স্রষ্টার খোঁজে

পুরো পৃথিবী জুড়ে নানান বিশ্বাসে স্রষ্টার বিভাজন ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যে-দ্বন্দ্ব চলে আসছে শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে, তা মানুষকে স্রষ্টার প্রকৃত ধারণা ও অবস্থান থেকে ক্রমশ দূরে ঠেলে দিয়েছে। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর কাছেই জীবনরহস্যের একেক রকম ব্যাখ্যা আছে। এসব ব্যাখ্যার কোনোটাকেই উদ্ভ্রান্ত ও উদ্ভট বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জীবনের অর্থ জীবনের অভিজ্ঞতা আর প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তিত হয়। একইভাবে, সত্য কী আর মিথ্যা কী, এর গ্রহণীয় ব্যাখ্যাও সম্পূর্ণ আপেক্ষিক।

মানুষ যখন সুন্দর মন নিয়ে প্রার্থনাগৃহে যায়, তখন প্রকৃতপক্ষে মানুষ তার আন্তরিকতা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস এবং মানবিক গুণাবলিকে বিশ্বস্ত বন্ধু মনে করে সাথে নিয়ে যায়। এরপর যখন মানুষের সাথে স্রষ্টার একটা যোগাযোগ তৈরি হয়, তখন তার কৃতিত্ব পুরোটাই মানুষের হৃদয়ের, যা সেই প্রার্থনাগৃহে মানুষকে পরম মমতায় সঙ্গ দিয়েছে। আমরা যতই স্রষ্টার কাছাকাছি চলে যাই বলে ভাবি, আমরা প্রকৃতপক্ষে আমাদের নিজেদের হৃদয়ের অসীম শক্তির ততই কাছে যেতে থাকি। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে একেক জন একেক রকম করে ভাবে। এই যেমন, ঈশ্বর সব জায়গায় আছেন, ঈশ্বর সবার হৃদয়ে আছেন, ঈশ্বরের সাথে একাত্ব হয়ে মিশে যাওয়া যায়, ঈশ্বর আমাদের বন্ধু, মনেপ্রাণে ডাকলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়, ঈশ্বরের অনেক রূপ আছে, ঈশ্বর এক এবং অভিন্ন—এরকম আরও অনেককিছু। সমস্যাটা হয় তখনই, যখন কোনো অসহিষ্ণু ধর্মবিশ্বাসী মানুষ অন্যমত অন্যপথের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করে, নিজের ধর্মমতকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, ধর্মকে উপজীব্য করে ব্যাবসা করে, যুদ্ধ করে।

জীবন ও ধর্মদর্শন সম্পর্কে ভিন্ন চিন্তা বা উপলব্ধি থাকতেই পারে, যে-পথে চললে নিজের মতো করে ভালো থাকা যায়, সে পথে যে-কেউই চলতে পারে, তবে সেটা কারও শান্তি নষ্ট করে নয়, জীবন সম্পর্কে কারও অনুভূতি আর বিশ্বাসকে আহত করে নয়। যদি আমরা অন্যদের ভিন্নতা মেনে না নিই, তবে আমরা কীভাবে আশা করি যে, অন্যরা আমাদের ভিন্নতা সহজে মেনে নেবে? স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভের পথ শান্তি, বিনয় আর সহিষ্ণুতায় গড়া। সেখানে ঔদ্ধত্য, অহংকার কিংবা গোঁড়ামির কোনো স্থান নেই। ধর্মের মত বা পথ যা-ই হোক না, প্রত্যেক পন্থাই মূলত এমন এক যাত্রাপথের সন্ধান দেয়, যে যাত্রা নিজের ভেতরের সত্তাটাকে জাগ্রত করার যাত্রা। স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করার মানেই হলো, নিজের ভেতরে এক পবিত্র শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করা, যে-শক্তি মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, মানুষের কল্যাণ করতে শেখায়, আত্মার অসীম সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে, জীবনকে শান্তি আর স্বস্তির আশ্রয় দেয়।

মানুষ পুরো পৃথিবী জুড়ে স্রষ্টার খোঁজ করতে করতে ব্যর্থ ক্লান্ত হয়ে শেষে নিজের মধ্যেই তাঁকে অনুভব করে। এ এক অদৃশ্য শক্তি, যেটার উপস্থিতি একমাত্র সে-ই টের পায়, যার মধ্যে এ শক্তি অবস্থান করে। কোনো ব্যক্তির ভেতরে কোন শক্তির রাজত্ব, তা ওই ব্যক্তি বাদে আর কেউই সঠিকভাবে জানতে পারে না। এ শক্তি যে সুখ আর শান্তি ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে দেয়, তা ব্যক্তির জীবনচর্যা, দর্শন আর বিশ্বাসকে প্রভাবিত করে। যখন কেউ মানবতার কথা বলে, ভালোমানুষ হবার কথা ভাবে, কিন্তু সেসবের প্রতি তার প্রকৃত আন্তরিকতা থাকে না, তখন তার কথা আর ভাবনাগুলি মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনির মতোই শোনায়, যার কাজ শুধুই ধ্বনিত হওয়া—অর্থহীনভাবেই।

যদি এমনও হয়, পৃথিবীর সব জ্ঞান আর বিদ্যা কেউ নিজের মধ্যে ধারণ করে ফেলতে পারে, তার নিজের ক্ষমতার উপর এমনই অটল বিশ্বাস থাকে, যে-বিশ্বাসে পর্বত পর্যন্ত নড়ে যায়, অথচ তার হৃদয়ে ভালোবাসাটাই নেই, তাহলে তার সকল ঐশ্বর্য‌ও তাকে কিছুই দিতে পারে না। আমার যা-কিছু আছে, তার সবটুকুই যদি যাদের কিছু নেই, তাদের মধ্যে বিলিয়েও দিই, নিজেকে সেই কষ্টে রাখি, যে-কষ্ট ইবাদতের সমান, তা-ও আমি বেশিদূর যেতে পারব না, যদি আমার মনে ভালোবাসার ঝরণা না থাকে।

ভালোবাসার কোনো ধর্ম নেই, অথচ সব ধর্মের মূলভিত্তিই হলো ভালোবাসা। ভালোবাসা দয়া আর সহমর্মিতার দীক্ষা দেয়, ধৈর্য ধরে বাঁচতে শেখায়, সকল ঈর্ষা আর দম্ভ থেকে দূরে রাখে, নিজের ভেতরের সুন্দরটাকে চোখের সামনে নিয়ে আসে, অন্যের প্রতি সম্মান আর সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করে। ভালোবাসা পাপকে দূরে ঠেলতে শেখায়, সত্যকে আলিঙ্গন করতে শেখায়। ভালোবাসা আশ্রয় দেয়, বিশ্বাস জন্মায়, আশা জাগায়, ধৈর্য বাড়ায়।

এক রহস্যময় শক্তি আমাদের পরিচালিত করে। আমরা শ্বাসপ্রশ্বাস নিই, আমাদের শরীরে রক্ত চলাচল করে, আমাদের স্নায়ুগুলি প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের সাড়া দেয়, এসবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় এক অসীম শক্তির প্রভাবে। সে শক্তিকে ভালোবাসলে, নিজের মধ্যে সে শক্তির উপস্থিতি অনুভব করলে, আর নিজেকে সে শক্তিতে জাগিয়ে তুললে সুন্দর শান্তিময় স্বস্তিপূর্ণ জীবনযাপন করা সহজ।