েছে চিন্তা, সংস্কার, স্মৃতি বা কোনো প্রকার মানসিক ছাপ, যা ভবিষ্যতে আবার ভাব বা কর্ম হিসেবে প্রকাশ পেতে পারে। নির্বীজ সমাধিতে মন থেকে এসব বীজ সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ হয়ে যায়।

যোগসূত্রে বলা হয়েছে, “তস্যাপি নিরোধে সর্বনিরোধাত্‌ নির্বীজঃ সমাধিঃ” (১.৫১)। অর্থাৎ, যখন সব ধরনের বীজ বা সংস্কারও সম্পূর্ণভাবে নিবৃত্ত হয়, তখনই নির্বীজ সমাধি লাভ হয়।

এই সমাধিতে কোনো ধ্যানবস্তু থাকে না। যোগী এখানে কোনো প্রতীক, শব্দ, দেবতা বা চিন্তার ওপর ধ্যান করেন না। মন সমস্ত অবলম্বন হারিয়ে নিজের চেতনার মধ্যেই লীন হয়ে যায়।

এই অবস্থায় কর্তা, কর্ম ও কর্মফল—সব ধারণা বিলীন হয়। দ্রষ্টা ও দৃশ্যের দ্বৈততা লোপ পায়। মন ও পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদ থাকে না—শুদ্ধ চৈতন্যই অবশিষ্ট থাকে।

নির্বীজ সমাধি হলো ক্লেশ, কর্ম ও সংস্কার-মুক্ত চেতনার অবস্থা। এখানেই ঘটে কৈবল্য, অর্থাৎ পরম মুক্তি, যেখানে পুরুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং প্রকৃতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকে না।

বেদান্তে যাকে বলা হয় ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার বা অদ্বৈত অবস্থা, যোগদর্শনে সেটিই নির্বীজ সমাধি। এটি হলো সমস্ত ভাব, জ্ঞান ও কর্মের অতীত তুরীয় চেতনা, যেখানে শুধু স্বরূপে অবস্থান—চিরনির্বাণ, চিরশান্তি ও চিরস্বাধীনতা।


কৈবল্য-পাদ (অধ্যায় ৪): যোগসূত্রের চতুর্থ অধ্যায়ের নাম কৈবল্যপাদ। এখানে পতঞ্জলি ব্যাখ্যা করেছেন চিত্ত, গুণ, কর্ম ও সংস্কারের সূক্ষ্ম তত্ত্ব, এবং মুক্তির চূড়ান্ত অবস্থা—কৈবল্য।

যোগসূত্রে প্রথমেই বলা হয়েছে—সিদ্ধি বা বিভূতি পাঁচভাবে লাভ হতে পারে—জন্ম, ওষধি, মন্ত্র, তপঃ ও সমাধি (৪.১)।

সিদ্ধি বা বিভূতি যোগদর্শনে এমন কিছু অতিন্দ্রিয় শক্তি বা বিশেষ ক্ষমতা, যা গভীর ধ্যানের ফলে চিত্ত সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশ পায়।

সিদ্ধি শব্দের অর্থ সিদ্ধ অবস্থা, অর্থাৎ যে-কোনো সাধনার মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতা, সাফল্য বা শক্তি। বিভূতি মানে ঐশ্বর্য বা অতিপ্রাকৃত সামর্থ্য। পতঞ্জলি এই দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন চিত্তনিয়ন্ত্রিত যোগীর অন্তর্নিহিত শক্তি বোঝাতে।

বলা হয়েছে, জন্মজাত অর্থাৎ প্রাকৃতিক সামর্থ্য, ওষধি বা তন্ত্রোৎপন্ন ভেষজ প্রয়োগ, মন্ত্রের শব্দশক্তি, তপস্যা বা সংযমী সাধনা এবং গভীর ধ্যান—এসবের ফলেই এই শক্তিগুলির উদ্ভব হয়।

ধারণা, ধ্যান ও সমাধি একত্রে অনুশীলিত হলে তাকে বলা হয় সম্যম। সম্যমের মাধ্যমে যোগীর চিত্ত যখন কোনো বস্তুর উপর সম্পূর্ণ মনোনিবেশিত হয়, তখন সেই বস্তুর সূক্ষ্ম তত্ত্ব, প্রকৃতি, কারণ ও অবস্থান সম্পর্কে যোগী প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করেন। এইভাবেই জন্ম নেয় নানা বিভূতি।

এই বিভূতিগুলির মধ্যে আছে অতীত ও ভবিষ্যতের জ্ঞান, মন-পাঠ, সূক্ষ্ম বা অদৃশ্য বস্তুর উপলব্ধি, স্থূল দেহ অতিক্রম, দূরদর্শিতা, লঘুত্ব, গুরুত্ত্ব, বা বিভিন্ন স্থানে একসঙ্গে উপস্থিতি।

তবে পতঞ্জলি স্পষ্ট সতর্ক করেছেন—এই বিভূতিগুলি যোগীর মূল লক্ষ্য নয়। এগুলি সমাধির পথে উপসর্গ, অর্থাৎ পার্শ্বফল মাত্র। যদি যোগী এগুলির প্রতি আসক্ত হয়, তবে মন আবার অহংকারে জড়িয়ে পড়ে এবং মুক্তির পরিবর্তে নতুন বন্ধন সৃষ্টি হয় (৩.৩৭, ৩.৫০)।

সিদ্ধি বা বিভূতির উদ্দেশ্য আসলে ক্ষমতা অর্জন নয়, বরং চিত্তের পরিশুদ্ধি ও ঈশ্বরচেতনার বিকাশ। যখন যোগী এসব পার্শ্বশক্তিরও ঊর্ধ্বে উঠে সম্পূর্ণ আসক্তিহীন থাকে, তখনই নীর্বীজ সমাধি ও কৈবল্য ঘটে—যোগের পরম পরিণতি।

গীতায় ‘বিভূতি’ শব্দের অর্থ হলো ঈশ্বরের প্রকাশরূপ শক্তি বা ঐশ্বর্য। শব্দটি এসেছে “ভূ” ধাতু থেকে, যার মানে অস্তিত্ব লাভ করা বা প্রকাশিত হওয়া। বিভূতি মানে সেইসব রূপ, যার মাধ্যমে ঈশ্বর নিজের সত্তা, শক্তি ও উপস্থিতি প্রকাশ করেন।

গীতার দশম অধ্যায়ের নামই ‘বিভূতি-যোগ’। এখানে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে জগতের সমস্ত কিছুর উৎস হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “অহং সর্বস্য প্রভবঃ, মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে”—আমি সর্বকিছুর উৎপত্তিস্থল, সব কিছুই আমার থেকেই প্রকাশিত। (১০.৮)

এই অধ্যায়ে কৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেন যে, তাঁর অসীম সত্তা জগতে নানা রূপে প্রকাশ পায়—ব্রহ্মা, রুদ্র, ঋষি, গঙ্গা, সূর্য, চন্দ্র, পর্বত, বৃক্ষ, প্রাণী, বীর, জ্ঞানী, দেবতা—সবই তাঁর বিভূতি বা প্রকাশ।

গীতায় বিভূতি কোনো যোগীর ব্যক্তিগত ক্ষমতা নয়, বরং ঈশ্বরের সগুণ প্রকাশ। জগতের শ্রেষ্ঠ, মহৎ, জ্ঞানী বা শক্তিধারী জীবগণ নানা-রূপে ঈশ্বরের একেক অংশ হিসেবে প্রকাশিত। যেখানে সৌন্দর্য, প্রজ্ঞা, শক্তি, দয়া বা বীরত্ব আছে, সেখানেই ঈশ্বরের আভাস। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “যে যে শোভা, গরিমা, শক্তি যেতেই থাকে—তা তুমি জানো, তা আমার তেজো-অংশ (আলোর অংশ) দ্বারা উৎপন্ন।” (১০.৪১)

বেদান্তমতে, এই বিভূতি জগতের মধ্যে ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ প্রকাশ। সূর্যের আলো যেমন সূর্যকে প্রকাশ করে, তেমনি প্রতিটি গুণ, শক্তি ও মহিমা ব্রহ্মেরই প্রতিফলন। জগৎ মায়াময় হলেও, সেই মায়ার মধ্যেই ঈশ্বরের শক্তি ও প্রজ্ঞা প্রকাশিত থাকে—এটাই বিভূতি।

গীতা বিভূতিতে আসক্ত হতে শেখায় না, বরং বিভূতির মাধ্যমে ঈশ্বরচেতনা জাগাতে বলে। অর্জুন বলেন, “হে জনার্দন, তোমার যোগশক্তি ও ঐশ্বর্য (বিভূতি) সম্বন্ধে আরও বিস্তারিতভাবে বলো; তোমার অমৃতবাণী শুনে আমার তৃপ্তি হচ্ছে না।” (১০.১৮) কৃষ্ণ উত্তর দেন, “হে অর্জুন, এত বিশদে জানারই-বা কী দরকার? আমি তো আমার এক অতি ক্ষুদ্র অংশ দিয়েই এই সমগ্র জগৎ ধারণ করে আছি।” (১০.৪২)

যোগসূত্রে বিভূতি মানে যোগীর মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি, কিন্তু গীতায় বিভূতি মানে ঈশ্বরের বিশ্বব্যাপী প্রকাশ। যোগসূত্রের লক্ষ্য চিত্তনিয়ন্ত্রণ ও মুক্তি, আর গীতার লক্ষ্য ঈশ্বরের সর্বব্যাপী অনুভব ও ভক্তি। গীতার বিভূতি দর্শন বলে, যেখানে মহত্ত্ব, সৌন্দর্য ও জ্ঞান আছে, সেখানেই ঈশ্বর আছেন। এই বিভূতিগুলিকে চিনে ঈশ্বরের সর্বব্যাপী উপস্থিতি অনুভব করাই বিভূতি-যোগের উদ্দেশ্য। এতে ভক্তি ও জ্ঞান মিলিত হয়ে মানুষকে নিয়ে যায় সেই পরম সত্যের উপলব্ধিতে, যিনি এক অথচ অসংখ্য রূপে প্রকাশিত।

চিত্তের অসংখ্য ধারা থাকতে পারে। পতঞ্জলি বলেন—“চিত্তের নানা রূপ বা ধারা হয়, এবং প্রতিটি ধারা নিজের নিজস্ব সংস্কার বা মানসিক ছাপ বহন করে।” (যোগসূত্র, ৪.৫)। প্রতিটি চিত্তধারায় অতীত অভিজ্ঞতার ছাপ জমে থাকে, যা ভবিষ্যৎ চিন্তা, ইচ্ছা, প্রবৃত্তি ও কর্মের কারণ হয়ে ওঠে। এই কারণেই মানুষের মনে একাধিক চিন্তার প্রবাহ একসঙ্গে কাজ করে—কখনো পরস্পরবিরোধী, কখনো সামঞ্জস্যপূর্ণ। যোগসূত্র বলে, ‘চিত্তনিয়ন্ত্রণ’ মানে কেবল চিন্তা থামানো নয়, বরং সমস্ত সংস্কারধারাকে স্থির ও শান্ত করা।

কর্মও নানা প্রকৃতির হতে পারে। পতঞ্জলি বলেন—“যোগীর কর্ম অশুক্লাকৃষ্ণ, কিন্তু অন্যদের কর্ম তিন রকম—শুভ, অশুভ ও মিশ্র।” (যোগসূত্র, ৪.৭)। এই কর্মগুলির চারটি রূপ হলো—

শুক্ল, অর্থাৎ শুভ কর্ম। এটি সত্ত্বগুণপ্রধান, যা জ্ঞান, শান্তি ও সদাচার বৃদ্ধি করে। এর ফল সুখ ও পবিত্রতা।

কৃষ্ণ, অর্থাৎ অশুভ কর্ম। এটি তমোগুণপ্রধান, যা অজ্ঞতা, হিংসা, অলসতা ও দুঃখ বৃদ্ধি করে।

শুক্ল-কৃষ্ণ, অর্থাৎ মিশ্র কর্ম। এটি রাজোগুণপ্রধান, যেখানে সুখ ও দুঃখ উভয় ফল বিদ্যমান থাকে। অধিকাংশ মানুষের কর্ম এই শ্রেণিতে পড়ে।

অশুক্লাকৃষ্ণ, অর্থাৎ যোগীর কর্ম। এখানে কর্তা-বোধ ও ফল-আসক্তি নেই। এই কর্ম নির্গুণ, তাই এটি আর কোনো বন্ধন সৃষ্টি করে না।

পতঞ্জলি বলেন—“প্রতিটি কর্ম তার উপযুক্ত অবস্থায় ফল দেয়, যেমন বীজ সঠিক সময়ে অঙ্কুরিত হয়।” (যোগসূত্র, ৪.৮)। যোগী যে-কর্ম করেন তা ক্লেশ বা আসক্তিতে আবদ্ধ নয়, তাই মুক্তির পথে তার কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় না।

এই সমস্ত কর্মফল ও চিত্তগতি আসলে গুণত্রয়ের—সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—ক্রিয়া মাত্র। সত্ত্ব জ্ঞান ও স্বচ্ছতা আনে, রজঃ গতি ও আসক্তি সৃষ্টি করে, তমঃ অজ্ঞতা ও জড়তা বাড়ায়। প্রতিটি চিন্তা ও অভিজ্ঞতা এই তিন গুণের প্রভাবে তৈরি হয়। তাই গুণত্রয় অতিক্রম না করলে মুক্তি অসম্ভব।

যখন যোগীর মধ্যে বিবেকখ্যাতি স্থায়ী হয়, তখন সে বুঝতে পারে, দ্রষ্টা (পুরুষ) ও দৃশ্য (প্রকৃতি) আলাদা। বিবেকখ্যাতি মানে এমন এক স্থির জ্ঞান, যেখানে আর কোনো বিভ্রম বা মিশ্রণ থাকে না। যোগী তখন জগতের কার্যকারণ-চক্র থেকে নিজেকে পৃথকভাবে উপলব্ধি করে।

এই অবস্থায় যোগী পৌঁছে যায় ধর্মমেঘ-সমাধিতে। পতঞ্জলি বলেন—তখন যোগী সমস্ত আচ্ছাদন ও মলিনতা থেকে মুক্ত হয়ে নিজের আত্মজ্ঞান-প্রদীপের আলোয় দীপ্তিমান হয়ে ওঠেন। (যোগসূত্র ৪.২৯)

এখানে পতঞ্জলি বর্ণনা করেছেন ধর্মমেঘ-সমাধির অবস্থা। এই সমাধিতে যোগীর চিত্ত থেকে সব ধর্ম, গুণ, কর্মফল ও অজ্ঞানতার আচ্ছাদন ঝরে যায়। মন আর কোনো কিছুর দ্বারা আবৃত থাকে না।

“সর্ব-আবরণ-মল” বলতে বোঝানো হয়েছে সব ধরনের অবিদ্যা, ক্লেশ, আসক্তি ও সংস্কার, যা চেতনার শুদ্ধ আলোকে ঢেকে রাখে। যোগসাধনার মাধ্যমে যখন এগুলি সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়, তখন চেতনা তার নিজস্ব স্বচ্ছতা ফিরে পায়।

“স্ব-জ্ঞান-দীপ” মানে আত্মজ্ঞান। এটি বাইরের আলো নয়, অন্তর্স্ফূর্ত চেতনার দীপ্তি। যখন সেই আত্মজ্ঞান উদ্ভাসিত হয়, তখন যোগী নিজের মধ্যেই আলোকিত হয়ে ওঠে। আর “বিবস্বান্” মানে সেই চেতনা দীপ্ত, স্বয়ংপ্রভ ও সর্বজ্ঞ হয়ে ওঠা।

ধর্মমেঘ শব্দটির অর্থ—যে মেঘ সমস্ত ধর্ম বা গুণ ঝরিয়ে দেয়। ধর্ম মানে এখানে গুণ, ফল, বা কর্তব্যের রূপ; মেঘ মানে আচ্ছাদন বা আবরক।

যখন যোগী সমস্ত ধর্ম, গুণ, জ্ঞান, কর্তব্য, এমনকি মুক্তির আকাঙ্ক্ষারও ঊর্ধ্বে ওঠেন, তখন এই মেঘ ঝরে পড়ে। যখন যোগী ধর্মমেঘ-সমাধি লাভ করেন, তখন তাঁর মধ্যে সমস্ত অজ্ঞান, ক্লেশ ও মলিনতা বা আচ্ছাদন বিলীন হয়ে যায়, চেতনার দীপ জ্বলে ওঠে, আত্মজ্ঞান-আলোয় তিনি নিজেই দীপ্তিমান হয়ে ওঠেন এবং তিনি নিজের স্বরূপে অবস্থান করেন।

এই অবস্থায় আর কোনো অন্ধকার বা ভ্রান্তি থাকে না—শুদ্ধ চেতনা নিজেই নিজের আলোয় প্রকাশিত হয়। তখন যোগী জানেন, জ্ঞান ও অজ্ঞান, শুভ ও অশুভ—সবই গুণত্রয়ের ক্রিয়া, আর তিনি তাদের সাক্ষী মাত্র। এখানে কর্তা, কর্ম, ও ফলের ধারণা বিলীন হয়ে যায়।