আমার বাসাটা একটু উঁচুতে। পাহাড়ের ঠিক পাশেই, গাছ-পাখিদের কাছে, সবুজের সমুদ্রে। জানালার ধারে দাঁড়ালে আশেপাশের অনেক বাড়ির ছাদ দেখা যায়। অবশ্য আমি এসবের কিছুই তেমন একটা দেখি না। বদ্ধ ঘরের দেয়াল দেখতে দেখতেই আমার একঘেয়ে জীবনটা কেটে যায়। আজ সকালে কয়েকটা ছাদে দেখলাম, ইদের জামাত হচ্ছে। প্রতিটি দলে বারো পনেরো বিশ জন মানুষ। ঝকঝকে ধবধবে পাঞ্জাবি-পরা। প্রত্যেকের মুখে মাস্ক। ওঁরা নামাজ শেষে কোলাকুলি করছেন, হয়তো কুশলাদি বিনিময় করছেন। ছোটোদের সালামি দিতেও দেখেছি। এরপর যে যার ঘরে। কোভিড-নাইনটিনের সময়ে এর বেশি তেমন কিছুই করার নেই। দেখতে দেখতে কেমন জানি বিষণ্ণতা এসে ভর করল মনে। ধর্মীয় কারণে নয়, মানবিক কারণে। আমার মানুষকে খুশি দেখতে ভালো লাগে। যে যেভাবে খুশি থাকে অন্য কারও কোনও ক্ষতি না করে, সেটাই আমার কাছে ধর্ম---মানুষের ধর্ম। আর আজকের দিনটার জন্য যে মানুষ সারাবছর অপেক্ষা করে থাকে! সবাই একসাথে ঘুরতে বেরোবে, খাওয়াদাওয়া হবে, আনন্দফুর্তি হবে। নতুন পোশাকের রঙে হাওয়ায় হাওয়ায় জাগবে বর্ণিল উন্মাদনা। উৎসবের ঘ্রাণে মাতাল হবে চারিদিক। ছোটোরা বড়োদের কাছ থেকে সালামি পাবে। সে টাকা দিয়ে নিজেরা নিজেরা মজা করবে। কিছু গরিব মানুষ আজকের দিনে ভালো-মন্দ কিছু খেতে পাবে, অর্থসাহায্য পাবে। আজকের দিনে মানুষের জন্য মানুষের দ্বার থাকবে খোলা। আহা, আজকের দিনটার জন্য প্রতীক্ষা করে থাকে কত কত গরিব মানুষ! মসজিদে ইদের জামাত হচ্ছে। যে নামাজে ধনী গরিবের কোনও ভেদাভেদ থাকে না, মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়ে, সে নামাজে মুসল্লিরা পরস্পর থেকে দুই-আড়াই ফুট দূরত্বে থেকে নামাজ আদায় করছেন। অনেকেই যাননি মসজিদে, বাসাতেই কিংবা বাড়ির ছাদে, বাড়ির সামনের জায়গায় দাঁড়িয়ে ইদের নামাজ পড়ছেন। প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও গরিবদের অকাতরে খাবার আর অর্থ বিলোতে পারছেন না মনের মতো করে। অনেক প্রিয়জনের সাথে দেখা করতে পারছেন না, কোলাকুলি করতে পারছেন না, সালাম করতে পারছেন না। এই একটা মাত্র দিনের দিকে মানুষ কেমন করে চেয়ে থাকে! আজকের দিনটা সবচাইতে প্রতীক্ষিত একটা দিন। সেই দিনেও নিজেকে এতটা আটকে রাখতে কারও ভালো লাগার কথা নয়। রাস্তায় রাস্তায় বাচ্চারা দৌড়ে বেড়াবে, আমাদের গরিব বোনটা আজকের দিনের জন্য ওর জমানো টাকা হাতে নিয়ে প্রিয়জনদের নিয়ে ঘুরতে বেরোবে বেশ সাজগোজ করে, বন্ধুরা মিলে আড্ডা-হইহুল্লোড় হবে, বিভিন্ন রকমের নাস্তা এক বাসা থেকে আর-এক বাসায় যাবে, বাসায় মায়েরা বোনেরা অনেক পদের রান্না করে টেবিল সাজিয়ে রাখবে মেহমানদের অপেক্ষায়। ইদের দিনেও লোকজনকে খাওয়াতে না পারলে রান্না করতে কার ভালো লাগে! যার সাথে অনেক দিন কথা হচ্ছে না কোনও রাগ বা অভিমান বা অস্বস্তি থেকে, আজকের দিনে তার সাথেও কোলাকুলি করে বিবাদ মিটিয়ে ফেলা যাবে খুব সহজেই। পার্ক, সি-বিচ, বিনোদন কেন্দ্রগুলি মানুষের প্রাণের সাক্ষী হবার অপেক্ষায় থাকে---হায়, সে অপেক্ষা আজ অপেক্ষাই থেকে গেল! না, এসবের কিছুই হতে পারছে না। কিছুই করার নেই আসলে। বেঁচে থাকলে বেঁচে থাকবার প্রতিটি দিনই ইদের আনন্দ নিয়ে কাটানো যাবে। এক ইদের বিনিময়ে হাজারো ইদ নিজেকে উপহার দেওয়া যাবে। প্রতিটি দুঃসময়ের নিজস্ব কিছু রীতি আছে, সেগুলি মেনেই উৎসব উদ্যাপন করতে হয়। এর একটা ভালো দিকও আছে কিন্তু! বাড়ির মানুষকেই আজকের দিনের পুরো সময়টা দেওয়া যাচ্ছে। বাবা-মা-ভাই-বোন পরিবার-পরিজন ওদের চোখের খুশিটা অনুভব করার সুযোগ তো আর সব সময় হয় না, তাই না? পুরো পৃথিবী যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখনও কাছে টেনে নেয় যা, তার নামই তো ঘর। আজকের দিনটা নাহয় সেই ঘরকেই দিলাম! আজকের দিনে প্রিয় মানুষদের কবরের সামনে বসে আরও একটু বেশি সময় ধরে কেঁদে নিজেকে হালকা ও পরিশুদ্ধ করে নেওয়া যাবে। বাসায় থাকলে এক খাওয়ার সময় বাদে আমি সাধারণত রুম থেকে বের হই না খুব একটা। নিজেকে বন্দি করে রাখতেই আমার ভালো লাগে। আজ সকালে মা খুব মন খারাপ করে আমাকে ডেকে কিছু ছাদে ইদের জামাত দেখাল। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। চুপচাপ। যে আনন্দ উপভোগ করাটা মানুষের অধিকার, সেটা থেকে মানুষকে বঞ্চিত হয়ে থাকতে দেখতে ভালো লাগে না। সত্যিই অনেক দুঃখ পেলাম আজ কেন জানি! আজকের এই বিষণ্ণতা অনেক দিন মনে থাকবে। আমিও মনে মনে প্রার্থনা করলাম: পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠুক, মানুষ বাঁচুক হাসিতে গানে খুশিতে। প্রতিটি মানুষ নিজের মতো করে ভালো থাকুক অন্যকে ভালো থাকতে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। নিজে ভালো থাকি, অন্যকে ভালো থাকতে দিই।---এটাই হোক আমাদের ধর্ম।