লাবনী বিরক্ত করে আশফাককে। ওটা বিরক্ত করা নয় আসলে, ওটা হচ্ছে লাবনীর ভালোবাসা। কিন্তু আশফাকের কাছে সেটা খুবই বিরক্তিকর।
সারাদিনই হোয়াটসঅ্যাপে, ভাইবারে, মেসেঞ্জারে, এমনকী ফোনেও মেসেজ পাঠাতেই থাকে সে।
'কী করো?' 'খেয়েছ কি না?' 'তোমার মন ভালো তো?' 'খুব ব্যস্ত?'
এই ধরনের মেসেজই লাবনী দিতে থাকে সারাদিন।
প্রতিদিনই এসব মেসেজ পেতে পেতে আশফাক আজকাল আর সব মেসেজের রিপ্লাই দেয় না।
সারাদিন কর্পোরেট দুনিয়ার সাথে মাথা খাটিয়ে ক্লান্ত-হয়ে-পড়া ছেলেটি ভাবে, লাবনীর মতো এত সময় নেই তার সারাদিন মেসেজ মেসেজ খেলার। এত মেসেজ পাঠাতে হবে কেন? আমি খেলেই কী, আর না খেলেই-বা কী! ব্যস্ত থাকলেই-বা ওকে বলতে যাব কেন?
ওপাশে লাবনী পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধবের আড্ডা, জরুরি নোটস লেখার মাঝে সময় বের করে আশফাককে মেসেজ পাঠায়। রিপ্লাই না পেলে কষ্ট পায়। মাঝে মাঝে ৩/৪ টা মেসেজ পাঠায় টানা, যেগুলোর বেশিরভাগেরই রিপ্লাই আসে না। এলেও লাবনীর বিশাল বিশাল মেসেজের বিপরীতে... হুম...খেয়েছি...ঘুমাব...টায়ার্ড...বিজি... ...এসব উত্তর আসে।
এসব দেখে খুব মন খারাপ হয় লাবনীর। প্রতিদিন রাতের বেলা এসব ভেবে সে কাঁদে।
আশফাকের খুব ক্লান্ত লাগছে আজকে। একটু আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে বাসায় চলে যায়। কাপড় পালটে, গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসে। অনেক দিন পর একটা বিকেলবেলা নিজের ব্যালকনিতে কাটানোর সুযোগ পেল। মনে মনে খুব হালকা আর ফুরফুরে অনুভব করে।
সিগারেট হাতে নিয়ে সে ভাবতে থাকে, এক লাবনী ছাড়া তার খোঁজখবর রাখার মতন কেউ নেই এই শহরে। ফোনের ওপাশে হলেও লাবনী যে না খেয়ে আশফাকের খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে, এটা সে খুব ভালো করে জানে। সে সত্যিই লাবনীকে ইগনোর করে চলে। কেন করে, সেটা সে নিজেও জানে না।
মেসজের রিপ্লাই না দিলেও লাবনীর ওসব অভিমান আর স্নেহমাখা মেসেজে আশফাক শান্তি পায়, সুখ পায়। তার মনে হয়, এই স্বার্থপর দুনিয়ায় কেউ তো আছে, যে কোনও স্বার্থ ছাড়াই ভালোবাসে তাকে।
লাবনী স্বাধীনচেতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়ে। ছিমছাম, এক্কেবারে সাধারণ। কিন্ত আশফাক চায়, লাবনী থাকুক রেড-হট টাইপের, অ্যাপিলিং, অকেশনালি একটুআধটু মদ খাবে-টাবে, সিগ্রেট ফুঁকবে, আশফাকের বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের কাপে ঝড় তুলবে। তার ইচ্ছে, যেন সে বন্ধুমহলে শুনতে পায়, 'আরে, শালার কী কপাল, মাইয়া পুরাই আইটেম একটা!' এরকম কথা শুনে উপরে উপরে রেগে যাবে আশফাক, কিন্তু ভেতরে ভেতরে স্বস্তি পাবে। আশফাক এরকমটাই চায়।
সে প্রায়ই ওরকম লাইফ লিড করতে বলে লাবনীকে। লাবনী বলে, 'না, আমাকে দিয়ে হবে না।'
একদিন রাতে এই বিষয় নিয়ে প্রচণ্ড ঝগড়া হয় দু-জনের মধ্যে।
'তুমি আমার মনের মতো নও!' 'তুমি ফ্যাকাসে টাইপের মানুষ!' 'অ্যাপিল কী জিনিস, তুমি তা বোঝোই না!'
'আমি নিজেকে বদলাতে পারব না, এমন সাদামাটাই থাকব।'
কথা কাটাকাটি চলতেই থাকে।
রাগে লাবনীর পর পর চারটা মেসেজের একটারও রিপ্লাই দেয় না আশফাক। খুব করে কাঁদে সেদিন লাবনী।
রাতে শুধুই বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে, ঘুম আসে না তার। ঘড়িতে ভোর চারটে বেজে দশ মিনিট। আয়নার সামনে গিয়ে বসে লাবনী। চোখ মুছতে মুছতে নিজের প্রতিচ্ছবিকে বলে, 'হ্যাঁ, পালটে যাব আমি, তুমি যেমন করে চাও, ঠিক তেমন করেই।'
এর পরে শুরু হয় লাবনীর রুটিনে চেইঞ্জ আসা। প্রথম প্রথম সিগ্রেট খেতে গেলে সে বমি করে দিত, চোখ জ্বালা করত, কিন্তু ধীরে ধীরে সে চেইনস্মোকারে পরিণত হয়। সে লক্ষ করে, একটা সিগ্রেট খেলে কিছুক্ষণ পরেই আরেকটা খেতে ইচ্ছে করে। তার কাছে সিগ্রেট হয়ে যায় নার্ভ-রিল্যাক্সিং একটা এক্সারসাইজের মতন।
আশফাকের বেশিরভাগ বন্ধুই এখন লাবনীর বন্ধু হয়ে গেছে। যখন যাকে ফ্রি পাওয়া যায়, লাবনী তার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ে।
চুলের কাট, জামাকাপড়, কথা বলার ধরন, গলার স্বর সবই যেন অদ্ভুতভাবে পালটে গেছে ওর। আশফাক লাবনীর মধ্যে এত বিশাল পরিবর্তন দেখে অবাক হতে থাকে। আগের মতন লাবনী আর তাকে মেসেজ পাঠিয়ে "বিরক্ত" করে না। ওকে ফোন করলেই পাশে ওর কোনও-না-কোনও বন্ধুর গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।
আশফাক ভাবে, এভাবে আর না। লাবনীর সঙ্গে দেখা করতে হবে।
লাবনী সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছে। চেহারার একটা রুক্ষভাব, চুলগুলো ঘাড়সমান করে ফেলেছে, চোখের তলায় কালি আর চোখদুটো প্রচণ্ড লাল।
: কেমন আছ, লাবনী? : দেখতেই তো পাচ্ছ। : এত সুন্দর চুলগুলো... : আরে, চুল বড়ো রাখলে "রেড-হট" হওয়া যায় না...অ্যাই, লাইটারটা দাও না, প্লিজ! আমি আনতে ভুলে গেছি। : তুমি তো দেখি আমার থেকেও বেশি সিগ্রেট খাওয়া শুরু করেছ! : তোমাকে ছাড়িয়ে যাওয়া যাবে না?...হা হা হা...এমন কিছু তো বলোনি শুরুতে...আরেহ্, লাইটার কোথায় তোমার?
পকেট থেকে লাইটার বের করতে করতে আশফাক দেখতে পায়, ওর বন্ধু রাজু এগিয়ে আসছে ওদের দিকেই।
আরে...লাবনী!...বলতেই লাবনী গিয়ে জড়িয়ে ধরে রাজুকে। আশফাক হতভম্ব হয়ে যায় ওদের কাণ্ড দেখে।
প্রচন্ড রেগে চিৎকার করে বলে ওঠে, 'কী হচ্ছে এসব, রাজু!'
'আরে, বলিস না, লাবনী সত্যিই একটা মাল! ও তোরও বান্ধবী, আমারও বান্ধবী! কী যে সৌভাগ্য তোর!'
ওপাশ থেকে এটা শুনে হাসিতে ফেটে পড়ে লাবনী। খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রাখে আশফাক।
রাজু চলে যাবার পর আশফাক চুপচাপ গিয়ে লাবনীর পাশের সিটে বসে। শক্ত করে ওর হাতটা মুঠির মধ্যে নিয়ে বলে, লাবনী, ঠিক করে বলো তো, তোমার কী হয়েছে! তোমাকে আজকাল খুব অচেনা লাগে।
লাবনী হাসে, আবার একটা সিগ্রেট ধরিয়ে সেটার ধোঁয়া ছাড়তে থাকে আশফাকের মুখের উপর।
: কী করছ এসব! : পোড়াচ্ছি। : আমাকে কেন পোড়াচ্ছ? : আরে, দেখতেই তো পাচ্ছ, সিগ্রেট পোড়াচ্ছি। তোমাকে কীভাবে পোড়াব? তোমার মধ্যে তো বারুদই নেই! হা হা হা... : তো, কার মধ্যে আছে? : রাজুর মধ্যে। হা হা হা... : চুপ করো, লাবনী...প্লিজ! : চুপই তো ছিলাম, তুমিই তো মুখ খুলতে বললে। অ্যাই, সিগ্রেট দাও তো, আমার প্যাকেট খালি! : লাবনী, আমি এভাবে তোমার সঙ্গে থাকতে পারব না। : থেকো না। : আমি কেন তোমাকে চিনতে পারছি না ইদানীং? কেন সব এলোমেলো করে দিলে আমার?
লাবনী এবার স্থির হয়ে বসে। চোখে চোখ রাখে আশফাকের। মুখ থেকে সিগ্রেটের ধোঁয়া পর পর ছাড়তে থাকে, ধোঁয়াগুলো রিংয়ের মত গোলগোল হয়ে আছে যেন। ঘোলাটে হয়ে যায় আশফাকের সারা চোখ-মুখ।
ভয়ংকর রকমের কাঁপা কাঁপা ভারী গলায় লাবনী বলে, 'আমাকে চেনা যাচ্ছে না, আশফাক! তুমি কি লাবনীকে সত্যিই চিনতে পারছ না?'