৬ এপ্রিল ১৯৩১।
বাংলাদেশের পাবনা জেলায় জন্ম নেওয়া সাধারণ মেয়েটিই যে পরবর্তীতে দুই বাংলা-সহ সারাপৃথিবীতে নিজের অক্ষয় কীর্তি রেখে যাবেন, তা কি আদৌ ভাবতে পেরেছিল কেউ?
বলছিলাম সুচিত্রা সেনের কথা। নামের পাশে ঠিক কয়টা বিশেষণ যোগ করতে পারলে পরে একজন সুচিত্রা সেন হওয়া যায় বলতে পারি না। তবে এটুকু বলতে পারি নিশ্চিতভাবেই, আর দশ জন সাধারণ মানুষের সাথে স্বপ্নদেখায়, চিন্তাভাবনায়, কাজেকর্মে, পরিশ্রমে আর চেষ্টায় বিস্তর ফারাক থাকলেই তবে একজন সুচিত্রা সেন হওয়া যায়। বাংলাদেশের মাটিতে অমন এক অতিমানবী জন্মেছিলেন ভাবলেই যে-কোনও বাঙালির আনন্দে-গর্বে লাফাতে ইচ্ছে করে।
বিভিন্ন চরিত্রে পর্দায় নিজেকে যতটা মেলে ধরেছিলেন, ঠিক ততটাই নিজের ব্যক্তিজীবন আড়াল করে রেখেছিলেন জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত। একজন সুচিত্রা সেনের ক্ষেত্রে এ এক অতি-অসাধারণ রকমের কঠিন কাজ! মৃত্যুর এত বছর পরও তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই আমাদের অজানা রয়ে গেছে। তিনি নিজে যেমন কিছুই জানতে দেননি, একইসাথে, পরিবার, আত্মীয়স্বজন, মেয়ে মুনমুন সবাই-ই তাঁর সেই জানতে না দিতে চাওয়াকে আরও বেশি সহজ করে দিয়েছেন তাঁর ব্যাপারে নিজেরাও মুখে কুলুপ এঁটে রেখে। শত শত ভক্তের চেষ্টায়ও নিজের সম্পর্কে শুধু সেটুকুই জানতে দিয়েছেন, যেটুকু তিনি নিজের সম্পর্কে জানাতে চেয়েছেন, তার বাইরে আর কিছুই জানার সাধ্য কারুরই হয়নি।
একটা সময়ের পর সেই যে মহানায়িকা আড়ালে চলে গেলেন, পাঁচিল তুলে দিলেন সিনেমা আর তাঁর কলাকুশলীদের দূরে সরিয়ে দিয়ে, তার পরে আর কখনও ফিরে এলেন না, ধরা দিলেন না। কেন তিনি নিজেকে আড়ালে রেখেছিলেন, এ বিষয়ে সিনেমাপ্রেমী, সিনেমাবোদ্ধা, ভক্ত কিংবা সমালোচকগোষ্ঠীর নানান যুক্তি আর নানান কথা আজও প্রচলিত আছে। কিন্তু আসল কারণটাকে কখনও কোথাও খোলাসা করেননি সুচিত্রা। সারাবিশ্বে এমন ঘটনা কেবল আর-একজন অভিনেত্রীই ঘটিয়েছিলেন, হলিউডের গ্রেটা গার্বো। সশরীরে গিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করতে হবে বলে সিনেমাজগতের শ্রেষ্ঠ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পর্যন্ত সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সুচিত্রা সেন! তিনি এ পৃথিবীকে দেখিয়ে গেছেন, শান্তি ও কেবল শান্তিই এ জীবনের শেষকথা। লক্ষ লক্ষ মানুষের সাহচর্য এ জীবনে কেবল অশান্তিই ডেকে আনে। পর্বতের চূড়ায় থাকা মানুষ শান্তির খোঁজে একদিন এভাবেই বুঝি মাটির ঘ্রাণ নেবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। নির্জনতায় প্রকৃত মুক্তি, নির্জনতাই প্রকৃত শান্তি।
সুচিত্রার ডাকনাম ছিলো কৃষ্ণা, স্কুলে ভর্তি হবার সময় নাম দেওয়া হয় রমা। ছোটোবেলায় উচ্চারণে দোষ ছিল তাঁর। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় একদিন নানান কথার মাঝে বন্ধুদের বলেছিলেন, “দেখিস, আমি পৃথিবীতে অমর কীর্তি রেখে যাব।” আর তার পরের বাকিটা ইতিহাস। যদিও সেই বয়সে তিনি অমর কীর্তি বলতে কী বুঝেছিলেন আর বুঝিয়েছিলেন, সেটা কারও কাছে স্পষ্ট নয়, তবুও ধরে নেওয়া যায়, হয়তো তাঁর ইনটিউশন থেকেই এমন কথা বেরিয়ে এসেছিল সেদিন। যিনি ভবিষ্যতে অত বড়ো একজন মানুষ হবেন, তাঁর কথার ধরন নিশ্চয়ই আপনার-আমার মতন হবে না, এবং এটাই স্বাভাবিক।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তাঁর বিয়ে হলো দিবানাথ সেনের সঙ্গে। ভালো বউ তাঁর বাউণ্ডুলে ছেলেকে পালটে দেবেন, সেই বিশ্বাসেই দ্রুত ছেলের বিয়ে দেন আদিনাথ সেন। তবে সেটা সম্ভব হয়নি বলে বিয়ের পর ছেলেকে শিক্ষা দিতে ছেলেবউকে নিজের কাছে রেখে ছেলেকে ত্যাজ্য করার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত তিনি নিয়েছিলেন।
ভাগ্যের পরিহাসে দিবানাথ যখন কোনও ব্যাবসাতেই সফল হতে পারলেন না, তখন সংসারের হাল ধরতে সুচিত্রাকেই এগিয়ে আসতে হয়। তিনি কখনোই অভিনেত্রী হতে চাননি, অথচ নিয়তির কী খেলা! পার্ক স্ট্রিটের এক অডিয়ো স্টুডিয়োতে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল নেপথ্য গায়িকার অডিশন দিতে। এরপর বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায়ের (উনি ছিলেন সুচিত্রার শ্বশুরবাড়ি পক্ষের আত্মীয়) কাছ থেকে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দেন তিনি। কিন্তু স্বামী আর শ্বশুরমশাই দু-জনেরই মত থাকায় একসময় আর সাত-পাঁচ না ভেবেই অভিনয় শুরু করে দেন তিনি। গ্রেটনেসের দিকে যাত্রাটা এভাবেই শুরু হয়, হঠাৎ!
সুচিত্রার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর সময়কালটা ভালো ছিল না। সিনেমা সে সময় সর্বসাধারণের পেশা ছিল না। সিনেমায় নামার মানেই তখন ছিল ভদ্রতার স্তর থেকে নেমে যাওয়া। রমা সেন থেকে নিজেকে সুচিত্রা সেন তৈরি করার এই জার্নিটা সহজ কোনও জার্নি ছিল না। “চেহারা ভালো হলেই নায়িকা হওয়া যাবে।” ব্যাপারটা ওরকম ছিল না মোটেই। সেজন্য বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ‘বড়োঘরের বউ’ সুচিত্রা সিনেমায় অভিনয়ের পর থেকেই পরিচিত হতে থাকেন ‘মিসেস সেন’ নামে।
সুচিত্রা সেনকে কে আবিষ্কার করেন? এই প্রশ্নের উত্তরে স্বয়ং সুচিত্রাই নাকি একবার জানিয়েছিলেন, “সিনেমার সন্ধান পেয়েছিলাম বিমল রায়ের কাছে, আর উৎসাহিত করেছিলেন দিবানাথ সেন। সুতরাং দু-জনের মধ্যে কেউ একজন হবেন!”
বলা হয়, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ছবিতে বিষ্ণুপ্রিয়াকে দেখার জন্য নাকি দর্শক চটিজুতো খুলে সিনেমাহলে ঢুকত! এর পর থেকেই শুরু হয় এক সাধারণ গৃহবধূর ‘তারকা’ হয়ে ওঠার আশ্চর্য কাহিনি। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর ‘রমলা’ হয়ে ‘সপ্তপদী’র ‘রিনা ব্রাউন’ পর্যন্ত পৌঁছোতে সুচিত্রার সাধনা ছিল ন-বছরের। বরাবরই মেইল-ডমিনেটেড সিনেমাজগতে একজন নারী যে নায়িকা হবার পর নিজেকে আরও অপ্রতিরোধ্য করে গড়ে নিয়ে ‘স্টার’ হতে পারেন, নায়কের বাইরেও যে আলাদা করে নিজের সত্তা তৈরি করতে পারেন, সেটা প্রথম প্রমাণ করেছিলেন সুচিত্রা সেন। তাঁর সময়ে তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম ফেমিনিস্ট নায়িকা। বাংলা সিনেমা এরকম ‘মিসেস সেন’ বলে আর কোনও নায়িকাকেই সম্মান জানায়নি কখনও।
সুচিত্রার দাম্পত্যজীবনে একসময় ঝড় উঠতে শুরু করে। শোনা যেত, সে সময়ে তাঁর স্বামী মদ্যপ হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতেন, আর স্ত্রীকে নিয়ে নানান আজেবাজে কথা বলে বেড়াতেন। বিবাহবিচ্ছেদ না ঘটলেও দু-জন একটা সময়ের পরে আলাদা থাকতে শুরু করেছিলেন। তবে আমেরিকায় স্বামীর মৃত্যু হবার পর তিনিই মরদেহ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করান এবং মুখাগ্নিও তিনিই করেন। বড়ো মানুষেরা কখনও অতীত ভোলেন না।
সিঙ্গেল মাদার হিসেবে মুনমুনকে তিনি বড়ো করে তুলেছিলেন। শ্যুটিংয়ের প্রয়োজনের বাইরে তাঁর সারাটা সময় বরাদ্দ থাকত মেয়ের জন্য। স্বামীর সাথে যে সময়ে অশান্তি চলছিল, সে সময়ে মেয়েকে সুরক্ষিত রাখতে দার্জিলিংয়ের এক বোর্ডিংস্কুলে পাঠিয়েছিলেন তিনি।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদা দেবীর প্রতি ভক্তি তাঁর জীবনে এক অনন্য অর্থ এনে দিয়েছিল। স্বামী অভয়ানন্দ (ভরত মহারাজ) তাঁকে সব ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। শোনা যায়, সেই আধ্যাত্মিক অমৃতের সন্ধান পাবার জন্যই তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়েছিলেন। যুগে যুগে এভাবেই খ্যাতির শীর্ষে থাকা বহু মহামানব শান্তির খোঁজে সব ছেড়েছুড়ে নিতান্তই সাধারণ মানুষের জীবন বেছে নিয়ে নিভৃতচারী হয়েছেন।
সুচিত্রা কখনও নিজের আত্মজীবনী লিখতে চাননি। তাঁর কোনও কথা অন্য কোনও মাধ্যমেও যেন কেউ জানতে না পারে, এমনই বিধান তিনি দিয়েছিলেন।
দাম্পত্যকলহ নিয়ে সুচিত্রা তেমন কোনও কথাই কাউকে বলতেন না। শুধু কানন দেবীর (ভারতের আরেক বিখ্যাত নায়িকা) সাথেই এসব নিয়ে কথা বলতেন তিনি। এখানেও তিনি অনন্য, অসাধারণ। নিজে দারুণ এক অভিনেত্রী-জীবন পার করলেও মেয়ে মুনমুনকে সিনেমায় দেখতে চাননি কখনও। মুনমুন নিজের ইচ্ছেতে সিনেমায় নামার পর সুচিত্রা এক বছর মেয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছিলেন।
স্বামীর অনুপ্রেরণায় সিনেমায় এলেও এই সিনেমাই তাঁকে স্বামী-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। শুরুতে সংসারের খরচ জোগাতে সিনেমার পথে হেঁটেছিলেন সুচিত্রা, সকলের অজান্তে যে আগুনের মধ্য দিয়ে হেঁটে এসে রমা থেকে সুচিত্রা হয়েছিলেন তিনি, সে রাস্তার খবর কাউকে জানতে দেননি সচেতনভাবেই। নিজে যেমন প্রয়োজনের বেশি কথা বলতেন না কখনও, তেমনি তাঁর সামনেও বাড়তি কথা বলার সাহস কেউ পেত না, এমনই ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী ছিলেন সুচিত্রা। আবার সেই একই মানুষ যখন বাকি চার বোন আর দুই ভাইয়ের সাথে একত্র হতেন, তখন ছুটত হাসির ফোয়ারা, যেন তিনি আবারও হয়ে যেতেন ছেলেবেলার সেই ‘কৃষ্ণা’। সবার কাছে সশরীরে ধরা দেননি বলেই অনেক উটকো ঝামেলা থেকে বেঁচে গেছেন তিনি। বাঙালি এমনই এক জাত, বুকে টানলেই সুযোগ বুঝে ছুরি বসিয়ে দেয়। একজন সুচিত্রাকে দেখতে হবে পর্দায়, দূর থেকে; অমন মানুষের কাছে ঘেঁষতে চাওয়াটা নেহায়েতই মানসিক অপরিপক্বতা।
সবকিছু ছেড়ে কেন চলে গেলেন আড়ালে, বড়ো বোনের এমন প্রশ্নের উত্তরে মিসেস সেন বলেছিলেন, “আমার আর কিছুই পাবার নেই।” পাওয়া ফুরোলো কবে, এইটুক বুঝতে পারে না বলেই বেশিরভাগ মানুষ আমৃত্যু পাগলের মতো সুখের খোঁজে ছোটে। ফুরিয়ে যাবার আগেই থেমে যেতে হয়।
উত্তম-সুচিত্রার জুটিকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ম্যাজিকাল জুটি হিসেবেই ধরা হয়। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’ গানের দৃশ্যে দু-জনের রসায়ন বাঙালির মনে বিশুদ্ধ প্রেমের যে ঝড় তুলেছিল, তা আর অন্য কোনও জুটি কোনোকালে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। সে সময়কার বসুশ্রী সিনেমা হলের মালিক মন্টু বসুর কথায়, “একজন দিনে দু-তিনবার করে একই সিনেমা দেখেছেন, বছর ৫০ আগেই আমি এই দৃশ্য দেখেছি। আরে বাবা, অগ্রিম টিকিট কাটার চল শুরু হলো তো উত্তম-সুচিত্রা জুটির হাত ধরেই!” সময় এখন অনেক আধুনিক হয়েছে, অথচ আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি সেই সময়ের চেয়ে।
উত্তম নিজে স্বীকার করেছিলেন, সুচিত্রা সেন না থাকলে উত্তমকুমারের জন্মই হতো না।
ফিল্ম ক্যারিয়ারে উত্তমের সময় যখন খুব খারাপ যাচ্ছিল, একের পর এক সিনেমা ফ্লপ করছিল, তখন এক সাংবাদিক উত্তমকে জিজ্ঞেস করে বসেন, “প্রযোজকরা তো একসময় আপনাকে ফ্লপমাস্টার জেনারেল বলতেন! আপনি কেন প্রতিবাদ করেননি? এতে তো আপনার ক্যারিয়ারের বারোটা বেজে যাচ্ছিল!” সাথে সাথে উত্তম অকপটে জবাব দেন, “তা-ই তো যাচ্ছিল! রমা এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিল। তার আগে তো অন্য কোনও নায়িকার সঙ্গে প্রেমের ডায়লগ বলতে গিয়ে মনের মধ্যে কোনও উত্তাপই বোধ করতাম না! ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে সুচিত্রা সেন নামের এক নায়িকার সাথে অভিনয় করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার নায়িকা এসে গিয়েছে!” আর সেজন্যই একটা সময় পরে উত্তমকুমার স্বয়ং মেনে নিয়েছিলেন, তাঁদের জুটির নাম উত্তম-সুচিত্রা নয়, বরং সুচিত্রা-উত্তম! ওই উত্তাপটাই আসল। মানুষকে দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষা করে থাকতে হয় ওইটুকু উত্তাপের জন্য। যার জীবনে ওটা আসে না, তার জীবনে কিছুই আসে না। হায়, এ পৃথিবীর প্রায় মানুষই উত্তাপহীন এক আয়ু ফুরোবার পর মৃত্যুবরণ করে!
উত্তমকুমার মারা যাবার বেশ কিছুদিন পরে, তরুণকুমার সুচিত্রা সেনকে নিয়ে একটা সিনেমার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই ছবির প্রস্তাব নিয়ে যাবার পর সব শুনে সুচিত্রা বলেছিলেন, “বুড়ো, উতু(উত্তম) যেখানে চলে গিয়েছে, সেখান থেকে কি ওকে ফিরিয়ে আনতে পারবি? যদি পারিস, সেভাবেই চিত্রনাট্য কর। আমি কাজ করব।“ এমন মধুর রসায়ন সারাজীবন পাশাপাশি থাকবার পরও ক-জন নর-নারীর মধ্যে গড়ে ওঠে?!
একজন বিবাহিত সুন্দরী নারীকে রহস্যময় আচরণ করতে দেখলে, অন্য দশটা বিবাহিত নারীর মতন ছাপোষা জীবনযাপন না করে আলাদা কিছু করতে দেখলে তো এমনিই তাকে সমাজ ভালোচোখে দেখে না, যা মন চায় একটা জুড়ে দেয় নামের সাথে; আর তিনি যদি হন সুচিত্রা সেন, এক রক্ষণশীল, সম্ভ্রান্ত পরিবারের পুত্রবধূ, যিনি কিনা বিয়ের পরে ক্যারিয়ার শুরু করে রমা থেকে নিজেকে সুচিত্রা উচ্চতায় এনে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন হাজারো মানুষকে, তাঁকে নিয়ে হাজারো গুঞ্জণ আর সমালোচনা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। সমালোচনার নামে ব্যক্তিআক্রমণ এ যুগের মতন সে যুগেও তো কিছু কম ছিল না। বাঙালির রক্তে এই উত্তরাধিকার প্রোথিত। পরের পেছনে লেগে থাকাই যেন আমাদের ভাবনার দুর্বলতম লিগ্যাসি! নিজে এগোতে চাইলে তো শক্তি লাগে, সেই শক্তি গড়পড়তা বাঙালির কোথায়!
সুদীর্ঘ তারকাজীবন, সিনেমার ঝলমলে পর্দা, তকতকে সুন্দর চেহারার ওই সুচিত্রাকে সুচিত্রা হবার আগে অকল্পনীয় ব্যথা সইতে হয়েছে। এই সুচিত্রাকেই ছেলেবেলায় ভাই-বোনদের হাসিঠাট্টার পাত্রী হতে হতো উচ্চারণে সমস্যা থাকার কারণে। অভিনয় দিয়ে অবাক করে দেওয়া এই সুচিত্রাই কিন্তু একসময় অভিনয়ে নামতে চাননি। হাতে ডেট না থাকায় সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী চৌধুরাণী’তে কাজের অফারকে না বলে দেওয়া এই মিসেস সেনই সিনেমায় স্ট্রাগলের দিনগুলোতে মেকআপ রুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা বসে থেকেছেন, কেউ তাঁর খোঁজ পর্যন্ত নিতে যায়নি তখন। প্রতিটি বড়ো মানুষকেই একসময় অপাঙ্ক্তেয় হয়ে দিন কাটাতে হয়।
সাক্ষাৎকারে মুনমুন সেনের বলা একটা অবাক-করা তথ্য দিয়ে লেখা শেষ করব। সুচিত্রা সেন বহুবছর পর্দা থেকে দূরে থাকার ফলে তাঁর জনপ্রিয়তায় কতটা ভাটা পড়েছে, এমন একটা প্রশ্নের উত্তরে মুনমুন বলেন, “মায়ের এক ভক্ত মা কলকাতার যে বাড়িটায় থাকতেন, সেই দেয়ালঘেরা বাড়ির পাঁচিলের ওপার থেকে খুব কষ্টে একটা গাছের পাতা ছুঁয়ে বলেছিলেন, আমি এখন দেশে গিয়ে সবাইকে বলতে পারব, সুচিত্রা সেন যে বাড়িতে থাকেন, আমি সে বাড়ির গাছ থেকে একটা পাতা ছুঁয়ে এসেছি!” চোখ বন্ধ করে এক বার ভাবুন এই কথাটি! বিস্ময়ে আর সম্ভ্রমে মনে হবে, তীব্র শিহরনে এখুনিই যেন কাঁপুনি দিয়ে অশ্রুর ফোয়ারা বইবে! হ্যাঁ, অমনই এক উচ্চতার বাঙালি তিনি!