চড়ুই চড়ুই সকাল

সকাল হবার তখন‌ও অনেক বাকি। তবে দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।




ঘুমে ভেঙে গেল, তবে চোখ মেললাম না। জানতাম, মহামান্য প্রতিদিন এমন সময়েই উঠে বাইরে যাবে, গিয়ে ও-ঘর থেকে মনার মাকে ডেকে তুলে চুলো ধরাতে বলবে, আর নিজে যাবে ও-পাশের নিমগাছটার তলায় কিছুক্ষণ পায়চারি করতে। তারপর স্নান সেরে একরাশ ভিজে চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়ে আবার ঘরে ঢুকবে। কি শীত, কি গ্রীষ্ম—এর কোনো ব্যত্যয় নেই। ছোটোবেলার অভ্যেস, আজ‌ও ছাড়তে পারেনি।




তাই ঘুম ভাঙলেও চোখ মেললাম না। শুধু পাশ ফিরে শুলাম। কিন্তু পাশ ফিরতে গিয়ে বোধ হয় খোকার ছোট্ট হাতটি পড়ে গিয়েছিল আমার গলার উপর থেকে। ও সচকিত হয়ে জেগে উঠল হঠাৎ। তারপর একটু কাছে সরে এসে আমার গালের উপর ওর নরম হাত রেখে কচিগলায় ডাকল: "বাবা!"




দু-হাতে ওকে বুকের আরও কাছে টেনে এনে বললাম, “কী, বাবা?” পাঁচ বছরের রাঙামুখে খোকা যেন কথার কাকলি তুলল। বলল, “তুমি ঘুমোচ্ছ?”




বললাম, “কই, না তো, এই তো তোমার সাথে কথা বলছি।” কথাটা ওর বিশ্বাস হলো না। বলল, “হ্যাঁ, তুমি তো ঘুমোচ্ছ। ওই যে তোমার চোখ বোজা!”




অগত্যা চোখ খুলতেই হলো। খুলে দেখি, ঘরময় আবছা আলো।




পুবদিকের খোলা জানালা দিয়ে আলো এসে বিছানায় পড়েছে। খোকার দিকে তাকালাম। দেখলাম, ওর তন্দ্রালু কচি চোখদুটোয় অপার কৌতুক। কী ব্যাপার! ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে জানালার দিকে চোখ ফেরালাম।




খোকা এতক্ষণে আনন্দে উঠে বসেছে। বলল, “বাবা, চড়ুই!” “হ্যাঁ রে, চড়ুই।” আমার খোকার মতোই দুষ্টু-চঞ্চল একটা চড়ুই বসে আছে জানালায়। বসে আছে আর টুকটুক করে শব্দ করছে মিষ্টি সুরে। চেয়ে চেয়ে দেখলাম, চড়ুইটা কিছুক্ষণ পর ফুড়ুৎ করে উড়ে এল ঘরের মধ্যে। কিছুক্ষণ ফুরফুর করে সরে গেল, তারপর আবার গিয়ে বসল সেখানে। খোকা বসে বসে চড়ুইয়ের খেলা দেখতে লাগল। আর আমি ভাবলাম, আজকের এই ছোট্ট খোকার চিন্তাধারা আর পৃথিবী এখন‌ও কত ছোটো, ওর কল্পনাও আজ কত সীমাবদ্ধ।




এই খোকাও একদিন বড়ো হবে, স্কুলে যাবে। সেদিন একটা ভালো সাইকেল কিনে দেবো; বড়ো সাহেবের ছেলের মতো করে সাইকেল চালিয়ে যাবে স্কুলে। স্কুল থেকে ফিরে নাস্তা খেয়ে খেলতে যাবে। খেলার পরে সন্ধ্যার পর বাড়ি এসেই পড়তে বসবে।




খোকাকে পড়াতে আমার একটুও খরচা হবে না। আজকাল ভালো ছাত্রদের জন্য কত কত সরকারি বৃত্তি। ধাপে ধাপে বৃত্তি রয়েছে। তারপর একদিন ম্যাট্রিকও পাশ করবে। তখন তো আর ভাবনা নেই। ম্যাট্রিকে ভালো করতে পারলে ভালো কলেজে থাকা ও খাওয়ার ভালো একটা সরকারি বৃত্তিই তার হয়ে যাবে। খরচের ভাবনাই আমাকে করতেই হবে না। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজিতে অনার্স যদি নেয়, ভালোই হবে; ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে এম‌এ পরীক্ষা দেবে।




আমি তখন আর কালেক্টরির কেরানিগিরি করব না। সামস ভাই, মহীনদা, রশিদ সাহেব, মোল্লাজি আর কাজী, অফিসের সব সহকর্মীকে দাওয়াত করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসব। ওরা সেদিন নিশ্চয়ই আমার সৌভাগ্য দেখে ঈর্ষা করবে। তারপর খোকার বিয়ে হবে, রাঙা টুকটুকে একটা ব‌উ আসবে ঘরে।




তারপর খোকা যদি আল্লার মর্জিতে কালেক্টর হয়ে এখানেই আসে এবং একদিন আজকের এই বড়োসাহেবকে আচ্ছামতো ধমকে দেয় তো বেশ হয়।




আমি তখন মনের সুখে খোকার ছেলে-মেয়ে’দের নিয়ে…কী আশ্চর্য! খোকার আবার খোকা-খুকু হবে? অ্যাঁ, তখন আমার আর খোকার মায়ের নিশ্চয়ই চুল পেকেছে, দাঁতও হয়তো কয়েকটা পড়ে গেছে।




হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। আমার তাহমিনার দাঁত পড়ে গেলে তখন দেখতে কেমন হবে?




ভাবতে ভাবতে আপন মনে হাসছি। হঠাৎ তাহমিনা ঘরে ঢুকল। ভিজে চুলগুলো গামছার ভেতর নিয়ে মোড়াতে মোড়াতে বলল, “বাঃ! বাঃ! যেমন ছেলে, তেমন তার বাপ। দু-জনেই কুঁড়ের বাদশাহ। আমি এতক্ষণ সব কাজ সেরে এলাম, আর তোমাদের ওঠার নাম‌ই নেই।” বলতে বলতে খাটের কাছে আসতেই অমি ওর আঁচলটা ধরে দিলাম টান।




“আঃ! ছাড়ো! কী যে করো!” বলতে বলতে তাহমিনা আমার কোলের কাছে খপ করে বসে পড়ল। বললাম, “দেখো, মিনা, আজ রোববার। অফিস নেই। দেরিতে উঠলেও তো চলবে, এমন সোনার সকালও আমাদের জীবনে খুব বেশি আসে না। বসো, তুমিও আর এখন উঠতে পারবে না।” বলে দু-হাত দিয়ে ওকে কাছে টেনে নিলাম।




খোকার চড়ুই দেখা বন্ধ হয়েছে। ওর মাকে বন্দি করেছি দেখে ও খুব খুশি। সে-ও একটা হাত আমার গায়ের উপর রাখল। তাহমিনা বলল, “হ্যাঁ, তা ব‌ইকি, তোমরা পুরুষেরা তো এমনই। চিরকালের প্রজাপতি মন তোমাদের। শুধু নতুন নিয়েই মশগুল। কেন, এরকম সকাল কি আমাদের জীবনে আর আসেনি?” এটুক বলে ও জানালা দিয়ে চেয়ে রইল। ওর দু-চোখের উদাস দৃষ্টি অনেক দূরে পেছনে ফেলে-আসা দিনগুলোর কথা ভেবে ভেবে পাতায় পাতায় বুনো মর্মর তুলল।




প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে তাহ‌মিনা বলল, “তুমি ভুলতে পারো, কিন্তু আমি কোনোদিন ভুলব না। এই তো আমাদের বিয়ের মাত্র বছরখানেক আগে। আজকের মতো সেদিনও তোমার অফিসের তাড়া ছিল না। তুমি গিয়েছিলে দশ দিনের ছুটি নিয়ে জামালপুরে। তখনও এমনি ভোরে গোসল সেরে সকালবেলা তোমার ঘরে ঢুকতাম। আমি মাথায় হাত দিয়ে ধাক্কা দিলে তুমি চোখ মেলে তাকাতে। তাকিয়ে দেখতে, আমি হাসছি। তখন তুমি কী বলতে মনে আছে?” বলেই জিজ্ঞাসু চোখে তাহমিনা আমার দিকে সোজাসুজি ফিরে চাইল।




বললাম, “নাঃ! অতদিনের কথা কি মনে থাকে কার‌ও?” তাহমিনা বলল, “থাকে, মেয়েরা কোনোদিন অতীতকে ভোলে না। আমার মনে আছে, তুমি আমার মুখ ছুঁয়ে সুর করে বলতে,




প্রভাতে উঠিয়া এ মুখ হেরিনু,
দিন যাবে আজি ভালো।”




বললাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আর শুনে তুমি রাগ করতে, না?” অভিমানক্ষুব্ধ ব্যথিত স্বরে ও বলল, “তবুও বিয়ের পর অমনি করে আর এক দিনও বললে না।”




এবার উত্তরে কী বলব, ভাবছি। ভাবছি, নারীচরিত্র কত জটিল, নারীমন কত বিচিত্র! যে-কথা জানতে ভালো লাগে, সে কথা সামনাসামনি শুনতে ওদের কত আপত্তি! তাই চিরকালই নারী থাকে রহস্যাবৃত।




তাহমিনা একটু পর আবার বলে, “আর একদিনের কথা তোমার মনে আছে? সেই যে সমুদ্রপাড়ের সকাল? শেষরাত্রে আমরা লঞ্চ থেকে নামলাম। খোকা তখনও হয়নি। পাঁচ মাসের সময় আমাকে রেখে আনতে গেলে। জামালপুরে উন্মুক্ত চরের উপর নামলাম আমরা। পৌষের ভোররাত্রে কী কনকনে শীত! আর কী মারাত্মক ঠান্ডা হাওয়া সমুদ্রের বুক থেকে এসে আমাদের গায়ে এসে এসে লাগছিল। তোমার শালটা খুলে দিলে আমার গায়ে। বার বার খুলে যাচ্ছিল গা থেকে, আর তুমি বার বার গায়ে জড়িয়ে দেবার অছিলায় শুধু শুধু…কী দুষ্টই যে ছিলে!”




আমি ওর আঙুলগুলো নিয়ে নাড়া-চাড়া করতে করতে কখন যে ওর হাতখানা টেনে নিয়েছি আমার বুকের উপর, খেয়াল নেই, খেয়াল হতেই ওকেও টেনে আনলাম কাছে। ও আমার বুকে মুখ রেখে খোকাকে জড়িয়ে ধরল।




জানালায় চড়ুইটা আবার বুঝি এসে সেখানেই বসেছে। খোকা চেঁচিয়ে উঠল। “মা, চড়ুই!”




হ্যাঁ, সেই চড়ুইটাই খোকার নিজস্ব ভাবনার জগৎ। আমরা তিন জনেই চড়ুইটার দিকে ফিরে তাকালাম। খোকার মা, খোকা আর আমি—অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের তিন টুকরো প্রতীক যেন।
Content Protection by DMCA.com