ভাবনা: দুইশো একাশি।
……………………………………..
এক।
আমি দীপালি। আমার বাবা সামান্য বেতনের একজন কেরানি। আমরা তিন ভাইবোন। ছোটবেলা থেকেই আমার অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। একদিন অনেক বড় হবো, বাবা-মা’কে খুশি করব। আমার দিদি আর দাদার উপর আমার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তারা সে স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। এটা নিয়ে আমার বাবার অনেক কষ্ট। বাবার এই কষ্টটা আমি বুঝতাম। তাই খুব চেষ্টা করছি বাবার ইচ্ছেটা পূরণ করার। কিন্তু জীবনের একটা সময়ে এসে বুঝেছি যে আসলে ইচ্ছে দিয়েই সবকিছু হয় না। ইচ্ছে পূরণ করতে হলে অর্থের প্রয়োজন।
আমি আমার বায়োডাটা পাঠাইনি, এমন কোনও জায়গা মনে হয় আর বাকি নেই। খুব ছোট পোস্ট হলেও সেখানে পাঠিয়েছি। শুধু একটা জব পাওয়ার আশায়। কারণ আমি আমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। এই এক অর্থ নামক বস্তু আমাকে সবকিছু অনেক পিছিয়ে দিয়েছে।
বর্তমানে বাবা খুব অসুস্থ। গরুর দুধ বিক্রির টাকা দিয়ে মা আমাদের সংসার চালাচ্ছে।
আমি এই বছর জানুয়ারিতে মেরিন ফিশারিজ একাডেমি থেকে বিএসসি (পাস) মেরিন ফিশারিজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছি। এই সার্টিফিকেট নিয়ে ন্যূনতম একটা জবও ম্যানেজ করতে পারছি না। এই অবস্থায় আমি খুব ডিপ্রেশনে ভুগছি।
বাবার চিকিৎসা, মার কষ্ট, আমার বেকারত্ব……সবকিছু আমাকে খুব কষ্ট দেয়। কাউকে কিছু বলতে পারি না। একাএকা রাতে বসেবসে ভাবি আর কান্না করি। আমি খুব সহজে কারও কাছে কিছু শেয়ার করি না।
কারও কাছে কখনও হাত পাতিনি। বাবা শিখিয়েছেন, প্রয়োজনে না খেয়ে মরে যাবি, তবু কখনও কারও কাছে মাথা নত করবি না।
কিন্তু জীবনের কাছে যখন মাথা হেঁট হয়ে যায়, প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যখন আর কিছু করার থাকে না, তখন কী করতে হয়, বাবা কেন শিখিয়ে দিলেন না?
দুই।
আমার ভাই ক্লাস নাইনে পড়ত। নাম সুগত, ডাক নাম তপু। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ও গলায় দড়ি দেয়। কেন, আমরা কেউ জানি না। তবে ও ছিল বেশ অনুকরণপ্রিয়। যা দেখত, তা-ই অনুকরণ করার চেষ্টা করত। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এক খুনের মামলায় দুইজনের ফাঁসি হয়, টিভি নিউজে সে খবর আমি আর আমার ভাই রাতজেগে দেখছিলাম। রাতে ও আর আমি একসাথেই ঘুমাতাম। ফাঁসির ব্যাপারটা নিয়ে ও খুব মজারমজার কথা বলে আমাকে। আমিও অতো কিছু না ভেবে ওর সাথে সারারাত ফাঁসি সংক্রান্ত নানান গল্প করি। নেক্সট দিন আমি একজাম দিতে হলে চলে যাই। সারাদিনই ও স্বাভাবিক ছিল। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে মায়ের হাতে ভাতও খায়। সেদিন কেন জানি ও মাকে ভাত মেখে খাইয়ে দেয়ার জন্য বায়না ধরে, মায়ের একটু কাজ ছিল, কিন্তু ও কিছুতেই তা শুনল না। রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ও মায়ের সাথে গল্প করতে থাকে। বাবা রাতে বাসায় ফিরলে যখন রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ওকে ডাকতে যাই, তখন দেখি, ওর রুমের দরোজা বন্ধ। অনেক ডাকাডাকি করলেও দরোজা খুলছিল না। এরপর মা এসে চাবি দিয়ে দরোজা খুলে দেখে, ওর নিথর শরীরটা ফ্যানের সাথে ঝুলছে।
ও আমার মায়ের হাত ছাড়া ভাত খেত না। মায়ের বড় আদরের ছিল সে। ও বাসায় ফিরতে একটু দেরি করলেই মায়ের প্রেসার বেড়ে যেত। ও নেই, এটা মেনে নেয়া আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমরা যৌথ পরিবারে থাকি। এতো লোক বাসায়, অথচ ও কখন কাজটা করল, কেউ টেরই পেল না। ও যে রুমে কাজটা করে, সে রুমভর্তি বিভিন্ন ঠাকুরদেবতার ছবি টাঙানো। গলায় বেডশিট পেঁচিয়ে ফাঁসটা দেয় ও। সেই ফাঁসটা এতো বড় ছিল যে, দুইজনের মাথা অনায়াসেই সেখানে ঢুকে যেতে পারে। ওর গলায় একটা লাল দাগ ছাড়া আর কিছু ছিল না, চেহারাও তেমন পরিবর্তিত হয়নি। সবাই মিলে ধরাধরি করে ওর শরীরটা যখন বিছানায় রাখলাম, ও তখনও যেন আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে হাসছিল। পুরোই অবিশ্বাস্য মৃত্যু আমার ভাইয়ের।
মা মাঝেমাঝে এমন করে কান্না করে যে সহ্য করা যায় না, বাবাও কেমন জানি ঝিমিয়ে পড়েছে। অনেক ফ্রি ছিলাম বাবা-মায়ের সাথে আমরা দুই ভাইবোন। খুব সুখী একটা পরিবার ছিল আমাদের। বিত্ত অতো ছিল না, কিন্তু চিত্ত ছিল সবখানেই। সব শেষ হয়ে গেল!
মা রুম থেকেই বের হয় না আর, তপুর বয়সি কাউকে দেখলে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। এর মধ্যে আমার এক কাকি এবং আরও দুএকজন বলাবলি করছে, মা নাকি অলক্ষ্মী, সে তার ছেলেকে ধরে রাখতে পারেনি। এসব শুনলে আর বাবা-মায়ের অবস্থা দেখলে আমার প্রায়ই মনে হয়, কিছু বিষ কিনে আনি। বাবা-মাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলি, এরপর নিজেও বিষ খাই। তিনজনই একসাথে আমার ভাইয়ের কাছে চলে যাই। এরপর তো আর কোনও দুঃখ থাকবে না। কারও কথা শুনতে হবে না, এতো কষ্টও আর সহ্য করতে হবে না। কিন্তু পারি না। এখন মা প্রায়ই বলে যে মরে যাবে। আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই নাকি সে নিশ্চিন্তমনে মরতে পারবে।
আমরা কখনও এটা মানতেই পারি না যে তপু আর নেই। ঘরের সব জায়গায় ওর জিনিসপত্র ছড়ানো। ওর খেলার জিনিস, ওর ঘুড়ি-নাটাই, ওর স্কুলের ব্যাগ-খাতাপত্র। ও শেষ যে জামাটা পরে ছিল, মা সেটা ধুতে দেয় না, ওতে ওর শরীরের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, মা জামাটা প্রায়ই বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। ওর ব্যাট, বল, ওর বুকশেলফ, ওর গল্পের বই, ওর জুতোমোজা, ওর সাইকেল সবই আগের মত রয়ে গেছে, শুধু ও নেই।
ওর মধ্যে খুব ছেলেমানুষি ছিল। ছোট বাচ্চাদের সাথেই বেশি মিশত ও। বাচ্চাদের সাথেই বল খেলত। বিকেলে ছোট বাচ্চাদের সাথে মাঠে দৌড়াতো। ওকে কখনও কোনও মেয়ের সাথে সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে দেখিনি। আমাদের বাসার ছোট বোনগুলি আর কাকিরা ছাড়া আর কোনও মেয়ের সাথেই ও তেমন একটা কথা বলতো না। আশেপাশের লোকজনকে যখন দেখি ওর মৃত্যুকে কোনও মেয়েকেন্দ্রিক দুর্ঘটনা বানিয়ে প্রচার করে, তখন বুকফেটে কান্না আসে।
ওর মৃত্যুর কারণ জানতে ওর প্রতিটি বন্ধুর সাথে কথা বলেছি আমরা। কেউ এমন কিছু জানে না, যেটার জন্য ও আত্মহত্যা করতে পারে। সবাই শুধু একটা কথাই বলে, আন্টি, ও ছোট মানুষ, না বুঝে খেলার ছলে এমন ভুল করে ফেলছে, ওকে আপনারা ক্ষমা করে দিন।
তবু লোকের মুখরোচক কাহিনি বানানো থামে না। ওরা বড় হুজুগে স্বভাবের। মিথ্যে তো বরাবরই সত্যের চাইতে উপাদেয়। লোকে সত্যের চাইতে মিথ্যা সহজে গ্রহণ করে। আমার ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে যে কত বাজে গল্প পাড়ায় এর মধ্যে প্রচলিত হয়ে গেছে, ভাবতেও কষ্ট লাগে। এমনকি ব্লু হোয়েল গেইমটা খেলতে গিয়ে আমার ভাই আত্মহত্যা করছে, এমন গল্পও অনেকে ফেঁদেছে, ফেসবুকে ছড়িয়েছে। মানুষের মধ্যে কোনও বিবেক আর মনুষ্যত্ব নেই। যখন কোনও কিছু নিয়ে কেউ লাফায়, তখন তার দেখাদেখি আশেপাশের সবাইও তা নিয়ে লাফায়। যা নিয়ে লাফাচ্ছে, সেখানে কতটুকু সত্য আছে, কিংবা আদৌ কোনও সত্য আছে কি না, সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
একটা বাচ্চা ছেলে যে কিনা মৃত, তার নামে উদ্ভট সব কাহিনি ছড়িয়ে, তার পরিবারের লোকজনকে কাঁদিয়ে লোকে যে কী শান্তি পায়! ওদের কোনও বিচার হয় না। এমন অপরাধের কোনও শাস্তি নেই। এ দেশে সে-ই কেবল শাস্তি পায়, যাকে সবাই মিলে দোষী বানায়। প্রকৃত ঘটনা সবসময় হুজুগে মূর্খ নিষ্ঠুর অবিবেচক লোকের নির্বুদ্ধিতার আড়ালেই থেকে যায়।
ভাবনা: দুইশো বিরাশি।
……………………………………..
পৌরুষ নিয়ে আপনার লেখা পড়লাম। অতীতের অনেক কিছুই মনে পড়ে গেল।
ছোটলোকের নজর থাকে ছোট কাজের দিকে।
আমার বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবে ২০১১ সালের জুলাইয়ের ১২ তারিখ। এর কয়েক মাসের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। সে দেখতে বেশ ভাল ছিল, কথা বলত খুব নরম সুরে ভদ্রভাবে। সবাই আমার উপর বিরক্ত ছিলো এজন্য যে ছেলে তো ভালই, তোমাকে ভালোওবাসে, তাহলে তাকে ছেড়ে দেওয়া কেন? আমি কখনওই কাউকে বোঝাতে পারিনি যে সে একটা ছোটলোক। তার সবকিছুই ছিল লোকদেখানো, যেটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। তার প্রতিটি কাজের পেছনে একটা উদ্দেশ্য থাকতো, লাভ ছাড়া কোনও কাজই সে কখনও করত না। বাইরে থেকে তাকে দেখে এসবের কিছুই বোঝা যেতো না। সে কোনও আত্মীয়স্বজনের বাসায় গেলে ওখানে কী খাওয়ালো, কী দিল, এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকত। আমাকে সবাই ভুল বুঝেছে, তাও আমি সে ছোটলোকের সাথে থাকিনি। তাদের প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা হয়, যাদের সবকিছুই লোকদেখানো।
কাল থেকে আপনার কোনও লেখা নেই। আমি ফেসবুকে লগইন করি কেবল আপনার লেখা পড়ার জন্য। যদি ব্যস্ত থাকেন, তবে ঠিক আছে। দুইদিন আগে একটা লেখায় পড়লাম, আপনি একটু অসুস্থ। এখন কেমন আছেন? আমাদের মত সাধারণ মানুষের জন্য আপনার ভালথাকা, সুস্থথাকা দরকার। যারা আপনার লেখা পড়ে প্রেরণা পায়, মনখারাপ ভাল হয়ে যায়, তাদের জন্য আপনি ভাল থাকুন। আমি আপনার লেখার একজন ভক্ত, খুব বেশি বই আমি পড়ি না, আমাকে ঠিক পাঠক বলা যায় না, তবে আমি আপনার লেখা পড়ি। আপনি সহজসাবলীল কথায় অনেক কঠিন বিষয় তুলে ধরতে পারেন, এজন্যই বেশি পছন্দ আপনার লেখাগুলো। অন্যদের কথা আমি জানি না, আমি আমার কথাই বলছি, সত্যিকার অর্থেই আমি অনুপ্রাণিত হই আপনার লেখা পড়ে। আপনার লেখা পড়ছি এই দুমাস ধরে। যখন প্রথম আপনার লেখা পড়ি, তখন আমি আপনাকে চিনতাম না। লেখা পড়ে আপনার প্রোফাইল দেখলাম। আপনি আপনি বলে আমি আপনার লেখা পড়িনি, আপনার লেখা পড়ে আমি আপনাকে চিনেছি। আমি বিশ্বাস করি, আপনি আপনার পাঠকদের অনেক ভালোবাসেন। যদি ভালো না বাসতেন, তাহলে এত ব্যস্ততার মাঝে এত পোস্ট দিতেন না। আপনার চাকরিটা অনেক ঝামেলার, সেখান থেকে এতটা সময় বের সত্যিই কঠিন। প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসা না থাকলে এটা সম্ভব নয়।
কোথায় আপনি? লিখছেন না? হারিয়ে গেলেন কি? জানি না, কেন জানি আপনার লেখাগুলো খুব মিস করছি, সেই সাথে আপনার জন্য দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। আপনি ভাল আছেন তো? হয়তো ভাবছেন আমি অজানা অচেনা একজন, কেন দুশ্চিন্তা করছি? হয়তোবা আদিখ্যেতা করছি। আসলে সত্যিই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ভাল থাকেন, সেই কামনাই করি।
আমি ফেসবুক ইউজার নই, বিশেষ একটা প্রয়োজনে ফেইক নাম দিয়ে এই আইডিটা ওপেন করেছিলাম। তারপর কীভাবে যেন আপনার পোস্ট চলে আসে। পড়ে ভাল লেগেছিল, লাইক দিয়েছিলাম। তারপর থেকে লগইন করিই আপনার লেখা পড়ার জন্য। আমার আর কোনও কার্যক্রম নেই ফেসবুকে। আমার নাম নারিন। রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলায় থাকি। মাস্টার্স শেষ, ছোটখাটো একটা সরকারি চাকরি করি। এ-ই তো!
আপনি অনেক ব্যস্ত মানুষ। ইনবক্সে অজস্র মেসেজ আসে আপনার। এর ভিড়ে আমার মেসেজ পড়ে রিপ্লাই করেছেন। ধন্যবাদ উত্তর দেয়ার জন্য। আপনি ভাল আছেন, এটা জেনে সত্যিই ভাল লাগছে। আমি আমার নাম বলেছি। কোথায় থাকি, কী করি, সবই তো বললাম! আচ্ছা, আপনি লিখছেন না যে?
আপনার ‘প্রপোজ ডে’ লেখাটা কেমন জানি এলোমেলো লেগেছে। অতটা যত্ন নিয়ে লেখেননি বোধহয়। তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন কি? ‘সবিনয় নিবেদন’ বইটা পড়ার পরামর্শ থাকল। (যদি না পড়ে থাকেন।)
শুভ বসন্ত, সেই সাথে শুভ ভালোবাসা দিবস।
এই এক ভালোবাসা দিবসের জন্যই তো ভালোবাসা, তাই না? এ দিনটি না থাকলে এতো ভালোবাসা কোত্থেকে আসত? এমন দিনে বৃষ্টি নামুক………বৃষ্টি থাকুক, থাকুক সাথে সেও। এই ক্যাপশনের সাথে যে ছবিটা দিয়েছেন সেটা দেখে মনের মাঝে সত্যিই প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার অনুভূতি হয়………খুব তীব্র অনুভূতি……..লিখে বোঝানো যাবে না!
জানি না, ছুটির দিনগুলো কেমন কাটে আপনার। আপনার মন ক্লান্ত, বিষণ্ণ, অবসাদগ্রস্ত। ভুল হতে পারে, তবে ছবিতে এমনই লাগছে। ভেবে দেখেছেন কখনও, আপনার হাজারহাজার বন্ধু, ফলোয়ার আছে………কিন্তু মন ভাল করে দেওয়ার মত কেউ নেই………আর আপনি একাই কতশত মানুষের মন ভাল করে দিচ্ছেন। আর্টিস্টরা সবার মন ভাল করে দেয়, অথচ ওদের মন ভাল করে দেয়ার জন্য কেউই থাকে না। বিখ্যাত হওয়ার জন্য আপনি হয়তো কখনও অনেক যন্ত্রণা সেধেসেধে নিয়েছিলেন, বিখ্যাত হওয়ার পর তার দ্বিগুণ যন্ত্রণা ভোগ করছেন এখন। যোগবিয়োগে কী থাকল তবে? সবাই বিসিএস ক্যাডার, লেখক, বক্তা সৌম্যব্রতের সাথে কথা বলতে চায়, তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চায়, তার সাথে দেখা করতে চায়। অথচ মানুষ সৌম্যব্রতের জন্য কোথাও কেউ নেই। এই খ্যাতির জন্য হয়তোবা অনেক আপনজন দূরে সরে গেছে। কী? যায়নি? কিংবা, আপনি নিজেই কত কাছের মানুষকে ভুলে গেছেন বেমালুম! গেছেন তো, না? সত্যিই ভিড়ের মাঝেও কত একা আপনি! বলি কী, নিজেকে একটু সময় দিন। আমি চারপাঁচ মাস ধরে আপনার লেখা পড়ছি, আপনাকে প্রতিনিয়তই আবিষ্কার করে যাচ্ছি। আচ্ছা, এর আগের লেখাগুলো কীভাবে পড়তে পারি?
মানুষ নোট না পড়েই লাইক দিয়ে দেয় কিভাবে? আপনার নোটটা পাবলিশড হওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচশ লাইক পড়ে গেছে। এটা কীভাবে সম্ভব?
একটা কথা আপনার সাথে শেয়ার করি। আমি একজনকে ভালোবাসি। সেও খুব ভালোবাসত আমাকে, বা এখনও বাসে। দুই বছর ধরে তার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত, এখনও ট্রিটমেন্ট চলছে। এটা নিয়ে সে বতর্মানে মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সে ভাল করে কারও সাথে কথা বলে না, ঠিকমত খায় না, ঘুমায় না। আমি ফোন করলে রিসিভ করে খুব কম, করলেও ভাল করে কথা বলে না, অল্পতেই রেগে যায়, বিরক্ত হয়ে যায়। আমি কীভাবে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনব, বুঝতে পারছি না। আপনি অনেক বিষয় সাধারণ মানুষের চেয়ে ভাল উপলব্ধি করতে পারেন। তাই আপনার কাছ থেকে একটু পরামর্শ চাইছি। তাছাড়া আপনি একজন ছেলে হিসাবে ছেলেদের সাইকোলজি ভাল বুঝতে পারবেন। আসলে তার মা অসুস্থ হওয়ায় তার সব এলোমেলো হয়ে গেছে। অসুস্থতার উপর তো আমাদের কারও হাত নেই। তবু নিজেকে তো কিছুটা স্বাভাবিক রাখতে হবে, তাই না? আমি কিছুতেই তাকে স্বাভাবিক করতে পারছি না।
এখন পর্যন্ত আপনার যে ছবিগুলো দেখেছি, সেগুলির মধ্যে বর্তমান কভারফটোটা সবচেয়ে সুন্দর লেগেছে। আপনার লেখা পড়ে সত্যিই অনুপ্রাণিত হই। আপনার একটা কথা খুব সত্য—যে আজ চড় দিচ্ছে, কাল সে লাথি খাবে……নিশ্চিত!
আপনার রুপার সোনালি গাথা’য় অনিক চাকরি না পাওয়াতে রুপার জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। আর দূরত্বের পরে’তে অরিত্র ভাল চাকরি পাওয়াতেই নীলার জীবন বিবর্ণ হয়ে যায়।
আসলে কে যে কখন নিজের রূপ বদলে ফেলবে, সময়ের সাথেসাথে অন্য মানুষ হয়ে উঠবে, তা কেমন করে বুঝব? যাকে আজ সারাজীবন ভেবে বসে আছি, সে-ই যে কাল নিরন্তর মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি শোনাবে না, তার কী নিশ্চয়তা আছে?
ভাবনা: দুইশো তিরাশি।
……………………………………..
বিসিএস’টাকে পাহাড় চূড়াসম মনে হয়। পড়াশোনায় রেগুলারিটিটা আর নেই, সংসার আর বাচ্চা সামলে যেটুকু সময় পাওয়া যায়, তা নেহায়েত কম নয়। তবুও পড়াটা যথেষ্ট হয় না। আপনার লেখা পড়ে মনে হয় পারা সম্ভব, আবার মনে হয়, আর যে-ই পারুক, আমার দ্বারা হবে না। মাথায় বুঝি জংটা ভালভাবেই লেগেছে! আবার পড়তে বসে কোথা থেকে যে শুরু করব, তা-ই বুঝি না। একেবারে যা-তা অবস্থা! আপনাকে ধন্যবাদ, নোটগুলো শেয়ার করার জন্য।
আপনি কখনও-কখনও কেমন করে যে লেখেন, মনখারাপ হয়ে যায়! আমি আপনার লেখার একজন গুণমুগ্ধ পাঠিকা। আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি ফিশারিজ নিয়ে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমার একটা ছেলে আছে, গৃহিনী, চাকরিবাকরি কিছু হয়নি এখনও। এ-ই আমি!
আপনি ব্যস্ত মানুষ, হাজারটা কাজ। ফেসবুকে হাজারটা মানুষের ভিড়ে, এতএত মেসেজের ভিড়ে আপনি মেসেজ দেখেছেন! আমি ভেবেছিলাম, আপনি কখনও মেসেজগুলো দেখবেনই না। ভেবেছিলাম, ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট তো পাঠানো যায় না, মেসেজও মেবি আদার্স-এ গিয়ে জমা হয়, তবু আমি আমার কথা বলে রাখব, আপনি না-ই বা দেখলেন, তবু আমার বলা তো হবে। মাঝেমাঝে এমন দুচারটা রিপ্লাই দেবেন, প্লিজ। হুট করেই ভীষণ খুশি হয়ে যাব! এখন তো আমাদের জীবনে খুশি হয়ে ওঠার কারণগুলি একএক করে কমে যাচ্ছে, আপনি যদি আমার খুশি হয়ে ওঠার কারণ হয়ে ওঠেন কখনওবা, আপনার তো আর কোনও ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না! আপনি সুস্থ থাকবেন।
জানেন, আমি যাদের ফলো করি, সে লিস্টটা খুব মজার। আমার ওয়ালে সব ধরনের লেখাই পাওয়া যায়। প্রেম, ঘৃণা, রাজনীতি, গান, মুভি, সাম্প্রদায়িকতা, নারীবাদ, বই, সাহিত্য, মনস্তত্ত্ব, বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, নৃতত্ত্ব। কী নেই? আমার সময় আনন্দেই কাটে!
আমি দেরিতে হলেও বুঝেছি, ফেসবুকে ফ্রেন্ডলিস্ট ছোট থাকা ভাল। অনেক দিন হল, কারও লেখা ভাল লাগলে ফলো অপশনে ক্লিক করে রাখি, কিন্তু তেমন কাউকে ফ্রেন্ডলিস্টে রাখি না। হ্যাঁ, কারও লেখায় কমেন্ট করার আর উনাকে মেসেজ পাঠানোর অপশন দুটো অফ করা থাকলে কখনও-কখনও খারাপ লাগে; কিছু মানুষ আছে, যাদের ব্যক্তিগতভাবে কিছু বলতে ইচ্ছে করে, শুধু কমেন্টে না, তাই! ইদানিং আপনাকে মেসেজ বেশিই দিচ্ছি, বিরক্ত হবেন না, প্লিজ!
আপনার সেদিনের বিবাহিত মেয়েদের মেসেজ পাওয়া সংক্রান্ত সেই লেখাটা পড়ার পর থেকে ভয়েভয়ে কয়েকদিন আর মেসেজ দিইনি। আজ আবার লিখছি। দাদাভাই, লাস্ট নোটটা পড়েছি সে-ই দুপুরে। খারাপ লেগেছে, বলতেই হবে। তবে প্রাণভরে প্রার্থনা করছি, আপনার একজন যোগ্য জীবনসাথী হোক। যে দেখতে ডানাকাটা পরী না হলেও যেন মায়াবতী হয়, স্মার্ট না হলেও যেন গুণবতী হয়, পড়াশোনায় বেস্ট না হলেও যেন সাহিত্যমনা হয়। মন থেকে প্রার্থনা করি, দাদা। এই ফেসবুকের নীল পেইজে আপনার পাশে মিষ্টি একটা বৌদির ছবিতে খুব খুশিতে যেন লাইক দিতে পারি।
দাদা কী করে? কেমন আছে আমাদের দাদাটা? আচ্ছা দাদাভাই, আপনার কখনও নাটোরে আসা হয়? বা হয়েছে? আরেকটা কথা আজ মাথায় খুব ঘুরছে, জিজ্ঞেস করি? দাদাভাই, আপনি কি খুব হাসেন? কেন যেন মনে হয়, কৌতুক বা মজার কথায় আপনি খুব হাসেন। যারা খুব হাসে, ওদের আমার ভাল লাগে।
লেখাটা বেশ ভাল তো দাদাভাই, খুব করে লিখবেন! পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস করলে রিপ্লাই দেন না, পড়াশোনা ছাড়াও তো রিপ্লাই নেই-ই! দাদাভাই, কবিতা লেখা শুরু করে দিয়েছেন, অনেক দারুণ লিখছেন। সুস্থ থাকুন, দাদা, লিখতে থাকুন।
শীত এসে গেল। দাদা, পিঠেপুলির দাওয়াত নেন।
অনেক দিন পর আজ কারও কোনও লেখা পড়ে কাঁদছি। কান্না না এসে পারেনি। শতাব্দীকে নিয়ে আপনার লেখা পড়েছি আর চোখ ঝরেছে। খুব অভিমান নিয়ে সবাই চলে যেতে পারে না, দাদা, কতজনই তো আছে যারা মরেমরেও বেঁচে থাকে, যাদের বেঁচে থাকতে হয়। ভালোবাসা ফেরায় যে, আর যে আঁকড়ে ধরে রাখে, দুজনের মাঝে পার্থক্য একটাই, তা হল—ভাগ্য; নয়ত সবার অবস্থা একই হত। ভালোবাসাটা সবার কপালে থাকে না কিংবা সয় না, দাদা।
আজকের দিনটা নিয়ে কিছু লাইন লিখেছি। পাঠালাম।
একুশে, আমার একুশে! কত বর্বরতার মুখোশ খুলেছে এই একুশে! কতশত ত্যাগের এনেছে বারতা একুশে আমার! ভাষাপ্রকাশের শেকল ভেঙেছে—সে-ই তো একুশে! কোথায় পাবে এ মহাগান, কতশত কবি, কবিতা হাজার, একুশে বাদে! একুশে এনেছে বাঁধভাঙা সুর, অমর জীবন, বীরের গাথা!
তবুও কেন হায় আজ মনে হয়, কথায় কেবল রাত এসে যায়, দিন আসে না! যে কথা এলো রক্তে ভেসে, সে কথা কেন শ্বাস চেপে মরে? বীর ভাইয়েরা হল অক্ষয় যে স্মৃতি ধরে, ধুলো জমে যায় সে অমর স্মৃতির প্রতিটি পাতায়! কত সাহস ছিল, ছিল ভালোবাসা ওদের মনে, ভাষার ঘরে ভাষা নেই তাই, ভাবলে চোখে জল জমে যায় অবচেতনায়! একুশ তুমি চেতনা দিয়েছ, রাঙিয়েছ মন, শাণিত করেছ হৃদয়-আসন! এসো, দলে এসো তরুণের প্রাণ, করো অর্পণ শত ফুলদল! হয় না কিছুতে কোনও প্রতিদান, তোমাদের ত্যাগ বিলিয়েছে যা বড় অকাতরে! তোমাদের দেয়া বর্ণমালায় যে গুণগান—তোমাদেরই দান! তোমাদের ভেবে যখন ব্যথায় এ বুক কাঁদে, স্বপ্নশিখায় সে বুকই বাঁধে! অন্তরে থেকো শত জনমেও, অক্ষয় হে! অভয় দিয়ো অমর শিখায়, একুশে ফেব্রুয়ারি!
ভাবনা: দুইশো চুরাশি।
……………………………………..
আমি আসলে আপনাদের মত না। আমি বাকী ১০ জন ছেলের মত না। আমার একটা প্রব্লেম আছে। আমি কানে ঠিকমত শুনি না। এই প্রব্লেম ২০০২ সাল থেকে শুরু হয়েছে। আমি ক্লাসে স্যারদের কথা ঠিকমত শুনতে পারি না। অনেক কষ্টে মার্স্টাস শেষ করলাম। ফলাফল মোটামোটি। এসএসসি’তে ৩.৫৬, আর এইচএসসি’তে ৩.৬০ পাই। অনার্সে ২য় শ্রেণী পাই। কিন্তু এখন দেখছি, আমাদের মত মানুষদের জন্য কোনও জব নাই। আমরা না আছি প্রতিবন্ধী কোটাতে, না আছি জেনারেল কোটাতে। কারণ আপনাদের সামনে ঠিকমত কথা বলতে পারি না। কিছু কথা শুনি, আর কিছু কথা শুনি না। মানুষ বয়রা বলে গালি দেয়। এইগুলো শুনেশুনে জীবনের প্রতি ঘেন্না জন্মে গেছে। ঢাকা শহরে আছি। ভালমত কথা শুনতে পারি না বলে কোনও প্রাইভেট পড়াতে পারি না। মাস শেষ হলে বাবা-মা’র কাছে হাত পেতে টাকা চাইতে হয়। ওই সময় নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়। আবার যখন দেখি, আমার ছোটভাই প্রাইভেট পড়িয়ে মাসে ৫ হাজার টাকা আয় করে, তখন নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করে। ও পারলে আমি কেন পারি না? আল্লাহ্ কেন আমাকে এমন করে রেখেছেন? আমাদের কষ্ট কেউ বোঝে না। আমরা চলার পথে পদেপদে অপমানিত হই। একটা কথা ঠিকমত শুনতে না পারলে বয়রা বলে গালি শুনতে হয়। বিসিএস দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দেখি, শর্তে লেখা আছে, “প্রার্থী উভয় কানে ভাল করে শুনতে পায় ও সেখানে কোনও রোগের লক্ষণ নাই, তা নিশ্চিত করতে হবে।” আমার কানে তো রোগ আছে। আমি কি তাহলে বিসিএস দিতে পারব না? যদি না পারি, তবে এর কারণ কী? আমি তো ইচ্ছা করে কানে কম শুনি না। আল্লাহ্ আমাকে এমন করে সৃষ্টি করেছেন। তাছাড়া আমরা তো নিজের খরচ নিজে চালাতে পারি না। কেও আমাদের কোনও জব বা টিউশনি দেয় না। যেখানে আমার ছোটভাই মাসে ৫ হাজার টাকা পায়, সেখানে আমি ১ টাকাও রোজগার করতে পারি না। আজ আপনার কাছে আমি আমার মনের কষ্টের কথা বললাম। কারণ, আপনি অনেকের মাঝে স্বপ্নের বীজ বুনে দিচ্ছেন। জানি না, আমি আপনার মাধ্যমে কোনও রাস্তা পাব কি না! এখন আমার কী করা উচিত, তা যদি বলতেন! এই হতাশার জন্য আমি এখন কোনও পড়াশোনাই করি না। পড়াশোনা করতে আর ভাল লাগে না। কারণ আমার মনে হচ্ছে, আমার জীবনে কোনও আলো নেই, আমাদের মত মানুষদের সমাজে থাকারই কোনও অধিকার নেই।
আমি জীবনে তেমন কিছুই চাই না। আমি শুধু চাই, আমি যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি। কারও উপর যেন আমি নির্ভর না করি। কিন্তু আমার জীবনে যে এখন কেবলই হতাশা। আমার বাবা ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন। আমার মা’ও একজন শিক্ষিকা। তিনি এখনো স্কুলে শিক্ষকতা করে চলেছেন। আমরা ৭ ভাইবোন। তাই পরিবারে অভাব আছে। নিজের ইচ্ছামত অনেক কিছুই করতে পারি না। তাছাড়া গত বছর আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। মা থাইরয়েডের প্রবলেমে ভুগছে। অপারেশন করার পর তিনি এখন কিছুটা ভাল। কিন্তু এখনো প্রতিমাসে মায়ের ওষুধের পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়। আমি গত ১২ তারিখ ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমার প্রবলেম দেখে বলেছেন, অপারেশন করানো হলে আমার সুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৮০%। আবার হিয়ারিং এইড ব্যবহার করেও আমি আমার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারি। কিন্তু এজন্য তো টাকার প্রয়োজন। আমি কারও কাছে কোনও টাকা চাই না। শুধু একটা জিনিস চাই। একটা পার্টটাইম জব। আমি যেন আমার নিজের খরচ নিজে চালাতে পারি। বিভিন্ন ভাল চাকরির আবেদন করার জন্য যে টাকার প্রয়োজন, তা যেন আমি নিজেই ম্যানেজ করতে পারি। আর যদি জবের ব্যবস্থা না হয়, তবে এ সমাজ যেন আমাদের মত অসহায় যারা, ওদের দুএকটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দেয়। কী করব? চলতে হবে তো! আমরা কারও করুণা চাই না, একটু সহমর্মিতা আর সহযোগিতা চাই। আমরা হতাশ হয়ে জীবন কাটাতে চাই না। আমরা জীবনের সাথে লড়াই করতে চাই। আমরা হার মানতে চাই না। শুধু একটু সুযোগ পেলে আমরা নিজেকে মেলে ধরতে পারতাম। এ সমাজ কত কিছু নিয়ে কত কী করে ফেলছে! আমাদের নিয়ে কেউ কখনও ভাবে না কেন? ফেসবুকে কত ভুয়া, অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর ব্যাপার নিয়ে তোলপাড় হয়, আমাদের নিয়ে দুই লাইন মায়াভরা কথা কেউ কোনওদিন লিখল না।
ভাবনা: দুইশো পঁচাশি।
……………………………………..
আমার যত কথা, সবই আমার হতাশা নিয়ে। পড়লে বিরক্ত হবেন, সেটা মাথায় না রেখেই লিখছি। কষ্ট দমিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু তা আর হয় কতটুকুই? আমার গল্পটা কেটে ছোট করতে পারছি না, তাই বেশ খানিকটা সময় আমি নিয়ে নেবো, এটা মাথায় রেখে আমার লেখা পড়লে আমার অস্বস্তি একটু হলেও কমবে।
আমি বড় হয়েছি একটা যৌথ পরিবারে, সেখানে আমি সবার বড় মেয়ে। মা, পরিবার আর সমাজ, সব মিলিয়ে সবাই ঠিক একটা জিনিসই বারবার শিখিয়েছে, তা হল, সামাজিকতা আর পরিবারের কথা সবার আগে ভেবে কাজ করতে হবে। আমি তখন এইটে। পাশের বাড়ির একটা ছেলে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। সেসময় আমি যতটা না সেটা উপলব্ধি করেছি, ব্যাপারটা তার চেয়ে অনেক বেশি লক্ষ্য করেছে আমার পারিপার্শ্বিক সমাজ। সে সারাদিন আমার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত আর কোচিং কখন কোথায় হত, সে অনুযায়ী আমার পিছু নিত। আমাদের বাড়ি ২ তলা, আর পাশেই ওর বাড়ি—৩ তলা। তার বাড়ি থেকে আমার বাড়ির অনেক ঘর দেখা যেত। যা বলছিলাম, এই সমাজ আমার পরিবারের লোকের কানে নানারকম কথা দিতে শুরু করল। ভিত্তিহীন নোংরা সব কথা। পরিবার তখন সমাজকে ভয় পেতে থাকে। তাই সবাই আমার উপর সবসময়ই কড়া নজর রাখতে শুরু করল। আমি যখন স্কুলে বা কোচিং-এ যেতাম, তখন মা, নাহয় বাবা, নাহয় ঠাকুমা, নাহয় পিসি, কেউ না কেউ সাথে থাকত। ঘটনাটা যতটা জটিল ছিল না, আমার পরিবার আর সমাজ, এই দুই মিলে ঘটনাটা ততটা জটিল করে আমার মানসিক অবস্থা কঠিন বানিয়ে দিল। আর ওদিকে সেও পিছু নেওয়া বন্ধ করত না।
যা বলেছিলাম, ওর বাসা থেকে আমাদের সব রুম মোটামুটি দেখা যেত, তাই নিজের বাড়িতেই এক বা দুই রুমের বেশিতে আনাগোনা করা আমার জন্য নিষেধ ছিল। রাস্তায় দিয়ে যাওয়ার সময় আমার সাথেসাথে যে-ই থাকত, একটাই কথা: মাথা নিচের দিকে রেখে হাঁটো! সব মিলিয়ে কী যে এক মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছি ওই বয়সে, সে এক আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ অনুভব করতে পারবে না। অবশ্য, কারও কষ্ট কেউ অনুভব করতে পারেও না।
এখন আসি পরিবারে কথায়। যৌথ পরিবার যে কতটা কুটিলতাপূর্ণ, যে যৌথ পরিবারে থাকেনি, সে কিছুতেই তা বুঝবে না। একটা ছেলে আমার পিছু নিয়েছে, ওর মনে হয়তোবা আমার জন্য প্রেমও থেকে থাকবে, কিন্তু সত্য হল এই যে, একটা দিনও সে আমার সাথে ভাল করে দেখা করেনি। অথচ কাকা বলত, আমাকে নাকি ওর সাথে রাস্তায় দেখেছে, বিভিন্ন জায়গায় আমরা ঘোরাঘুরি করে বেড়াই। এমন অনেক কিছুই বানিয়ে মা-বাবাকে বলে ওদের মনে বারবারই আমাকে নিয়ে ভয় আনতে বাধ্য করেছে। ওরা ভাবল, আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়াই ভাল। আমার ঠাকুমা, যিনি কিনা আমাকে নিয়ে কোচিং-এ আসাযাওয়া করতেন, উনি মনেমনে চাইতেন, আমি যেন সেই ছেলের সাথে কোথাও পালিয়ে যাই। তখন উনিও আমার মা-বাবা’কে কথা শোনাতে পারবেন। উনার মনে একটা কষ্ট ছিল। আমার ছোটপিসি কাউকে ভালোবাসতেন, কিন্তু অন্য কোথাও বিয়ে হওয়ায় উনি এখন সুখি নন। তার সব দায় যেন আমার মা-বাবার, তাই ঠাকুমা আমার ছোট কাকির কাছে বলেছিল, আমি পালিয়ে গেলে ভাল হবে। তখন উনি মা আর বাবাকে কথা শোনাতে পারবেন। সব মিলিয়ে মা-বাবাও দিশেহারা ছিল। তারপর ওরা যা যা করল আমার সাথে, তা আজও ভাবতে অবাক লাগে।
কেউ কখনও শুনেছে কি ডিম দিয়ে তাবিজ তোলার কথা? কত মাইল রাস্তা হাঁটিয়ে নিয়ে যায়, রীতিমত অবাক করা কাহিনি, পেটে ডিম কিছু সময় বেঁধে রেখে এরপর যা দিয়ে তাবিজ করা হয় সেটা বের করে আনে! শুনে হাসি পেতে পারে! আমি লিখছি, আমার একটুও হাসি পাচ্ছে না, কেননা এইসব কিছুর উপর আমার বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস না থাকার পরও আমাকে ওই অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। রাত সাড়ে ১০টায় আমায় গাড়ি করে অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া হয়; কোথায়, নামটা মনে পড়ছে না। সেখানে নাকি শিবঠাকুরের পুজো! গেলাম। গিয়ে গাঁজার বাজে গন্ধ সহ্য করতে হয়েছে, রীতিমত দমবন্ধ অবস্থা! সেখানে ঠাকুরের সামনে আসনে বসিয়ে আমায় ওই ছেলের নাম বলে কী কী সব আহুতি দিল, আমি জানি না। তারপর ওর নাম কাগজে লিখে সে কাগজ পুড়িয়ে ছাই করলো। বাসায় আসার পর মা আমাকে জল খেতে দিল ওই ছাই মিশিয়ে। কত আপত্তি করলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
আবার কোথায় কোন জ্যোতিষী ছিল, অনেক দূরে। গাড়ি ভাড়া করে সেখানে যাওয়া। উনি আমার হাত দেখে, চোখের কোণা টেনেটেনে কী কী যেন বললেন! তারপর একদিন ওরা সবাই মিলে আমায় কী কী দিয়ে পূজা করল! শুনলে অবাক হবেন, ঘি, মধু, দুধ, আরও অনেক কিছু আমার কপালে লেপটে দিল আর কী কী সব মন্ত্র পাঠ করল। তারপর সারাদিন উপোস করে পূজা, মন্ত্রপড়া জলে স্নান, তাবিজ, পুরো ঘর ঘন ধোঁয়ায় ভরে আমাকে সে ঘরে আটকে রাখা, এমন আরও কত কী যে করল ওরা আমাকে নিয়ে!
আসলে কিন্তু এসবের কোনও প্রয়োজন ছিল না, এই অসুস্থ সমাজ আর আমার পরিবার আমায় এতটা মানসিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছে! আরও কত কী শুনলাম, সহ্য করলাম! ভাবা যায় না ওই বয়সে কী যে হয়েছিল আমার ওই ছোট্ট মনের সাথে! এখন সেটা ভেবে মা-বাবা বুঝতে পারে সেখানে তাদের কত ভুল ছিল! তারপর আরও অনেক কথা আছে, যেগুলি সব আমার মনেও নেই। আমি আমার উপলব্ধিকে কিছুটা ভাষা দেয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ছিল আরও ভয়াবহ, যা আমাকে সহ্য করতে হয়েছে!
আমার বিয়ে হয়ে গেল। নিজের পরিচয়টা তৈরি করে নেয়ার কোনও সুযোগ আর পেলাম না কখনও। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সব স্বপ্নকেই আমার কাছে বাস্তবতা বিবর্জিত মনে হয়। স্বপ্নের রাস্তায় হাঁটব বলে জন্ম নিয়েছিলাম। বিয়ে আমাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। জন্মের সব দায় এক বিয়েতেই চুকে গেছে যেন! সময় পেলে ডায়রি লিখি। কবিতা লেখা বিয়ের পরও ছেড়ে দিইনি। খুবই নগণ্য আমার এ চেষ্টা। তবু তা দামি মনে হয়। লেখার চেষ্টা মানেই মনকে ভালরাখার চেষ্টা। রবি ঠাকুরকে শ্রদ্ধা করি, জীবনানন্দকে ভালোবাসি। প্রচুর গল্প করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু গল্প করার মত কেউ নেই আমার। তাই হৃদয়ের যত কথা, কাগজে রেখে দিই।
বর বাসায় ফিরলে রান্না করি, বর বেরিয়ে গেলে লিখতে বসি। ও সাথে থাকলে আমার পাশে কাউকেই পাই না, খুব একাএকা লাগে; আর একা থাকলে পাশে নিজেকে পাই। তাই একা থাকতে ভাল লাগে। নিজের মত করে সময় কাটাতে ভালোবাসি। এমনি করে জীবন কেটে যায়।
ভাবনা: দুইশো ছিয়াশি।
……………………………………..
এক।
আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন এলাকার একটি ছেলের সাথে আমার প্রেম হয়। ওকে খুব পছন্দ করতাম। ওই সময় পড়াশোনায় আমি খুব ভালে করতে থাকি, এবং ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আর ওদিকে ও এসএসসি পরীক্ষাটাই শেষ পর্যন্ত দেয়নি। আমি কোনওদিনই ওকে বুঝতে দিইনি আমার আশেপাশের স্ট্যাটাসটাকে। কারণ, আমি জানতাম, ও কোনওভাবেই আমার সাথে তাল মেলাতে পারবে না। সবসময়ই ওর মতো করে চলেছি, দেখা করার জন্য ও ঢাকায় ছুটে আসেনি, আমিই ফরিদপুরে গিয়ে দেখা করেছি। আমার জীবনের সর্বত্রই ছিল ওর স্পষ্ট উপস্থিতি।
বছরখানেক আগের কথা। তখন আমার বিসিএস প্রিলির রেজাল্ট মাত্র দিয়েছে, এমন সময় হঠাৎ জানলাম, ওর বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ও স্বীকার করল না। আমি পাগলের মতো ওর পরিচিতদের ফোন করেছি, সত্যটা জেনেছি। বারবার তাদের কাছে ছোট হয়েছি। তারপর ওকে হাজার অনুরোধ করে বলেছি একবার দেখা করতে। কিন্তু তার কিছুতেই মন গলে না। তাই উপায় না দেখে বলেছি দেখা না করলে আমি আত্মহত্যা করব। সে তখন রাজি হয়েছিল, আমি গেলাম ওর সাথে দেখা করতে। ৫ ঘণ্টা ছিলাম ওর সাথে। বারবার শুধু এটাই বলেছি, তুমি প্লিজ বিয়েটা কোরো না। ওর একটাই কথা, তার পক্ষে এখন এখান থেকে সরে আসা সম্ভব না। তারপর ফিরে এসেছি ব্যর্থ হয়ে। সেদিন ওর চোখে যে আনন্দ দেখেছি, তা কোনওদিন ভোলার নয়। গত বছর এপ্রিলে ও বিয়ে করে। এরপর থেকে বেঁচে আছি, শুধু বাবা-মা’র জন্য। আমি জানি, আমার এ জীবনটাকে জেনে কেউ তার জীবনের সাথে আমায় জড়াবে না। আর আমি এত বড় সত্যটাকে কোনওদিন গোপন করবও না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সারাজীবন এভাবেই থাকব, একাএকা। জানি না, তা কতখানি সঠিক।
দুই।
২০১২ সালে এইচএসসি পাস করার পর কোথাও চান্স না পেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই অনিচ্ছা সত্ত্বেও। সবার কত অপমান, অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে, তা লিখে বোঝানো যাবে না। এইচএসসি পাস করি পাবনা থেকে। পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স না পাওয়ায় সবার অপমান থেকে বাঁচার জন্য ঢাকা কলেজে অ্যাডমিশন নিই। হতাশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ১ম বর্ষের রেজাল্ট চরম খারাপ হয়। কোনওমতে প্রমোটেড হই। ওই যে শুরু, তারপর ফেলের রাজ্য থেকে আর বের হওয়া সম্ভব হয়নি। এর ফল হল এই, ২য় বর্ষের পরীক্ষা শেষে থার্ড ইয়ারে ননপ্রমোটেড।
এই চারবছরের ভেতর আমার একটা রিলেশন হয়। ভালই চলছিল। বাবার বন্ধুর মেয়ে। কিন্তু আমি ঢাকায় আসার পর থেকে সমস্যা শুরু হয়। ওই মেয়ে এতোই ইমোশনাল ছিল যে বলে বোঝানো যাবে না। আমি অনেক ধরনের চেষ্টা করে তাকে সাহস দিতে চেষ্টা করি। সে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এরপর আরও সমস্যা শুরু। এই বছরের ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে সামান্য একটা কথায় আমাদের কথা বন্ধ হয়। আমি ফোন দিই না, সেও দেয় না। এই নববর্ষের দিন ওকে ফোন করে কথা বলি। ও আমায় তখন যা বলেছে, কী যে বলেছে, লিখে প্রকাশ করতে পারব না। একে তো আমি পরীক্ষায় ননপ্রমোটেড হয়েছি, তার উপর সে আমার সাথে প্রচণ্ড বাজে ব্যবহার করল। আজসহ টানা ৩ দিন ধরে অনেক চেষ্টা করছি ওকে ফেরানোর। এর জবাবে কেবল তুই-তোকারি ছাড়া আর কিছুই পাইনি। সে এখন একটাই কথা বলে, আমি যদি নিজের ক্যারিয়ার ঠিক করে তার সামনে কোনওদিন দাঁড়াতে পারি, তখন সে মন চাইলে আমায় অ্যাকসেপ্ট করবে, নয়তো না। তার ভাষ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একটা মেয়ে যার-তার সাথে দিন কাটাতে পারবে না।
খুব হতাশায় আছি। একটু সাহস দেওয়ার মত কেউ নেই। কী করব, বুঝতে পারছি না। কিছুই ভুলতে পারছি না। রাতে ঘুম হয় না। মাথা ঘোরে, হাত-পা কাঁপে। সবসময়ই অপমানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তাচ্ছিল্য নিয়ে বেঁচে আছি। এমন কেউ নেই যার সাথে এ কষ্ট শেয়ার করা যায়। আমি আমার কথা হয়তো সব গুছিয়ে লিখতে পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরে কেমন জানি এক ধরনের তীব্র কান্না দলা পাকিয়ে আছে। কলিজাটা সবসময় ভারি হয়ে থাকে। সারাদিন চোখের জল ঝরে। গত ৩ দিনে শুধু একবেলা ভাত পেটে পড়েছে। কী করব, বুঝতে পারছি না।
দুই ধরনের দুটো গল্প। প্রেক্ষাপট প্রায় একই। ভিন্ন মানসিকতার কারণে দুটো ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে গল্পের শেষটা। সম্পর্কের পরিণতি কেমন হবে, তা যতটা নির্ভর করে আর্থিক, সামাজিক কিংবা পারিবারিক অবস্থার উপর, তার চাইতে অনেক বেশি নির্ভর করে সম্পর্কেথাকা দুজন মানুষের মানসিকতা, ইচ্ছা, বিশ্বাস ও আন্তরিকতার উপর। জোর জবরদস্তি করে আর যা-ই হোক কেন, ভালোবাসাটা অন্তত হয় না। জোর করে যে ভালোবাসা হয়, তা বড়জোর ভালোবাসার অভিনয় কিংবা অভ্যস্ততা, যা হৃদয় থেকে নয়, কোনও দায় কিংবা ভয় থেকে আসে।
ভাবনা: দুইশো সাতাশি।
……………………………………..
এক।
ছোট্ট একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ব্যর্থ সৈনিক আমি। বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়ে দিলাম লাইফের ট্রিগার ধরার কথা চিন্তা করেকরে। লাইফে অনেকবার নিজের মধ্যে চে গুয়েভারার বিপ্লব নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পুঁজিবাদী মনের কাছে বারংবার হেরেই গেছি। এক সময় লাইফ নিয়ে কোনও টেনশন ছিল না, ছিল না বেঁচেথাকার অনিশ্চয়তা, কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর, যে বিষয়গুলো আগে পরীক্ষার খাতায় লিখতাম, সেগুলো এখন বাস্তবায়ন করার ইচ্ছে জাগে।
আমি আপনার সেমিনার করেছি, আপনার সব ক্যারিয়ার-রিলেটেড পোস্ট পড়েছি, কিন্তু তীব্র হতাশার কারণে বারবার পিছিয়ে পড়ছি। কেন এমন কিছুই হচ্ছে, যা হওয়ার কথা নয়? আমি অনেক চেষ্টা করেও এটার কোনও সদুত্তর পাইনি।
কিছু করতে না পারার লজ্জায় বাড়িতে যাই না অনেকদিন। মাঝেমাঝে মাকে দেখার অনেক ইচ্ছা জাগে, কিন্তু ভাল কিছু করতে না পারার অপরাধে আমি নিজেকে সবার কাছ থেকে ইচ্ছে করেই গুটিয়ে নিয়েছি। আমি চাই না, আমার জন্য আমার মাকে কেউ কিছু বলুক।
আমার বন্ধুরা সবাই সচ্ছল, ভাল স্টুডেন্ট, ভাল ক্যারিয়ারিস্টও বটে। কিন্তু আমার এমন কোনও অভিভাবক নেই, যে আমাকে কিছু করার জন্য বলবে। অনেক কান্না পায়, যখন ভাবি আমি এই পৃথিবীতে আসলেই একা।
বন্ধুদের সবাই হয়তো একদিন অনেক বড় হবে, কিন্তু আমার ভাগ্যে জুটবে চা-দোকানদারের সিলগালা স্টিকার। আপনি মাঝেমাঝেই মজা করে বলতেন, যারা ব্যর্থ হয়, তাদের নাকি স্প্রাইট দিয়ে মুড়ি খেতে হয়। আজকে মনে হল, আপনার থিওরিটা আমার অ্যাপ্লাই করা উচিত। তাই আজকে দোকান থেকে স্প্রাইট আর মুড়ি কিনে আনলাম। খেতে ভালই লাগে, কিন্তু এটা খাওয়ার সময় নিজেকে কেমন জানি ব্যর্থ-ব্যর্থও লাগে। অবশ্য, ব্যর্থ লাগলেই বা কী! কারণ, আমি তো আসলেই ব্যর্থ!
আচ্ছা, আপনি এতো থিওরি পান কোথা থেকে? আপনি কি মানুষ, না অন্য কিছু? মাঝেমাঝে মনে হয়, একটা মানুষের পক্ষে এতো কিছু করা ক্যামনে সম্ভব! এই গোল্ড ধরছেন তো এই স্ট্যাটাস দিচ্ছেন! আবার ঘুরছেন, ক্যারিয়ার আড্ডা করছেন! অবাক লাগে………
আমি আপনাকে ক্যারিয়ার গড়ার টেন্ডুলকার মনে করি। যদি আমার কথা বিশ্বাস করেন আরকি! আপনার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য আমি এসব বলছি না, সিরিয়াসলিই মন থেকে বলছি।
আমি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। বাড়ি খুলনায়।
ভাবছি, আপনার শণপাপড়ির থিওরি অ্যাপ্লাই করবো এবার। পাগল মনে হচ্ছে আমাকে? হ্যাঁ, আমি আসলেই পাগল। যেদিন থেকে আমি কুমিল্লা আছি, সেদিন থেকেই আমি পাগলা। আমার পরিচিত সবাই আমাকে পাগল হিসেবেই জানে।
আচ্ছা, আপনার কি কোনও আঙ্কিতা আছে? মানে, আপনার গল্পের অপরূপা আঙ্কিতার মত কেউ………‘হ্যাঁ’ বলার জন্য জীবনে একজন আঙ্কিতাকে লাগে তো!
না থাকলে নেই কেন? মেয়েদের টিম সিলেকশন আসলেই বাজে……বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফ্লপ মারে!
আমার আসলে কোনও নায়ক ছিল না, ওইসব আইকন মানার থিওরিতে আমি চলিনি কখনও। আপনার সেমিনার করে নায়ক ঠিক করেছি, কিন্তু আপনাকে জানাবো না, কারণ জানালে আপনি ভাব নিয়ে ফেলবেন।
জানেন তো, প্রিয় মানুষের অবহেলা অনেক খারাপ লাগে! কথা কিছু থাক না গোপন! পৃথিবীতে তো অনেক ভালোবাসাই চিরকালই গোপন থেকে যায়। আমারটাও সেরকম। আমি যদি কখনও চায়ের দোকানের মালিক হতে পারি, তবে একদিন ঘটা করে আপনাকে নেমন্তন্ন করবো। চেষ্টা করবো, আপনার ভাললাগার প্রায় সব কিছুই সেদিন রাখতে। আসবেন তো?
দুই।
আমি তিতুমীর কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে এ বছর। বেশ কিছুদিন ধরে ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে আছি। আমার পরিবারের অবস্থা ভাল না। মা-বাবা দুজনই বৃদ্ধ এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ। আম্মুর ডায়বেটিস এবং হার্টের সমস্যা। উনি প্রায়ই খুব অসুস্থ হয়ে থাকেন। আব্বুর অবস্থা আম্মুর চাইতে বেটার, তবে উনিও বেশ অসুস্থ। বাসায় এ দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। আমি সারাদিনই বাইরেবাইরে থাকি, বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। বড় আপুর বিয়ে হয়ে গেছে, সে থাকে শ্বশুরবাড়িতে। আব্বু এ অসুস্থ শরীর নিয়ে আম্মুর দেখাশোনা করেন, দেখাশোনা করতে হয়—উনাদের বর্তমান অবস্থা অনেকটা ফরাসি মুভি Amour (2012)-এর সেই বৃদ্ধবৃদ্ধার মত।
আমি তাঁদের চিন্তায় কোনও কাজই মন দিয়ে করতে পারি না। কেবলই ভাবি, কবে পরিবারের হাল ধরতে পারবো! এদিকে আমি থিয়েটার করি, আবৃত্তি করি, এবং সঙ্গীতের সাথে আছি ছায়ানটে। এছাড়াও আমি ফার্মগেইটে একটা অ্যাকাডেমিক কোচিং সেন্টারে শিক্ষক হিসেবে আছি। সেখানে অনেক সময় দিতে হয়, কিন্তু সম্মানী বেশ সীমিত। টিউশনি করি চারটা। এদিকে আমার অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা এবং চাকরির পড়াশোনা করাটাও অনেক বেশি দরকার। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, নানান সাংস্কৃতিক সংগঠনে সময় দিতে গিয়ে আমার পড়াশোনার গতি অনেক কমে গিয়েছে। প্রায়ই বিভিন্ন প্রোগ্রাম থাকে, রিহার্সালে সময় দিতে হয়, এদিকওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। নিজেকে দেয়ার মত সময়ই থাকে না হাতে। নিজের পড়াশোনা ভাল হচ্ছে না। আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমার বন্ধুদের চেয়ে আমি অনেক পিছিয়ে গিয়েছি। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমার আনাগোনা বেশ ভাল, যদিও সেখানে ক্যারিয়ার গড়ার কোনও ইচ্ছা আমার নেই। ওটা শুধু নিজের শখের বশে এবং ভাললাগা থেকেই করি। আমি সরে আসব ওখান থেকে, তবে গানটা ছাড়তে পারবো না। এটা আমার আত্মার সাথে মিশে গেছে। যেহেতু অচিরেই আমাকে সংসারের হাল ধরতে হবে, সেহেতু আমাকে দ্রুতই এসব ছেড়েছুঁড়ে ক্যারিয়ারের কথা সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। তা না হলে মা-বাবা’কে বাঁচাতে পারবো না।
এ পর্যন্ত পড়াশোনাসহ সবকিছু মিলিয়ে আমার পরিবারের প্রায় ৮/৯ লাখ টাকা ঋণ হয়ে গেছে, সুদসহ। পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসেবে এ ঋণ আমাকেই শোধ করতে হবে। এই টেনশনে আমার রাতে ঘুম হয় না। টাকার জন্য অনেক মানুষ বাবা-মা’কে চাপ দেয়, উনাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। আর আমি কিছুই করতে পারি না। এসব মনে এলে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। নীরবে কাঁদি। মনের ভেতর কেবলই হাহাকার তৈরি হয়। কাউকে দেখাতে পারি না এ ব্যথা। ঢাকা শহরে তো প্রাণ খুলে কান্না করারও কোনও জায়গা নেই যে নিজেকে একটু হাল্কা করবো। সবকিছু মিলিয়ে আমার জীবন এখন একদম এলোমেলো। সামনে ৭/৮ মাস পর আমার অনার্স শেষ হবে। আমি কোন পথে হাঁটবো, বুঝতে পারছি না। আমাকে গাইডলাইন দেয়ার মত পরিবারে কোনও মানুষ আগেও ছিল না, এখনও নেই। কারণ, পরিবারে আমিই একমাত্র ব্যক্তি, যে নিজেকে একটুএকটু করে অনেক কষ্টে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি।
সামনে কোনও রাস্তা দেখতে পাই না আর। চোখ মেললে ঘোর অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখি না।