‘জানলার ওপারে কদমগাছ। তার বাঁপাশে সগর্বে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা জারুলগাছে দুটো জারুল ফুল দেখা যাচ্ছে। তারও পেছনে একটা বাঁশবাগান। সেই বাগানের মাথার উপর কাজলাদিদির সেই পুরনো চাঁদটি। আকাশের কালচে নীল গালিচায় হরেক তারার কারুকাজ। দেখে মনে হয়, চাঁদের যেন কয়েক গজ দূরেই একটা শুকতারা। দখিনমুখী জানলাটার গ্রিলে দু-চারটা ইচ্ছের স্বেচ্ছানির্বাসন। রাত্রির সারাগায়ে লেপটে-থাকা চিরমুক্তির সুখী সুরে কোনও বিষাদী গানের কানাকানি। হে পৃথিবী, আমায় বাঁচিয়ে রেখেছ অনেককাল। তোমায় ধন্যবাদ।’ ঘড়ির কাঁটায় ভোররাত তখন ঠিক চারটা। চিরকুটটা লিখেই ফেইসবুকে পোস্ট করে নাতাশা ফ্যানের সাথে ঝোলানো ওড়নায় নিজের ধরটাকে শক্ত করে আটকে দিয়ে পায়ের তলার টুলটাকে দুপায়ের ধাক্কায় সরিয়ে টুপ করে ঝুলে পড়ল। নিথর নিস্তব্ধ নাতাশার শরীর ঝুলে আছে ফ্যানের সাথে আটকানো ওড়নার ফাঁসে। ২০০৮ সালের পহেলা বৈশাখ। নাতাশা লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরেছে। চুলে খোঁপা করে গুঁজে দিয়েছে একটি লাল গোলাপ। কপালের টিপটিও লাল। ওই শ্যামা অঙ্গে যেন দেবী সরস্বতীর অবতারণা ঘটেছে। শীতের সকালের ঘাসে টুপটাপ পড়া শিশিরবিন্দুর মতো নাতাশার শরীরে তখন যৌবনের ভিড়। সদ্য কিশোরী বয়সে পা-ভেজানো নাতাশার ঠোঁটে সারাক্ষণই ভর করে রাজ্যের যত হাসির ঢল। কাজলে-ঠাসা চোখের পাতা যেন পদ্মাপারের মায়াবী চর। সাথে থাকা বান্ধবীদের নিয়ে কলেজমাঠের একটা জায়গায় বসে সে ইলিশে কামড় দিচ্ছে, পান্তা খাচ্ছে, আর খানিক পর পর কীসব কথার ছলে খিলখিল করে হেসে উঠছে। তাদের থেকে দুই-তিন গজ দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসবই খেয়াল করছিল এক সদ্যকিশোর। তার চোখ আটকে আছে নাতাশার দুষ্টু দুষ্টু মিষ্টি হাসির রহস্যময় ছকে। এত কোলাহলের ভিড়ে ওই এক কিশোরীতেই আটকে গেছে কিশোরের দুচোখ। আহা, কেমন এক মায়ায় ঠাসা ওই কিশোরীর সারাঅঙ্গ! বেখেয়ালে চুলের ফাঁক থেকে আলগা হয়ে খোঁপার ফুলটা টুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। কিশোরীর দল ফুর্তিতে ব্যস্ত থাকায় সেসবে অত খেয়াল নেই তাদের। নাতাশাকে লক্ষ করে থাকা সেই কিশোরের নাম হিমু। হিমু ধীর পায়ে এসে নাতাশার পেছনে দাঁড়িয়ে মাটিতে পড়া গোলাপটাকে কুড়িয়ে নিল। গোলাপে থাকা বালি ঝেড়ে এক হাতে ফুল নিয়ে আর-এক হাতে নাতাশাকে আলতো ছুঁয়ে ডেকে বলল, ‘এই নিন, আপনার খোঁপার ফুল মাটিতে পড়ে গিয়েছিল।’ নাতাশা তড়িঘড়ি করে খোঁপায় হাত দিয়ে দেখল, আসলেই তার ফুলটি খোঁপায় নেই। মৃদুহাসিতে দুজনের চোখাচোখি হলো। নাতাশা পটিয়া কলেজে এইচএসসি সেকেন্ডইয়ারে পড়ে। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। সে বাড়ির বড়ো মেয়ে। বাবা একটা মুদি দোকান চালায়। ছোটো এক ভাই, এক বোন। কোনওমতে টেনেটুনে চলতে পারার মতো অভাবী সংসার। ক্লাস নাইন থেকেই নাতাশা টিউশন করে হাতখরচ ও নিজের টিউশন ফি জোগাড় করে। কয়েক মাস পরেই তার পরীক্ষা। হিমু পাশের গ্রামে থাকে। বৈশাখী মেলায় দেখার পর থেকেই নাতাশার প্রতি একধরনের ভালোলাগা কাজ করে হিমুর। দুজনের বাড়িই পটিয়াতে। প্রথমদেখার পর থেকেই হিমু নাতাশার খোঁজখবর নিতে শুরু করে। বন্ধুদের মারফতে খোঁজ পেয়েও যায়। কলেজের সময় হিমু নাতাশার যাবার পথে দাঁড়িয়ে থাকতে শুরু করে। যতক্ষণ নাতাশার কলেজ শেষ না হয়, ততক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকে সে। নাতাশাও ধীরে ধীরে টের পায় ব্যাপারটা। দুজনের চোখাচোখি হয়, মাঝেমধ্যে চোখে চোখে হাসির ছকে কথা বলাবলিও চলে। কথা না হয়েও অনেক কথা হয়ে যায় চোখে চোখে। চোখের ভাষায় নামে হরেক কথার বান। সেদিন সোমবার। নাতাশা কলেজে যাবার সময় পেছন পেছন হাঁটতে থাকে হিমু। নাতাশাকে দেখার জন্য রাস্তার পাশে বা কলেজগেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও কখনও সরাসরি কথা বলার সাহস কুড়িয়ে উঠতে পারেনি হিমু। নাতাশার সাথে কথা বলবে বলবে করে সে পার করে দিয়েছে চার-পাঁচ মাস। অনেক দিন ধরে নিজেকে সাহস জুগিয়ে আজকে মনের সব কথা খুলে বলবে বলে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে হিমু। নাতাশা অবশ্য ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুচকি মুচকি হাসে, আর না বোঝার ভান ধরে। কলেজগেইটের সামনে নাতাশার পথ আগলে তার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়েই সেখান থেকে লজ্জায় ভোঁ দৌড় দিয়ে পালাল হিমু। কাগজটি খুলে দেখে নাতাশা। ওতে লেখা, ‘আপনাকে ভালো লাগে, না মানে, ভালোই বাসি। চলবেন ওই পথ ধরে একসাথে?’ সাথে একটা মোবাইল নম্বর লেখা। নাতাশা মৃদু হাসে। কাগজে লেখা নম্বরটা টুকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকে যায়। ক্লাস থেকে ঘরে ফিরে কাগজের নম্বরটাতে ফোন করে নাতাশা। ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে হ্যালো শব্দ। হয়তো সে বুঝতেই পেরেছিল যে নাতাশাই ফোন করবে। সেদিন থেকে পরিচয়টা পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে আরও একটু দূরে গড়াল। পরিচয়পর্বে জানা গেল, হিমু নাতাশার এক বছরের ছোটো। সে এইচএসসি ফার্স্টইয়ারে পড়ে, আর নাতাশা সেকেন্ডইয়ারে। নাতাশা হিমুর এক বছরের সিনিয়র, সেটা হিমু নাতাশার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার সময় জানতে পেরেছিল। তবুও নাতাশাকেই তার ভালো লাগে। নাতাশাকেই তার চাই। নাতাশারও কেন জানি অদ্ভুত কোনও এক কারণে হিমুকে বেশ ভালো লেগে গেল। নাতাশাকে একপলক দেখার জন্য ক্লাস না করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাতাশার কলেজ যাবার রাস্তায় কড়া রৌদ্রে হিমু দাঁড়িয়ে থাকত। কেমন মায়া মায়া চোখে একপলকে তাকিয়ে থাকত সে। ওই দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক পবিত্রতা ছিল। কখনও কখনও লজ্জায় মুখও লুকিয়ে ফেলত। ওসব দেখে নাতাশার হিমুর জন্য মায়া জন্মে যায়। নাতাশারও ভালো লাগতে শুরু করে হিমুকে। সেদিনের ফোনকলের পর থেকে দুজনের কথার ঢল বাড়তেই থাকে। সিদ্ধান্ত হয়, ওরা দেখা করবে কোনও কুলিংকর্নারে। দুজনে দেখা করে। সেদিন রবিবার ছিল। কলেজের পাশে একটা কুলিংকর্নারে দেখা করে ওরা। দুজন মুখোমুখি বসে। হিমু প্রচণ্ড লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। নাতাশাও ঠিক ওর দিকে তাকাতে পারছে না। কেমন একটা জড়তা। নীরবতা ভেঙে নাতাশাই কথা বলে ওঠে। ‘দেখো, তুমি তো আমার জুনিয়র, তুমি যেটা চাইছ, সেটা কী করে হবে, বলো তো?’ কথাটা শুনে হিমুর চোখে মুখে অসহায়ত্বের ছাপ দ্বিগুণ থেকে বেড়ে তিনগুণ হয়ে গেল। নাছোড়বান্দার মতো হুট করে টেবিলে রাখা নাতাশার হাত দুটোকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অসহায়ত্বভরা চোখে নাতাশাকে ধরাগলায় বলতে লাগল, ‘প্লিজ, না করবেন না! আমি আপনাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না, আপনাকে ছাড়া আমার পুরো দুনিয়াটাই নিরর্থক লাগে!’ বলেই ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে ফেলল। সে কেমন জানি নাতাশার দৃষ্টি থেকে চোখ লুকাতে চাইছে এপাশ ওপাশ করে, কিন্তু ঠিক পেরে উঠছে না। নাতাশা খেয়াল করল, হিমুর চোখ বেয়ে টপটপ জলের ফোঁটা পড়ছে মাটিতে, আর হিমু আপ্রাণ চেষ্টা করেই যাচ্ছে জল লুকিয়ে কান্না গিলতে। নাতাশা বুঝল, এই ছেলেটির চোখজোড়া থেকে ঝরে-পড়া প্রতিটি জলবিন্দুতে মিশে আছে তার প্রতি ভালোবাসার সুগভীর সমুদ্র। এই সমুদ্রে নাতাশা ডুবে যেতে পারে অনায়াসেই। এই জলে কোনও ছলচাতুরি নেই, নেই কোনও কপটতা। এই জলের প্রতি কণায় কণায় জমে আছে না-পাওয়ার শঙ্কা, ভালোবাসার তৃষ্ণা। এই জল অকৃত্রিম, এই জল খাঁটি। এবার নাতাশার মনটা মোমের মতো গলে একাকার হয়ে গেল। মেয়েমানুষ পৃথিবীর এই একটা জায়গায় সবচাইতে বেশি দুর্বল। ওরা বিশুদ্ধ কোনও ভালোবাসার সন্ধান পেলেই ওটাকে দুহাতে আগলে ধরে যুগ যুগ বেঁচে থাকতে চায়। কীভাবে যেন ওরা বুঝতেও পারে ভালোবাসার গাঢ়ত্ব। স্রষ্টা ওদের হৃদয়টাকে অনুভব করতে পারার অসীম ক্ষমতা দিয়ে বানিয়েছেন। এই ক্ষমতা দিয়ে ওরা ঠিক বুঝে যায়, কে তাকে সত্যিই ভালোবাসে, আর কে তাকে কেবলই ছুঁয়ে যেতে চায়। কিশোর বয়সের হিমুর মনপ্রাণ জুড়ে কেবলই নাতাশা। তার পৃথিবী বলতেই নাতাশা। এই কিশোর বয়সটাই আসলে কেমন একটা ভয়ংকর সময়। এই বয়সে ভালোবাসলে সে ভালোবাসার গভীরতা সমুদ্রের গভীরতার চেয়েও বেশি হয়। প্রথম ভালোবাসার মতো হৃদয় তোলপাড়-করা জিনিস পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। হিমুর সেই নিখাদ ভালোবাসায় সাড়া দেয় নাতাশা। হিমুর হাত দুটোতে হাত রেখে তার চোখের জল মুছে দেয়। সেদিনের পর থেকে দুজনের পরিচয়পর্বটা প্রণয়ে পরিণত হলো। সেই থেকে ওদের দুজনের একসাথে পথচলার শুরু। এই প্রেম বড়ো বিচিত্র জিনিস। প্রেম পৃথিবীর কোনও নিয়ম মানে না, মানে না কোনও আইন বা বিধিনিষেধ। প্রেম বড্ড অন্ধ। প্রেম সকল নিয়মের ঊর্ধ্বেই থেকে যায় শেষপর্যন্ত। যে প্রেম নিয়ম মেনে, হিসেব কষে হয়, সেটা প্রেম নয়, বড়োজোর চুক্তি বা ব্যবসা। বেশ ভালোভাবেই চলছে নাতাশা হিমুর প্রেম। কলেজশেষে দুজনের একসাথে হাঁটাহাঁটি। কুলিংকর্নারে বসে চোখাচোখি। দুজন দুজনের হাত ধরে আজীবন একসাথে পথচলার অঙ্গীকার। প্রতিদিনই চলে পরের দিনের, পুরো জীবনের স্বপ্নবুননের কারুকাজ। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা কলেজের পরিচিতদের কাছে জানাজানি হয়। যারাই জানতে পারে ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে, তারাই মুখে সরাসরি কিছু না বললেও আড়ালে মুখ টিপে টিপে হাসে, যদিও নাতাশা-হিমুর ওসব নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই। সামনের মাসেই নাতাশার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। এদিকে নতুন প্রেমের ঝড়ো হাওয়ায় তার মনটা ভীষণ উতলা। সেই উতলা মনে পড়ালেখার জায়গা ততটা হচ্ছে না। সারাক্ষণই হিমুর কথা তার মনে ঘুরঘুর করে। যেন মাথায় কোনও মগজই নেই, এক হিমুতেই টইটম্বুর। মোটামুটি ভালো ধাঁচের স্টুডেন্ট নাতাশা, ওকে কিছুতেই খারাপ ছাত্রী বলা যায় না। এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ গ্রেড পেয়ে পটিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছে। এবার কপালে কী আছে, কে জানে! পরীক্ষার জন্য পড়ায় মন বসাতে চেয়েও সে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। হিমুর অনুরোধে তা-ও সে পড়তে বসে। নয়াপ্রেমের হাওয়া কি আর অত সহজে মাথার মগজ ছাই না করে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? তার উপর কৈশোরের প্রথম প্রেম। এ বয়সের প্রেম তো বৈশাখের দমকাহাওয়া কিংবা সমুদ্রতলের টর্নেডো থেকেও বেশি শক্তিধর! কোনওমতে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করল সে। এর মধ্যে হিমুর সাথে প্রেমের সম্পর্কের কথা পাড়ায় জানাজানি হয়ে গেল। পাড়ার যে মুরব্বিরা জানতে পেরেছেন, তাঁরা সবাই অনেকটা ব্যঙ্গ করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথাবলা শুরু করলেন। নাতাশার বাবা প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে মেয়েকে ভীষণ মারলেন। অথচ আদরের এই মেয়েটির গায়ে কখনও একটি ফুলের টোকাও লাগতে দেননি বাবা। বাড়ি থেকে নাতাশাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হলো, সে হয় হিমুর সাথে সম্পর্ক ছাড়বে, নয়তো তাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে। এদিকে নাতাশা হিমুকে ছাড়তে পারবে না কিছুতেই। ‘ভালোবাসার সাহস’ বলে একটা ব্যাপার আছে। এই সাহসের উপর ভর করে নাতাশা সিদ্ধান্ত নিল, সে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাবে এবং শহরের যে-কোনও একটা কলেজে ভর্তি হবে। টিউশনির জমানো টাকা হাতে নিয়ে নাতাশা শহরের হোস্টেলের খোঁজ নেয়। খোঁজখবর নিয়ে চকবাজারের এক হোস্টেলে উঠে যায় সে। পাশাপাশি টিউশনি খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল। এর মধ্যে এইচএসসির রেজাল্ট বের হলো। সে এবারও এ গ্রেড পেয়ে পাস করে। ওদিকে হিমুর পরিবারও নাতাশার সাথে সম্পর্কের কথা জানতে পেরে ওকে মানসিক নির্যাতন শুরু করে দেয়। ওরা আর্থিকভাবে বেশ অসচ্ছল। হিমু মেধাবী ছাত্র। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে সে কমার্স গ্রুপ থেকে গোল্ডেন এপ্লাস পেয়েছে এসএসসিতে। সামনে সে এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। এর মধ্যে বাড়ি থেকে হিমুকে কোনও প্রকার হাতখরচ বা টিউশন ফি দিতে পারছে না, কিংবা পারলেও দিচ্ছে না তার অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কের জেরে। অথচ সামনেই ওর পরীক্ষা। নাতাশা ব্যাপারটা জানতে পারে। হিমুর আর্থিক দুরবস্থার কথা জেনে নাতাশা আরও টিউশন ধরে। টিউশনের টাকা থেকে হিমুর পড়াশোনার খরচ পাঠাতে লাগল সে। এভাবে নাতাশা চট্টগ্রামের মহসীন কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়। পারিবারিক ও সম্পর্কজনিত এত ঝামেলায় পড়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চান্স হয়নি। আসলে পড়াশোনার সুযোগটাই সে পায়নি। ওদিকে হিমুর পড়াশোনার যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে হিমুকে প্রতিমাসেই টাকা পাঠাতে থাকে নাতাশা। নিজের সমস্ত খরচও চালাতে হয় তাকে। এভাবেই দিন কেটেই যাচ্ছে। হিমু পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী। সে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়। যথারীতি এইচএসসিতেও সে ভালো রেজাল্ট করে। এপ্লাস পায়, তবে গোল্ডেনটা মিস হয়ে যায়। এবার পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নেবার সময়। ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য ভর্তিকোচিংয়ের টাকা দরকার। নাতাশা একটু একটু করে সেই টাকাও জোগাড় করে নেয়। পটিয়ার একটা কোচিংয়ে ভর্তি হয় হিমু। এভাবে কয়েক মাস পেরিয়ে যায়। ভালোবাসা আর দায়িত্ব দুজনেরই অনেক বেড়ে যায়। এ কয়েক মাসে সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়। হিমু দিন-রাত এক করে পড়তে থাকে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে যে সময়টা পায়, সে সময়টায় নাতাশার সাথে সে কথা বলে। আজীবন পাশাপাশি থাকার প্রত্যয়ে ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে দুজনে। দিন মাস পেরিয়ে হিমুর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ক্ষণ চলে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় সে। যাতায়াত, থাকাখাওয়া থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসংক্রান্ত যাবতীয় যা-কিছু খরচ, তার প্রতিটি পয়সাই নাতাশা দেয়। হিমুর এই সাফল্যে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় নাতাশা। অবশ্য হিমুর সাফল্যের পেছনে সবচাইতে বড়ো অবদানটা নাতাশারই। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। দুজনেই খুব খুশি। নাতাশার সাথে তার পরিবার তেমন একটা যোগাযোগ রাখেনি। সে বেঁচে আছে কি মরে গেছে, তারও খোঁজ পরিবারের কেউ রাখে না। নাতাশা কখনও খোঁজ নিতেও ফোন করলে ওর গলা চিনতে পেরে কল কেটে দেয় পরিবারের লোকজন। পরিবারকে বিসর্জন দিয়ে নাতাশাকে তার প্রেম বাঁচাতে হয়েছে। দুজনেই সারাদিন ফেইসবুকে চ্যাটিং আর কথাবলায় সময় কাটিয়ে দেয়। সেই সকাল থেকে রাত অবধি নাতাশা-হিমু যেন একই সুতোয় গাঁথা বেলিফুলের মালা। দুজন দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে ঘুমুতে যায়। আবার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে দুজনের প্রতিদিনের সকাল শুরু হয়। ওদের প্রেম যেন সাগরের তল ছুঁই ছুঁই। হিমু ভার্সিটির হলে সিট পায়। ওর যা হাতখরচ, তা নাতাশাই পাঠায়। ঢাকা শহরে টিউশন পাওয়া সহজ নয়, তার উপর নতুন শহরে অ্যাডজাস্ট করে নিতে হিমুর একটু সময় লাগছে। আস্তে আস্তে শহরের অলিগলি চিনে নিলে সব কিছু সে মানিয়ে নিতে পারবে। নাতাশা এখন অনার্স দ্বিতীয়বর্ষে, হিমু প্রথমবর্ষে। ভালোই চলছে জীবন। প্রথমবর্ষের শেষের দিকে করে হিমু দুটো টিউশন জুটিয়ে নেয়। এবার সে নিজের খরচের দায়িত্বটা নিজের হাতে নিল। এভাবে কেটে গেল দুই বছর। হিমু তৃতীয়বর্ষে, আর নাতাশা চতুর্থবর্ষে। অনার্স কমপ্লিট করে দুজনে বিয়ে করে নেবে, এমন সিদ্ধান্ত হয় অনেক আগেই। দিনগুলি যাচ্ছিল ভালোই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জার্নি করে নাতাশা হিমুকে দেখতে ঢাকায় যায়। কখনওবা হিমুই আসে চট্টগ্রামে। এভাবে ওদের মাঝেমধ্যে দেখা হয়। নাতাশা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখি করে ভালো। লেখার হাত ওর দারুণ। হিমুকে উৎসর্গ করে সে অনেক কবিতা, গান লিখেছে। তার ডায়েরির পাতায় পাতায় কবিতার ছড়াছড়ি। সব কবিতারই পেছনের মানুষটা হিমু। ফেইসবুকেও কবিতা পোস্ট করে মাঝেমধ্যে। ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে দিন মাস বছর বদলায়। সেই রেশ ধরে কখনও কখনও মানুষের নিয়তিও বদলে যায়। সাথে বদলে যায় মানুষের পছন্দ অপছন্দ, রুচি অভিরুচিও। এমনকি বদলায় চিরপরিচিত মানুষটাও। ইদানীং হিমুকে বেশ ব্যস্ত দেখায় সব কিছুতে। ফোন করলে ওয়েটিং দেখায়। ফোন ধরলে সে ব্যস্ততা দেখায়, অল্প কথার পর কেটে দেয়। কেমন একটা অস্থির অস্থির ভাব। আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বললেও এখন কেমন জানি পাঁচ-দশ মিনিটেই তার কথার সমুদ্র শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায়। কথার পিঠে কথা বুনত যে কথার জাদুকর, আজকাল তার মুখে কথাই যেন আসে না। নাতাশার সাথে করার মতো তার কোনও গল্পই যেন আর নেই হিমুর। আগের মতো কথার মাঝে সেই পুরনো টান, পুরনো কথার তুবড়ি কিছুই যেন আর নেই। আগে নাতাশার সাথে দেখা করার জন্য যে পাগলামিগুলো ছিল তার, ওসবের কিছুই যেন আজ আর নেই। নাতাশার প্রতি এখন কেমন একটা উদাসীনতায় ভরা হিমুর আপাদমস্তক। যে মানুষটির সাথে তার এক ঘণ্টায় দুবার কথাবলা হয়ে যেত, এখন দু-তিন-চার ঘণ্টা বা সকাল পেরিয়ে রাত ঘনালেও সে মানুষটির আর খোঁজ নেয় না হিমু। নাতাশা ফোন করলেও কেমন একটা ব্যস্ত ব্যস্ত ভাব। নাতাশা বুঝতে পারল তার জীবনে নতুন ঝড়ের দমকাহাওয়ার আভাসটি। সাজানোগোছানো একটা ছনের ঘরে হঠাৎই এমন অশনিসংকেত! সেই সংকেত শব্দহীনভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে অনেক ধরনের শব্দের গভীরতা। হিমু আর আগের মতো নেই। নাতাশার প্রতি তার উদাসীনতা বেড়েই চলছে দিন দিন। প্রচণ্ড ভালোবাসার মানুষটির উদাসীনতা বেঁচে থেকে সহ্য করা যায় না। এটা বোধহয় সব থেকে কঠিন কাজ। এর চেয়ে বরং মরে যাওয়াও অনেক সহজ। নাতাশার ডায়েরি-লেখার অভ্যাস বেশ পুরনো। জীবনে ঘটে-যাওয়া নানান কিছু সে জমিয়ে রাখে ডায়েরির পাতায় পাতায়। জীবনের যত হার-জিত, পাওয়া না-পাওয়া, কিংবা সুখ-অসুখের যত তাল-বেতাল সবই গচ্ছিত আছে কালো রংয়ের মলাটের ডায়েরিটায়। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় কিনেছিল শখ করে। সেই থেকে আনাফ্রাংকের ডায়েরির মতোই নাতাশার নিজের ডায়েরিটা হয়ে ওঠে তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অনুষঙ্গ। সব কথা সবাইকে বলা যায় না, সব কথার মর্মার্থ সবাই বুঝতে পারে না। পৃথিবীতে এমনও অনেক কথা আছে, যা একমাত্র নিজেকে ও নিজের ডায়েরিকে ছাড়া আর কাউকেই বলা যায় না। যে শব্দের ব্যাপ্তি আমার কাছে সমুদ্রের চেয়েও বিশাল, সে শব্দটিই হয়তো অন্যের কাছে কয়েকটি অক্ষর মাত্র। কী হয় কাউকে অত সব বলে? তার চাইতে বরং কিছু কথা, কিছু অনুভূতি নিজের কাছেই বড়ো যত্ন করে রেখে দেওয়া ভালো। নাতাশা লিখতে থাকে। লিখতে লিখতে পাতা ফুরায়, তবুও কথা ফুরায় না। রাত গভীর হলে সে হিমুকে ফোন দিয়ে জানতে চাইত সারা দিনে সে কী করল না করল, সারা দিন কী দেখল, কী শুনল, কী খেল না খেল। দিনের শুরু থেকে রাতের গভীরে গিয়ে কথার গায়ে কথার ঝুড়ি হুমড়ি খেয়ে পড়ত একসময়। অথচ আজকাল হিমুর নাকি রাত নামলেই ভীষণ ঘুম পায়। কথাবলার কথা খুঁজে পায় না। এখন হিমুর কণ্ঠে নাতাশার জন্য কথা জন্মে না, জন্মে কপালের মাঝখানটায় কুঁচকানো বিরক্তির বলিরেখা। যে সমস্ত কথা হিমুকে বলার সুযোগ নাতাশার আজকাল হয় না, সে কথাগুলি ডায়েরিকে বলা হয়। ডায়েরির পাতায় পাতায় জমে-থাকা বিষাদ আর অতৃপ্তির ঢেকুরে ঢেকুরে সাদা পৃষ্ঠাও কখনও কখনও নোনতাজলের দিঘি হয়ে ওঠে। ভালোবাসা বড়ো বিচিত্র জিনিস। ইচ্ছে করলেই যাকে তাকে ভালোবেসে ফেলা যায় না, আবার একবার কাউকে ভালোবেসে ফেললে ইচ্ছে করলেও তাকে ভালো না বেসে আর পারা যায় না। এই জগতের সবচেয়ে জটিল বিষয় মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য, অথচ ভালোবাসার রহস্য আরও শতগুণ বেশি জটিল রহস্যে ডোবা, সে রহস্য আজ অবধি উদ্ঘাটন করতে পারেনি পৃথিবীর কেউই। যুক্তির মুখের উপর বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে যে অসমবয়সি ছেলেকে ভালোবেসে ঘর ছেড়ে একাকী শহরের এক কোণের কানাগলিতে পড়ে আছে নাতাশা, আজ সেই ছেলেরই মনে নাতাশার প্রতি ভালোবাসা হয়তো হয়ে পড়েছে ঠুনকো। হয়তো আজকাল সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। আহা, এইসবও মেনে নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়! ভালোবাসা হাত বদলায়, এদিকে একজোড়া হাত ওই বদলে-যাওয়া সদ্যঅপরিচিত হাত দুটির দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকে। দুইজোড়া হাতের একটি জোড়া আলোয় নাচে, অপরটি অন্ধকারে হাতড়ায়। ভালোবাসার মানুষ আমাকে ভালোবাসে না, এইটুকুও মানা যায়, কিন্তু সে অন্য কাউকে ভালোবাসে, এটাও মানতে পারার মতো উদারমনের প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা বোধহয় সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেননি। একটা সময় হিমুকে কেন্দ্র করে নাতাশার কলমপ্রসূত কত শত কবিতার ঝরনা বইত, সেইসব কবিতার লাইনে লাইনে থাকত গভীর ভালোবাসা, অক্ষরে অক্ষরে থাকতো টইটম্বুর স্বপ্নের হাতছানি। এসব প্রেমময় কবিতা পড়ে হিমু কখনও-সখনও কেঁদেও ফেলত আনন্দে কিংবা বিষাদেও। আজকাল এমন সব কবিতাকে হিমুর কাছে বেখাপ্পা শব্দের বেঢপ আকৃতির জোড়াতালি মনে হয়। আহা, ভালোবাসা ফুরোলে বুঝি কবিতার পাতাও হয়ে যায় ঝালমুড়ির ঠোঙা। এভাবে হেলায় অবহেলায় দিন কাটছে। রাত্রি ফুরোচ্ছে। হয়তো হিমু ফিরবে আগের মতো করে। যার হাত ধরে ছেড়ে এসেছে ঘরবাড়ি, সমাজ, সে একদিন ফিরবে। এসব হয়তো তার সাময়িক হেঁয়ালি। ভোরে দূরদিগন্তে উড়ে-চলা ঘরছাড়া পাখিটিও তো সন্ধে হলে ঠিকই ঘরে ফিরে। আর হিমু তো মানুষ, সে তো ফিরবেই! এইসবই ভাবে নাতাশা। ভাবে আর বেঁচে-থাকার রসদ খোঁজে। সেদিন পনেরো এপ্রিল। নাতাশার জন্মদিন। নাতাশার জন্মদিনে সবচেয়ে বেশি উৎফুল্ল থাকত হিমুই। নাতাশা ভুলে গেলেও এই দিনটি হিমু কখনও ভুলে যায় না। অথচ সেদিন সকাল থেকেই হিমু বেশ ব্যস্ত। কী একটা নাকি কাজ আছে তার! অথচ একটা অলিখিত নিয়ম ছিল, পৃথিবীর যত কঠিন কাজই থাকুক, যত ব্যস্ততার স্তূপই থাকুক, এই দিনে রাত বারোটা থেকে সকাল অবধি টানা কথা হবে ওদের। আর সেদিন হিমুর সারা দিনই সময় মিলেনি। গোটা একটা জন্মদিনে সে একমুঠও সময় কুড়াতে পারেনি। নাতাশার কেমন যে বুক ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল! মনে হচ্ছিল, কেউ তার বুকের উপর বসে ছুরি দিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে কেটেকুটে কলিজাটা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটা ফোনকল, একটা মেসেজ, একটা হ্যালো শব্দ…এই কয়েকটা শব্দে মিশে আছে কত কত আবেগ, অনুভূতি। সামান্যই তো এসব! কিন্তু নাতাশার কাছে এসবই বিশাল এক-একটা সমুদ্রের সমান। অথচ হিমু? হিমু যে ভীষণ ব্যস্ত এখন! নাতাশার জন্য সময় তার ফুরিয়ে গেছে। পৃথিবীর প্রতিটি প্রেমের সম্পর্কেই কিছু-না-কিছু এক্সপেকটেশন থাকেই। প্রিয় মানুষটি থেকে বার্থডেউইশ কিংবা দু-একটা মধুর কথার আশা তো থেকেই যায়। তার উপর এমন একটা দিনে, যেদিন তার জন্মদিন, সেই দিনে তো একটু পরম ভালোবাসাও পেতে নাতাশার বড়ো ইচ্ছে করে। রাত সাড়ে চারটায় হিমুকে অনলাইনে দেখা যাচ্ছে। নাতাশা দ্বিধা ভেঙে ফোন করল। এত গভীর রাতে হিমু অ্যানাদার কলে বিজি। ধুক্ করে কেঁপে উঠল নাতাশার বুক। হিমুর এমন কোন জন থাকতে পারে, যার সাথে সে এত গভীর রাতে কথায় এমন ব্যস্ত? যার সাথে ব্যস্ততায় থেকে নাতাশার জন্মদিনের উইশটুকু করতেও ভুলে যেতে পারে সে? নাতাশা ভেবেছিল, সারা দিন ব্যস্ততার কারণে ভুলে গেলেও হয়তো শেষরাতে ফোনটা করে উইশ সে নিশ্চয়ই করবে। নাতাশা তাই অপেক্ষা করে ছিল। না, তা আর হয়নি। হিমু ফোন করার বদলে বরং ফোনে ব্যস্ত আছে অন্য কারও সাথে। পরিচিত বন্ধুবান্ধব, ফেইসবুকের লোকজন সবাই উইশ করেছে শুধু এক হিমু ছাড়া। অথচ হিমুর উইশটাই সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত ছিল তার কাছে। ভোররাত সাড়ে পাঁচটা। হিমু তখনও অনলাইনে। নাতাশা কল দিল। আবারও সে বিজি-লাইনে। মোবাইলে ফোন দিল, হিমু কলটা কেটে দিল। এবার নাতাশা বালিশে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠল। পৃথিবীটাকে তার কাছে অসাড় লাগছে। এভাবে রাত পেরিয়ে সকাল গড়িয়ে দুপুরে করে নাতাশার ঘুম ভাঙল। দেখল, সাড়ে এগারোটার দিকে হিমু একবার কল দিয়েছিল। শুধু একবারই। অথচ আগে সে একবার ফোনে না পেলে শতবার কল দিত। নাতাশা কলব্যাক করলে হিমু কেমন অপ্রস্তুত কণ্ঠে কথা বলছে। কেমন একধরনের জড়তা, ভয়। হয়তো রাতের ঘটনার কারণে সম্ভাব্য প্রশ্নের মুখোমুখি হবার ভয় কাজ করছে হিমুর মধ্যে। নাতাশা গতরাতের কোনও কথাই তুলেনি। খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে কথা শেষ করল। লাইন কাটার আগে একবার মনে করিয়ে দিল যে গতকাল তার জন্মদিন ছিল। হিমু ঠিকমতো কোনও কথা বলতে পারছিল না। খানিক সময়ের নীরবতা। কেউ কাউকে কিছু বলছে না। একসময় এপাশ থেকে নাতাশাই লাইনটা কেটে দিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, হিমু এরপর কলব্যাক করে একবারও ‘সরি’ বলেনি। নাতাশার ইদানীং খুব একা একা লাগে। দুজন মানুষ সম্পর্কে থাকার পরও যদি ওদের মধ্যে কারও একা লাগে, তবে ধরে নিতে হবে, ওরা একটা ভুল সম্পর্কে আছে। ভালোবাসা এমন একটা বিষয়, যা মুখে বলার প্রয়োজন পড়ে না, অনুভবে বোঝা যায়। চব্বিশ ঘণ্টায় চব্বিশ বার ফোন করে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে যারা, তারা আরও কাউকে কাউকে ওরকম করে ফোন করে। এই সহজ সত্যটাই বেশিরভাগ মেয়ে বুঝতে পারে না। যদিও নাতাশা ওরকম মেয়ে নয়, তবে সে অনুভবে ধরতে চায় তার প্রতি হিমুর টানটা, যা সে একসময় ধরতে পারলেও এখন আর পারে না। আজকাল নাতাশাও কিছু কিছু বিষয় বুঝতে পারছে। শুকিয়ে-যাওয়া নদীর চরের মতোই ভালোবাসাহীনতারও একধরনের স্পষ্টতা থাকে। নাতাশা তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাবা-মায়ের রাগ এত বছরেও কমেনি। বরং এত বছরে গ্রামে নানা কথা রটে গেছে। বয়সে ছোটো এক নাবালকের হাত ধরে শহরে পালিয়ে গিয়ে বিয়েশাদিও নাকি নাতাশা করে ফেলেছে। লোকের মুখে মুখে আরও রটেছে, শহরে গিয়ে নাকি দেহব্যবসায়ও নেমে গেছে নাতাশা। কে কে নাকি ওকে সরাসরি দেখেছে এই কাজ করতে। (যদিও এটা শুনে গ্রামের কেউ রটনাকারীদের জিজ্ঞেস করেনি, ‘তুমি ‘সরাসরি’ দেখলে কী করে, মিয়া?’) এজন্য নাকি সে গ্রামে আর আসে না। এসব কথার কূটজালে পরিবারের অন্যরা বাইরে বেরোতে পারে না। লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারে না ওরা। সমাজের চোখে উৎসন্নে-যাওয়া নাতাশার ওদের সমাজে আর ঠাঁই হবে না। এমন মেয়েকে সমাজে ঢুকতে দিলে নাকি সমাজের অন্য মেয়েদের চরিত্রও খারাপ হয়ে যাবে। (ভাবখানা এমন যেন এক নাতাশা বাদে ওই সমাজের প্রতিটি মেয়ের তথাকথিত চরিত্র ‘ফুলের মতো পবিত্র’!) তাই আগে থেকেই নাতাশাকে গ্রামে ঢুকতে না দেবার কারফিউ জারি হয়ে গেছে। এসব কথা সে জানতে পেরেছে তার ছোটো ভাই-বোনদের কাছ থেকে। লুকিয়ে লুকিয়ে ছোটো দুই ভাই-বোন মাঝে মাঝে কথা বলে নাতাশার সাথে। ওরা দুইজন ছিল নাতাশার কলিজার টুকরা।