এক। রান্নাবান্না নিঃসন্দেহে অনেক বড়ো একটা শিল্প। কিন্তু জানেন কি, কিছু মানুষের কাছে দুনিয়াতে এটাই একমাত্র শিল্প? গানকরা কিংবা কবিতালেখা, ছবিআঁকা, সেলাইকরা ইত্যাদি কিছুকে তাঁরা শিল্প বলে মনেই করেন না। কেন করেন না, জানেন? কারণ গান, কবিতা কিংবা সেলাই-করা কাপড় তো আর খাওয়া যায় না, তাই। সত্যিই, তাঁদের চিন্তানুযায়ী, যে জিনিস খাওয়া যায় না, সেই জিনিস আবার কীসের কী ঘোড়ার ডিম? আমরা প্রায়ই, অপরিচিত কিছু দেখিয়ে বা ওটার নাম ধরে একটা কথা বলি: ‘এ জিনিস আবার কী? খায়, না মাথায় দেয়?’ এই যে এমন করে বলি, এই ধরনের কথা থেকেই বোঝা যায়, আমরা খাবার জিনিসকে কত বেশি গুরুত্ব দিই! খাবার তো গুরুত্ব দেবারই জিনিস, এটাই বলবেন তো? হ্যাঁ, মানছি আমিও। কিন্তু ঠিক কতখানি গুরুত্ব দিই আমরা? আপনি কি জানেন, কিছু মানুষ বেঁচেই আছে শুধু খাওয়ার জন্য? এদের কাছে খাবারই সুখ, আর খাবারই দুঃখের একমাত্র কারণ। খাবার বেশি খাওয়া মানেই জেতা, আর কম খাওয়া বা কম খাবার ভাগ্যে জোটা মানেই, তাদের কাছে, হেরে যাওয়া। এসব মানুষের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে হয় না, এদের সামনে খাবার কিংবা খাবারের লোভ রেখে আপনি তাদের কাছ থেকে তাদের প্রিয় মানুষটিকেও ছিনিয়ে নিতে পারবেন, যে-কোনও কাজ করিয়ে নিতে পারবেন শুধু এই লোভটিকে তাদের সামনে রেখে। আপনি যদি কোনও সুন্দর জায়গায় ঘুরে এসে তাদের কাছে গিয়ে সেই জায়গার সৌন্দর্যবর্ণনা করতে যান, তখন সব কিছু ডিঙিয়ে তারা প্রশ্ন করবে, ‘তা ওখানে তোমাকে কী খেতে দিল?’ কিংবা ‘সেখান থেকে আমার জন্য হাতে করে কিছু খাবার জিনিস না নিয়েই ফিরে এলে!’ হা হা হা…। দুই। মেয়েদের প্রতি করা পুরুষদের সবচাইতে প্রিয় প্রশ্নগুলির একটি হলো: ‘তুমি কি ভার্জিন?’ যা-ই হোক, আমরা সেদিকে না যাই। আপনি ছেলে কিংবা মেয়ে যা-ই হোন না কেন, ধরে নিলাম, আপনি ভার্জিন। খুব কষ্ট করে নিজেকে ধরে রেখেছেন, তাই না? খুবই ভালো কথা। আমি আপনাকে সম্মান করছি এইজন্য যে, এটা অবশ্যই বেশ কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার, অন্তত এই ফেইসবুকের যুগে এসে। নিজের ভার্জিনিটি নিয়ে আপনি অহংকার করেন প্রায়ই, সেটার আবার প্রমাণও দিতে চান কথায় কথায়! (ইয়ে মানে, ভার্জিনিটি না হারিয়ে ভার্জিনিটির প্রমাণ দেবেনটা কীভাবে! মেডিকেল সায়েন্স বলে, হারিয়েও আপনি সে প্রমাণটা দিতে সক্ষম না-ও হতে পারেন। অর্থাৎ, আপনি প্রথমবার ভার্জিনিটি হারিয়েও নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করতে পারবেন না যে আপনি ভার্জিন ছিলেন!) তা আপনি যে আপনার বাড়ির কাজের লোকের গায়ে প্রতিনিয়তই হাত তোলেন, ড্রাইভারের চাকরি প্রতিদিনই মুখে মুখে নট করে দেন, মেয়েদের রাস্তায় দেখলে উলটাপালটা কমেন্ট করেন, টিচারদের আড়ালে শালা/শালি বলে ডাকেন, এসব নিয়ে প্রকাশ্যে লজ্জা প্রকাশ করবেন কবে? না কি, ভার্জিনিটি ঠিক তো জগত ঠিক? তিন। আপনার প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার শরীর থেকে হালকা ঘামের গন্ধও আপনাকে জাজমেন্টাল হতে বাধ্য করে, অথচ সেই মানুষটা কতগুলি টিউশনি করে কিংবা সবে শুরু করা চাকরি শেষ করে একসমুদ্র ক্লান্তি নিয়েও আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন, সেটা নিয়ে তো আপনাকে খুশি হতে দেখি না। ওহ্, ভালো কথা, জেনে রাখুন, আপনাদের অনেকেরই বেকার প্রেমিক কিংবা প্রেমিকাই কিন্তু বাবার টাকায় কেনা পারফিউম মেখে আপনার সাথে দেখা করতে যায়। ঘামওয়ালা কর্মঠ পার্টনার, না কি ঘামের ঘ্রাণ, (যে মানুষ পরিশ্রমী, তার ঘামের গন্ধকে ‘ঘ্রাণ’ বলার মধ্যে আমি কোনও দোষ দেখি না।) কোনটির সাথে আপোশ করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। আর যাকে ভালোবাসেন, তার গায়ের ঘামটা সহ্য করতে না পারলে তাকে ভালোবাসার কোনও অধিকারই নেই আপনার! নিজেই ভাবুন না, এ কেমন ভালোবাসা আপনার? আরও একটা কথা। বেকারের জেন্ডার কিন্তু শুধু প্রেমিক না, প্রেমিকাও হয়। কীভাবে? যেই মেয়ে যোগ্যতা আর সুযোগ থাকার পরেও ঘরে বসে বসে কোনও কাজ না করেই সারাদিন সিরিয়াল দেখে, (ইয়ে মানে, রিপিট-টেলিকাস্টও দেখে!) বাবা-মায়ের সাথে তুচ্ছ তুচ্ছ কারণেও ঝগড়া করে, প্রেমিকের টাকায় চলে ফিরে, একইসাথে চার-পাঁচটা ফেইসবুক আইডি দিয়ে ছয়-সাতটা প্রেম করে, এরকম প্রেমিকাকে কি অথর্ব অপদার্থ বেকার বলা যায় না? এ কেমন বোধ আপনার যে, এইটুকু সত্যকথা আপনি নিজেই বলতে পারেন না? চার। আপনার প্রাক্তন যদি তার বর্তমান পার্টনারের সাথে ছবি দিয়ে ‘আই কান্ট ডেসক্রাইব হাউ মাচ আই লাভ/মিস ইউ!’ এই ধরনের ক্যাপশন দেয়, আর সেটা দেখে যদি আপনার ঘুম হারাম হয়ে যায়, তবে আপনাকে কানে কানে একটা কথা বলি? বহু বহু প্রাক্তন এরকম ছবি দেয় শুধুমাত্র আপনার মতন একজন প্রাক্তনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে! এই বিষয়টা একটু অন্যভাবে বলি। ধরুন, আপনার প্রাক্তন একজন সিনেমার পরিচালক। উনি কয়েক দিন পর পর সিনেমা বানানই শুধুমাত্র আপনাকে দেখানোর জন্য! (এটা একটা হাস্যকর, কিন্তু সত্য উদাহরণ! এমন হয়, ভালো করে খেয়াল করুন।) তাহলে, যে ছবিটা আপনার জন্যই কষ্ট করে বানানো হয়েছে, নিজেদেরকে হাসিখুশি দেখানোর কোনও কমতিই যে ছবিতে নেই, সেটার ক্ষেত্রে আপনি কী করবেন? আপনিই তো সেই ছবির একমাত্র দর্শক! কী দরকার তা দেখার? কবেকার কোন এক্স, ওয়াই, জেড এসব দেখার কী মানে? এইসব হুদা-বেহুদা ব্যাপারে অ্যালফ্যাবেট ভুলে যাওয়াই সবচেয়ে ভালো! তার ভালোও দেখতে যাবেন না, মন্দও দেখতে যাবেন না। কিছুদিন সময় নিন। তারপর এমন একটা স্টেইজ আসবে, যখন ওসব দেখে বুকের ভেতর জ্বলা তো অনেক দূরের কথা, আপনার কাছে মনে হবে, ‘কীসব পাগলামি করতাম ছোটোবেলায়! হা হা হা…।’ আসবেই এমন স্টেইজ, হয়তো কিছু কাঠখড় পোড়াতে হবে, এই যাহ্! হলে হোক! যেদিন ওই পরিচালক, মানে আপনার প্রাক্তন, আপনার মনের এই স্থিরতা ধরতে পারবেন, বিশ্বাস করুন, উনি অমন সব সিনেমা বানানোই বন্ধ করে দেবেন। তখন আসল সিনেমাটি আপনি দেখাবেন---সিনেমা বানানোই বন্ধ করে দিয়ে! সেই সময়টা আসা পর্যন্ত একটু দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করুন না! জীবনে কত এক্সপেরিমেন্টই তো করলেন, এটাও করে দেখুনই না কী হয়! পাঁচ। যতদিন পর্যন্ত আপনি নিজের ছোটোখাটো মন খারাপকে ডিপ্রেশন, আর অন্য মানুষের ডিপ্রেশনকে মন খারাপ বলে বলে গা বাঁচিয়ে যাবেন, অর্থাৎ ‘ডিপ্রেশন’-এর মতন একটা ব্যাপারকে না জেনে-বুঝে যেখানে সেখানে যে-কোনও সময় যথেচ্ছ ব্যবহার করে যাবেন, মনে রাখুন, ততদিন পর্যন্তই আপনি নিজের জন্য একটু একটু করে ফাঁদ পেতে যাচ্ছেন, যে ফাঁদে শেষসময়ে আপনি নিজেই আটকা পড়বেন! আর ততদিন পর্যন্ত কোনও ধরনের মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলার কিংবা শোনার বেলায় আপনি থেকে যাবেন একটি নাদান শিশু! ছয়। যেই মানুষটা জীবনের সব বিষয়কেই ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’-এর মাঝামাঝিই রাখেন, তাকে আপনি আপনার জীবনে রেখেছেন কী করতে? এমন ছাগলের সাথে চলার চাইতে একলা চলা অনেক ভালো। সাত। ধরুন, আপনারা দুজন মানুষ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাবার সময় বিপদে পড়লেন। আটকে রাখা হলো দুজনকেই। আটকে রইলেন, কিন্তু দুজন রইলেন দুই জায়গায়। এদিকে, আপনি স্বাভাবিকভাবেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেখান থেকে বেরোতে। তো, বহু চেষ্টার ফলে, অনেক দিন পরে হয়তো আপনি মুক্তি পেয়েও গেলেন, আর এটা ধরে নিলেন, আপনার অতীতের সাথীও একই নিয়মেই পালিয়েছে। আপনি মুক্ত হয়ে বাড়ি গিয়ে জানতে পারলেন যে আপনার সঙ্গী সুযোগ পেয়েও বাড়ি না ফিরে একটা স্টুপিডের মতন আপনার অপেক্ষায় ওখানেই রয়ে গেছে! ওরকম একজন মানুষকে ফেলে এসে যে আপনি ভুল করেছেন, এখনও তা বুঝতে পারেননি, তাই না? ভালো, খুবই ভালো! সময় হোক, ভুলের মাশুল আপনাকে দিতেই হবে! আট। আপনার জীবনে যা-ই ঘটে যাক না কেন, কখনওই একজন সাইকোপ্যাথের সাথে থাকবেন না। আমাদের জীবনে সবচাইতে বাজে কিছু যা ঘটতে পারে, তা হচ্ছে মৃত্যু, তা-ই তো মনে হয়, তাই না? একজন সাইকোপ্যাথের সাথে থেকে গেলে আপনি প্রতিটি মুহূর্তে যে অসীম যন্ত্রণা ভোগ করবেন, তার চাইতে অনেক অনেক অনেক ভালো প্রয়োজনে মৃত্যুর মুখোমুখি হবার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে হলেও তাকে ছেড়ে চলে আসা, নিজেকে তার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা। মরলে, বার বার মরার চাইতে একবারই মরা ভালো! যে মুহূর্তে বুঝতে পারবেন, আপনার বন্ধু কিংবা পার্টনারটি সাইকোপ্যাথ, সে মুহূর্তেই, দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে যে-কোনও মূল্যে তার সঙ্গ ত্যাগ করুন।