গভীর নিদ্রা বা সুষুপ্তি (Suṣupti) হলো কারণ-দেহের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞ প্রকাশ। এই অবস্থায় ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির সব কার্যকলাপ স্থগিত থাকে। জীব তখন কিছুই দেখে না, কিছুই জানে না, তবুও চেতনা থেকে যায়—কিন্তু আবৃত অবস্থায়। অদ্বৈত-মতে, এই নিদ্রা অবস্থা অবিদ্যার এক নিস্তব্ধ রূপ—যেখানে অজ্ঞানতা ও আনন্দ মিলেমিশে থাকে। মানুষ ঘুম থেকে উঠে বলে—“আমি কিছুই জানতাম না, কিন্তু ভালো বিশ্রাম পেয়েছি।” এই অভিজ্ঞতা দেখায়, আত্মা সেই সময়ও সচেতন ছিল, তবে তার চেতনা অবিদ্যার পর্দায় ঢাকা ছিল। সুষুপ্তি তাই ব্রহ্মের সঙ্গে সাময়িক মিলন—কিন্তু জ্ঞানের অভাবে অপ্রকাশিত। এটি আত্মার অন্তর্নিহিত অদ্বৈত স্বরূপের এক ছায়া-মাত্র, যেখানে দ্বৈততা বিলীন হলেও অজ্ঞানতা টিকে থাকে।
অদ্বৈতের ভাষায়, সুষুপ্তি আমাদের শেখায় যে, আত্মা কখনো জাগ্রত (jāgrat), কখনো স্বপ্ন (svapna), কখনো গভীর নিদ্রায় থাকে—তবু আত্মা নিজে পরিবর্তনশীল নয়। পরিবর্তন ঘটে কেবল তার উপাধি (upādhi)-গুলিতে—দেহ, মন ও অবিদ্যার আচ্ছাদনে। আত্মা সব অবস্থায় সাক্ষী (sākṣin)—সে দেখছে, কিন্তু কোনো অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত নয়। তাই সুষুপ্তি হল অবিদ্যার নীরব প্রশান্তি, যেখানে দ্বৈততার সব তরঙ্গ থেমে যায়, কিন্তু মহাসমুদ্রের গভীর অন্ধকার রয়ে যায়।
তুরীয় (Turīya) বা “চতুর্থ”, এই তিন অবস্থার (জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি) অতীত। এটি কোনো অবস্থা নয়, বরং সমস্ত অবস্থার আধার (adhisṭhāna)। এটি আত্মার স্বরূপ—শুদ্ধ চেতনা (śuddha-caitanya), স্বপ্রকাশমান (svayam-prakāśa), অবিকৃত, সর্বব্যাপী। মাণ্ডূক্য উপনিষদ বলে—“নান্তঃপ্রজ্ঞং, ন বাহিঃপ্রজ্ঞং, ন উভয়তঃপ্রজ্ঞং… অদ্বৈতং চতুর্থম্ আত্মা”—অর্থাৎ, এটি না বাহিরমুখী, না অন্তর্মুখী, না উভয়, বরং এক অদ্বৈত, নিঃশব্দ, স্বপ্রকাশমান আত্মা। তুরীয় অবস্থায় আত্মা উপলব্ধি করে—“আমি সেই”—অহং ব্রহ্মাস্মি (Aham Brahmāsmi)। এখানে কোনো কর্তা বা ভোক্তা নেই, কোনো কর্ম বা ফল নেই; যা থাকে, তা কেবল চেতনার অখণ্ড অভিজ্ঞতা—সর্বস্বতার নিঃশেষ ঐক্য।
কারণ-দেহ, সুষুপ্তি ও তুরীয়—এই তিনটি পরস্পরের ধারাবাহিক স্তর। কারণ-দেহে আত্মা অজ্ঞানতার সম্ভাবনায় আবৃত থাকে; সুষুপ্তিতে সেই সম্ভাবনা অভিজ্ঞ নিস্তব্ধতায় রূপ নেয়; আর তুরীয় অবস্থায় সমস্ত আচ্ছাদন বিলীন হয়ে আত্মা নিজ স্বরূপে উন্মুক্ত হয়। কারণ-দেহে অবিদ্যা নিহিত, সুষুপ্তিতে অবিদ্যা স্থিত, তুরীয় অবস্থায় অবিদ্যা সম্পূর্ণরূপে নিবারিত। এই উত্তরণই অদ্বৈত দর্শনের মুক্তির পথ—অবিদ্যা থেকে বিদ্যা, মায়া থেকে ব্রহ্ম, অন্ধকার থেকে আলোক। এখানেই জীব উপলব্ধি করে যে, সে কখনোই সীমিত ছিল না; কেবল জ্ঞানের অভাবেই সীমাবদ্ধতার বিভ্রমে আবদ্ধ ছিল। তুরীয় সেই জাগরণ—যেখানে আত্মা জানে, আমি সেই একক চেতনা, যা সব কিছুর পেছনে, সব কিছুর মধ্যে থেকেও, কিন্তু কোনো কিছুর সঙ্গে নয়।
“এটি সঠিক নয়। কারণ অভিজ্ঞতা (Pratyaya) বা তার বস্তুর অগ্রাধিকার (Prādhānyaṁ) আছে বলে বলা হয়নি।”—এই উক্তিটি জ্ঞান ও বাস্তবতার সম্পর্ক নিয়ে এক গভীর অদ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। এখানে বলা হচ্ছে, চেতনা (অভিজ্ঞতা) ও বস্তু (অভিজ্ঞতার বিষয়)—এই দুইয়ের মধ্যে কোনো একটির “প্রথম” বা “অগ্রগণ্য” হওয়া সম্ভব নয়। জ্ঞান ও বস্তু পরস্পরনির্ভর; একটির অস্তিত্ব অন্যটিকে ছাড়া অর্থহীন। যেমন দেখা ও দেখা-যাওয়া একইসঙ্গে ঘটে—চোখ থাকলেই দেখা সম্ভব নয়, আলো ও বস্তু উপস্থিত না থাকলে দেখাও সম্পূর্ণ হয় না।
প্রত্যয় (Pratyaya) শব্দটি সংস্কৃত ধাতু “প্রতি + ই” (প্রতি + ই) থেকে এসেছে, যার অর্থ “দিকে গমন করা”, “মনোনিবেশ করা” বা “বিশ্বাস করা”। দার্শনিক প্রেক্ষাপটে প্রত্যয় মানে মন বা বুদ্ধিতে উদ্ভূত কোনো নির্দিষ্ট বোধ, ধারণা, বা জ্ঞানরূপ মানসিক অবস্থা—অর্থাৎ জ্ঞানস্বরূপ একটি চেতনা-বিকৃতি। অদ্বৈত বেদান্তে প্রত্যয় হলো জ্ঞানের এক তরঙ্গ, যা চেতনার (cit) উপর অবিদ্যার পর্দার মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে কোনো নির্দিষ্ট বস্তু, চিন্তা বা অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করে। যেমন, “এই ঘট আছে”—এই চিন্তাটি একটি প্রত্যয়। প্রত্যয় আসলে আত্মার (Ātman) স্বপ্রকাশ চেতনারই একটি মানসিক প্রতিবিম্ব, যা অন্তঃকরণ (Antaḥkaraṇa) বা মনের মাধ্যমে সীমিত আকারে প্রকাশ পায়। আত্মা নিজে কোনো পরিবর্তনশীল জ্ঞানী সত্তা নয়; সে সাক্ষী (sākṣin), এবং প্রত্যয়সমূহ তার উপস্থিতিতে উদিত ও নিবারিত হয়।
অদ্বৈত দৃষ্টিতে প্রত্যয় দুটি স্তরে প্রকাশিত হয়। প্রথম স্তর হলো ব্যাবহারিক প্রত্যয় (Vyāvahārika Pratyaya), যা ইন্দ্রিয় ও মনের মাধ্যমে জাগতিক জ্ঞান উৎপন্ন করে; যেমন—‘ঘড়া আছে’, ‘আগুন গরম’। দ্বিতীয় স্তর হলো পারমার্থিক প্রত্যয় (Pāramārthika Pratyaya), যা আত্মার প্রকৃত জ্ঞান; যেমন—‘আমি ব্রহ্ম’। প্রথমটি পরিবর্তনশীল ও অবিদ্যা-জাত, দ্বিতীয়টি চিরন্তন ও বিদ্যা-জাত। যখন জ্ঞানে অবিদ্যা থাকে, প্রত্যয় তখন মিথ্যা (mithyā)—অর্থাৎ আংশিক সত্য; কিন্তু যখন প্রত্যয় আত্মার স্বরূপে লীন হয়, তখন সেটিই ব্রহ্মজ্ঞানের প্রত্যয়, যা আর কোনো ভেদ রাখে না।
শঙ্করাচার্য “অহং প্রত্যয়” (আমি-চিন্তা)-কে অদ্বৈতের কেন্দ্রীয় প্রত্যয় বলে দেখিয়েছেন। এটি এমন এক প্রত্যয়, যা প্রতিটি জ্ঞানের ভেতরে নিহিত—‘আমি জানি’, ‘আমি দেখি’, ‘আমি আছি’। এই “অহং প্রত্যয়”-এর বিশুদ্ধ রূপ (অহং ব্রহ্মাস্মি)—অর্থাৎ ‘আমি ব্রহ্ম’ উপলব্ধিই চূড়ান্ত মুক্তি। এখানে প্রত্যয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধ তরঙ্গ নয়, বরং আত্মার স্বপ্রকাশ সত্তারই প্রত্যক্ষ প্রকাশ হয়ে ওঠে।
প্রাধান্য (Prādhānyaṁ) শব্দের অর্থ “অগ্রগণ্যতা” বা “প্রাধান্যতা”—কোনো কিছুর মধ্যে কোন উপাদানটি মূল বা মুখ্য ভূমিকা পালন করছে, তা নির্দেশ করে। অদ্বৈত বেদান্তে প্রাধান্য মানে কোন সত্তা বা নীতি আসলে কার্যকারণ সম্পর্ক বা অভিজ্ঞতায় মুখ্য ভূমিকা রাখছে; এটি একধরনের ontological priority বা epistemic dominance।
অস্তিত্বগত প্রাধান্য বা Ontological Priority অর্থ হলো সত্তার স্তরে কোনটি মৌলিক, আর কোনটি তার উপর নির্ভরশীল—তা নির্ধারণ করা। দর্শনে এটি এক মৌলিক প্রশ্ন, যা বলে দেয়, কোন বাস্তবতা স্বতঃসিদ্ধ এবং কোনটি আপেক্ষিক। যদি একটি সত্তা অন্যটির উপর নির্ভর না করে, অথচ অন্যটি তার উপর নির্ভরশীল হয়, তবে প্রথমটিকেই অস্তিত্বগতভাবে প্রাধান্যশালী বলা হয়। অদ্বৈত বেদান্তে এই ধারণাটি সত্যের তিন স্তর—পারমার্থিক, ব্যাবহারিক এবং প্রাতিভাসিক—এই ত্রিবিধ সত্তাতত্ত্বের ভিত্তি। ব্রহ্ম পারমার্থিক স্তরে সর্বাধিক প্রাধান্যশালী, কারণ জগৎ ও জীব উভয়েই তার উপর নির্ভরশীল, কিন্তু ব্রহ্ম কোনো কিছুর উপর নির্ভর করে না।
জগৎ যতই বাস্তব বলে মনে হোক, তার অস্তিত্ব ব্রহ্মের মধ্যে নিহিত এবং সে ব্রহ্মের অস্তিত্বের কাছে ঋণী। যেমন সোনা থেকে বিভিন্ন আকার তৈরি হয়—আংটি, হার বা মুদ্রা—কিন্তু আকারগুলির অস্তিত্ব সোনার উপর নির্ভরশীল; সোনা নিজে তাদের দ্বারা কোনোভাবেই প্রভাবিত হয় না। এই কারণেই অদ্বৈত বলে, “ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা”—অর্থাৎ ব্রহ্ম স্বয়ং প্রতিষ্ঠিত, আর জগৎ নির্ভরশীল। যেটি স্বতঃসিদ্ধ, অন্যের দ্বারা নির্ভরশীল নয়, সেটিই অস্তিত্বগতভাবে প্রাধান্যশালী। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই আত্মা বা Ātman-কে বলা হয় একমাত্র ontologically independent সত্তা; অন্য সমস্ত কিছু তার প্রতিফলন বা আপাত প্রকাশমাত্র।
জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রাধান্য বা Epistemic Dominance বোঝায়, জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় কে বা কী মুখ্য—চেতনা না বস্তু। এটি epistemology বা জ্ঞানতত্ত্বের মূল প্রশ্ন: জানা-বস্তু কি মুখ্য, না জানন-চেতনা? অদ্বৈত বেদান্ত এই প্রশ্নের উত্তর দেয় একান্ত স্পষ্টভাবে—জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় প্রাধান্য চেতনার। কারণ কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নিজের দ্বারা প্রকাশিত নয়; সেটি কেবলমাত্র জ্ঞানের দ্বারা প্রকাশিত হয়। চেতনা ছাড়া কিছুই জানা সম্ভব নয়, এমনকি অজ্ঞতাও চেতনার প্রেক্ষিতেই ধরা পড়ে। তাই বলা হয়, “জ্ঞানই অস্তিত্ব”—Jñānam eva sat। সমস্ত অস্তিত্ব, সমস্ত অভিজ্ঞতা, সমস্ত জানা—সব কিছুই চেতনার আলোয় ধরা পড়ে; তাই আত্মা বা চৈতন্যই epistemically dominant, বস্তুর নয়। বস্তু কখনও স্বপ্রকাশ নয়; চেতনা সর্বদা স্বপ্রকাশ। আত্মা কিছু জানার জন্য নিজে পরিবর্তিত হয় না, বরং সমস্ত জ্ঞান তার মধ্যে প্রতিফলিত হয়, যেমন আয়নায় প্রতিবিম্ব।
অদ্বৈত বেদান্তে এই দুই প্রাধান্যের সম্পর্ক গভীর ও অবিচ্ছেদ্য। যা অস্তিত্বগতভাবে প্রাধান্যশালী, তা-ই জ্ঞানতাত্ত্বিক ক্ষেত্রেও মুখ্য। ব্রহ্ম সত্তার স্তরে মৌলিক, কারণ সব কিছু তার উপর নির্ভরশীল, এবং জ্ঞানের স্তরেও মৌলিক, কারণ সব জানা ও জানন তার চেতনারই প্রতিফলন। একই সত্যের দুই দিক—একটিতে “আছে”-র দিক, অন্যটিতে “জানে”-র দিক। অদ্বৈতের দৃষ্টিতে এই দুইয়ের মিলনেই পরম একত্ব প্রকাশ পায়, যেখানে সত্তা ও জ্ঞান, ব্রহ্ম ও আত্মা, জানা ও জানন—সব কিছু এক হয়ে যায়। এ কারণেই বলা হয়, “সৎ-চিত্-আনন্দ” (Sat-Cit-Ānanda) কোনো তিনটি পৃথক গুণ নয়; বরং একই পরম সত্তার অস্তিত্বগত, জ্ঞানতাত্ত্বিক ও অভিজ্ঞতামূলক তিনটি দিক।
এভাবে অদ্বৈত বেদান্তে ontological priority প্রকাশ করে যে, ব্রহ্মই চূড়ান্ত ও স্বয়ংপ্রতিষ্ঠ সত্য, আর epistemic dominance প্রকাশ করে যে, সেই ব্রহ্মই আত্মা, চেতনা—যার মধ্যেই সব জানা, সব দেখা, সব অভিজ্ঞতা সম্ভব। দুটি ধারণা একত্রে দেখায়, বাস্তবতার পরম ভিত্তি এবং জ্ঞানের পরম উৎস এক ও অভিন্ন, এবং সেই অভিন্নতাই অদ্বৈতের মর্মকেন্দ্র।
“সৎ–চিত্–আনন্দ” (Sat–Cit–Ānanda) অদ্বৈত বেদান্তে ব্রহ্ম বা আত্মার স্বরূপ প্রকাশের একটি মৌলিক অভিব্যক্তি, যা তিনটি অবিচ্ছেদ্য কিন্তু দৃষ্টিভেদে পৃথক দিক নির্দেশ করে। এই তিনটি শব্দের সম্মিলিত অর্থ কোনো যৌগিক ধর্ম নয়—এগুলো ব্রহ্মের স্বরূপের তিনটি অপরিহার্য দিক, যেগুলি একই বাস্তবতার অস্তিত্বগত, জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং আনন্দাত্মক মাত্রাকে নির্দেশ করে।
“সৎ” (Sat) শব্দের অর্থ “অস্তিত্ব” বা “Being”—যা সর্বদা আছে, যা কখনও বিলীন হয় না। এটি পরম বাস্তবতা (Paramārthika Satya), যা কোনো কালের, স্থান বা অবস্থার সীমায়িত নয়। ব্রহ্ম সত্তা হিসেবে স্বয়ংপ্রতিষ্ঠিত (svataḥ–siddha), তার অস্তিত্ব কোনো কিছুর উপর নির্ভর করে না। সমস্ত পরিবর্তনশীল জগতের ভিত্তি, আশ্রয় এবং সারসত্তা এই “সৎ”—যেমন মাটির পাত্রের আসল সত্তা মাটি, তেমনই সমস্ত দৃশ্যমান রূপের অন্তর্নিহিত সত্য ব্রহ্ম। তাই বলা হয়, “যা কখনো ছিল, এখন আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে—সেই সত্যই সৎ।” এই “সৎ” দিকটি ব্রহ্মের ontological dimension—অর্থাৎ সত্তার স্তরে চূড়ান্ত প্রাধান্য নির্দেশ করে।
“চিত্” (Cit) অর্থ “চেতনা” বা “Pure Consciousness”—যা সব কিছুকে জানায়, কিন্তু নিজে কোনো কিছুর দ্বারা জ্ঞাত নয়। এটি সেই প্রভা বা জ্ঞানের আলো, যার দ্বারা সমস্ত কিছু জানা যায়, অনুভূত হয় এবং বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়। চেতনা স্বয়ংপ্রকাশ (svayaṁ–prakāśa)—তাকে প্রকাশ করার জন্য কোনো অন্য আলো প্রয়োজন নেই। যেমন সূর্য নিজে নিজেই দীপ্ত, তেমনি চিত্ নিজেই সমস্ত জ্ঞানের উৎস। এই চেতনা কোনো ব্যক্তিগত মনের গুণ নয়; এটি সর্বব্যাপী, নিঃশর্ত সচেতনতা, যা প্রত্যেক জাগ্রত, স্বপ্ন ও নিদ্রা অবস্থার মধ্য দিয়ে অবিচ্ছিন্নভাবে বিরাজমান। “চিত্” দিকটি তাই epistemic dominance-এর প্রতীক—জ্ঞানতাত্ত্বিক স্তরে চেতনার প্রাধান্য প্রকাশ করে।
“আনন্দ” (Ānanda) শব্দটি বোঝায় “পরম আনন্দ”, “পূর্ণতা” বা “আত্ম-তুষ্টি”—যা কোনো বাহ্যিক বস্তু থেকে উদ্ভূত সুখ নয়, বরং নিজের স্বরূপ উপলব্ধির ফলস্বরূপ স্বয়ংসম্পূর্ণ শান্তি। যখন আত্মা তার সত্য স্বরূপকে জানে যে—সে কখনও জন্মায় না, মরে না, অপরের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়—তখন সব অভাব, আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ এবং দ্বৈততার বোধ লুপ্ত হয়। এই অন্তর্নিহিত পরিতৃপ্তিই “আনন্দ”। এটি আনন্দ-স্বরূপ ব্রহ্মের অভিজ্ঞতামূলক প্রকাশ—যা অভাবের মুক্ত অবস্থার আনন্দ, কোনো ইন্দ্রিয়সুখ নয়।