বেদান্ত দর্শন বলে, সাধনার প্রথম ধাপ হলো আত্মা (আত্মন) ও অনাত্মা (বিশ্ব, শরীর, মন)-এর পার্থক্য অনুধাবন করা। সর্বোচ্চ স্তরে গিয়ে দেখা যায়—কেবল ব্রহ্মই আছে এবং বাকি সব কিছুই বিভ্রমমাত্র। এ অবস্থায় জীব-জগৎ, ঈশ্বর, জন্ম-মৃত্যু, পুণ্য-পাপ, গুরু-শিষ্য, মুক্তি—কিছুই থাকে না—থাকে শুধু নির্জীব, নিরাকার, নিঃসঙ্গ ব্রহ্ম।
আত্মস্বরূপ উপলব্ধির জন্য সমস্ত চিন্তা, রূপ, অনুভব ত্যাগ করতে হবে। এমনকি 'আমি ব্রহ্ম' এই ধ্যানও ছাড়তে হবে। এই ভাবনাহীন অবস্থাই প্রকৃত 'পরম অবস্থা'—যেখানে কোনো সত্তা বা অভিজ্ঞতাও নেই। অবশেষে উপলব্ধ হয়—“আমি ব্রহ্ম। আমি চৈতন্য। আমি নিজেই শুদ্ধ, চিরন্তন, নির্গুণ আনন্দ।”
তখন সকল সনাতন সাধন পদ্ধতি (শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন) অতিক্রান্ত হয়ে যায় আর মনে হতে থাকে—এ সব কিছুই মায়া। কেবল চৈতন্যই সত্য। এমনকি তীর্থ, যজ্ঞ, গঙ্গা-রামেশ্বরম, উপনিষদ, শ্রুতি—সবই বিভ্রম। তবে এগুলো এক-একটি ‘মায়াময় দরজা’, যা দিয়ে অ-মায়িক ব্রহ্মে প্রবেশ সম্ভব। সমস্তই চৈতন্য—পঞ্চভূত, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, গুণত্রয়, জ্ঞান, স্মৃতি, বেদান্ত, আত্মা, গুরু, কর্ম, আনন্দ—সবই চৈতন্য। সুতরাং যিনি এই জ্ঞান হৃদয়ে ধারণ করেন, তিনি ধীরে ধীরে আত্মারূপ ব্রহ্ম হয়ে যান।
আত্মস্বরূপের এই উপলব্ধি নিয়ে কিছুটা ধারণা পেতে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে এগোনো যাক।
কণ্ঠ ১ (অন্বেষণকারী সত্তা): এই জগতের ভেতর কি কিছু সত্য আছে? না কি সবই কল্পনা? শুধু—আমি আছি, এ অনুভব—এটাই কি বাস্তব?
কণ্ঠ ২ (অন্তর্জ্ঞাতা আত্মা): তুমি যা ভাবছ, তা-ই… এই বিশ্ব, এই দেহ, মন—সবই অনাত্মা। আত্মা একটাই—নিরাকার, নিঃশব্দ, চৈতন্যময়।
কণ্ঠ ১: আচ্ছা, তবে গুরু, ঈশ্বর, সৃষ্টি, ধর্ম—এসব কী? আমার তো চেতনা আছে, চিন্তা আছে, ইচ্ছা আছে…
কণ্ঠ ২: তবে জেনে রাখো—জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। না আছে শাস্ত্র, না আছে সাধনা। ব্রহ্মই একমাত্র, আর সবই শুধু বিভ্রমের ছায়া।
কণ্ঠ ১: তাহলে আমি কে? এই “আমি” কি সত্যিই কোনো একক অস্তিত্ব?
কণ্ঠ ২: “আমি” বলে কিছু নেই, “তুমি” বলে কিছু নেই। এই বিভেদই মায়ার প্রপঞ্চ। তুমি ব্রহ্ম—চিরন্তন, নিরুপাধি, অপার!
কণ্ঠ ১: জ্ঞানযোগের গল্পগুলি কি তাহলে শুধু কাহিনি? নিছকই পথের দিশা দেখানোর জন্য সৃষ্ট?
কণ্ঠ ২: ও সবই জ্ঞানযোগের নাট্যরূপ—যেখানে গুরু ছদ্মবেশে এসে প্রশ্ন করেন—উপরে কে? নিচে কে?—আর ছাত্র বুঝে ফেলে—'আমি-তুমি' সবই অজ্ঞতার ছায়া।
কণ্ঠ ১: তবে সাধনার শেষ কি শুধুই নীরবতা? কোনো ধ্যান নেই? কোনো ভাবনা নেই?
কণ্ঠ ২: 'সাধনার শেষ' নয়, শুরুই সেখানে—যেখানে নেই 'আমি ব্রহ্ম' ধ্যানও, নেই 'জ্ঞান' নামক পরিচয়ও। আছে শুধু এক, অবিচল, নিরুপাধি চৈতন্য।