শৈব কালী: এক-শো এগারো



এই দখল ভাঙার মধ্যেই মন উন্মুক্ত হয়; যেমন ভরা ঘরে নতুন আলো ঢোকে না, খালি জানালা খুলে দিলে বাতাস-আলো নিজে থেকেই আসে। এ উন্মুক্ততাই শূন্যতার প্রাণ—দখলহীন, পক্ষপাতহীন, ধারণাহীন এক মুক্ত পরিসর। কিন্তু এই মুক্ত পরিসর কেবল “শূন্য ঘর” হয়ে থাকে না; এখানেই দেখা দেয় চেতনার প্রাকৃতিক দীপ্তি—প্রভাস্বরতা।

মুক্তি বা পরম সত্য হলো এমন এক অবস্থা, যেখানে জগৎকে যখন তার মিথ্যা আত্ম-সার থেকে মুক্ত বলে উপলব্ধি করা হয় (শূন্যতা = দখলহীনতা), তখন চেতনার সেই স্থানটি কেবল ফাঁকা থাকে না, বরং তা তার নিজস্ব, উজ্জ্বল, শুদ্ধ জ্ঞান দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে (পূর্ণতা = প্রভাস্বরতা)। অর্থাৎ, শূন্যতা হলো কী নেই (ভ্রম নেই), আর প্রভাস্বরতা হলো কী আছে (বিশুদ্ধ, উজ্জ্বল জ্ঞান আছে)। এই দুটি হলো একই চূড়ান্ত সত্যের দুটি দিক—বৌদ্ধধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য এই শূন্যতা ও করুণার ঐক্যে (Union of Emptiness and Compassion) প্রতিষ্ঠিত হওয়া।

প্রভাস্বরতা (প্রভা (Prabhā): দীপ্তি, আলো, তেজ; স্বরতা (Svaratā): ভাব বা প্রকৃতি) মানে চেতনার সেই সহজ, বিশুদ্ধ, অনাবৃত জ্যোতি, যা কোনো কিছুর বিরুদ্ধতা নয়, বরং সব কিছুকে আলোকিত করার ক্ষমতা; আবরণ সরলে সূর্যকে “তৈরি” করতে হয় না—মেঘ সরে গেলেই সূর্য নিজেই দীপ্ত। বৌদ্ধ তন্ত্রের ভাষায় মন স্বভাবতই প্রভাস্বর; কলুষ, ক্লেশ, অজ্ঞান কেবল আগন্তুক আবরণ—এসে জুড়েছে, তাই অপসারণযোগ্য। শূন্যতার দর্শন এই আবরণগুলোকে অর্থহীন করে দেয়; প্রভাস্বরতার অভিজ্ঞতা দেখায়—আবরণহীন চেতনা কেবল ফাঁকা নয়, জ্ঞান, করুণা ও সৃজনশীলতার পূর্ণ উৎস।

এই দুই দিক একই সত্যের দুই মুখ—একটি কাটে, আরেকটি জ্বালে। শূন্যতা ধারণাগত জড়তা কাটায়—“এটাই আমি”, “এটাই সত্য”—এমন আঁকড়াগুলোকে (আঁকড়ে ধরার অংশ) শল্যচিকিৎসার মতো ছেঁটে দেয়; প্রভাস্বরতা সেই খোলা পরিসরকে প্রাণ দেয়—সচেতন উপস্থিতি, কোমল উষ্ণতা, স্বচ্ছ বোধ ও স্বতঃস্ফূর্ত করুণার স্রোত সেখানে নিজে থেকেই প্রবাহিত হয়।

ক্যানভাস-চিত্রের উপমা এখানে সহায়ক: ক্যানভাস ফাঁকা না থাকলে ছবি আঁকা যায় না—এ ফাঁকাই শূন্যতা; আর রং-রেখার খেলায় যে-পূর্ণতা জেগে ওঠে, সেটিই প্রভাস্বরতা। আকাশের উপমাটিও তেমন—আকাশ ধারণাহীন বলে সব মেঘ আসে-যায়; আকাশের এই দখলহীনতা শূন্যতা, আর যেভাবে আকাশ প্রতিটি মেঘ, পাখি, সূর্যালোককে আলোক-পরিসরে জায়গা দেয়, সেই আলোক-উপস্থিতিই প্রভাস্বরতা।

শ্বাসের ছন্দেও এ ঐক্য ধরা পড়ে: নিঃশ্বাস ছেড়ে দেওয়া—ছেড়ে-দেওয়ার ঐশ্বর্য—শূন্যতা; নিঃশ্বাস নেওয়া—জীবনীশক্তির পূর্ণতা—প্রভাস্বরতা; দুটো মিলেই এক জীবন। ক্রম-কালীর ধারায় এই সত্যকে বলা হয় পরিপূর্ণতার জাগরণ—শূন্য পরিসরের ভেতরেই চেতনা নিজের স্বরূপকে চিনে ওঠে (বিমর্শ), এবং সেই স্বচেতনা সমস্ত রূপ-অরূপকে আলোকিত করে (প্রকাশ)। তাই শূন্যতা-পূর্ণতার দ্বন্দ্ব আসলে কৃত্রিম; শূন্যতা হলো অবাধ ক্ষেত্র, পূর্ণতা হলো সে-ক্ষেত্রের জাগ্রত উপস্থিতি; একটিতে আঁকড়া ভাঙে, অন্যটিতে জীবনের দীপ্তি ফোটে।

ধ্যান-অভ্যাসে এটি সরাসরি দেখা যায়। স্থির হয়ে বসলে চিন্তা-অনুভূতি তরঙ্গের মতো ওঠে-নামে; শূন্যতার দৃষ্টিতে বোঝা যায়—এগুলোকে “আমার” বলে ধরার মতো কোনো কঠিন কেন্দ্র নেই; যা আছে তা কেবল আগমন-নিগমন। যখন আঁকড়া আলগা হয়, শান্ত নীল পরিসরে হঠাৎ টের পাওয়া যায় এক জাগ্রত উজ্জ্বলতা—জ্যোতিষ্মান উপস্থিতি, যেখানে দেখা স্পষ্ট, হৃদয় নরম, সাড়া স্বতঃস্ফূর্ত। এই জ্যোতিষ্মান উপস্থিতিই প্রভাস্বরতা; এখানেই প্রজ্ঞা আর করুণা আলাদা থাকে না—যা সত্য, তাই মমতাময়; যা মমতাময়, তাই কার্যকর।

নৈতিক জীবনেও এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়: শূন্যতা শেখায়, “আমি”-“অন্য”-র কড়া সীমানা কল্পিত; তাই অন্যের দুঃখকে পাশ কাটানো যায় না। প্রভাস্বরতা শেখায়, এই দেখা নিস্তেজ বোধ নয়—এটি সৃষ্টিশীল সাড়া; সাহায্য কর্তব্যবোধ থেকে নয়, স্বাভাবিক স্বরূপ থেকে ঝরে পড়ে। মহাযানের প্রবাদ—“প্রজ্ঞা ছাড়া করুণা অন্ধ, করুণা ছাড়া প্রজ্ঞা শূন্য”—আসলে এই একাত্মতারই সহজ ভাষ্য: শূন্যতা বাঁধন কাটে, প্রভাস্বরতা হৃদয় ভরে; দুইয়ে মিলে জাগে বোধিসত্ত্বর প্রাণস্পন্দন।

ভুল ধারণা দুটি এড়ানো দরকার।

এক, শূন্যতা নৈরাশ্য নয়; এটি আসক্তিহীন স্বাধীনতা—ধারণার কড়া দেয়াল ভাঙার সাহস।

দুই, প্রভাস্বরতা কোনো আবেগঘন উচ্ছ্বাস নয়; এটি অভিযোগহীন প্রাচুর্য—চেতনার স্ব-উজ্জ্বল উপস্থিতি, যেখানে কিছু যোগ করার নেই, বাদ দেওয়ারও নেই।

শ্রীবিদ্যার শ্রীচক্র-দর্শনে বাহিরের বহুত্বের স্তর অতিক্রম করে কেন্দ্রে, বিন্দুতে, যে অদ্বৈত জ্যোতি ধরা পড়ে—সেই একই সংহতি এখানে বৌদ্ধ ভাষায় শূন্যতা-প্রভাস্বরতার যুগলরূপ। কাশ্মীর শৈবের প্রকাশ-বিমর্শ, স্পন্দের অবাধ ক্ষেত্র ও তার রসরূপ—সব শেষমেশ এই এক উপপত্তিতে (যুক্তি বা প্রমাণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা বা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো) এসে মেশে: শূন্যতা হলো অবরোধমুক্ত পরিসর; প্রভাস্বরতা হলো সেই পরিসরে চেতনার স্বয়ং-দীপ্ত সত্তা; দুটি আলাদা করা যায় না, যেমন তরঙ্গকে সমুদ্র থেকে বা আলোকে দীপ্ততা থেকে আলাদা করা যায় না।

পরম সত্য কোনো “শূন্যতা বনাম পূর্ণতা”-র দ্বন্দ্ব নয়; এটি “দখলহীন জ্ঞানের দীপ্ত উপস্থিতি”—একই নিঃশ্বাসে পরিসর ও উপস্থিতি, একই ঢেউয়ে ছেড়ে-দেওয়া ও আলোকিত-হওয়া। প্রজ্ঞাপারমিতার শূন্যতা দৃষ্টিকে নির্মোহ করে, ক্রম-কালীর পূর্ণতা হৃদয়কে সচল করে; দৃষ্টি ও হৃদয় একত্র হলে যে-চেতনা উন্মোচিত হয়, সেটিই প্রভাস্বর অদ্বৈত—শূন্য অথচ পূর্ণ, নিস্তরঙ্গ অথচ উজ্জ্বল, মায়াময় অথচ পরম বাস্তব।

চেতনা নিজস্বভাবে কোনো বস্তু নয়, আবার নিছক শূন্য শূন্যও নয়। চেতনা একদিকে দখলহীন—কোনো ধারণা, পরিচয় বা অভ্যাস তাকে স্থায়ীভাবে বাঁধতে পারে না; অন্যদিকে সে স্বদীপ্ত—নিজেরই আলোয় জাগ্রত, উপস্থিত, উজ্জ্বল। এই দুই দিক একসঙ্গে ধরা পড়লে যে-অভিজ্ঞতা জন্মায়, সেটিই প্রভাস্বর অদ্বৈত: এমন এক অখণ্ড অবস্থা, যেখানে শূন্যতার অবাধ পরিসর আর দীপ্ত উপস্থিতির আলো অবিচ্ছেদ্য। শূন্যতা এখানে নৈরাশ্য নয়; এটি আঁকড়া ভাঙার সাহস—“এটাই আমি”, “এটাই চূড়ান্ত”—এসব কঠিন গাঁট শিথিল হলে যে মুক্ত পরিসর দেখা দেয়, সেটাই শূন্যতা। আর প্রভাস্বরতা কোনো কৃত্রিম উচ্ছ্বাস নয়; এটি অভিযোগহীন প্রাচুর্য—আবরণ সরে গেলে চেতনা নিজের মতো জ্বলে, যেমন মেঘ সরলেই সূর্যকে নতুন করে বানাতে হয় না।

এই অভিজ্ঞতা ধরতে একটি উপমা কাজে দেয়: আকাশ ও আলো। আকাশ কিছুই আঁকড়ে ধরে না, তাই মেঘ-বৃষ্টি-রংধনু—সবই সেখানে আসে-যায়; এ দখলহীনতা হলো শূন্যতা। কিন্তু আকাশ অন্ধকারের সমার্থক নয়; সূর্যালোক যখন পড়ে, আকাশ-পরিসর আলোকে আশ্রয় দেয়—এ আলোই প্রভাস্বরতা। একইভাবে চেতনা যদি শূন্য—তাহলে তাতেই সব অভিজ্ঞতা উঠবে-নামবে, কিন্তু চেতনার নিজস্ব দীপ্ত উপস্থিতি থাকবে—দেখার ক্ষমতা, বোঝার স্বচ্ছতা, করুণার উষ্ণতা। তাই প্রভাস্বর অদ্বৈতে শূন্যতা ও আলো—দুটোই এক সত্যের দুই মুখ: এক মুখ ছেড়ে দেওয়া, আরেক মুখ জেগে থাকা।

ধ্যান-অভ্যাসে এটি খুব সরাসরি দেখা যায়। আপনি স্থির হয়ে নিঃশ্বাস লক্ষ করছেন; মনে ভাব, স্মৃতি, ইচ্ছা, উদ্‌বেগ—তরঙ্গের মতো ওঠে-নামে। যদি সঙ্গে সঙ্গে “আমার ভাব”, “আমার সমস্যা” বলে আঁকড়ে ধরেন, মন ভারী হয়। কিন্তু এক পা পেছনে দাঁড়িয়ে দেখলে বোঝেন—এসবই প্রতিমুহূর্তে গড়া-ভাঙা চিহ্ন; কোনো কঠিন কেন্দ্র নেই। এই দেখায় আঁকড়া আলগা হয়—এটাই শূন্যতার স্বাদ। ঠিক তখনই লক্ষ করবেন, এই দখলহীন নীরবতার মধ্যে একটি জ্যোতিষ্মান উপস্থিতি নিজে থেকেই জেগে আছে—কিছু করতে হয় না; দেখা স্বচ্ছ, হৃদয় নরম, সাড়া স্বতঃস্ফূর্ত। এই জ্যোতিষ্মান উপস্থিতিই প্রভাস্বরতা। এখানেই প্রজ্ঞা ও করুণা আলাদা থাকে না—যা সত্য, তা মমতাময়; যা মমতাময়, তা কার্যকর।

দর্শনের ভাষায় বললে, বৌদ্ধ মধ্যমক বলে—সব কিছু স্বভাবশূন্য, স্বতন্ত্র সত্তাহীন; তাই আঁকড়া ভাঙলেই মুক্তি। তন্ত্র বলবে—মুক্ত পরিসরেই চেতনার স্বদীপ্ত প্রকৃতি জেগে ওঠে; মন স্বভাবতই প্রভাস্বর, ক্লেশ কেবল আগন্তুক আবরণ। শূন্যতা এখানে ফাঁকা ঘর নয়; জানালা খোলা ঘর—যেখানে বাতাস-আলো নিজে থেকেই ভরে ওঠে। কাশ্মীর শৈবের ভাষায়, এটি প্রকাশ-বিমর্শের ঐক্য: প্রকাশ হল আলো—চেতনার দীপ্তি; বিমর্শ হল আত্মসচেতনতা—চেতনা নিজেকে চেনে। দুই মিলেই স্পন্দ—জীবন্ত নৃত্য। শ্রীবিদ্যার শ্রীচক্র-মানচিত্রেও দেখা যায়—বাহিরের বহুত্ব অতিক্রম করে কেন্দ্রে, বিন্দুতে পৌঁছালে ধরা পড়ে অদ্বৈত জ্যোতি: একসঙ্গে শূন্য ও পূর্ণ।

প্রয়োগিক জীবনে এর প্রভাব অত্যন্ত বাস্তব। শূন্যতার দৃষ্টি “আমি-অন্য”-র কড়া সীমানা নরম করে; বুঝি—অন্যের দুঃখ বিচ্ছিন্ন নয়, আন্তঃনির্ভর বন্ধনের অংশ। প্রভাস্বরতার বোধ সেই দেখাকে কর্মে রূপ দেয়—সহায়তা কর্তব্যবোধ থেকে নয়, স্বাভাবিক স্বরূপ থেকে ঝরে পড়ে। তাই মহাযান বলে—“প্রজ্ঞা ছাড়া করুণা অন্ধ, করুণা ছাড়া প্রজ্ঞা শূন্য।” শূন্যতা বাঁধন কাটে; প্রভাস্বরতা হৃদয় ভরে। দুই একত্র হলে জীবন একইসাথে স্থির ও সজাগ হয়—স্পষ্ট দেখা, কোমল সাড়া।

এখানে দুটি ভুল ধারণা এড়ানো দরকার। প্রথমত, শূন্যতা নিহিলিজম নয়; এটি সম্পর্ক-নির্ভরতার অন্তর্দৃষ্টি—কিছুই কঠিন নয় বলে সবই অর্থহীন—এটা ভুল। বরং কঠিন না হওয়ায় সৃজনের সম্ভাবনা অসীম। দ্বিতীয়ত, প্রভাস্বরতা কোনো আবেগঘন উত্তেজনাও নয়; এটি স্থির, শান্ত, স্বচ্ছ আলোক—দেখার ক্ষমতা, যেখানে ভালো-মন্দকে ঠেলে না দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায়, তাই যথাযথ কাজ বেরিয়ে আসে। এই সমন্বয়ই প্রভাস্বর অদ্বৈত—দখলহীন মুক্তি ও দীপ্ত উপস্থিতির একাত্মতা।

সাধনার ভাবে এটি কীভাবে চর্চা করবেন? প্রথমে শরীর-শ্বাস-মনের সাধারণ স্থিতি গড়ুন: বসার সময় মেরুদণ্ড শিথিল সোজা, দৃষ্টি নরম, শ্বাস স্বাভাবিক। পরের ধাপে “লেবেলিং” কমিয়ে কেবল অনুভব করুন—শ্বাস-শরীর-শব্দ-চিন্তা উঠছে-যাচ্ছে। কোনো অভিজ্ঞতাকে ঠেকাবেন না, টানবেনও না—এটাই শূন্যতার অনুশীলন: অনাসক্ত মনোযোগ (non-clinging attention)। তারপর সূক্ষ্মভাবে টের নিন—এই আসা-যাওয়ার ভেতরে একটি নিরন্তর, নীরব, জ্যোতিষ্মান সচেতনতা আছে—যা বদলাচ্ছে না।

মাঝে মাঝে প্রশ্ন তুলুন—“এই দেখা জিনিসটির বদলে যে-দেখা নিজেই আছে, সেটি কেমন?” প্রশ্নের পেছনে ছোটার দরকার নেই; প্রশ্নটি যেন দরজা খোলে, আর আপনি সেই দরজা দিয়ে নীরবে প্রবেশ করেন। যত বার খেয়াল হারাবেন, তত বার কোমলভাবে ফিরে আসুন। স্থিরতা বাড়লে অনুভব করবেন—প্রত্যেক মুহূর্তই একসঙ্গে পরিসর (শূন্যতা) ও উপস্থিতি (প্রভাস্বরতা)।

শেষপর্যন্ত প্রভাস্বর অদ্বৈত কোনো দর্শন নয়, অভিজ্ঞতার নাম—মন যখন কোনো ভিত্তি দাবি করে না, তবুও জাগ্রত থাকে; যখন কোনো পরিচয় আঁকড়ে ধরে না, তবুও দায়িত্বশীলভাবে সাড়া দেয়। এতে “আমি কে?” প্রশ্নটির উত্তর ধারণা দিয়ে নয়, জীবন্তভাবে মেলে: আমি সেই চেতনা, যা একই সঙ্গে শূন্য অথচ পূর্ণ, নিস্তব্ধ অথচ উজ্জ্বল। এখানেই দ্বন্দ্ব গলে যায়—পরম সত্য হয়ে ওঠে “দখলহীন জ্ঞানের দীপ্ত উপস্থিতি”: এক নিঃশ্বাসে ছেড়ে দেওয়া, পরের নিঃশ্বাসে আলোকিত হওয়া; এক স্রোতে মুক্তি, একই স্রোতে প্রেম।

শ্বাসের উপমায়ও বিষয়টি ধরা যায়। শ্বাস—ছেড়ে দেওয়া—শূন্যতা: আঁকড়া, পরিচয়, অভিমান, সঙ্কীর্ণতা—সব বেরিয়ে যায়; প্রশ্বাস—নেওয়া—পূর্ণতা: প্রাণ, স্বচ্ছতা, সচেতনতা ভরে ওঠে দেহ-মন। কৌল ভাষায়—বিসর্গ (নিঃসরণ) ও বিন্দু (কেন্দ্র)—এই দুই চলাচলেই চেতনার নৃত্য। একদিকে ধুয়ে-মুছে দেওয়া, অন্যদিকে দীপ্তি-ভরে ওঠা—একই স্রোতের দুই ঢেউ।

ধ্যান-অভ্যাসে এটাকে দেখা যায় খুব সরাসরি। আপনি স্থির হয়ে বসে নিঃশ্বাস লক্ষ করলেন—চিন্তা-ছায়া উঠছে, পড়ছে। যদি সঙ্গে সঙ্গে “আমার চিন্তা” বলে তা আঁকড়ে নেন, জড়তা তৈরি হয়। কিন্তু শূন্যতার বোধ এলে দেখবেন—চিন্তা উঠছে-যাচ্ছে, ধরা পড়ছে এমন কিছু নেই। এই দখলহীন উন্মুক্ততায় হঠাৎ টের পাবেন—নীরবতার ভেতরে একটি উজ্জ্বল উপস্থিতি নিজে থেকেই জ্বলছে: স্পষ্ট দেখা, কোমল উষ্ণতা, অযতনে করুণা। এটাই ক্রম কালীর পূর্ণতা—শূন্য পরিসর খালি নয়, চৈতন্যে ভরা। এখানে প্রজ্ঞা (শূন্যতার অন্তর্দৃষ্টি) ও করুণা (সেই অন্তর্দৃষ্টির জীবন্ত সাড়া) একটি অনির্বিচ্ছিন্ন গতি।