অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: আটষট্টি



এই বোঝাপড়াকেই মাধ্যমক বলে প্রজ্ঞা (Prajñā)—যে-জ্ঞান নিজেই সমস্ত ধারণার সীমা অতিক্রম করে। এই প্রজ্ঞা জন্ম নেয়, যখন আমরা দেখি, কোনো কিছুই আলাদা, স্থায়ী, নিজস্ব নয়। আর এই প্রজ্ঞাই আসক্তি ভাঙে, কারণ আসক্তি গড়ে ওঠে সেই ভ্রান্ত ধারণা থেকে যে, কোনো কিছুকে স্থায়ীভাবে পাওয়া বা ধরে রাখা সম্ভব। এই প্রজ্ঞার জাগরণই দুঃখের অবসান—এটাই মুক্তির পথ।

অদ্বৈতের ‘মিথ্যা’ ও মাধ্যমকের ‘শূন্য’ এক নয়। অদ্বৈত বলে—জগৎ মিথ্যা। অর্থাৎ, এটি ব্যাবহারিকভাবে সত্য হলেও চূড়ান্ত স্তরে শুধু ব্রহ্মই সত্য। যখন জ্ঞান আসে, তখন ভ্রান্ত জগৎ মায়ার মতো বিলীন হয়, কিন্তু চূড়ান্ত আধার বা ব্রহ্ম থেকে যায়, অপরিবর্তনীয়ভাবে।

মাধ্যমক বলে—জগৎ শূন্য। অর্থাৎ, এটি ব্যাবহারিক স্তরে কার্যকর হলেও তার কোনো নিজস্ব স্বভাব নেই, এবং কোনো চূড়ান্ত আধারও নেই। জ্ঞান এলে স্বভাব ও আধার—দুটোরই প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়। তখন যা দেখা যায়, তা হলো নির্ভরতার দৃষ্টিই—সব কিছুই সম্পর্কের ভেতর দিয়ে আছে, কোনো কিছুর নিজস্ব অস্তিত্ব নেই।

অদ্বৈতের জ্ঞান শেষপর্যন্ত এক চূড়ান্ত বাস্তবতার দিকে পৌঁছে যায়, আর মাধ্যমকের প্রজ্ঞা পৌঁছে যায় বাস্তবতার সম্পর্কনির্ভর প্রকৃতি বোঝার মধ্যে। একজন বলে—“সবই ব্রহ্ম”, অন্যজন বলে—“সবই শূন্য।” কিন্তু উভয়ের লক্ষ্য একই—মনের সীমাবদ্ধতা ভেঙে মুক্তির দিকে অগ্রসর হওয়া।

প্রতিধ্বনি/মরীচিকা উপমার সঠিক ব্যবহার:
প্রতিধ্বনি—শুনতে ঠিক আছে, কাজে লাগে, কিন্তু নিজস্ব কোনো স্থায়ী উৎস-সত্তা নেই; এর সৃষ্টি ও ধ্বংস দুই-ই শর্ত-ভিত্তিক।
মরীচিকা—দেখা যায়, তৃষ্ণা জাগে, কিন্তু “জল” নিজে নেই; আলো-তাপ-দৃষ্টিকোণ—এসব শর্তে দেখা-যাওয়া একটা প্রপঞ্চ।
মাধ্যমক এই উপমাগুলো দিয়ে বোঝায়—ঘটনা ‘অকারণ’ নয়, ‘অসত্য’ও নয়; তারা ‘শর্ত-নির্ভর’, তাই স্বভাবহীন এবং আধারহীন।

‘স্বভাব নেই’ মানে হলো, কোনো কিছুর মধ্যে এমন কোনো স্থায়ী সার নেই, যা নিজে নিজে টিকে থাকতে পারে। তাই কিছুই চিরন্তন বা অপরিবর্তনীয় নয়। যখন বোঝা যায় যে, কোনো বস্তু বা ভাব নিজের মধ্যে স্থায়ী নয়, তখন তাকে আঁকড়ে ধরার মতো কিছু অবশিষ্ট থাকে না। এই ‘আটকে ধরার কিছু নেই’—এই বোধই আসলে মুক্তির সূচনা।

‘আধার নেই’ মানে হলো, সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো এক চূড়ান্ত সত্তা বা স্থায়ী ভিত্তি ধরে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। জগৎকে বোঝার জন্য আলাদা করে কোনো ‘ব্রহ্ম’ বা ‘চিরন্তন মূল কারণ’ ধরে নেওয়া একধরনের ধারণাগত আসক্তি। মাধ্যমক দর্শন সেই ধারণাকেই অতিক্রম করে বলে—সব কিছু পরস্পরের নির্ভরতার মধ্যে গঠিত, তাই একক কোনো উৎস বা আধার মানা যুক্তিহীন।

‘নির্ভরতাই সার’—এই উপলব্ধির অর্থ হলো, কোনো কিছুরই নিজস্ব, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই; সব কিছু কারণ ও শর্তের ওপর নির্ভর করে প্রকাশ পায়। যখন এই নির্ভরতা বোঝা যায়, তখন দেখা যায়, আসক্তি বা তৃষ্ণার যৌক্তিক ভিত্তিই দুর্বল হয়ে যায়। কারণ যা শর্তে আসে ও শর্তে যায়, তাকে স্থায়ী ধরে রাখা বা তার ওপর নির্ভর করে সুখ খোঁজা মূলত অবিদ্যা—অর্থাৎ ভুল বোঝা। এই ভ্রান্ত ধারণা ভেঙে ফেলার মাধ্যমেই দুঃখের কারণ ক্ষয় হয়। এই দেখার ভঙ্গিই প্রজ্ঞার কাজ, আর সেই প্রজ্ঞাই মুক্তির পথ।

মাধ্যমক দর্শন বলে, জগৎ স্বভাব-শূন্য, কারণ সব কিছুই শর্ত-নির্ভর। তাই কোনো স্থায়ী আধার—যেমন অদ্বৈতের ব্রহ্ম বা কোনো চিরন্তন substratum—ধারণা করার দরকার নেই। “দড়ি-সাপ” উদাহরণেও মাধ্যমক ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দেয়—দড়ি ও সাপ দুটিই নির্ভর-নির্দেশিত ধারণা। অর্থাৎ, সাপকে “সাপ” হিসেবে বুঝতে হলে আমাদের মনে “সাপ” নামের একটি ধারণা আগে থেকেই থাকতে হয়। তাই “সাপ” নামটিও নির্ভর করে জ্ঞান, ভাষা ও প্রেক্ষিতের ওপর; এটি নিজের মধ্যে স্বাধীন সত্তা নয়।

অদ্বৈত যেখানে ধারণা, বাস্তবতা ও জ্ঞানকে স্তরবিন্যাস করে এক “চূড়ান্ত আধার-ব্রহ্ম”-এর ওপর স্থাপন করে, মাধ্যমক সেখানে নামমাত্রবাদী দৃষ্টিতে কেবল নির্ভরশীল বিশেষগুলোকে স্বীকার করে। মাধ্যমকের কাছে কোনো সর্বজনীন, স্বভাবজাত বা চূড়ান্ত আধার নেই—সব কিছুই শর্তনির্ভর নামমাত্র রূপে বিদ্যমান। এই কারণে মাধ্যমকে জ্ঞানও আপেক্ষিক ও প্রেক্ষিতনির্ভর। জ্ঞানের উদ্দেশ্য কোনো চূড়ান্ত সত্তা আবিষ্কার নয়; বরং এটা বোঝা যে—শূন্যতা (স্বভাবহীনতা) ও নির্ভরতা (প্রতীত্যসমুত্পাদ) সর্বত্র একইভাবে কাজ করে। যখন এই বোঝাপড়া সম্পূর্ণ হয়, তখন মন সব আসক্তি থেকে মুক্ত হয়ে যায়। কারণ তখন বোঝা যায়—ধরা, পাওয়া, বা ধরে রাখার মতো কিছুই নেই। এই বোধই প্রজ্ঞা, আর প্রজ্ঞাই মুক্তি।

মুক্তির পথে অজ্ঞানতাকে দূর করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক বৌদ্ধ দর্শন—এই দুটি ঐতিহ্য “অজ্ঞানতা”-কে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে বোঝে। ফলে মুক্তির উপায়ও তাদের কাছে আলাদা হয়ে যায়।

অদ্বৈত বেদান্তে অজ্ঞানতা বা অবিদ্যা মানে হলো—ব্রহ্মের সত্য, অদ্বৈত প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা। আত্মার আসল পরিচয় ব্রহ্ম, কিন্তু অবিদ্যার কারণে সেই আত্মা নিজের প্রকৃত স্বরূপ ভুলে যায় এবং নিজেকে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে একীভূত মনে করে। এর ফলে ব্যক্তি নিজেকে এক পৃথক “আমি” হিসেবে দেখে এবং জগৎকেও এক বহিরাগত, স্বতন্ত্র বাস্তবতা হিসেবে অভিজ্ঞতা করে।

এই বিভ্রমই হলো মায়া—যা ব্রহ্মের ওপর জগতের নাম-রূপ আরোপ করে দেয়। অবিদ্যা তাই কোনো নতুন সৃষ্টি নয়, বরং এক চিরন্তন সত্যের “অস্বীকৃতি” বা “ভুলে যাওয়া”। এখানে ত্রুটি হলো সত্যকে না জানা, যে-কোনো মিথ্যা কিছুকে সত্য হিসেবে জেনে নেওয়া।

অদ্বৈতের মতে, এই ভুল শুধরে দেওয়ার উপায় হলো জ্ঞান—আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান। যখন সাধক উপলব্ধি করে যে, “আমি” দেহ-মন নয়, বরং ব্রহ্মই আমার প্রকৃত স্বরূপ, তখন অবিদ্যা বিলুপ্ত হয়। তখন অভিজ্ঞ হয়—“অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—আমিই ব্রহ্ম। এই উপলব্ধিই মুক্তি।

মাধ্যমক বৌদ্ধ দর্শনে অজ্ঞানতা (বৌদ্ধ পরিভাষায় অবিদ্যা বা অবিজ্ঞান) মানে শুধু না জানা নয়, বরং একটি ভুল দেখার প্রক্রিয়া—অর্থাৎ, অনিত্য, নির্ভরশীল বস্তুর ওপর মিথ্যা স্থায়িত্ব বা স্বাধীনতা আরোপ করা। মানুষ মনে করে, প্রতিটি বস্তু বা “আমি”-এর মধ্যে কোনো স্থায়ী সার বা স্বভাব আছে—যা নিজের জোরে টিকে থাকে। এই ধারণাটাই হলো অজ্ঞানতা।

অজ্ঞানতা মানে এখানে—অস্থায়ীকে স্থায়ী মনে করা, আপেক্ষিককে পরম ধরে নেওয়া। ফলে মানুষ জগতকে আসল রূপে—নির্ভরশীল ও শূন্য হিসেবে—দেখতে পারে না।

মাধ্যমকের মতে, এই ত্রুটি জ্ঞানের অভাব নয়, বরং ভুল জ্ঞানের ফল—একটি ধারণাগত নির্মাণ, যা বাস্তবতার ওপর মিথ্যা স্থায়িত্ব বসিয়ে দেয়। তাই মুক্তির পথও এখানে আলাদা। অদ্বৈতের মতো “চূড়ান্ত সত্তার জ্ঞান” নয়, বরং দার্শনিক বিনির্মাণ (deconstruction)—অর্থাৎ, মিথ্যা ধারণাগুলোর বিশ্লেষণ ও ভাঙন।

যখন গভীরভাবে বোঝা যায় যে, সব কিছুই স্বভাবশূন্য—সব অস্তিত্বই পরনির্ভর, সম্পর্কময়, অস্থায়ী—তখন অবিজ্ঞান ভেঙে পড়ে। তখন জন্ম নেয় প্রজ্ঞা (Prajñā)—যে-জ্ঞান সব ধারণার সীমা অতিক্রম করে। প্রজ্ঞার আলোয় “স্থায়ী বাস্তবতা”-র ভ্রম বিলীন হয়, আর মন মুক্ত হয় আসক্তি থেকে।

অদ্বৈত বলে—অবিদ্যা মানে হলো, একটি সত্য সত্তা (ব্রহ্ম) সম্পর্কে অজ্ঞানতা। সত্য আছে, কিন্তু তা জানা হয়নি। মুক্তি মানে সেই সত্যকে চিনে নেওয়া। মাধ্যমক বলে—অজ্ঞানতা মানে হলো, অস্থায়ী ও সম্পর্কনির্ভর জিনিসের ওপর স্থায়িত্ব কল্পনা করা। এখানে কোনো চিরন্তন সত্য নেই; বরং আছে অজ্ঞানতা, যা হচ্ছে ভুল ধারণা—যা বাস্তবতাকে বিকৃত করে। মুক্তি মানে সেই মিথ্যা স্থায়িত্বের ধারণাকে ভেঙে ফেলা।

অদ্বৈতের মুক্তি হলো “স্মরণ”—ব্রহ্মস্বরূপে নিজের পরিচয় পুনরুদ্ধার করা। মাধ্যমকের মুক্তি হলো “দর্শনবিনাশ”—স্থায়িত্বের ধারণা বিলুপ্ত করে শূন্যতা ও নির্ভরতার স্বরূপ উপলব্ধি করা। দুটি পথের গন্তব্য আলাদা, কিন্তু উদ্দেশ্য একই—অবিদ্যার অবসান ও মুক্তি। একজন বলে, “জেনে ওঠো—যা সত্য।” অন্যজন বলে, “বুঝে ফেলো—যা মিথ্যা।”

স্ব এবং চেতনার মতবাদ—আত্মা বনাম নৈরাত্ম্য: অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক বৌদ্ধ দর্শনের মধ্যে সবচেয়ে গভীর এবং বিরোধপূর্ণ পার্থক্যটি দেখা যায় স্ব (আত্মা) ও চেতনা-র ধারণায়। দু-পথই মানুষের অভিজ্ঞতার মূল উৎসকে ব্যাখ্যা করতে চায়, কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বিপরীত।

অদ্বৈতের আত্মা—শাশ্বত, বিশুদ্ধ, অ-ইচ্ছামূলক চেতনা। অদ্বৈত বেদান্তে আত্মা (আত্মন) কোনো পৃথক বা সৃষ্ট সত্তা নয়; এটি ব্রহ্মের সঙ্গেই অভিন্ন। প্রতিটি জীবের মধ্যে যে-চেতনা বিরাজ করে, তা একক, চিরন্তন এবং অবিভাজ্য। এই চেতনা—যা সৎ-চিৎ-আনন্দ (অস্তিত্ব, চেতনা ও আনন্দ)-এর রূপে বর্ণিত—সমস্ত জীবনের মূল ভিত্তি।

অদ্বৈতের মতে, আত্মা হলো বিশুদ্ধ, অ-ইচ্ছামূলক চেতনা—যা নিজে কোনো ক্রিয়া করে না, কোনো কিছু উৎপন্ন করে না, কিন্তু সব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নীরবে বিদ্যমান থাকে। এটি সব মানসিক পরিবর্তনের নেপথ্যে-থাকা এক অবিচল উপস্থিতি, এক অপরিবর্তনীয় আধার (substratum)।

দেহ, মন, চিন্তা, ইন্দ্রিয়—সব কিছু পরিবর্তনশীল, কিন্তু আত্মা পরিবর্তনহীন। এই আত্মাই হলো সেই একক “দ্রষ্টা” বা পর্যবেক্ষক, যা চূড়ান্ত বাস্তবতার সঙ্গে এক। তাই অদ্বৈতের মতে, মুক্তি মানে হলো এই আত্মার সঙ্গে ব্রহ্মের অভিন্নতা উপলব্ধি করা—“অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—আমিই সেই চেতনা, যাকে জগৎ বলে জানা যায়।

শূন্যতার নৈরাত্ম্য—অস্থায়ী এবং শূন্য চেতনা। বৌদ্ধ দর্শন, বিশেষত মাধ্যমক শাখা, আত্মা বা কোনো চিরন্তন স্ব-এর অস্তিত্ব একেবারেই অস্বীকার করে। এই মতবাদকে বলা হয় নৈরাত্ম্য (anātman) বা “নো-সেল্ফ” মতবাদ। এর মতে, মানুষ বা চেতনা—কিছুই স্বতন্ত্র, স্থায়ী বা অবিনাশী সত্তা নয়।

চেতনা এখানে একটি স্বতন্ত্র সত্তা নয়; এটি একটি শর্তনির্ভর প্রক্রিয়া (dependent process)। বৌদ্ধ বিশ্লেষণ অনুসারে, মানুষ গঠিত পাঁচটি উপাদান বা পঞ্চস্কন্ধ দ্বারা—রূপ, বেদনা, সঞ্জ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান। চেতনা (বিজ্ঞান) এই পাঁচটির একটি অংশ মাত্র; এটি নিজে কোনো কেন্দ্র বা আত্মা নয়, বরং প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল অভিজ্ঞতার প্রবাহ।

এই কারণে, বৌদ্ধ-মতে, চেতনা অনিত্য (অস্থায়ী) এবং শূন্য (স্বভাবশূন্য)। কোনো চেতনা নিজে থেকে থাকে না—এটি নির্ভর করে ইন্দ্রিয়, মন, অবস্থা ও অভিজ্ঞতার ওপর। মাধ্যমক দর্শন যেহেতু নামমাত্রবাদী—অর্থাৎ কোনো সারসত্তার বাস্তবতা স্বীকার করে না—তাই চেতনার ক্ষেত্রেও কোনো চূড়ান্ত সত্তাতাত্ত্বিক মর্যাদা দেওয়া হয় না। চেতনা এখানে এক নির্ভরশীল, ক্ষণস্থায়ী ঘটনাধারা—যা উদিত হয়, থাকে কিছুক্ষণ, এবং নিঃশেষে বিলীন হয়ে যায়।

চেতনার প্রকৃতির ওপর এই বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মুক্তির ধারণাতেও মৌলিক পার্থক্য তৈরি হয়। অদ্বৈতের মতে, মুক্তি মানে হলো নিজের ভেতরে সেই অক্ষয় চেতনা বা আত্মাকে চিনে নেওয়া—যে একক ও ব্রহ্মের সমান। জ্ঞান এলে বোঝা যায়—“আমি ব্রহ্ম”—অর্থাৎ, আমার চেতনা সর্বব্যাপী ও চিরন্তন। কিন্তু মাধ্যমকের মতে, মুক্তি মানে হলো—আমি বা চেতনা কোনো স্থায়ী বাস্তব সত্তা—এই ভ্রান্ত ধারণার অবসান। এখানে মুক্তি মানে বোঝা—“আমি কিছুই নই”, এই অর্থে যে, “আমি” বলে যা ধরা হয়, তা আসলে নির্ভরশীল প্রক্রিয়ার অস্থায়ী সমষ্টি। যখন এই ভ্রম ভেঙে যায়, তখন আর কোনো “আত্মা”-র ধারণা টিকে থাকে না, এবং সেই সঙ্গে বিলীন হয় সমস্ত আসক্তি ও দুঃখ।

অদ্বৈতের দৃষ্টিতে চেতনা হলো চিরন্তন সত্য—মাধ্যমকের দৃষ্টিতে চেতনা হলো ক্ষণস্থায়ী শূন্যতা। একজন খোঁজে স্থায়ী আত্মাকে, অন্যজন ভেঙে দেয় আত্মার ধারণাটাকেই। তবু দুই দর্শনের লক্ষ্য এক—অজ্ঞানতার অবসান ও মুক্তি। একজন বলে—“চিরন্তন স্ব-কে চিনে নাও”, অন্যজন বলে—“যে-স্ব-কে চিনছ, সেটাই আসলে নেই।”