শৈব কালী: এক-শো



এই পাঁচ বাহ হলো চেতনার নিজস্ব ক্রিয়ার সূক্ষ্মতম ধারা, যা পরবর্তীতে বিশ্বসৃষ্টির আদিম কাঠামো গঠন করে। বলা হয়, চেতনা থেকে শক্তি, তা থেকে গতি, তা থেকে রূপ, তা থেকে অভিজ্ঞতা—এই ধারাবাহিক প্রবাহেই মহাবিশ্বের উন্মোচন ঘটে।

১. প্রথম প্রবাহে চেতনা নিজের সম্ভাবনাকে প্রকাশ করতে চায়—এটি ইচ্ছাশক্তি (Icchā-Śakti)।

২. দ্বিতীয় প্রবাহে সেই ইচ্ছা নিজের রূপ নির্ধারণ করে—এটি জ্ঞানোদ্ভূত শক্তি (Jñāna-Śakti)।

৩. তৃতীয় প্রবাহে সেই জ্ঞান ক্রিয়া রূপে প্রকাশিত হয়—এটি ক্রিয়াশক্তি (Kriyā-Śakti)।

৪. চতুর্থ প্রবাহে ক্রিয়াশক্তি নিজেকে রূপ দেয়, সৃষ্টি করে দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা—এটি রূপ-প্রকাশ (Ābhāsa)।

৫. পঞ্চম প্রবাহে সেই প্রকাশ অভিজ্ঞতার রস পায়—চেতনা নিজেই নিজেকে ভোগ করে; এটি আনন্দ-প্রবাহ (Ānanda-Vāha)।

এই পাঁচ বাহকে মিলিয়ে বলা হয় “কুল-পঞ্চক”—কারণ তারা একত্রে কুল (Kula) বা “চেতনার ঐক্য-পরিবার” গঠন করে, যেখানে শিব (চেতনা) ও শক্তি (প্রকাশ) একত্রে ক্রিয়াশীল।

এই পাঁচটি প্রবাহকে বোঝার জন্য একটা সহজ উদাহরণ নিই—একজন শিল্পী যখন ছবি আঁকতে বসেন।

১. ইচ্ছাশক্তি (Icchā-Śakti): প্রথমে তাঁর মনে জন্ম নেয় এক অন্তর্দৃষ্টি—“আমি একটি ছবি আঁকব।” এটি সৃষ্টির মূল আকাঙ্ক্ষা, সম্ভাবনাকে প্রকাশ করতে চাওয়া চেতনার প্রথম জাগরণ।

২. জ্ঞানোদ্ভূত শক্তি (Jñāna-Śakti): তারপর সেই ইচ্ছা আকার নিতে শুরু করে; তিনি ভাবেন ছবির রূপ, রং, বিন্যাস, অর্থ—এখানে চেতনা নিজের ধারণাকে জ্ঞানরূপে নির্ধারণ করে।

৩. ক্রিয়াশক্তি (Kriyā-Śakti): জ্ঞানের এই ধারণা এখন ক্রিয়ায় রূপ পায়; তিনি ক্যানভাসে তুলির আঁচড় দিতে শুরু করেন। এখানে চেতনা সক্রিয়ভাবে নিজের রূপ প্রকাশ করছে।

৪. রূপ-প্রকাশ (Ābhāsa): তুলির স্পর্শে ধীরে ধীরে ছবির রূপ ফুটে ওঠে—চেতনার অন্তর্নিহিত ভাব দৃশ্যমান রূপ ধারণ করে। এই পর্যায়ে অদৃশ্য চিন্তা দৃশ্যমান অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়।

৫. আনন্দ-প্রবাহ (Ānanda-Vāha): যখন শিল্পী নিজের সম্পূর্ণ ছবিটা দেখে, তখন সে আনন্দে পূর্ণ হয়—এখানে চেতনা নিজেই নিজের প্রকাশকে উপভোগ করছে, যেমন স্রষ্টা নিজের সৃষ্টিকে দেখে তৃপ্ত হয়।

এই উদাহরণে বোঝা যায়—চেতনা কেবল সৃষ্টি করে না, নিজেকেই প্রকাশ করে, এবং সেই প্রকাশের মধ্যেই নিজের আনন্দ অনুভব করে। এই পাঁচ প্রবাহ আসলে সেই এক চেতনার পাঁচটি ছন্দ—ইচ্ছা, জ্ঞান, ক্রিয়া, রূপ ও আনন্দ, যা একত্রে সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ চক্র তৈরি করে।

এই পাঁচ বাহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন বামেশ্বরী (Vāmeśvarī)—যিনি চেতনার গতিময়, প্রাণময় দিকের প্রতীক। “বাম” শব্দটি সংস্কৃতে ইঙ্গিত করে শক্তির বাঁ-দিকের বা গতি-নির্দেশক রূপ—অর্থাৎ, শিবের স্থিত চেতনার বিপরীতে সেই গতি, যা লীলা ও সৃষ্টি রূপে প্রকাশিত হয়। তাই বামেশ্বরীকে বলা হয় চেতনার প্রথম গতি (Prathama Spanda)—তিনি স্থিত ও গতির মধ্যবর্তী সংযোগবিন্দু।

তবে বামেশ্বরী কালীর সমান স্তরে অবস্থান করেন না। কালী হলেন অকাল বা ক্রমাতীত চেতনার রূপ—যিনি সমস্ত গতি ও সময়ের অতীত; আর বামেশ্বরী হলেন সেই কালীর মধ্য থেকেই বিকশিত প্রথম স্পন্দন, অর্থাৎ চেতনার গর্ভে জন্ম নেওয়া গতি। কালী নিস্পন্দ, বামেশ্বরী স্পন্দিত; কালী নিস্তব্ধ দীপ্তি, বামেশ্বরী সেই দীপ্তির তরঙ্গ।

বামেশ্বরী ও কুল-পঞ্চক মিলে গঠন করে মহাজাগতিক ক্রিয়াশীলতার আদিম কেন্দ্র—যেখান থেকে চেতনা আত্মবিমর্শ থেকে আত্মপ্রকাশে রূপান্তরিত হয়। কাশ্মীর শৈব তত্ত্বের ভাষায়, এই মুহূর্তেই শিবচেতনা নিজের স্বরূপে থাকতেও শুরু করে লীলা—এবং সেই লীলাই হলো বিশ্বসৃষ্টি।

“ষোড়শাধিক সপ্তদশী কলা (Ṣoḍaśādhikā Saptadaśī Kalā)” বলতে বোঝানো হয়—চেতনার সেই অতিপূর্ণ দীপ্তি, যেখানে ষোড়শ কলা (পূর্ণতার ১৬ ধাপ) সম্পূর্ণ হওয়ার পর আরও এক অতিরিক্ত জাগরণ ঘটে। শ্রীবিদ্যায় ১৬ কলা মানে পূর্ণিমার পূর্ণতা—সব শক্তি, সব মাত্রা জেগে ওঠা। কিন্তু ক্রমপন্থার ভাষায় সপ্তদশী কলা হলো পূর্ণতারও অতীত: যেখানে দীপ্তি নিজ উৎসে প্রত্যাবর্তন করে এবং সব স্তরকে একযোগে আলোকিত করে, কিন্তু কোনোটির মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না। এইজন্যই কাল-সংকর্ষিণীকে এখানে সপ্তদশী কলা বলা হয়—তিনি স্তর-স্বাধীন দীপ্তি: প্রত্যেক স্তর তাঁর আলোয় দেখা দেয়, তবু তিনি কোনো স্তর-পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নন।

এটা বোঝার সহজ উপায়—প্রকাশ (prakāśa) ও বিমর্শ (vimarśa)-এর সম্পর্ক। ষোড়শ কলা পর্যন্ত “আলো” বিভিন্ন মাত্রায় ছড়ায়—ইচ্ছা, জ্ঞান, ক্রিয়া, ভাব, রূপ—সব ধাপে আলোক বিস্তার পায়। সপ্তদশে এসে সেই আলো নিজেরই দিকে ফিরে তাকায়—এটাই বিমর্শ: আলো নিজেকে জানে, আলো আলোকিত—এই স্বজ্ঞা জাগে। তখন যা কিছু প্রকাশিত (বিশ্ব, সময়, অভিজ্ঞতা) সবই দেখা যায় চেতনার স্ব-চেতন দীপ্তির প্রতিফলন হিসেবে; আলাদা কোনো বাহ্য বাস্তবতা নয়।

এখানেই আয়নার দৃষ্টান্তটি খাটে: আয়না যেমন সব প্রতিচ্ছবি ধারণ করে, কিন্তু কোনো প্রতিচ্ছবিই আয়নার বাইরের আলাদা সত্তা নয়—তেমনি সপ্তদশী কলায় সমগ্র সৃষ্টি চেতনার আয়নার মধ্যেই প্রতিবিম্বিত। প্রতিচ্ছবি আছে—কারণ আলো আছে; কিন্তু আয়নার নিজস্ব উজ্জ্বলতা কোনো নির্দিষ্ট ছবিতে আটকে নেই। চেতনা (আয়না) অপরিবর্তিত, প্রতিচ্ছবি (বিশ্ব) পরিবর্তিত—তবু দুটিই অবিচ্ছেদ্য, কারণ প্রতিচ্ছবির অস্তিত্ব আয়নার আলোকেই।

এই অবস্থার কয়েকটি দার্শনিক দিক:

স্তর-অতিক্রম (trans-level awareness): চেতনা এখানে একেকটি স্তর “পার” করে না; বরং সব স্তরকে একসঙ্গে ধারণ করে। ফলে “আগে–পরে” বা “উপর–নীচ” এমন ক্রমবোধ শিথিল হয়ে যায়।

অভিনির্মিত ঐক্য: বহুত্ব (রূপ-রূপান্তর) ও ঐক্য (এক দীপ্তি) একসঙ্গে সত্য—বহুত্বকে নস্যাৎ করে নয়, নিজ আলোয় অভ্যন্তরীণ ঐক্য হিসেবে ধারণ করে।

স্ব-প্রকাশিত পরিতৃপ্তি: এ দীপ্তি কোনো লক্ষ্য-সাধনের ফল নয়—এটা স্বভাবগত পরিপূর্ণতা। তাই একে অতিপূর্ণতা (ati-pūrṇatā) বলা হয়—পূর্ণতারও “অতিরিক্ত”, কারণ এখানে পূর্ণতাই নিজের উৎস-স্বভাবে স্থিত।

কর্তা-কর্ম অদ্বৈত: আলোক (জ্ঞাতা), আলোকিত (জগৎ), আলোকায়ন (জ্ঞান)—তিনটি ভিন্ন সত্তা নয়; এক চেতনার তিন দিক মাত্র।

তাই ষোড়শাধিক সপ্তদশী কলা হলো চেতনার স্ব-জ্যোতিষ্মত আন্তঃস্থিতি—যেখানে কালী স্তর-নিরপেক্ষ কেন্দ্রদীপ্তি হিসেবে প্রতিভাত—

তিনি সব স্তরকে আলোকিত করেন (তাই জগৎ আছে),

তিনি কোনো স্তরে সীমাবদ্ধ নন (তাই তিনি কাল-ক্রম-রূপের ঊর্ধ্বে),

আর সব কিছু শেষত এক স্ব-চেতনার খেলাই (তাই বিশ্ব তাঁরই বিমর্শ তথা স্ব-প্রতিফলন)।

এইজন্যই বলা হয়—সপ্তদশী কলায় প্রকাশ ও প্রতিফলন, বহুত্ব ও ঐক্য, সৃষ্টি ও লয়—সবই এক দীপ্তিতে মিলে যায়। কালী এখানে আয়নাও, প্রতিচ্ছবির আলোও, এবং দেখা-হওয়ার স্বজ্ঞাও—একই সঙ্গে তিনটিই; কিন্তু শেষ বিশ্লেষণে তিনি শুধু এক চিহ্নহীন দীপ্তি, যার আলোয় সব দেখা দেয়, আর যা নিজে কোনো চিহ্নে ধরা পড়ে না।

এই প্রতিফলনকে শাস্ত্রে বলা হয়েছে বিমর্শ (Vimarśa)—অর্থাৎ চেতনার আত্ম-প্রতিফলন বা স্ব-বোধ। যেমন আয়নায় মুখের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়—কিন্তু সেই মুখ ও প্রতিচ্ছবি কখনো আয়না থেকে পৃথক নয়, বরং আয়নার মধ্যেই তার সত্তা নিহিত থাকে—তেমনি সমস্ত সৃষ্টি, সমস্ত অভিজ্ঞতা, সমস্ত কাল ও স্থান আসলে কালীর নিজের চেতনার প্রতিফলন মাত্র। বিশ্ব যেন এক অন্তহীন প্রতিচ্ছবির খেলা—যেখানে প্রতিটি রূপ, প্রতিটি গতি, প্রতিটি শব্দ আসলে তাঁরই অভ্যন্তরীণ আলোতে উদ্‌ভাসিত।

এই প্রতীকটি তাই গভীর দার্শনিক সত্য প্রকাশ করে—সৃষ্টি ও চেতনা ভিন্ন নয়, প্রতিফলন ও প্রতিফলিত একই। মহাবিশ্ব কোনো বহির্জগত নয়; এটি কেবল পরম চেতনার স্ব-বিমর্শের দৃশ্যরূপ। সেই কারণে বলা হয়, কাল-সংকর্ষিণী সপ্তদশী কলা রূপে আলোরও উৎস, প্রতিফলনেরও ভিত্তি এবং প্রতিফলিত রূপেরও অন্তঃসত্তা।

এই সপ্তদশী কলা চেতনার সেই অবস্থাকে নির্দেশ করে, যেখানে সব স্তর একে অপরের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে এক অভিন্ন দীপ্তিতে মিলিত হয়। তিনি প্রকাশ ও লয়ের মধ্যবর্তী সেই নিস্তব্ধ জ্যোতি—যিনি আয়না ও প্রতিচ্ছবির ঐক্য, যেখানে দেখা, দেখা-যাওয়া এবং দেখনেওয়ালা—তিনিই এক। এখানেই কালী চূড়ান্ত রূপে প্রতিভাত হন—সমস্ত জগতের প্রতিবিম্বনশক্তি, সমস্ত চেতনার আয়না এবং সমস্ত অস্তিত্বের পরম দীপ্তি।

এই দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রত্যভিজ্ঞা দর্শনের মূল অন্তর্দৃষ্টি-র সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিলিত। প্রত্যভিজ্ঞা বলে—“বিশ্বমিদং চিন্মাত্রবিমর্শমাত্রং”—অর্থাৎ, “এই বিশ্ব কেবল চিত্‌ (চেতনা)-এর আত্মবিমর্শ বা প্রতিফলনমাত্র।”

এটি বোঝায় যে, বিশ্ব কোনো বাহ্য বস্তু নয়; এটি চেতনারই নিজস্ব প্রতিফলন—চেতনা নিজেকে জানছে, নিজেরই দিকে তাকাচ্ছে। যেমন কেউ আয়নায় নিজের মুখ দেখে, কিন্তু সেই মুখ আর প্রতিচ্ছবি দুটি ভিন্ন নয়—একই সত্তা ভিন্ন প্রতিফলনে প্রকাশিত—তেমনি সমস্ত সৃষ্টি, সময় ও স্থান, কালীর নিজের অন্তঃবিমর্শের প্রতিচ্ছবি মাত্র।

এখানে কালী হচ্ছেন সেই সময়হীন (kālātīta) চেতনা, যিনি নিজের অন্তর্লীন লীলায় সময়, স্থান, কার্যকারণ—সবকিছু সৃষ্টি করেন, আবার নিজেই তা গ্রাস করেন। তাই তাঁকে বলা হয় কালগ্রাসিনী (Kālgrāsinī)—“যিনি কালকে গ্রাস করেন।” এই ‘গ্রাস’ কোনো ধ্বংস নয়; এটি চেতনার নিজের প্রকাশকে আবার নিজের মধ্যে টেনে নেওয়া, যেমন ঢেউ আবার সাগরে মিশে যায়। সময় তাই তাঁর বাইরের কিছু নয়; সময় তাঁরই ছায়া—তিনি কালাতীত, কারণ কাল তাঁর মধ্যেই অন্তর্গত।

এই স্তরের উপলব্ধি কেবল ধারণা বা বিশ্লেষণের দ্বারা বোঝা যায় না; এখানে চূড়ান্ত মনোনিবেশ (ekāgratā) ও আত্ম-স্ফুরণ (ātma-sphuraṇa) প্রয়োজন। অর্থাৎ, এই উপলব্ধি আসে তখনই, যখন চেতনা নিজের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থির হয়—যেখানে আর চিন্তা বা ভাষা পৌঁছায় না।

ক্রমপন্থায় সংকর্ষিণী (Saṁkarṣiṇī) এই চূড়ান্ত স্তরের প্রতীক—তাঁকে বলা হয়েছে সর্বোচ্চ নীতি (parama-nīti), যিনি ব্যোম-বামেশ্বরী (Vyoma-Vāmeśvarī)-র অধীন প্রথম বাহ (vāha)-র প্রতিনিধি। এখানে “বাহ” মানে চেতনার সেই প্রবাহশক্তি, যার মাধ্যমে পরম চেতনা সমস্ত স্তর অতিক্রম করে নিজের পূর্ণতা (pūrṇatā) উপলব্ধি করে। অর্থাৎ, সংকর্ষিণী হলেন সেই প্রবাহ, যেখানে চেতনা নিজের বিকাশ ও প্রত্যাবর্তনের পরিণতি অর্জন করে—নিজেই নিজেকে চিনে ফেলে।

তবে একটি সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। ক্রমপন্থায় ব্যোম-বামেশ্বরী-র ধারণা ত্রিপুরা-তন্ত্রের বামাকেশ্বরী বা বামেশ্বরীর সমান নয়। নাম ও প্রতীকতায় মিল থাকলেও, তাদের দর্শনগত ভূমিকা ভিন্ন। ত্রিপুরা-তন্ত্রে বামেশ্বরী হলেন শিবচেতনার বাহ্য প্রকাশের দেবী—সৃষ্টির আরম্ভবিন্দু। কিন্তু ক্রমপন্থায় ব্যোম-বামেশ্বরী হলেন শিব-চেতনা ও শক্তি-চেতনার সংযোগসীমা, সেই সূক্ষ্ম বিন্দু, যেখানে শক্তি শিবে মিলিত হয়, কিন্তু এখনও একটুখানি স্পন্দন (spanda) বা গতি অবশিষ্ট থাকে।

এই পার্থক্যই কাশ্মীর শৈব-অদ্বৈত দর্শনের রহস্য। শিব ও শক্তি সারসত্তায় অভিন্ন—অর্থাৎ এক চেতনার দুই দিক—তবু অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে তাঁরা ধারণাগতভাবে পৃথক: শিব নিস্তরঙ্গ, শক্তি স্পন্দিত; শিব আলো, শক্তি সেই আলোর প্রতিফলন।

এই কারণেই ক্রমপন্থায় কালী বা কাল-সংকর্ষিণী সম্পর্কে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়—

১. প্রথম মতে, কাল-সংকর্ষিণীই পরম বাস্তবতা (parama-tattva) ও পরম সত্তা (parama-sattā)—অর্থাৎ তিনি নিজেই শিব; অন্য কোনো উচ্চতর সত্তা নেই।

২. দ্বিতীয় মতে, তিনি পরম সত্তার শক্তিরূপ—অর্থাৎ শিবের গতিময় রূপ, যা শিবের নিষ্পন্দ, স্থিত চেতনা থেকে উদ্ভূত হয়, এবং শেষে পুনরায় তাতেই লীন হয়।

কালী এখানে একই সঙ্গে প্রকাশ ও লয়, সৃষ্টি ও গ্রাস, গতি ও নীরবতা। তিনি যেমন সময় সৃষ্টি করেন, তেমনই সময়কে গ্রাস করেন; যেমন জগৎ প্রকাশ করেন, তেমনই জগৎকে নিজের অন্তঃপ্রভায় টেনে নেন। আর এই দ্বিমুখী লীলার মধ্য দিয়েই তিনি প্রকাশ করেন অদ্বৈত চেতনার পূর্ণ স্বরূপ—যেখানে সৃষ্টিও চেতনা, লয়ও চেতনা, আর চেতনা নিজেই উভয়ের ভিত্তি।