শব্দভাগ ও মূল অর্থ: লোক (loka)—মানুষ, সমাজ, বিশ্বজগৎ। সংগ্রহ (saṁgraha)—ধারণ করা, রক্ষা করা, ঐক্যবদ্ধ করা, স্থিত রাখা। অর্থম্ (artham)—উদ্দেশ্যে, জন্য, অভিপ্রায়ে। সব মিলিয়ে “লোকসংগ্রহার্থং” মানে দাঁড়ায়—“সমগ্র মানবসমাজের কল্যাণ, স্থিতি ও শৃঙ্খলার উদ্দেশ্যে।”
এই শব্দটি এসেছে ভগবদ্গীতা থেকে—তৃতীয় অধ্যায় (কর্মযোগ), শ্লোক ২০ থেকে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন—
“কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহার্থমপি সম্পশ্যঙ্কর্তুমর্হসি।।” (গীতা ৩.২০)
অর্থাৎ, “জনক প্রভৃতি রাজা কেবল কর্মের মাধ্যমেই সিদ্ধি লাভ করেছেন; তুমিও তেমনভাবে কাজ করো—লোকসংগ্রহার্থম্, অর্থাৎ সমাজের কল্যাণ ও শৃঙ্খলার জন্য।”
গীতার অদ্বৈত প্রেক্ষাপটে এর মানে—যে-ব্যক্তি জ্ঞানী, মুক্তির পথে অগ্রসর, তিনিও জগতে উদাসীনভাবে কাজ করেন, কিন্তু উদ্দেশ্য থাকে লোকসংগ্রহ—অর্থাৎ সমাজকে পথ দেখানো, অন্যদের অনুপ্রেরণা দেওয়া, মানবিক ও ধর্মীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখা। যেমন একজন সিদ্ধ যোগী নিজে মুক্তি পেয়ে গেলেও যদি সমাজের উন্নতির জন্য, অন্যদের জাগরণের জন্য তাঁর জ্ঞান-বিতরণ ও কর্ম চালিয়ে যান, তাহলেই তা হয় লোকসংগ্রহার্থং কর্ম—অর্থাৎ নির্লিপ্ত (নিষ্কাম কর্ম), কিন্তু সমাজকল্যাণমূলক কাজ।
সংক্ষেপে, “লোকসংগ্রহার্থং” মানে, সমাজের কল্যাণ, ঐক্য ও ধারাবাহিকতার জন্য। এটি স্বার্থহীন কর্মের উদ্দেশ্য, যা মুক্ত ব্যক্তির আচার বা “কর্তব্য”-এর প্রকৃত রূপ নির্দেশ করে।
যদি ব্যাবহারিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়, তাহলে নৈতিকতা, ধর্মাচরণ, ও মুক্তির পথ সবই অর্থহীন হয়ে পড়বে। অদ্বৈত তাই শেখায়—যদিও জগৎ চূড়ান্ত সত্য নয়, তবু এর মধ্যে থাকা অবস্থায় আমাদের কর্তব্য পালন করতে হবে (“লোকসংগ্রহার্থং”, গীতা অনুযায়ী)। এভাবেই ব্যাবহারিক জগৎ হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক উত্তরণের ক্ষেত্র।
এই দ্বিস্তরীয় বাস্তবতা অদ্বৈতের যুক্তিগত ভারসাম্য বজায় রাখে। এটি বলে—জগৎ না পুরোপুরি মিথ্যা, না পুরোপুরি সত্য। এটি “মিথ্যা-সত্যের মধ্যবর্তী অবস্থা”—যেখানে কার্যকর অভিজ্ঞতা থাকে, কিন্তু চূড়ান্ত স্বতন্ত্রতা থাকে না। এইভাবে অদ্বৈত জগতের দৃঢ় অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার না করে তা ব্রহ্মণের একমাত্র সত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে।
ব্যাবহারিক সত্য (Vyāvahārika Satya)—জগৎ আপাতভাবে বাস্তব, অভিজ্ঞতাগতভাবে কার্যকর। পারমার্থিক সত্য (Pāramārthika Satya)—কেবল ব্রহ্মণই চিরন্তন, চূড়ান্ত বাস্তব। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ব্যাবহারিক স্তরে থাকে, জগৎ ও কর্তব্য বাস্তব; কিন্তু জ্ঞান উদয় হলে, সব কিছুই ব্রহ্মণের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। এককথায়, জগৎ ব্যাবহারিকভাবে সত্য, কিন্তু পারমার্থিকভাবে মিথ্যা; আর একমাত্র ব্রহ্মণই—চূড়ান্ত, অপরিবর্তনীয়, পরম সত্য।
মিথ্যাত্বের যুক্তিগত প্রমাণের প্রয়োজন। অদ্বৈত দর্শনে “জগৎ মিথ্যা”—এই দাবি শুধু বিশ্বাস বা প্রতীতি নয়, বরং যৌক্তিকভাবে প্রমাণযোগ্য সত্য। অতএব, দর্শনটি যুক্তিশাস্ত্রের ন্যায়প্রণালী ব্যবহার করে দেখায় যে—যা-কিছু অংশযুক্ত (composite), তা স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না; আর যা স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না, তা চূড়ান্ত অর্থে অবাস্তব বা মিথ্যা (mithyā)। এই প্রমাণই “যৌগিক নির্ভরতার অনুমান (inference of composite dependency)” নামে পরিচিত।
অনুমানের মূলসূত্র একটি সংস্কৃত শ্লোক; তা বলে—“নিজস্ব অংশ/আধারে বিদ্যমান চরম অ-বিদ্যমানতার প্রতিযোগিত্ব থাকে, কারণ এটি একটি কাপড়ের মতো অংশযুক্ত (anśitvāt tiro-'nśivat guṇādiṣu)।” এর সরল অর্থ: যে-বস্তুটির মধ্যে অংশ বা গুণের নির্ভরতা আছে, তার মধ্যে চরম অ-অস্তিত্ব (atyantābhāva) লুকিয়ে থাকে—অর্থাৎ, সেটি স্বাধীনভাবে বিদ্যমান নয়, বরং তার বাস্তবতা অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল।
একটি কাপড় (paṭa) দেখতে একক ও মজবুত মনে হয়, কিন্তু বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়—তার অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে সুতোর (tantu) ওপর নির্ভর করে। সুতো ছাড়া কাপড় থাকে না; সুতোর গুণ, রং, বুননই কাপড়ের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। অর্থাৎ কাপড়ের অস্তিত্ব উৎপন্ন ও নির্ভরশীল (derivative and dependent)।
তাহলে যুক্তিটি দাঁড়ায়: কাপড়ের মতো যা-কিছু অংশযুক্ত, তা স্বাধীনভাবে টিকতে পারে না, তাই তা চূড়ান্ত অর্থে মিথ্যা।
যুক্তির রূপ (formal inference structure): অদ্বৈত এই যুক্তিকে একটি পূর্ণাঙ্গ syllogism-এ রূপ দেয়—
প্রতিজ্ঞা (thesis): সব যৌগিক বস্তু মিথ্যা।
হেতু (reason): কারণ তারা অংশযুক্ত (anśitva)।
দৃষ্টান্ত (example): যেমন কাপড় সুতো-নির্ভর।
উপনয় (application): জগৎও অংশ ও গুণের সমন্বয়, তাই নির্ভরশীল।
নিগমন (conclusion): অতএব, জগৎ মিথ্যা।
Syllogism (সিলোজিজম) হলো যৌক্তিক প্রমাণ বা তর্কের একটি সংগঠিত পদ্ধতি, যেখানে তিনটি ধাপে (বা তিনটি বাক্যে) কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়। এটি প্রাচীন এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যা (Aristotelian logic) থেকে এসেছে। সংস্কৃত দর্শনে একে বলা হয় “অনুমান (anumāna)”-এর একটি রূপ বা কাঠামো, যা “প্রতিজ্ঞা-হেতু-দৃষ্টান্ত-উপনয়-নিগমন” পদ্ধতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
সিলোজিজমের তিনটি মূল অংশ:
Major Premise (প্রধান প্রতিজ্ঞা)—একটি সাধারণ সত্য বা সর্বজনীন নিয়ম। যেমন: “(সব) মানুষ নশ্বর।”
Minor Premise (উপপ্রতিজ্ঞা)—সেই নিয়মের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট উদাহরণ বা ঘটনা। যেমন: “সক্রেটিস একজন মানুষ।”
Conclusion (নিগমন)—উপরের দুই বক্তব্য থেকে যে-সিদ্ধান্ত অবশ্যম্ভাবীভাবে আসে। যেমন: “অতএব, সক্রেটিস নশ্বর।”
এটাই হলো একটি syllogism—তিনটি বাক্যে সাজানো এক নিখুঁত যৌক্তিক প্রমাণ।
আরেকটি উদাহরণ—
প্রতিজ্ঞা: সব ফুলই নরম।
উপপ্রতিজ্ঞা: গোলাপ একটি ফুল।
নিগমন: অতএব, গোলাপ নরম।
দর্শনের প্রেক্ষিতে উদাহরণ (অদ্বৈত): অদ্বৈতের মিথ্যাত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে সিলোজিজমটি হবে—
Major premise: যা-কিছু অংশযুক্ত, তা স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না।
Minor premise: জগৎ অংশযুক্ত (যেমন গুণ, পদার্থ, স্থান, সময় ইত্যাদি নিয়ে গঠিত)।
Conclusion: অতএব, জগৎ স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না—অর্থাৎ, মিথ্যা।
এভাবে যুক্তিটি ক্রমান্বয়ে এক অব্যর্থ সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
সংস্কৃত/ভারতীয় রূপ (Anumāna structure): ভারতীয় যুক্তিতে অনুরূপ কাঠামো পাঁচ ধাপে দেওয়া হয়—
প্রতিজ্ঞা (thesis)
হেতু (reason)
দৃষ্টান্ত (example)
উপনয় (application)
নিগমন (conclusion)
অদ্বৈতের উদাহরণে—
প্রতিজ্ঞা—জগৎ মিথ্যা।
হেতু—কারণ তা অংশযুক্ত।
দৃষ্টান্ত—যেমন কাপড় সুতোর ওপর নির্ভরশীল।
উপনয়—জগৎও অংশ ও গুণে গঠিত, তাই নির্ভরশীল।
নিগমন—অতএব, জগৎ মিথ্যা।
Syllogism হলো তর্কের একটি ক্রমবদ্ধ যৌক্তিক সূত্র, যেখানে সর্বজনীন নীতি—নির্দিষ্ট ঘটনা—অনিবার্য সিদ্ধান্ত—এই তিন স্তরের মাধ্যমে সত্য নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ, এটি হলো “যৌক্তিক চিন্তার কঙ্কাল” (logical skeleton)—যার ওপর দর্শন তার যুক্তিগত সত্যের ভবন নির্মাণ করে।
যুক্তির সারকথা: নির্ভরতা মানেই মিথ্যাত্ব। যেখানে নির্ভরতা (dependence) আছে, সেখানে স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। আর স্বাধীন অস্তিত্ব না থাকলে সেটি চূড়ান্ত অর্থে অ-বাস্তব (non-ultimate)। অতএব, নির্ভরতা মিথ্যাত্বের বৈশিষ্ট্য।
সর্বজনীন প্রয়োগ: অণু থেকে ব্রহ্মাণ্ড—এই যুক্তি কেবল কাপড়-সুতো নয়, পুরো জগৎ, সব বস্তু, সমস্ত চেতনা ও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে-কোনো সত্তা যদি “অংশযুক্ত” হয়—যেমন শরীর অঙ্গ-নির্ভর, গাছ শেকড়-নির্ভর, পৃথিবী উপাদান-নির্ভর—তবে তার অস্তিত্বও নির্ভরশীল। অতএব, যা-কিছু “ব্রহ্মণ নয়”, অর্থাৎ যা যা কোনো-না-কোনো আধার বা কারণের ওপর টিকে আছে, তার সবই মায়াময় (mithyā)।
দার্শনিক ফলাফল—একমাত্র স্বাধীন বাস্তবতা ব্রহ্মণ। এখন, যদি আমরা খুঁজে দেখি—কোন সত্তা আছে, যা কোনো অংশ বা আধারের ওপর নির্ভরশীল নয়, তাহলে তার একটিই উত্তর: ব্রহ্মণ। ব্রহ্মণ অখণ্ড (non-composite), স্বয়ংসিদ্ধ (self-existent), এবং নির্ভরশূন্য (independent)। তাই, কেবল ব্রহ্মণই সত্য (satya), আর বাকি সমস্ত কিছু মিথ্যা (mithyā)—কারণ তারা নির্ভরশীল।
দ্বৈতবাদ ও বহুত্ববাদ খণ্ডন: এই যুক্তি দিয়ে অদ্বৈত দ্বৈতবাদ (dualism) ও বহুত্ববাদ (pluralism) উভয়কেই খণ্ডন করে। কারণ, যদি একাধিক “স্বাধীন” বাস্তবতা থাকে, তবে তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হবে না—কিন্তু নির্ভরশূন্য একাধিক বাস্তবতা থাকা যুক্তিগতভাবে অসম্ভব। অতএব, একটিই পরম স্বাধীন বাস্তবতা আছে—ব্রহ্মণ, আর বাকি সবই তার ওপর নির্ভরশীল মায়াময় প্রতীতি।
যা নির্ভরশীল, তা মিথ্যা। যা নির্ভরশূন্য, তা সত্য। এই একমাত্র মানদণ্ডেই অদ্বৈত দর্শন মহাবিশ্বের সমগ্র মিথ্যাত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে। সব যৌগিক সত্তা—যত সূক্ষ্ম বা বিশালই হোক না কেন—অংশ, গুণ, বা কারণের ওপর নির্ভর করে; আর তাই, তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। চূড়ান্তভাবে কেবল ব্রহ্মণই অবলম্বনহীন, একক, চিরন্তন সত্য। অর্থাৎ, নির্ভরতা বোঝায় অস্থায়িত্ব, অস্থায়িত্ব বোঝায় মিথ্যাত্ব, আর মিথ্যাত্বের পেছনে একমাত্র অবলম্বন—ব্রহ্মণ।
সর্বজনীন অধ্যাস (Universal Superimposition–Ādhyāsa)—অদ্বৈত বেদান্তে মিথ্যাত্ব তত্ত্বের হৃদয়। নিচে ধাপে ধাপে সহজ ভাষায় এটিকে ব্যাখ্যা করছি—
মিথ্যাত্বের সর্বজনীনতা: অদ্বৈত দর্শন বলে, যা-কিছু দেখা যায়, অনুভব করা যায় বা চিন্তা করা যায়—সবই মিথ্যা (mithyā), কারণ তা ব্রহ্মণের ওপর নির্ভরশীল এবং স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল নয়। কিন্তু এর মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন (saṁśaya) উঠতে পারে—“যদি সব কিছু অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করে, তাহলে এমন কোনো সত্তা কি নেই, যার কোনো আধার নেই, অর্থাৎ যা স্বয়ং অস্তিত্বশীল (self-existent)?” এই প্রশ্নই আধারবিহীন সত্তার সম্ভাবনা (śāśvatī saṁśaya)—যা অদ্বৈতের মিথ্যাত্ব সংজ্ঞাকেই সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে।
আপত্তি (Pūrvapakṣa): “ব্রহ্মণ থেকে ভিন্ন কোনো স্বতন্ত্র সত্তা কি থাকতে পারে?” আপত্তিটা দাঁড়ায় এমনভাবে—যদি মিথ্যাত্ব বোঝায় “যে-সত্তা তার আধারের ওপর নির্ভরশীল”, তাহলে যদি কোনো সত্তা আধারবিহীন হয়—অর্থাৎ যা নিজেই নিজের ভিত্তি (self-grounded)—তাহলে তো সেটি অবশ্যই বাস্তব (satya) হবে। এতে অদ্বৈতের ভিত্তি কেঁপে উঠবে, কারণ তখন ব্রহ্মণের বাইরে অন্য বাস্তবতার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
পালটা-যুক্তি (Siddhānta): আত্মনই একমাত্র উৎস—অদ্বৈত এর জবাব দেয়—“সব কিছুই আত্মন (Ātman) থেকে উদ্ভূত, তাই আত্মন (যা ব্রহ্মণ) থেকেই মায়িকভাবে আরোপিত (kalpitaṁ)।” অর্থাৎ, জগৎ কোনো স্বাধীন সত্তা নয়, বরং আত্মনের (ব্রহ্মণের) ওপর অধ্যাস (superimposition)। এই বক্তব্যে দুটি মৌলিক দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি আছে—
উৎস ও পরিচয়ের ঐক্য: সব কিছুর উৎসই আত্মন, তাই আত্মন থেকে কিছু “ভিন্ন” থাকতে পারে না। এই সূত্রেই উপনিষদের বাণী—“তৎ ত্বম্ অসি” (Tat Tvam Asi)—“তুমিই সেই।”
অধ্যাসের সর্বজনীনতা: জগৎ কোনো বাস্তব সৃষ্টি নয়, বরং আত্মনের ওপর অর্পিত প্রতীতি (superimposed appearance)। অর্থাৎ, আত্মা নিজেরই এক বিকৃত প্রতিফলন হিসেবে জগতরূপে প্রতীয়মান।
“অধ্যাস (adhyāsa)” শব্দের অর্থ—আরোপ বা superimposition। অদ্বৈতের ভাষায়, “যেখানে একটি জিনিসের গুণ বা পরিচয় অন্য জিনিসে আরোপ করা হয়।” যেমন দড়ির ওপর সাপ দেখা (rajju-sarpa-bhrānti), শরীরকে আত্মা মনে করা (“আমি মোটা, আমি খুশি”), এগুলো সবই “অধ্যাস”—যেখানে বাস্তব আধারের ওপর অবাস্তব ধারণা আরোপিত হয়েছে। অদ্বৈত বলে, এই ভুল আরোপ শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং মহাজাগতিক (cosmic)—মায়া নিজেই এই অধ্যাসের শক্তি, যার ফলে ব্রহ্মণ “জগৎ” রূপে প্রতীয়মান।
মহাজাগতিক অধ্যাস (Cosmic Superimposition): এখানেই অদ্বৈতের গভীরতম বক্তব্য—“যে বহুবিধ জগৎ আমরা দেখি, তা আসলে আত্মনের ওপর মহাজাগতিক অধ্যাস।” অর্থাৎ, সমগ্র সৃষ্টি একটি আপাত প্রকাশ (apparent manifestation), যা আত্মার চেতন-সত্তার ওপর আরোপিত, যেন চেতনা নিজেই নিজের শক্তির প্রতিফলনে “বহু” বলে প্রতীয়মান। এইভাবে—বহুত্ব (plurality) কোনো সত্য বাস্তবতা নয়, বরং এক (Brahman)-এর বিকৃত প্রতিফলন, যা মায়া নামক শক্তির মাধ্যমে দেখা যায়।