সাধারণত থেরাপি শুরু হয় এই ধারণা দিয়ে যে, তুমি আলাদা একজন মানুষ বা সত্তা, যার সুস্থ বা আরোগ্যপ্রাপ্ত হওয়া দরকার। তারপর নানা উপায়ে তোমার দুঃখ কমানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যদি এই ধারণাটাই ভুল হয়? যদি আলাদা একজন “আমি” ভাবাটাই আসলে দুঃখের মূল কারণ হয়?
অদ্বৈত থেরাপি একেবারেই অন্য পথে চলে। এখানে তোমাকে আলাদা একজন মানুষ ধরে নিয়ে কিছু করানো হয় না, বরং সেই “আলাদা হওয়ার” ধারণাটাকেই গভীরভাবে ভেবে দেখে বাদ দেওয়া হয়। তখন বোঝা যায়, তোমার আসল কাজ দুঃখ সামলানো বা কমানো নয়, বরং নিজের ভেতরে থাকা প্রকৃত শান্তি আর সুখকে চিনে নেওয়া—যা তোমার ভেতর সবসময়ই আছে।
সাধারণত আমরা থেরাপিস্ট বা কোচের কাছে যাই, কারণ ভাবি, আমাদের দুঃখের কারণ হলো কাজ, শরীর, সম্পর্ক বা বাইরের কিছু-একটা। থেরাপিস্ট তখন সাহায্য করেন কারণটা বুঝতে, নতুনভাবে ভাবতে, আর তার সাথে উদ্ভূত প্রাসঙ্গিক অনুভূতি বা চিন্তাগুলো নিয়ে কাজ করতে। এতে আশা থাকে, সময়ের সঙ্গে একদিন দুঃখ কমবে।
তবে এই পদ্ধতিতে “আমি আলাদা একজন”—এই ধারণাটা থেকেই যায়। আর যেহেতু সেটাই দুঃখের মূল, তাই পরবর্তীতে আবার নতুন কষ্ট জন্ম নেয়।
অদ্বৈত থেরাপি এখানে আলাদা। এখানে থেরাপিস্ট তোমাকে আলাদা একজন ধরে নেন না। বরং বলেন—“এই আলাদা হওয়ার ধারণাটাই বাদ দিতে চেষ্টা করো।” তুমি মনোযোগ দাও সেই সত্তার দিকে, যে বলে: “আমি কষ্ট পাচ্ছি।”
সাধারণ থেরাপিতে তুমি ভাবো সম্পর্ক, কাজ বা স্বাস্থ্যের কারণে তুমি কষ্ট পাচ্ছ। কিন্তু অদ্বৈত পদ্ধতিতে মনোযোগ দেওয়া হয় “আমি”-র দিকে।
তুমি কি ভাবনা? না। তুমি কি ছবি, স্মৃতি, আবেগ বা শরীরের অনুভূতি? না। এরা আসে আর যায়। তুমি সবসময়ই আছ “আমি” হিসেবে।
এই “আমি”-র প্রকৃতি কী? সেটি হলো কেবল সচেতন থাকা—সত্তা, চেতনা, উপস্থিতি। সেখানে তাকালে দেখা যায়, আসলে কোনো দুঃখ নেই, কোনো অশান্তি নেই।
অশান্তি থাকে চিন্তায়, দুঃখ থাকে অনুভূতিতে। কিন্তু তুমি সেইজন, যে চিন্তাগুলো জানে আর অনুভূতিগুলোকে দেখে। তাই তুমি নিজে—যে সচেতন—সে স্বভাবতই দুঃখ ও অশান্তি থেকে মুক্ত।
শান্তি আর সুখ তোমার আসল সত্তার স্বভাব। তাই এই শান্তি ও সুখ, যেটা তুমি এতদিন খুঁজছিলে বস্তু, কাজ, সম্পর্ক বা থেরাপির অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, সেটাই আসলে তোমার ভেতরে সবসময় উপস্থিত।
অন্যভাবে বললে, প্রচলিত থেরাপিতে সব মনোযোগ যায় “আলাদা আমি”-র দিকে—তাকে কিছু করতে হয়, যাতে অশান্তি থেকে শান্তিতে, দুঃখ থেকে আনন্দে যাওয়া যায়। কিন্তু অদ্বৈত বোঝাপড়ায় এই “আলাদা আমি”-কেই প্রশ্ন করা হয়, আর দেখা যায়, সেটি আসলে এক ভ্রম।
এতে বোঝানো হয় না যে, এই আলাদা আমি একেবারেই নেই। যেমন “চৌকো বৃত্ত” একেবারেই অস্তিত্বহীন, কিন্তু ভ্রমের অস্তিত্ব আছে। সেটা বাস্তব, তবে যেমন দেখা যায়, তেমন নয়।
তাহলে 'আলাদা আমি' বা স্ব-এর আসল সত্য কী? সেটি হলো একমাত্র অসীম সচেতনতা—যার প্রকৃতি শান্তি ও সুখ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, তুমি যখন চিনতে শুরু করবে এই প্রকৃত স্বভাবকে—শান্তি আর নীরব আনন্দ হিসেবে—আর তাতে স্থির হবে, তখন তুমি আবার সেই অভিজ্ঞতাগুলোর দিকে ফিরবে, যেগুলো আগে এড়িয়ে গিয়েছিলে।
এখানে থেরাপির ভূমিকা হলো: সাহায্য করা—যাতে এই নতুন উপলব্ধি তোমার কাজ, সম্পর্ক আর দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশে যায়, সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। দুঃখ বা সুখ সবই আছে তোমার মধ্যে, তা তোমার বাহ্যিক বা মানসিক অবস্থা যেমনই হোক না কেন।
অদ্বৈত বোঝাপড়ায়, থেরাপিস্ট তোমাকে সাহায্য করেন নিজের স্বরূপ অনুসন্ধান করতে। ধীরে ধীরে সেই অনুসন্ধান তোমাকে গভীর চিন্তন আর স্পষ্ট উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাবে। আর সময়ের সঙ্গে তুমি প্রতিষ্ঠিত হবে তোমার অস্তিত্বের স্বাভাবিক শান্তি ও আনন্দে। তখন প্রচলিত থেরাপি হবে সহায়ক হাতিয়ার, কেবলই এক অনুষঙ্গ—কোনো দুঃখ বা কষ্ট দূর করার মাধ্যম নয়, দুঃখ-কষ্ট দূর হবে নিয়ম অনুযায়ীই—যা তোমার সব অভিজ্ঞতাকে এই নতুন বোঝাপড়ার সঙ্গে এক করে দেবে।
সহজ করে বললে, আমরা যেন প্রতিদিন হাঁটি সুস্বাস্থ্যের লোভে নয়, আনন্দের লোভেও নয়, বরং নিতান্ত অভ্যেসের কারণে—এমন অভ্যেস, যেটাকে জীবনযাপন থেকে আলাদা কিছু মনে হয় না—নিঃশ্বাস নেওয়াকে যেমনি সচেতন প্রয়াস বলে কিছু মনে হয় না, আলাদা কোনো বাহ্যিক প্রচেষ্টা হিসেবে যা চোখের সামনে আসে না—স্বাস্থ্যলাভের কাজ যা হবার, তা আপনিই হবে।