গাছের অনেক উঁচু ডালে একটা পাখি বসে গান গাইছিল। সকালে গান গাইছিল, সারাদিন গান গাইছিল, বিকালেও গান গাইছিল, সন্ধ্যায়ও গান গাইছিল। তো এক খরগোশ, ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল সন্ধ্যাবেলায়। সে পাখিটাকে বলল, আচ্ছা ভাই, তোকে দেখলাম সকালেও কোনও কাজ না করে বসে আছিস, গান করছিস, এখনও গান করছিস, তোর কোনও কাজ-টাজ নেই? সে বলল, না রে ভাই, আমার কোনও কাজ নেই। কাজ করতে আমার ভালো লাগে না, আমার গান গাইতেই ভালো লাগে। শুনে খরগোশটা বলল, কিন্তু আমাকে যে অনেক কাজ করতে হলো। পাখিটি বলল, 'তুই বোকা, তাই কাজ করছিস।' 'তাহলে আমিও কি তোর মতো কাজ-টাজ না করে বসে থাকব?' 'হ্যাঁ, বসে থাক, কাজ করতে তো তোর বিরক্ত লাগে।' খরগোশ ভাবল বুদ্ধি তো ভালো! তখন খরগোশ ওই গাছটার নিচে বসে গান গাইতে লাগল। কিছু সময় পর সে পথ দিয়ে এক শেয়াল যাচ্ছিল। শেয়াল যখন দেখল, খরগোশটা মনের সুখে গান গাইছে, তখন পেছন থেকে খপ করে ধরে তাকে খেয়ে ফেলল!
এই গল্পের লেসন কী? এই গল্পের লেসন হলো, যখন আপনি অনেক উঁচু কোনও আসনে বসে আছেন, এতটাই উঁচু যে হাত বাড়িয়েও আপনাকে ধরা যায় না, তখন আপনি কোনও কাজ না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সেই উঁচু আসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে কঠোর পরিশ্রম করে সেখানে বসার জন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে।
শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য সাইবেরিয়া থেকে একটা পাখি বাংলাদেশে আসছে উড়ে উড়ে। মানে অতিথি পাখি আর কি! এত ঠান্ডা ছিল যে, পথের মাঝখানে পাখিটা ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে টুপ করে নিচে পড়ে গেল। পাখিটার মৃত্যু মোটামুটি নিশ্চিত, মারা যাবে সে। তীব্র কষ্ট পাচ্ছে, ঠিক ওই সময়ে ওই পথ দিয়ে এক গরু যাচ্ছিল। যখন গরুটা দেখল, একটা বরফখণ্ডের ভেতরে একটা পাখি আটকে আছে, তখন তার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি চাপল। সে ভাবল, এখানে একটু মলত্যাগ করে দেখিই না কেমন লাগে। তখন সে ওখানে মলত্যাগ করল, বরফখণ্ডটার উপরে।
তো গোবরের উষ্ণতায় পাখিটার শরীরের সমস্ত বরফ ঝরে গেল। ঝরে যাওয়ায় পাখিটা প্রাণে রক্ষা পেল। তখন ওই পাখিটা অনেক খুশি হয়ে গরুর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ গান গাইতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর ওই পথ দিয়ে এক বেড়াল হেঁটে যাচ্ছিল, দুষ্ট বেড়াল। বেড়াল যখন দেখল, গোবরের মধ্য থেকে একটা শব্দ আসছে, তখন গোবরটাকে সরিয়ে সে ছোট্ট একটা পাখি পেল। অমনিই পাখিটাকে ধরে খপ করে খেয়ে ফেলল সে।
এই গল্পের লেসন কী কী?
প্রথম লেসন: এই যে গরুটা ওই পাখির উপরে মল নিক্ষেপ করল, গোবর নিক্ষেপ করল, শিট নিক্ষেপ করল, তো ওই গরু কাজটা করেছে দুষ্টুমি করে। কিন্তু এতে পাখিটার প্রাণ বেঁচে গেছে। অর্থাৎ যারা আমাদের উপর নোংরা নিক্ষেপ করে, ময়লা নিক্ষেপ করে, তাদের সবাই আমাদের শত্রু না-ও হতে পারে। Not everyone who drops shit on you is your enemy! এই যে আমরা যে যখন পড়াশোনা করি না, তখন আমাদের স্যারেরা, আমাদের বাবা-মায়েরা, আমাদের কাছের মানুষগুলো বকাঝকা করে; যখন কোনও ভুল করি, তখন বকাঝকা করে; সেসময় তাঁদেরকে শত্রুর মতো মনে হয়। কিন্তু সেই তাঁরা আমাদের শত্রু না-ও হতে পারেন।
সেকেন্ড লেসন: ওই পাখিটাকে শিট থেকে উদ্ধার করেছিল কে? বেড়ালটা। ওই ময়লা থেকে উদ্ধার করার জন্য যে হাতটা বাড়াল, সে কি পাখিটার বন্ধু ছিল? সে তো পাখিটাকে খেয়ে ফেলেছে, হত্যা করেছে। আমরা যখন কোনও একটা বিপদে পড়ি, ঝামেলায় থাকি, তখন বন্ধুবেশে যারা হাত বাড়িয়ে দেয়, তাদের সবাই আমাদের বন্ধু না-ও হতে পারে। Not everyone who gets you out of shit is your friend!
অনেক উপকারের মধ্যেও ক্ষতি লুকিয়ে থাকে, আমরা সময়মতো বুঝতে পারি না। একটা সত্য ঘটনা বলি। আমেরিকায় যখন কৃতদাস প্রথা ছিল, তখন ওখানে এক কৃতদাস ছিল। তার নাম ছিল ফ্রিডম। ফ্রিডম যে মালিকের অধীনে কাজ করত, সে মালিকের একটা পা ছিল না। বোধ হয় ডান পা'টা ছিল না, শুধু বাম পা'টা ছিল। যখন সেই মালিক তাঁর জুতো কিনতেন, তখন উনি শুধু বাম পায়ের জুতোটা রেখে ডান পায়ের যে জুতো, ওটা ফ্রিডমকে দিয়ে দিতেন সবসময়। জুতো পেয়ে ফ্রিডম তো ভীষণ খুশি, ভীষণ খুশি! তার মালিক এত ভালো, এতো ভালো…তাকে জুতো দিচ্ছে, তার তো নিজের জুতো কেনার ক্ষমতা নেই! অনেক খুশি হয়ে মালিকের প্রতি সে কৃতজ্ঞ হয়ে উঠত। এবং ডান পায়ের জুতো কষ্ট করে সে দু-পায়েই পরত।
এভাবে দীর্ঘদিন পরতে পরতে একটা সময়ে তার বাম পা'টা ডান পায়ের মতো করে বেঁকে গেল! স্থায়ীভাবেই বেঁকে গেল এবং ফ্রিডম একসময় পঙ্গু হয়ে গেল! এইজন্যই বলছি, যে ব্যাপারটা আমার কাছে ফেয়ার মনে হচ্ছে, ভালো মনে হচ্ছে, তা ভালো না-ও হতে পারে।
থার্ড লেসনটা আমার জন্য সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট ছিল, আমার সবচেয়ে ভালো লাগে থার্ড লেসনটাই।
এই যে পাখিটা বিপদে ছিল, শিটের মধ্যে ছিল, ময়লার মধ্যে ছিল, তখন যদি সে তার মুখটাকে বন্ধ রাখত, তবে সে কিন্তু মারা পড়ত না। সে দিব্যি বেঁচে থাকত। তাই যখন আমরা কোনও বিপদে আছি, ময়লার মধ্যে আছি, ঝামেলায় আছি, তখন আমাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে: মুখটাকে বন্ধ রাখা। When you are in the shit, keep your mouth shut!
একটা দিন শুধুই আপনার হবে, তবে আজকের এই দিনগুলো আপনার নয়। সেই একদিন আপনার হবেই হবে। যে-দিনটা আপনার হবে, সে-দিন আপনার অবস্থানই আপনার পক্ষে কথা বলবে। তার আগ পর্যন্ত আপনার মুখটাকে বন্ধ রাখুন, একদমই চুপ থেকে কাজ করে যান।
আমি পার্সোনালি কখনও কারও কথার রিপ্লাই দিই না, আগেও দিতাম না, চুপ করে শুনতাম। একদম চুপ করে শুনতাম। অনেকে অনেক কথা বলত, অনেক কথা শোনাত। কথা শোনানো আমাদের সবচেয়ে প্রিয় কাজ! কথা শোনাত, আমি কিছুই বলতাম না। আমার ইচ্ছে করত রীতিমতো মারতে, কিন্তু কিচ্ছু বলতাম না, চুপচাপ সহ্য করতাম। যখন আমি কিছু একটা করতে পারলাম, তখন আমার কাজ ও আমার অবস্থান শুধু কথা শোনায়ইনি, যারা কথা শুনিয়েছে একসময়, তাদের গালে ঠাস ঠাস করে চড় মেরেছে। সবাই চুপ হয়ে গেছে, এখন সবাই চুপ। হ্যাঁ, সেই দিনটার যেন ওয়েট করতে হবে, আর নিরলস পরিশ্রম করে যেতে হবে।
সাঙ্ক-কস্ট সম্পর্কে আমরা অনেকেই তো জানি, বিশেষ করে যারা কমার্সের স্টুডেন্ট। সাঙ্ক-কস্ট হচ্ছে, ডুবে-যাওয়া খরচ। গল্প দিয়েই বলি। ধরুন, আপনি কফিশপে গিয়ে কফি অর্ডার করলেন। প্রিপেইড শপ। এক-শো টাকা পে করলেন, কফি চলে এল। এরপর আপনি কফিটা খেতে যাবেন, ঠিক ওই মুহূর্তে কোত্থেকে জানি একটা পোকা উড়ে এসে পড়ল কফিতে। আপনি দেখছেন, কফির মধ্যে একটা পোকা ভাসছে, পোকাটা ছটফট করছে, পোকাটার শরীর থেকে কী কী যেন বের হচ্ছে! প্রচণ্ড ঘেন্না লাগছে! একসময় পোকাটা ওখানেই মরে গেল।
তখন আপনি চিন্তা করলেন, টাকা তো খরচ করে ফেলেছি। টাকা তো ফেরত পাবো না। কফিটা ফেরত দিলেও তো ওরা টাকা ফেরত দেবে না। কী করব? টাকা তো দিয়েই ফেলেছি। তখন আপনি অনেক ঘেন্না নিয়ে একটা চামচ দিয়ে পোকাটা ফেলে দিলেন, আর কফিটা খেয়ে ফেললেন। অনেক অনেক ঘেন্না সত্ত্বেও খেয়ে ফেললেন টাকাটার সদ্ব্যবহার করার জন্য! এখন, এরপর যা হলো, যেহেতু ঘেন্না নিয়ে খেয়েছেন, সেহেতু আপনার পেট খারাপ হলো। পেট খারাপ হবার কারণে আপনি অফিস কামাই করলেন দুই দিন। ডাক্তার দেখালেন। ডাক্তারের চেম্বারে যাবার জন্য আপনার গাড়িভাড়া লেগেছে, ডাক্তারের ফি লেগেছে, ওষুধ কিনতে হয়েছে, তারও একটা খরচ আছে। আপনি কাজও করতে পারলেন না। Time is money কিন্তু! ওটার একটা কস্ট আছে। হ্যাঁ, অনেকগুলো কস্ট যোগ হলো।
যদি আপনি কফিটা না খেয়ে ফেলে দিতেন, তাহলে আপনার খরচ হতো কত টাকা? এক-শো টাকাই। যেহেতু আপনি সেই এক-শো টাকার মায়া ত্যাগ করতে পারলেন না, তাই আপনার অনেক খরচ কিন্তু যোগ হয়ে গেছে। আমি আপনাকে বলব, আপনার যে দুঃখটা, আপনার যে অপ্রাপ্তিগুলো, আপনি জীবনে যা হারিয়েছেন, যদি সেগুলোকে ওখানে ফেলে রেখে সামনের দিকে এগোতে না পারেন, তাহলে আপনার লাইফে আরও অনেকগুলো ক্ষতি এসে যোগ হবে। আমি তো এভাবে করে বলি, যদি এমন হয়, আমার অতীত যদি আমাকে সামনে এগোতে না দেয়, যদি আমার পা’টা আটকে ধরে রাখে, কোনোভাবেই ছাড়ানো সম্ভব না হয়, তবে সামনে যাবার জন্য আমি প্রয়োজনে আমার পা-টাই কেটে ফেলব, তবুও আমি সামনে যাবই যাব! কোনও অসুবিধে নেই!