কাল রাত থেকে এখন অবধি কিছুই খাইনি, কিন্তু আমার খিদে পেয়েছে অনেক।
জানো, আমি বেশি সময় না খেয়ে থাকতে পারি না, ডাক্তারের বারণ আছে। অথচ দেখো, তুমি আমাকে এতটাই বাজেভাবে বকেছ…এতটাই বাজেভাবে বকেছ, আমি কিছুতেই খেতে পর্যন্ত পারছি না!
আমার শুধুই কান্না পাচ্ছে। সারাক্ষণই কাঁদছি, প্রচুর কাঁদছি! এ কী এক কচুর কান্না, বলো তো! হায়, এই কচুর কান্নাটাই কোনওভাবে থামছে না!
ভেবেছিলাম, নামাজ পড়তে বসলে মন শান্ত হবে। আমার খুব কষ্ট হলে আমি এটা প্রায়ই করি। রুমের লাইট বন্ধ করে জায়নামাজে বসে পড়ি। হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে আমার আঁকার খাতাটা নিয়েও বসি কিংবা একা একা হাঁটতে চলে যাই দূরের কোনও পাহাড়ে বা নদীর পাড়ে। ওসবে কাজ হয়।
অথচ এই উপায়গুলি আজ তোমার কাছে এসে অসহায় হয়ে পড়ে আছে…। নিজেকে নিয়ে আমি বোধহয় এখনও জানি না পুরোপুরি, এরকমই মনে হচ্ছে।
এই মুহূর্তে, তীব্র কষ্টে আমার শ্বাসনালী রুদ্ধ হয়ে আসছে, এমন মনে হচ্ছে!
কেবলই মনে হচ্ছে, তুমি আমার অপরিচিত কেউ।
তুমি এমন কেউ, যাকে আমি কোনও দিন দেখিনি, স্পর্শ করিনি।
তুমি সেই মানুষটি নও, যার শরীরের ঘ্রাণে আমি বিভোর হয়ে পড়ি।
তুমিই সেই মানুষ, যার চলে যাওয়ার পায়ের ছাপ গুনে গুনে আমি নিজের পা রাখিনি,
যাকে আবারও কাছে পাওয়ার অপেক্ষা আমার ছিল না, ছিল না কোনও উৎকণ্ঠাও,
অনেক দিন পর কাছে পেয়ে বুকে জাপটে ধরার তীব্রতাও ছিল না কখনও।
আজকের তোমাকে আমি সত্যিই চিনি না। এমন করে আর কোনও দিন তোমাকে চিনতে…চাইও না!
জানো, যেমনই, যতই কষ্ট হোক না কেন, আমি চাইলেই মরে যেতে পারব না।
কোনওমতে নিঃশ্বাস টিকিয়ে রেখে রেখে কিছু দায়িত্ব আমাকে পালন করে যেতে হবে---
কিছু মানুষের প্রতি, যাদের সাথে আমার বন্ধন নাড়ির কিংবা আত্মার।
এই বন্ধনটির প্রতি আমার যে দায়বদ্ধতা বা পিছুটান, তার কাছে
তোমার দেওয়া সমস্ত কষ্ট খুবই তুচ্ছ কিছু।
আমি জায়নামাজে বসে আল্লাহ্র কাছে একটি প্রার্থনাই করেছি শুধু---
তিনি যেন আমাকে ধৈর্য দেন সৃষ্ট এই পরিস্থিতি সামলে ওঠার জন্য।
তোমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করিনি তাঁর কাছে,
তোমার জন্য শুধু দোয়াপ্রার্থনা করা যায়, অভিযোগ করা যায় না।
আমি বিশ্বাস করি, সৃষ্টিকর্তা নিজেও
ভালোবাসার মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ-করাটা ঠিক পছন্দ করেন না।
কাউকে সত্যিই ভালোবাসলে তার জন্যে শুধু দোয়াই করতে হয়,
তাকে শুভকামনায় রাখতে হয়। অন্য সব কিছু দ্রুত ভুলে যাওয়াই মঙ্গলকর।
এরপর, মূঢ় নিঃশব্দতায় জায়নামাজ ছেড়েছি,
কয়েক ফোঁটা লোনাজল জমা রেখেছি সেখানে, ভাঁজ করে তুলে রাখার সময়।
তোমার প্রতি আমার অনুভূতি সৎ, আন্তরিক, প্রগাঢ়।
পৃথিবীর কোনও কিছুই তোমার ধ্যান থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না।
তবু, আজ থেকে, ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আমি সত্যিই বিচ্ছিন্ন হতে চাই!
আমি চাইছি তোমার কাছ থেকে পালাতে,
তোমার দেওয়া কষ্টের বোধগুলি থেকে পালাতে।
চাইছি পালাতে…তোমাকে ঘিরে আমার যা অনুভূতি, তার সমস্ত কিছু থেকেই।
অথচ, পারছিই-বা কই, দেখো!
দুদণ্ড শান্তির জন্য তোমার স্মৃতি ভুলে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতে চেয়েছি।
এসে দেখি, এখানেও তুমি…অর্কিডের গায়ে গায়ে, গ্রিলের প্রত্যেকটি ফাঁকে…!
দূরআকাশের দিকে তাকিয়ে একটাই প্রশ্ন ছুড়েছি---
আমার সমস্ত অনুভূতি তোমাকে ঘিরে কেন? তুমি ছাড়া পৃথিবীতে কি আর একটিও মানুষ নেই ভালোবাসার জন্য? এত কষ্ট, এত উপেক্ষা ছুড়ে ছুড়ে দিলে, তবুও তোমার কাছে আটকে পড়ে থাকার ইচ্ছে…কেন!
আমার প্রতি তোমার দীর্ঘ অভিযোগপত্রের কাছে,
তুমি যে মননশীলতার চর্চা করো, তার কাছে,
যে চেতনাগুলি তুমি ধারণ করো, তার কাছে---আমার কিছু প্রশ্ন:
আদৌ কি কখনও আমায় ভালোবেসে ছিলে?
এসেছিলে কখনও কাছে?
কণামাত্রও বুঝেছ আমাকে?
তোমাকে ঘিরে আমার চাওয়াগুলি, ভাবনাগুলি, আর আমার ছোট ছোট স্বপ্নগুলি…
বুঝতে পেরেছ কখনও?...আসলে বুঝোনি কিছুই! বুঝলে,
এমন কঠিন ভাষায়, এমন বাজে শব্দ নির্বাচন করে করে,
তুমি আমাকে মিথ্যেঅপবাদ দিতে না কিংবা অত কিছু লিখতে সত্যিই পারতে না!
এ কেমন সৃষ্টিশীল মানুষ তুমি!
যে মানুষের চোখ পড়তে পারে না, মন পড়তে পারে না!
এত ইগো, এত অহংকার যার কাছে প্রশ্রয় পায়, সে আবার কেমন সৃষ্টিশীল মানুষ!
কেউ তোমাকে ভালোবাসলে হাজার পদের কষ্ট গিলতে বাধ্য করবে তাকে,
আর তোমাকে উঁচু করে একটা কথা পর্যন্ত বললে, তার নাম দেবে মানসিক নির্যাতন!
---এটা কেমন বিচার তোমার?
তোমাকে ভালোবেসে একজন মানুষ তোমার সব কিছুকে ভালোবাসবে,
তোমার সব কিছুই সহ্য করবে,---তখন তোমাকেও তো
একই বিষয় মাথায় রাখতে হবে কিংবা কখনও কখনও নীরবে মানতেও হবে।
জানোই তো, সম্পর্কে সমান্তরাল ছন্দ না এলে মানুষ ছেড়ে যাওয়ার পথ খোঁজে!
আজ আমার ভাবনায় এমন কিছুই এসেছে! হ্যাঁ, আমি তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার পথ খুঁজছি!
আমার প্রতি তোমার অর্ধসত্য-ভালোবাসাও এখনও উদ্বেলিত হয়নি,
অথচ এরই মাঝে তোমার এত জটিল হিসেবনিকেশ!
তোমাকে নতুন করে দেখলাম, বুঝলাম, জানলাম।
কিছু বিষয় মাথায়, কিছু বিষয় মনে জমিয়ে রাখলাম।
এখন আমার শরীরের স্নায়ুতে স্নায়ুতে কিছু নিশ্চুপ মৌন এসে ভর করেছে।
তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য
সীমাহীন অন্তরালের দিকে পা বাড়িয়েছি…এই প্রথম।
চুপ করে তোমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ…তুমিই দিয়েছ!
আমার আচ্ছন্নতার মেঘে ঢাকা অন্তর্দীপ্তিহীন চোখের সীমানায়
বিষাদের ঘোর দিয়েছ অহেতুকই…প্রয়োজনের হাজার গুণে!
তোমাকে কাটিয়ে ওঠা এত সহজ নয়, জানি।
যেমন সহজ নয়…তোমাকে ভুলেযাওয়া, ভুলেথাকা।
তোমাকে ভালো না বেসে থাকা আরও অনেক কঠিন কিছু!
তবু, চেষ্টা থাকবে আমার…এইসব পেরে ওঠার!
আজ তোমার অভিযোগের এই বেপরোয়া ছাড়পত্রটি হাতে পেয়ে,
অপমানে ভরিয়ে-রাখা ভাষামিছিল পাঠ করতে করতে…আমার একটি উপযুক্ত শিক্ষা হয়েছে।
এতে করে, তোমার প্রতি আমার যে মায়া, প্রাণের যে উচ্ছ্বাস, সুন্দর যে ভাবনা, শুদ্ধতম যে অনুভূতি---
প্রায় সবগুলিরই অকালমৃত্যু ঘটেছে!
এখন আমি কিছুটা হলেও, আবেগ থেকে বের হয়ে এসে
বাস্তবতার ঘুলঘুলি দিয়ে তোমাকে দেখছি।
তোমাকে দেখতে না পাওয়ার হাহাকার, কাছে না পাওয়ার হাহাকার, ছুঁতে না পারার হাহাকার…
এসব ক্রমেই প্রাক্তন হয়ে যাচ্ছে। এসব আমাকে আর তাড়া করছে না। এখন আমি অনেক শান্ত হয়ে গিয়েছি,…অনেক!
তোমাকে কাছে পাবার কোনও ব্যাকুলতাই এখন আর আমার মধ্যে নেই।
তোমার কোনও ফোনকলের অপেক্ষা নেই, একটিও মেসেজের অপেক্ষা নেই।
…নেই আরও অনেক কিছুই, যা-কিছু ছিল বলে তোমাকে তীব্রভাবে ভালোবেসেছিলাম!
তোমাকে এখন আমি অন্য মানুষ হিসেবে জানি।
অপরিচিত কারও সাথে আমার বেশি গল্প হয় না, আমি চলে যাচ্ছি।
যাওয়ার আগে গুটিকয়েক মুহূর্ত তোমার চোখের দিকে ঠায় তাকিয়ে আছি।
তোমার চোখদুটি ভারি মিষ্টি, ভারি সুন্দর। এই দুটি চোখই আমাকে অন্যমনস্ক করেছে হাজারবার!
এই শহরে…সাঁঝের বেলায়, বাস্তবতার ছলে, প্রয়োজনবিহীন…
কখনও-সখনও দেখা হয়ে যেতে পারে তোমার সাথে।
তখন হয়তো এমন হবে---চোখে চোখ রাখার ভয়ে হয় তুমি পালাবে, না হয় আমি।
বেদনার ধোঁয়ায় নীরবে কিছু ক্ষত হৃদয়ে ঘনীভূত হবে আমার। তোমার হবে না।
তোমাকে ঘিরে স্বপ্নালু মুগ্ধ আঁখিপাতে অগনিত অশ্রুকণা কারারুদ্ধ হবে আমার। তোমার হবে না।
নিস্তব্ধতার কবলে সন্ধিহীন স্বাক্ষরবিহীন ভালোলাগা থেকে যাবে আমার। তোমার থাকবে না।
আমার শরীরজুড়ে বিচ্ছেদের ঘ্রাণ থাকবে। তোমার থাকবে না।
…হয়তো তখনও, হৃদয়ের আস্বাদে লুকায়িত সব প্রেমই রক্ষিত থেকে যাবে এক তোমারই জন্য!
জানো তো, তোমাকে ভালোবাসার পাশে কোনও রকম দায়িত্বের খসড়া আমি রাখিনি,
রাখিনি কাগজ-কলমের স্বাক্ষর, চাপিয়ে দিইনি নিজের কোনও ইচ্ছে,
তোমাকে বাধ্য করিনি কখনও কোনও কিছুতেই!
এমনকি, আমার অসুখের পাশেও তোমাকে চাইনি।
চাইনি আরও সহস্র জায়গায়, যেখানে আসতে তোমার বিন্দুসমানও কষ্ট হতে পারে।
…আমি শুধুই তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছি।
তাই বলছিলাম কী, বাধ্যবাধকতার দায় নেই যে ভালোবাসায়, তার পাশে
অতটা জ্ঞান খরচ করে, আবেগহীন হয়ে, যুক্তিতর্ক মিশিয়ে…
অভিযোগ - অপমান, সাথে কিছু তাচ্ছিল্যের বাণী ইনবক্সে রেখে যেয়ো না।
এতে করে ইনবক্সের প্রতি আকর্ষণ আর মায়া কমে যায়।
বুকের ভেতর যত্নেরাখা মানুষটাকে আর সুন্দর মনে হয় না।
ইনবক্সে ফিরে আসার জন্যও একটি মায়ার দরকার হয়।
যথাউপযুক্ত মনের টান না থাকলে, দায় না থাকলে…কোথাও ফেরা হয় না আমার।
যাকে দেখে আমার দিন শুরু হয়, রাত শেষ হয়,
তার আচরণের জন্য তাকে দেখতে ইচ্ছে করবে না, এমন একটা নিষ্ঠুর বাজে অনুভূতি নিয়ে…
মরতেও আমি চাই না!
আমি তো তোমার লেখায় তোমাকে মানবিক পেয়েছি,
তুমি সমস্ত আকাশের বিশালতা ধারণ করে আছ,---এমন কিছুই তো সেখানে ছড়ানো!
আমি তো তোমার লেখায় তোমাকে পেয়েছি
সফেদ ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির মতো পবিত্র, মসজিদ - মন্দির - গির্জামুখী প্রার্থনার মতো কেউ।
আমি তো তোমার লেখায় তোমাকে পেয়েছি গভীর অন্ধকারে পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় কেউ।
আমি তো তোমার লেখায় তোমাকে পেয়েছি সবুজ পল্লবে ঘেরা, স্থির দাঁড়িয়ে-থাকা পর্বত-পাহাড়ের মতো ধৈর্যশীল কেউ।
আমি তো তোমার লেখায় তোমাকে পেয়েছি সমুদ্রের উপচেপড়া ঢেউয়ের ঘোলাটে জলের মাঝেও স্বচ্ছ আয়নার মতো কেউ।
…কিন্তু গতকাল, তোমার দিক থেকে ধেয়েআসা কিছু বিষবাক্য
আমাকে মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিতে সক্ষম হয়েছে বেশ কিছুটা,
এবং পরিবর্তন করে দিয়েছে আমার অনেক ভাবনারও!
মনের যন্ত্রণায় যখন ছটফট করছি, চোখের কান্নাধারা যখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে,
সেই যন্ত্রণা আর ক্রন্দন মিলে তোমাকে বুঝেছে ঠিক এমন---
একজন লেখকের সত্তা লেখার কাগজের সাথে একরকম, ব্যক্তির সাথে সম্পূর্ণ আর একরকম!
আমরা সৃষ্টিশীল মানুষ বা লেখকদের নিয়ে যা ভাবি, তা সম্পূর্ণ সত্য বা সঠিক,…
কখনও কখনও না-ও হতে পারে!
অনেক দিন পর মনে হলো, দীর্ঘ অন্ধকার গলি পেরিয়ে আলোর কাছে এলাম!
যন্ত্রণার সাথে, কান্নার সাথে…একটি মায়ামুখও উবে গেল দূরে কোথাও!
আর ভালোভাবেই বুঝলাম, তোমাকে ভালোবাসা যাবে, কিন্তু তোমার সাথে পথ পাড়ি দেওয়া যাবে না।
তুমি এখন আমার জীবনে ঘোরলাগা কিছু রঙিন ক্ষণে দুঃখ-দেওয়ার অতিথিমাত্র!
আগের মতো করে তোমাকে আর চাইব না।
মায়াহীন সম্পর্ককে আমার প্রাণহীন মনে হয়, আর
প্রাণহীন কোনও কিছুর সাথে…বেশিক্ষণ বাঁচতে আমি পারি না।
…তুমি সুস্থ থেকো।