অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: আটান্ন



৬. সম্যক ব্যায়াম (Sammā-vāyāma)—সঠিক প্রচেষ্টা। এটি আত্মসংযম ও চিত্তপরিশুদ্ধির অবিরাম চেষ্টাকে বোঝায়। সম্যক ব্যায়াম মানে—অসৎ চিন্তা উদয় হওয়ার আগে তা রোধ করা, উদয় হলে তা দূর করা, সৎ চিন্তা জন্মালে তা বৃদ্ধি করা, ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখা। অর্থাৎ এটি এক অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা—যেখানে মন সর্বদা সচেতনভাবে জাগ্রত থাকে।

৭. সম্যক স্মৃতি (Sammā-sati)—সঠিক সচেতনতা। এটি হলো মনোযোগ বা mindfulness। সম্যক স্মৃতি মানে—প্রতিটি মুহূর্তে নিজের দেহ, মন, অনুভূতি ও চিন্তার উপর পূর্ণ সচেতন উপস্থিতি। যখন কেউ দেখে—“এটি আমার চিন্তা”, “এটি আমার রাগ”, “এটি আমার ভয়”—তখন সে রাগ বা ভয় নয়, বরং তার সাক্ষী হয়। এই সচেতনতা থেকেই ধীরে ধীরে আসে মুক্তি।

৮. সম্যক সমাধি (Sammā-samādhi)—সঠিক একাগ্রতা। এটি ধ্যান বা সমাধির অবস্থা, যেখানে মন একবিন্দুতে নিবদ্ধ হয়ে সম্পূর্ণ প্রশান্ত হয়। বুদ্ধ বলেন, সম্যক সমাধি মানে এমন একাগ্রতা, যা আসক্তিহীন, অহংহীন, এবং পরম প্রশান্তির দিকে নিয়ে যায়। এখানে মন চিত্তবৃত্তিনিরোধের দিকে যায়—অর্থাৎ চিন্তার স্বাভাবিক নিস্তব্ধতায় স্থিত হয়। এ অবস্থায় চেতনা মুক্ত হয়—“নিরোধ” (দুঃখনিবৃত্তি)-এর প্রকৃত উপলব্ধি এখানেই ঘটে।

বুদ্ধ এই পথকে তিনটি বিভাগে সাজিয়েছিলেন—শীল (নৈতিকতা), সমাধি (মনঃসংযম) ও প্রজ্ঞা (জ্ঞান)। বুদ্ধের “আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ” আসলে আটটি আলাদা পদক্ষেপ নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ সামগ্রিক সাধনা-পথ, যা তিনটি প্রধান স্তরে বিকশিত হয়—শীল (নৈতিকতা), সমাধি (মনঃসংযম) এবং প্রজ্ঞা (জ্ঞান)।

প্রথম স্তর হলো শীল, অর্থাৎ নৈতিকতার সাধনা। এখানে মানুষ তার আচরণ, বাক্য এবং জীবিকা বিশুদ্ধ করতে শেখে। শীলের অন্তর্ভুক্ত তিনটি অঙ্গ হলো—সম্যক বাক, সম্যক কর্ম, এবং সম্যক আজীবিকা। এই স্তরে সাধক শেখে, কীভাবে অন্যকে আঘাত না করে, মিথ্যা না বলে, সৎভাবে জীবনযাপন করতে হয়। এর উদ্দেশ্য হলো—মনকে নৈতিক শৃঙ্খলার ভিতরে স্থিত করা, যাতে ভেতরের অস্থিরতা ও অপরাধবোধ দূর হয়।

দ্বিতীয় স্তর হলো সমাধি, অর্থাৎ মনঃসংযম বা ধ্যানসংক্রান্ত অনুশীলন। এতে তিনটি অঙ্গ রয়েছে—সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি, এবং সম্যক সমাধি। এই স্তরে সাধক শেখে, কীভাবে মনকে প্রশমিত, একাগ্র ও সচেতন রাখতে হয়। নিয়মিত প্রচেষ্টা (ব্যায়াম), মুহূর্তে মুহূর্তে সচেতনতা (স্মৃতি) এবং গভীর ধ্যান (সমাধি)—এই তিনের মাধ্যমে মন ক্রমে স্বচ্ছ ও স্থির হয়। সমাধি হলো সেই চূড়ান্ত মনোসংযম, যেখানে মন আর বিকারগ্রস্ত থাকে না।

তৃতীয় ও সর্বোচ্চ স্তর হলো প্রজ্ঞা, অর্থাৎ জ্ঞান বা অন্তর্দৃষ্টি। এর মধ্যে রয়েছে সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সংকল্প। এখানে সাধক উপলব্ধি করেন—জীবনের সমস্ত দুঃখ ও ভ্রান্তির মূল হলো অজ্ঞতা ও তৃষ্ণা, এবং তার অবসানই মুক্তি। সম্যক দৃষ্টি হলো জগতকে তার প্রকৃত স্বরূপে দেখা, আর সম্যক সংকল্প হলো সেই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সৎ মনোভাব গঠন করা। এই প্রজ্ঞা-স্তরে মন সম্পূর্ণভাবে জাগ্রত হয়—আর এখানেই ঘটে দুঃখনিরোধ, অর্থাৎ মুক্তি বা নির্বাণ/নিব্বান।

এভাবে দেখা যায়, শীল মনকে বিশুদ্ধ করে, সমাধি মনকে স্থির করে, এবং প্রজ্ঞা মনকে আলোকিত করে। এই তিনের সমন্বয়েই সম্পূর্ণ হয় বৌদ্ধ সাধনার পথ—দুঃখ থেকে মুক্তির পূর্ণ উপলব্ধি, যাকে বলা হয় নিরোধ বা নির্বাণ/নিব্বান। দুঃখ থেকে মুক্তির পথ হলো আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এটি নৈতিকতা, মনোসংযম ও প্রজ্ঞার একত্র বিকাশ। যখন এই তিনের পরিপূর্ণতা ঘটে, তখন মন স্থিত হয় নিরোধে (শান্ত নির্বাণ/নিব্বান)—যেখানে আর কোনো দুঃখ, আসক্তি বা জন্ম-মৃত্যুর চক্র অবশিষ্ট থাকে না।

দুঃখ সত্য—জীবন দুঃখময়। সমুদয় সত্য—তৃষ্ণা বা আসক্তি দুঃখের কারণ। নিরোধ সত্য—তৃষ্ণার অবসানেই দুঃখের অবসান (নির্বাণ/নিব্বান) মার্গ সত্য—অষ্টাঙ্গিক পথ দুঃখনিরোধের উপায়। এই চার সত্য বুদ্ধের মতে অভিজ্ঞতার সত্য—তত্ত্ব নয়, উপলব্ধি। যখন কেউ এই চারটি সত্য সরাসরি বুঝে নেয়, তখন সে বোধি (জাগরণ) লাভ করে। তখনই দুঃখ-সমুদয়-নিরোধ-মার্গ একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়, এবং চেতনা পৌঁছে যায় নিরোধের শান্তিতে—“নির্বাণায়/নিব্বানায় ধাতু”।

“নিব্বানায় ধাতু” (Pāli: Nibbānadhātu / Sanskrit: Nirvāṇa-dhātu)—এই ধারণাটি বুদ্ধের মুক্তিবিষয়ক শিক্ষার একদম কেন্দ্রে। এটি মূলত বোঝায় “নির্বাণের অবস্থা” বা “নির্বাণের উপাদানগত রূপ”—অর্থাৎ, নির্বাণের প্রকৃতি কেমন, সেটির বিশ্লেষণ। বুদ্ধ ইতিবুত্তক (Itivuttaka) নামের পালি সূত্রে এই ধারণাটি ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, “দুই প্রকার নিব্বানধাতু আছে”—সোপাধিশেষ-নিব্বানধাতু ও অনুপাধিশেষ-নিব্বানধাতু।

“ধাতু” শব্দের অর্থ: সংস্কৃত ও পালিতে ধাতু (Dhātu) মানে “মূল উপাদান”, “মৌলিক অবস্থা”, “প্রকৃতি” বা “স্তর”। সুতরাং “নিব্বান-ধাতু” মানে—নিব্বানের প্রকৃতি বা অবস্থা। অর্থাৎ, “নির্বাণ কেমন ধরনের বাস্তবতা?”—এই প্রশ্নের উত্তর।

দুই প্রকার “নিব্বানায় ধাতু”—বুদ্ধের ভাষায়—“হে ভিক্ষুগণ, দুই প্রকার নিব্বানধাতু আছে।” (Itivuttaka, 44)
(১) Sopādisesa-nibbānadhātu—উপাধি-সহ নিব্বানধাতু
(২) Anupādisesa-nibbānadhātu—উপাধিশূন্য নিব্বানধাতু

(১) সোপাধিশেষ নিব্বানধাতু অর্থ: “স-উপাধি” মানে—এখনও কিছু উপাধান (residue) বা অবশিষ্ট উপাদান আছে; অর্থাৎ, শরীর, ইন্দ্রিয়, চেতনা ইত্যাদি এখনও কার্যকর আছে, কিন্তু মানসিক আসক্তি সম্পূর্ণ নিঃশেষ। তাঁর মধ্যে আর কোনো কামনা নেই, আর কোনো নতুন কর্মফল সঞ্চিত হয় না, তবু দেহ-মন-ইন্দ্রিয় এখনও সক্রিয়, কারণ পুরোনো কর্মের শক্তি পুরোপুরি ক্ষয় হয়নি। তাই বলা হয়—“দেহ থাকে, কিন্তু দুঃখ থাকে না।” এটিই জীবন্মুক্তির সমতুল্য, যেমন বেদান্তে “সোপাধি মুক্তি” বলা হয়।

এটি হলো জীবিত অবস্থায় অর্জিত নির্বাণ—অর্থাৎ অরহত্ত্ব। অরহত ব্যক্তি দুঃখের সমস্ত মূল (তৃষ্ণা, দ্বেষ, মোহ) নির্মূল করেছেন, কিন্তু জীবনের দেহ ও ইন্দ্রিয় এখনও বিদ্যমান, তাই তিনি জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তবে তাঁর চিত্ত সম্পূর্ণ শান্ত—তৃষ্ণা নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই, অহং নেই। এই অবস্থায় অবিদ্যা ও তৃষ্ণা সম্পূর্ণ নিভে গেছে, কিন্তু শরীর ও মানসিক স্কন্ধের কার্যক্রম এখনও চলমান—কারণ প্রারব্ধ কর্ম (kamma-vipāka) এখনও অবশিষ্ট। এ অবস্থায়: জন্ম-মৃত্যু-কর্মফল ইত্যাদি আর ভবিষ্যতে বাঁধে না, কিন্তু জীবদেহ অবশিষ্ট থাকে বলে, বুদ্ধ একে বলেন সোপাধিশেষ নিব্বানধাতু।

(২) অনুপাধিশেষ নিব্বানধাতু অর্থ: “অনুপাধি” মানে—কোনো অবশিষ্ট উপাদান নেই; অর্থাৎ, দেহ-ইন্দ্রিয়-চিত্ত—সব শারীরিক ও মানসিক উপাদান নিঃশেষ হয়েছে। এটি হলো চূড়ান্ত বা পরিনির্বাণ (Parinibbāna)—যখন অরহৎ মৃত্যুর পর সমস্ত উপাধি (পঞ্চস্কন্ধ) সম্পূর্ণ বিলীন হয়। এখানে আর কোনো দেহ নেই, কোনো মানসিক প্রক্রিয়া নেই, কোনো পুনর্জন্মের সম্ভাবনাও নেই। কারণ সমস্ত কামনা, কর্ম ও অবিদ্যা সম্পূর্ণরূপে নিভে গেছে। বুদ্ধ এই অবস্থাকে ব্যাখ্যা করেছেন—“যেখানে নেই জন্ম, মৃত্যু, অবস্থান বা বিলয়—সেই অবস্থাকেই নির্বাণ বলে।” (Udāna, 8.1) এই অবস্থা কেবল নেগেশন নয়; এটি এমন এক চেতনার নিস্তরঙ্গ শান্তি, যেখানে সব সম্পর্ক ও দ্বৈততা নিভে গেছে—এক চিরন্তন অশর্ত মুক্তি।


এটি হলো মৃত্যুর পর অরহতের নির্বাণ—অর্থাৎ সম্পূর্ণ মুক্তি। যখন দেহ ও চেতনা ভেঙে যায়, এবং আর কোনো পুনর্জন্মের সম্ভাবনাও থাকে না, তখন সেই অবস্থাই অনুপাধিশেষ নিব্বানধাতু। এটি কোনো স্থান নয়, কোনো স্বর্গ নয়—বরং সমস্ত সংযোজিত উপাদানের বিলুপ্তিতে চিরশান্ত অস্তিত্বহীনতার মুক্ত অবস্থা। এখানে আর কোনো চেতনা, অভিজ্ঞতা, বা পরিবর্তন অবশিষ্ট থাকে না—শুধু থাকে “দুঃখের সম্পূর্ণ নিবারণ”।

বুদ্ধের বক্তব্য (Itivuttaka, 44): “ভিক্ষুগণ, দুই প্রকার নিব্বানধাতু আছে—একটিতে উপাধি আছে (জীবিত অবস্থায়), অন্যটিতে নেই (দেহ পতনের পর)।” “যে-ভিক্ষু কাম, দ্বেষ, মোহ পরিত্যাগ করেছে, তার চিত্ত মুক্ত—এ হলো সোপাধিশেষ নিব্বানধাতু। আর যখন ওই মুক্তচিত্ত ভিক্ষুর দেহ ভেঙে যায়, এবং ইন্দ্রিয়নির্ভর চেতনা নিঃশেষ হয়—তখন সেটিই অনুপাধিশেষ নিব্বানধাতু।”

সোপাধিশেষ নিব্বানধাতু: জীবিত অবস্থায় মুক্তি (অরহতের নির্বাণ)। দেহ আছে, কিন্তু দুঃখের কারণ নেই।
অনুপাধিশেষ নিব্বানধাতু: দেহের অবসানের পর সম্পূর্ণ মুক্তি। আর কোনো জন্ম-দুঃখ-চেতনা অবশিষ্ট নেই।
প্রথমটি হলো মনের মুক্তি, দ্বিতীয়টি হলো অস্তিত্বের সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা।

বৌদ্ধ দর্শনে অনুপাধিশেষ নির্বাণ কেবল তখনই সম্ভব, যখন কেউ জীবদ্দশায়ই সোপাধিশেষ নির্বাণ অর্জন করেছে। অর্থাৎ, প্রথমে সমস্ত মানসিক কলুষ, তৃষ্ণা ও অবিদ্যা সম্পূর্ণ নিবারণ করতে হয়। তারপর যখন শরীরধারী জীবন শেষ হয়, তখন আর কোনো নতুন জন্ম বা পুনরাবর্তন ঘটে না। এই অবস্থাই অনুপাধিশেষ নির্বাণ। এটি কোনো সময়ক্রমে অর্জিত নতুন “অভিজ্ঞতা” নয়; বরং ইতিমধ্যেই অর্জিত জ্ঞানের পূর্ণ স্থিতি—যেখানে আর কোনো উপাধির (স্কন্ধের) প্রক্ষেপণ নেই।

শূন্যতা ও অনুপাধিশেষ নির্বাণ: নাগার্জুন ও মাধ্যমক দর্শন এই ধারণাকে আরও গভীরে নিয়ে গেছেন। তাঁদের মতে, অনুপাধিশেষ নির্বাণ মানে কোনো অস্তিত্ব-বিলোপ নয়, বরং সমস্ত স্বতঃসিদ্ধতার বিলোপ—যেখানে দুঃখ, কর্ম, উপাধি, সব শর্তের অন্ত হয়, কিন্তু “শূন্যতার” স্বচেতনা নিঃশেষ থাকে। অর্থাৎ, এটি অস্তিত্বের নাশ নয়, বরং অস্তিত্বের শর্তের নাশ।

নির্বাণ/নিব্বান (Nirvāṇa) ও শূন্যতা (Śūnyatā)–র পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাদের দার্শনিক পার্থক্য:

নির্বাণ (Nirvāṇa) মানে—দুঃখ, তৃষ্ণা ও অজ্ঞানের সম্পূর্ণ অবসান। বুদ্ধের মতে, এটি পরম শান্তি, যেখানে আর কোনো জন্ম-মৃত্যুর চক্র নেই। শূন্যতা (Śūnyatā) হলো মধ্যমক দর্শনের (Nāgārjuna) মূল তত্ত্ব—যা বলে যে, সব বস্তু, চেতনা ও অভিজ্ঞতা “স্বভাবশূন্য” (নিরপেক্ষ আত্মসত্তাহীন)। অর্থাৎ, কোনো কিছুরই স্বাধীন অস্তিত্ব নেই; সবই পরস্পরনির্ভর (pratītya-samutpāda)।

প্রাথমিক থেরবাদী বৌদ্ধধর্মে নির্বাণ ছিল বাস্তব এক “অবস্থা”—দুঃখ থেকে মুক্তির “শান্ত উপাদান” (nibbānadhātu)। কিন্তু মহাযান যুগে, বিশেষ করে নাগার্জুনের মধ্যমকে, এই ধারণা রূপান্তরিত হয়। নাগার্জুন বলেন—“নির্বাণ ও সংসার ভিন্ন নয়; উভয়েরই প্রকৃতি শূন্য।” অর্থাৎ, নির্বাণ কোনো পৃথক বাস্তবতা নয়—বরং শূন্যতার উপলব্ধিই নির্বাণ।

শূন্যতা কীভাবে নির্বাণের দার্শনিক রূপ নেয়? মধ্যমক মতে, দুঃখের মূল হলো ‘অস্তিত্ববোধের আসক্তি’—আমরা ভাবি, “আমি আছি”, “আমার আছে”, “ওটা সত্য”। কিন্তু যখন এই ধারণাগুলি ভেঙে পড়ে, এবং আমরা বুঝি যে, সব কিছুই অনিত্য, অনাত্মা ও পরস্পরনির্ভর, তখন মন আর কিছু আঁকড়ে থাকে না—এবং এই মুক্ত চেতনার অবস্থাই হলো নির্বাণ। অর্থাৎ, নির্বাণ কোনো স্থির সত্তা নয়, বরং সমস্ত সত্তাবোধের অবসান।

নাগার্জুনের দৃষ্টিতে নির্বাণ ও শূন্যতা: “সংসার ও নির্বাণের মধ্যে কোনো প্রকৃত ভেদ নেই।” (Mūlamadhyamakakārikā, ২৫.১৯) যখন অজ্ঞানে দেখা হয়, তখন সেটাই সংসার। যখন জ্ঞানে দেখা হয়, তখন সেটাই নির্বাণ। অর্থাৎ, ভেদটি দৃষ্টিভঙ্গিতে, বাস্তবতায় নয়। এভাবে নাগার্জুন “নির্বাণ”-কে কোনো চূড়ান্ত অবস্থান হিসেবে না দেখে, বরং বাস্তবতার অনন্ত শূন্যতার প্রত্যক্ষ জ্ঞান হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

থেরবাদ ও মধ্যমক দৃষ্টিতে তুলনামূলক ভাব:
থেরবাদী দৃষ্টিতে: নির্বাণ এক পরম অবস্থা (parama dhātu), যেখানে তৃষ্ণা, দ্বেষ, মোহ সম্পূর্ণ নিঃশেষ; এটি শান্ত ও অজন্ম।
মধ্যমক দৃষ্টিতে: নির্বাণ কোনো “অবস্থা” নয়; এটি বোঝার পরিবর্তন—যেখানে কেউ আর “অবস্থা”, “সত্তা”, বা “অস্তিত্ব” এঁকে দেয় না।
প্রথমটিতে নির্বাণ কিছুটা “অস্তিত্বের অবসান”, দ্বিতীয়টিতে নির্বাণ হলো অস্তিত্ব–অনস্তিত্বের দ্বন্দ্বের অবসান।

উপনিষদীয় সমান্তরাল (তুলনা হিসেবে): অদ্বৈত বেদান্তে ব্রহ্মজ্ঞান ও বৌদ্ধ নির্বাণের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম মিল আছে—দুটিই মানসিক ক্রিয়ার নিস্তব্ধতা, অহংকারের অবসান, ও চৈতন্যের প্রশান্ত রূপ প্রকাশ করে। তবে পার্থক্য এই যে—বেদান্তে চেতনা (Ātman / Brahman) চিরন্তন বাস্তব; কিন্তু মধ্যমকে চেতনা-সহ সমস্ত কিছুই শূন্য (śūnya)। অদ্বৈতে মুক্তি হলো “স্বরূপে স্থিতি” (নিজস্ব অস্তিত্বে অবস্থান), আর মধ্যমকে মুক্তি হলো “স্বভাবের অনুপস্থিতি উপলব্ধি” (নিরস্বভাবতা-দর্শন)।