অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৪৪



এই ধারণা অদ্বৈতের মূল আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত: ব্রহ্ম থেকে পৃথক কিছু নেই। জগৎ যদি ব্রহ্ম ব্যতীত অন্য উপাদান বা নির্মাতা দ্বারা গঠিত হতো, তবে দ্বৈততা অনিবার্য হতো; কিন্তু “একমেবাদ্বিতীয়ম্‌” (ছান্দোগ্য ৬.২.১)—সেই একটিই পরম সত্তা, যা নিজেরই অন্তর্লীলায় নানারূপে উদ্‌ভাসিত হয়।

এভাবে অভিন্ন-নিমিত্ত-উপাদান-কারণবাদ আমাদের বোঝায়—সৃষ্টি কোনো বাহ্য ঘটনা নয়, বরং আত্মস্বরূপ ব্রহ্মের অন্তর্গত প্রকাশ। যেমন তরঙ্গ, ফেনা, আর জোয়ার—সবই জলের নিজেরই খেলা; সমুদ্র নিজে কখনও অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হয় না। তেমনি এই জগৎও ব্রহ্মচৈতন্যেরই স্ব-প্রকাশ—তাকে সত্যভাবে উপলব্ধি করলেই সব কিছু জানা হয়ে যায়।

এই তত্ত্ব শেষপর্যন্ত “অদ্বয় ব্রহ্ম”-এর দিকে নিয়ে যায়—যেখানে কারণ, কার্য, সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি—সব মিলিয়ে একমাত্র পরম চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মই স্থিত। “নেহ নানাস্তি কিঞ্চন” (বৃহদারণ্যক ৪.৪.১৯)—এই এক বাক্যেই তার পরিণাম নিহিত: যা-কিছু দেখা যায়, সবই সেই এক ব্রহ্মের নামরূপভেদমাত্র।

এই ধারাগুলির ভিন্নতা মূলত প্রকাশের দৃষ্টিকোণেই। ভামতী বলে, জ্ঞান ঘটে মনের বৃত্তির মাধ্যমে; বিবরণ মনে করে, চৈতন্য নিজেই স্বপ্রকাশমান; দৃষ্টি-সৃষ্টি মত অনুযায়ী, দেখা-মাত্রই সৃষ্টি ঘটে; বিবর্তবাদে জগৎ ব্রহ্মের অভাসমূলক বহুরূপ প্রকাশ; আর অভিন্ন-নিমিত্ত-উপাদান-কারণবাদে ব্রহ্মই একমাত্র কারণ—নিমিত্ত ও উপাদান উভয়। কিন্তু তাদের মূল সিদ্ধান্ত এক ও অভিন্ন—চৈতন্যই পরম সত্য, জগৎ তারই প্রতিফলন।

রজ্জু-সাপের দৃষ্টান্তে এই পার্থক্য স্পষ্ট হয়। ভামতী বলবে, মনের ভ্রম-বৃত্তি না হলে ‘সাপ’ দেখা যায় না; বিবরণ বলবে, সেই ভ্রম আলোকিত করছে স্বপ্রকাশ চৈতন্য; দৃষ্টি-সৃষ্টি বলবে, দৃষ্টির সঙ্গেই ‘সাপ’-বিশ্বের সৃষ্টি; বিবর্তবাদ বলবে, দড়ির রূপই আপাতভাবে ‘সাপ’ হয়ে উঠেছে; আর অভিন্ন-নিমিত্ত-উপাদান-কারণবাদ দেখাবে, দড়ি ও সাপ উভয়ই একই চৈতন্য-ব্রহ্মের অভিন্ন অভাস।

সব মিলিয়ে এদের পার্থক্য কেবল প্রকাশের ভাষা ও ব্যাখ্যার ভিন্নতা; তত্ত্বত তারা এক—চৈতন্যই পরমার্থসত্তা, আর জগৎ তারই প্রতিফলন, প্রতিভাস বা অভাসমাত্র। মুক্তি মানে নতুন কিছু লাভ নয়, বরং এই প্রতিফলনের মধ্যেই নিজের স্বয়ং-দীপ্ত ব্রহ্ম-স্বরূপকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করা। সেই উপলব্ধিতেই শেষপর্যন্ত সব সৃষ্টি, সব জ্ঞান মিলিয়ে যায় এক চৈতন্যের অচল ও অনন্ত আলোয়।

অদ্বৈত বেদান্তে “মায়া ও প্রতিভাস-সংলগ্ন” ব্যাখ্যাধারাগুলি মূলত চৈতন্যের সঙ্গে জগতের সম্পর্ককে—দেখা, প্রতিফলন, আভা, স্বপ্ন ও অনির্বচনীয়তা—এই কয়েকটি কৌশলে বিশ্লেষণ করে।

৭। প্রতিভাসবাদ (Pratibhāsa-vāda) অদ্বৈত বেদান্তের এক সূক্ষ্ম তত্ত্ব, যা বলে—জগৎ চৈতন্যে প্রতিভাসমাত্র, অর্থাৎ আত্মচৈতন্যে প্রতিফলিত এক আয়নার মতো ছায়া। এটি কার্যকর, অনুভবযোগ্য, অভিজ্ঞতায় বাস্তব বলে মনে হয়, কিন্তু পরমার্থে কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। যেমন আয়নায় মুখের প্রতিফলন স্পষ্ট দেখা যায়, নড়াচড়া করে, হাসে; তবু জানি—আয়নার বাইরে কোনো দ্বিতীয় মুখ নেই; ঠিক তেমনি জগৎ চৈতন্যে প্রতিফলিত, কিন্তু ব্রহ্ম ব্যতীত তার নিজস্ব সত্তা নেই।

এই তত্ত্বের মূল ভিত্তি শঙ্করাচার্যের “ত্রিস্তর সত্যতত্ত্ব” বা তিনস্তরীয় বাস্তবতার ধারণা। শঙ্করাচার্য সৃষ্টিকে তিনটি স্তরে ভাগ করে দেখিয়েছেন—প্রাতিভাসিক, ব্যাবহারিক এবং পারমার্থিক।

প্রাতিভাসিক স্তর হলো প্রতিভাসমাত্র বা ভ্রমমূলক সত্য—যেমন স্বপ্নে-দেখা শহর বা মরুভূমিতে দেখা মরীচিকার জল। সেই মুহূর্তে এগুলি সত্য বলে মনে হয়, কিন্তু জাগরণ বা স্পর্শের পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এই ধরনের সত্যকে শঙ্কর “সবলেশ-নিরাস”—অর্থাৎ পরে যা অবলুপ্ত হয়—এই মানদণ্ডে ব্যাখ্যা করেছেন।

সবলেশ-নিরাস (Sāvaśeṣa-nirāsa) হলো অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে ব্যবহৃত একটি পারিভাষিক শব্দ, যা মোক্ষ বা মুক্তির চূড়ান্ত প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এটি হচ্ছে জীবন্মুক্ত পুরুষের মৃত্যুর পর তাঁর কারণ শরীরের সমস্ত অবশেষ (বাসনা, অবিদ্যা ও কর্মের ছাপ) সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যাওয়া এবং ব্রহ্মের সঙ্গে চিরতরে একীভূত হওয়া।

ব্যাবহারিক স্তর হলো ব্যবহারোপযোগী বা বাস্তব জীবনের সত্য—যা আপাতভাবে টিকে থাকে এবং সাধারণ অভিজ্ঞতায় কার্যকর, যেমন আমরা জল পান করি, আগুনে দগ্ধ হই বা পৃথিবীকে দৃঢ় বলে অনুভব করি। এই স্তর সামাজিক ও ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতার জন্য সত্য, কিন্তু পরমার্থে নয়।

পারমার্থিক স্তর একমাত্র চিরসত্য, যা কখনও পরিবর্তিত হয় না—এটি ব্রহ্মচৈতন্যের স্তর। এই স্তরে আর কোনো ভেদ, পরিবর্তন বা মিথ্যাভাব নেই; এখানে শুধুই চৈতন্য বা ব্রহ্মের অচল উপস্থিতি।

শঙ্করাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (২.১.১৪)-এ “মৃৎ-ঘট” দৃষ্টান্তে বলেন—যেমন মাটির ঘট (পাত্র) তৈরি হলেও আসলে সবই মাটি, তেমনি জগত নানা রূপে প্রকাশ পেলেও ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। আবার বৃহদারণ্যক উপনিষদ ভাষ্য (২.১.২০)-এ তিনি দেখান, নিম্নতর অভিজ্ঞতায় যা সত্য বলে প্রতীয়মান, উচ্চতর অভিজ্ঞতায় তা মিথ্যা হয়ে যায়—যেমন স্বপ্নের নগর জাগরণে মিলিয়ে যায় বা মরীচিকার জল হাত দিয়ে ধরতে গেলে অদৃশ্য হয়।

এই ত্রিস্তর সত্যতত্ত্বের মাধ্যমে শঙ্করাচার্য বোঝান যে, জগৎ আপাতভাবে সত্য হলেও, শেষপর্যন্ত তা ব্রহ্মের অভাসমাত্র; শুধুমাত্র পারমার্থিক স্তরেই নিখাদ সত্য অবশিষ্ট থাকে—সেই সত্যই চৈতন্য-ব্রহ্ম।

অদ্বৈত ব্যাখ্যায়, প্রতিভাসবাদ এই প্রাতিভাসিক স্তরটিকেই সত্তাতাত্ত্বিক মূল হিসেবে চিহ্নিত করে। জগৎ এখানে বাস্তব নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ মিথ্যাও নয়—এটি “প্রতিভাস”, অর্থাৎ চেতনার স্বপ্রকাশে উদিত এক ছায়া-রূপ, যা অভিজ্ঞতার মধ্যে সত্য হলেও পরম চেতনার দৃষ্টিতে অবাস্তব। শঙ্কর বলেন—“অদ্বিতীয়ব্রহ্মপ্রতিবিম্বিতবুদ্ধিনির্মিতং বিশ্বমিদং প্রতিভাসতে”—"এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মের প্রতিবিম্বিত বুদ্ধি (চিদাভাস বা জীবাত্মা) দ্বারা নির্মিত এই জগৎ প্রকাশিত বা প্রতীয়মান হয়।" অর্থাৎ, জগৎ হলো সেই এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মের প্রতিবিম্বিত চৈতন্যে প্রতিভাসিত ধারণা।

এই প্রতিভাস তত্ত্বটি বোঝাতে শাস্ত্রগুলি দড়ি-সাপ (rajju-sarpa) ও শুক্তি-রূপা (śukti-rūpya) দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেছে। যেমন অন্ধকারে দড়িকে সাপ বলে ভ্রম হয়—সাপ দেখা যায়, ভয়ও হয়, প্রতিক্রিয়াও বাস্তব, কিন্তু পরে আলো জ্বেলে দেখা যায়, দড়ি ছাড়া কিছু নেই। তেমনি, জগৎও চেতনার অজ্ঞাত অবস্থা বা মায়ার আলোছায়ায় প্রতীয়মান, পরম চেতনা উদ্‌ভাসিত হলে সেই বিভ্রম লুপ্ত হয়।

এইভাবেই প্রতিভাসবাদ দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদের চেয়েও সূক্ষ্ম। দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ বলে—দেখা মানেই সৃষ্টি; জগৎ চেতনার দর্শন-প্রক্রিয়ার সঙ্গেই গঠিত। কিন্তু প্রতিভাসবাদ আরও এক ধাপ গভীরে গিয়ে বলে—দর্শনও মিথ্যা-অভাসমাত্র; দেখা, দেখা-হওয়া এবং দেখা-বস্তু—এই তিনই চৈতন্যে প্রতিফলিত অভাস। কোনো বাহ্য বাস্তবতা বা স্বতন্ত্র দর্শন-প্রক্রিয়া নেই; সবই চেতনার প্রতিচ্ছায়া।

এই ধারণাটি অদ্বৈত-সিদ্ধি ও চিদ্‌ভাসবাদ-এর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। চিৎসুখাচার্য, মাধবাচার্য (বিদ্যারণ্য) ও পরবর্তীকালে সচ্চিদানন্দ যতি প্রমুখ এই তত্ত্বকে সুসংহতভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁদের মতে, জগৎ এক চিদাভাস—চৈতন্যের প্রতিফলন। প্রতিফলন যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ জগতের অভিজ্ঞতা আছে; যখন মায়ার প্রতিবিম্ব লুপ্ত, তখন থেকে যায় কেবল স্বপ্রকাশ চৈতন্য, যা অপরিবর্তনীয়।

এই ভাবটি গৌড়পাদীয় মাণ্ডূক্য কারিকা (৩.৩১)-য়ও প্রতিধ্বনিত—“অজং সর্বগতং বীজং জ্ঞানং কিঞ্চিদপি নাস্তি হি”—যা-কিছু প্রতীয়মান, তা চেতনার মধ্যেই প্রতিভাস; কারণ ব্রহ্ম কখনও জন্মায় না, পরিবর্তিত হয় না, তবু বহুরূপে প্রকাশিত বলে মনে হয়।

পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে আত্মগত ভাববাদ বা ব্যক্তিগত ভাববাদ (Subjective Idealism) ধারণাটি ভারতীয় প্রতিভাসবাদ-এর সঙ্গে গভীর সাদৃশ্য বহন করে। এই মতবাদের মূল কথা—“সত্তা মানে অনুভূত হওয়া” (Esse est percipi–To be is to be perceived)। অর্থাৎ, জগতের কোনো স্বাধীন বা বস্তুনিষ্ঠ বাস্তব অস্তিত্ব নেই; যা-কিছু আমরা “বস্তু” বা “বিশ্ব” বলে জানি, তা আসলে দ্রষ্টা বা জ্ঞাতার চেতনার মধ্যেই বিদ্যমান। জগৎ আমাদের মনের এক অভিজ্ঞতামূলক রূপ—চেতনা ব্যতীত তার কোনো অস্তিত্ব নেই।

এই দর্শনের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন আঠারো শতকের আইরিশ দার্শনিক জর্জ বার্কলি (George Berkeley)। তাঁর মতে, “আমাদের মন ছাড়া কিছুই বিদ্যমান নয়”; দেখা বা অনুভব করার ক্রিয়াতেই কোনো কিছুর অস্তিত্ব নির্ভর করে।

এই ভাবনারই ভারতীয় প্রতিধ্বনি হলো প্রতিভাসবাদ (Pratibhāsavāda), যেখানে বলা হয়েছে—দৃষ্টি, সৃষ্টি ও জগৎ—সবই চেতনার আয়নায় প্রতিফলনমাত্র। চেতনার বাইরে কোনো পৃথক বাস্তব জগৎ নেই; যা-কিছু দেখা যায়, অনুভূত হয় বা ভাবা যায়, তার সবই চৈতন্যের নিজের অভাস বা প্রতিফলন।

যেমন স্বপ্নে আমরা শহর, নদী, মানুষ দেখি—সবই বাস্তব বলে মনে হয়, কিন্তু জেগে উঠতেই তা মিলিয়ে যায়; তেমনি জাগতিক জগতও চৈতন্যের প্রতিফলিত অভিজ্ঞতা, যা পরম জ্ঞানে উদিত হলে মায়ার মতো বিলীন হয়ে যায়।

আধুনিক গবেষণাতেও এই মিল স্পষ্টভাবে দেখা যায়। উইকিপিডিয়া-র “প্রতিভাসবাদ (Advaita Vedānta)” নিবন্ধে এবং জেএসটিওআর (JSTOR)-এর প্রবন্ধসমূহে—যেমন “The Doctrine of Appearance in Post-Śaṅkara Advaita”—বর্ণনা করা হয়েছে যে, প্রতিভাসবাদ আসলে দৃষ্টি-সৃষ্টি তত্ত্বেরই এক পরিণত রূপ, যেখানে “দেখা” ও “যা দেখা হচ্ছে”—উভয়েরই অস্তিত্ব চেতনার অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ, অস্তিত্ব মানেই অনুভূত হওয়া—চৈতন্যই একমাত্র সত্য, আর জগৎ সেই চৈতন্যেরই প্রতিফলিত প্রতিভাস।

প্রতিভাসবাদ সেই অদ্বৈত উপলব্ধির এক অন্তিম দার্শনিক রূপ—যেখানে জগৎ আর চেতনা পৃথক নয়; বরং সব প্রতীয়মানতা চেতনারই প্রতিফলিত মুখ, আর ব্রহ্ম সেই এক অনাবৃত, স্বপ্রকাশ আয়না—যার বাইরে কিছুই কখনও ছিল না, নেই, থাকবে না।

৮। আভাসবাদ বা প্রকাশতত্ত্ব শঙ্করোত্তর অদ্বৈত বেদান্ত ও কাশ্মীর শৈব দর্শনের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন-ভাবনা। সহজভাবে বলতে গেলে, এটি বলে—জগৎ মায়া বা ভ্রম নয়, বরং চৈতন্যেরই এক আভাস বা উদ্‌ভাস। অর্থাৎ, ব্রহ্মচৈতন্য নিজের দীপ্তিতে নিজেকেই নানা রূপে প্রকাশ করে, কিন্তু কখনও নিজের স্বরূপ থেকে আলাদা হয় না।

এই তত্ত্বে চৈতন্যকে কোনো নিষ্ক্রিয় প্রতিবিম্ব হিসেবে দেখা হয় না, যেমন প্রতিভাসবাদে বলা হয়েছিল; বরং এখানে চৈতন্যকে সক্রিয়, সৃষ্টিশীল ও আলোকদায়ী শক্তি হিসেবে বোঝানো হয়েছে। চৈতন্য যেন এক দীপ্ত সূর্য—তার আলোতেই সব কিছু দৃশ্যমান হয়, কিন্তু সেই সূর্য নিজে অপরিবর্তিত থাকে। জগৎ তাই আলাদা কোনো সত্তা নয়, বরং সেই আলোরই নানা প্রতিফলন।

এই ভাবনার ভিত্তি বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৩.৯)-এর একটি বিখ্যাত মন্ত্র—“ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকম্‌… তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং”—অর্থাৎ সেখানে সূর্য, চন্দ্র, তারা বা অগ্নি কিছুই জ্বলে না; কেবল চৈতন্যই নিজে জ্বলে, আর তার দীপ্তিতেই সব কিছু আলোকিত হয়ে ওঠে। এখানেই “আভাস” শব্দের গভীর অর্থ—চেতনা নিজের আলোকেই জগৎকে উদ্‌ভাসিত করে; জগৎ নিজে কোনো স্বতন্ত্র আলোক নয়, বরং সেই এক আলোর প্রতিচ্ছটা।

শঙ্করাচার্যের “বিবর্তবাদ”-এ যেমন জগৎকে ব্রহ্মের মায়াজাত অভাস বলা হয়—যেখানে মায়া মূলত এক বিভ্রম বা অবিদ্যা—আভাসবাদ সেই ধারণাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে। এখানে মায়া বিভ্রম নয়, বরং প্রকাশশক্তি (Prakāśa-śakti)—যা চৈতন্যকে নানা রূপে, নানা স্তরে প্রকাশিত করে। যেমন সূর্য নিজের কিরণ দ্বারা চারদিকে আলো ছড়ায়, অথচ সূর্য কখনও তার কিরণ থেকে আলাদা নয়, তেমনি ব্রহ্মচৈতন্যও নিজের আভাসরূপে নাম-রূপের জগৎ হিসেবে প্রকাশিত হয়, কিন্তু কখনও নিজের স্বরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না।

এই ধারণা বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছে কাশ্মীর শৈব প্রত্যভিজ্ঞা দর্শনে। উৎপলদেব তাঁর ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা গ্রন্থে বলেন—“চিদ্‌ অহং স্বপ্রকাশোহস্মি”—অর্থাৎ “আমি সেই চৈতন্য, যা নিজের আলোতেই উদ্‌ভাসিত।” তাঁর মতে, চেতনা কোনো বস্তু নয়, যা দেখা যায়, বরং সেই আলোক, যার মধ্য দিয়েই দেখা সম্ভব।