বাংলায় লেখার সময় বানান- ও প্রয়োগসংক্রান্ত অনেক ব্যাপার নিয়ে সংশয়ে পড়তে হয়। [‘বানানসংক্রান্ত ও প্রয়োগসংক্রান্ত’ এটিকে ‘বানান- ও প্রয়োগসংক্রান্ত’ এভাবে লেখা হয়। অর্থাৎ প্রথম শব্দটির পর একটি হাইফেন ব্যবহার করে শব্দের দ্বিত্বতা এড়ানো যায়।] আমি যা লিখছি, তা শুদ্ধ কিংবা প্রমিত হওয়া প্রয়োজন, এমন একটা দায় থেকে আমি অনেক দিন ধরেই ভাবছি, বাংলায় লেখার সময় সঠিক বা প্রমিত বানানে ও প্রয়োগে লিখছি কি না, তা জেনেবুঝেই আমি লিখব। অতএব, বানান ও প্রয়োগ শিখতে হবে। কিছু শেখার সবচাইতে কার্যকরী উপায় হলো, তা নিয়ে পড়াশোনা করে কী শিখলাম, তা লিখে ফেলা। আমিও তা-ই করছি। তা করতে গিয়েই এই লেখার সৃষ্টি। বলে রাখা ভালো, এ-লেখায় অনেক কিছুই আছে, যা আমি আগে জানতাম না, কিংবা তেমন করে ভাবিনি, ফলে আমার অনেক লেখাতেই ভুল বা অপ্রমিত বাংলা আমার পাঠকরা পেয়েছেন, অনুগ্রহ করে সহ্যও করেছেন। ওরকম ভুল বা অপ্রমিত বাংলায় লেখার কারণে আমার লেখার মান নিশ্চয়ই কমেছে, যা কোনওভাবেই কাম্য নয়। তাই বলা যায়, এই লেখাটি আমার নিজের প্রতিও একধরনের চোখ-রাঙানি!
এই লেখা তৈরি করার সময় কিছু বিষয় মাথায় এসেছে। আপনাদের সাথে শেয়ার করি:
এক। সত্যিই অনেক ভুলভাল বানানে ও প্রয়োগে বাংলা লিখেছি এতদিন। ভাবতেও খুব লজ্জা হচ্ছিল। তাই বারবারই মনে হয়েছে, এই লেখাটি শুদ্ধ, ব্যাকরণসিদ্ধ ও প্রমিত বাংলায় লেখার জন্য একটি ম্যানুয়েল হিসেবে কাজ করবে আমার নিজেরই জন্য, সাথে কারও কারও জন্য।
দুই। অভ্র কিবোর্ড-এর টিমের প্রতি অনেক শ্রদ্ধা কাজ করেছে, কেননা সঠিক বাংলা শব্দের এত বিশাল ডাটাবেজ প্রস্তুত-করা কম কথা নয়। অভ্রতে টাইপ করার সময় পাশে যে ড্রপ-ডাউন উইন্ডো আসে, সেখানে সম্ভাব্য শব্দের বানানের সাজেশন দেখানো থাকে। যদিও কিছু শব্দের সঠিক বানান অভ্রতে দেওয়া নেই, তবুও প্রায় শব্দেরই বানান সেই উইন্ডোতে পাওয়া যায়। সত্যিই, ‘অভ্র’র বাংলা শব্দের ডাটাবেজ দেখলে বিস্মিত হতে হয়! আমরা যারা লিখি, তাদের জন্য অভ্র কিবোর্ড একটি পরমআশীর্বাদ।
তিন। অভিধানে কিছু শব্দ পাবেন, যেগুলি শুদ্ধ বা প্রচলিত, কিন্তু অপ্রমিত বা ব্যাকরণ-অসিদ্ধ। আমি সেগুলিকে প্রথম বন্ধনীতে রেখেছি।
চার। প্রয়োগবিধি নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আমি ব্যাখ্যায় না গিয়ে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তবে কিছু ক্ষেত্রে উদাহরণের পাশাপাশি ব্যাখ্যাও আছে।
পাঁচ। এই লেখাটিকে বলা চলে অনেকটা অনধিকারীর আস্পর্ধা বা দুঃসাহস। তাই আমার এই লেখার কোনও অসম্পূর্ণতা, অসংগতি, ভুল চোখে পড়লে অনুগ্রহ করে দেখিয়ে দেবেন, সত্যিই নতমস্তকে কৃতজ্ঞ থাকব। কোনও পরামর্শ থাকলে, দেবেন। কোনও প্রশ্ন মাথায় এলে, করবেন।
ছয়। এই লেখাটি লিখতে লিখতে কতদূর অবধি যাব, আমি জানি না। কীভাবে যাব, তা-ও জানি না। তাই বলা যায়, এই লেখায় কোনও নির্দিষ্ট ফরম্যাটে আমি চলব না। মাথায় যখন যা আসে বা লিখতে গিয়ে সামনে যখন যা পাই, তা-ই লিখে ফেলব। এর বাইরে আপনাদের কোনও জিজ্ঞাসা থাকলে তা কমেন্টবক্সে রাখবেন, জানা থাকলে জানাব, জানা না থাকলে জেনে জানাব।
এ লেখায় আমি বন্ধনীবিহীন অংশ, প্রথম বন্ধনী ও তৃতীয় বন্ধনীর সাহায্যে (ভেতরে) যথাক্রমে শুদ্ধ বা প্রমিত বা সংগত রূপ, অশুদ্ধ বা অপ্রমিত বা অসংগত রূপ ও কিছু ক্ষেত্রে, ব্যাখ্যা বা টীকা বা মনেরাখার টেকনিক লিখেছি। অর্থাৎ,---লিখব। (লিখব না।) [ব্যাখ্যা, দরকার হলে/প্রযোজ্য ক্ষেত্রে।]
তো ঠিক আছে, শুরু করা যাক!
আমি জানতাম যে, উনি আসবেন। (আমি জানতাম যে উনি আসবেন।)
অনেক কাজে টাকা খরচ হয়ে গেছে, যেমন/যেমন: আসা-যাওয়ায়, বই-কেনায়/বইকেনায়। (অনেক কাজে টাকা খরচ হয়ে গেছে, যেমন, আসা-যাওয়ায়, বই-কেনায়।) [আসা ও যাওয়া বিপরীত শব্দ কিংবা সমজাতীয় শব্দ নয়, তাই মাঝখানে হাইফেন। যদি হতো সমজাতীয় শব্দ, তবে হাইফেন লাগত না, যেমন দরদাম, ঝড়ঝাপটা। এ সম্পর্কে পরে আরও বিস্তারিত আলোচনা করব।]
সে ওখানেই যাবেই, এমন নয়। (সে ওখানেই যাবেই এমন নয়।)
এ-কথা আগে কেউ কখনও বলেননি, শ্রীবিকাশ দত্তই প্রথম বললেন। (এ কথা আগে কেউ কখনও বলেন নি, শ্রী বিকাশ দত্তই প্রথম বললেন।)
সব সময়ই এটা খাটে না। (সবসময়ই এটা খাটে না।) [সব-এর পর গ্যাপ না দিয়ে বসে যা যা: সবদিকে, (কিন্তু সব দিক, সবদিক নয়) সবকিছু, সবরকম, সবখানে, সবচাইতে, সবচেয়ে, সবরকম, সবশেষে ইত্যাদি।]
ইদানীং অনেকেই বিরামচিহ্ন, উদ্ধৃতিচিহ্ন এ-সব/এসব/এইসব নিয়ে সচেতন নন। (ইদানিং অনেকেই বিরাম চিহ্ন, উদ্ধৃতি চিহ্ন এ সব/এই সব নিয়ে সচেতন নন।)
এ ছাগলের মাংস, না ভেড়ার? (এ ছাগলের মাংস না ভেড়ার?)
সে আমায় নানানভাবে সাহায্য করে। (সে আমায় নানান ভাবে সাহায্য করে।) [লক্ষণীয়: নানান রকম, নানাপ্রকার, নানাবিধ, নানাভাবে, নানারকম, নানারকমের, নানারঙের, নানারূপ ইত্যাদি।]
সে থাকা না-থাকায় কী এসে যায়? (সে থাকা না থাকায় কি এসে যায়?)
ছেলেটা বাবা বাবা/বাবাবাবা/বাবা-বাবা বলে কাঁদছে। (ছেলেটা বাবা, বাবা বলে কাঁদছে।) [অনুরূপ: এত খাই খাই কোরো না। সে কখন থেকেই যাব যাব করে যাচ্ছ! ইত্যাদি।]
আমি এলাম, আর তুমি চলে গেলে? (আমি এলাম আর তুমি চলে গেলে?)
সে কাল আসেনি। আর, এলেও কীই-বা হতো? (সে কাল আসেনি। আর এলেও কী-ইবা/কীইবা হত?) [এ ধরনের ‘বা’-কে আলাদা করে না-লিখে (‘না লিখে’ অপ্রমিত) ‘বা’-এর আগে হাইফেন দিয়ে লেখা যায়।]
আমি লক্ষ করলাম, বিয়ে উপলক্ষ্যেই তার এখানে আসা। (আমি লক্ষ্য করলাম, বিয়ে উপলক্ষেই তার এখানে আসা।) [‘লক্ষ’ অর্থ ‘দেখা’ বা ‘নজর দেওয়া’, যেমন: সে কারও দিকেই লক্ষ করে না। ভালো করে লক্ষ করে দেখো, ছেলেটাকে চিনতে পার কি না। ‘লক্ষ্য’ অর্থ ‘উদ্দেশ্য’ বা ‘নিশানা’, যেমন: তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? সে আমটাকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ল। ‘উপলক্ষ’ ও ‘উপলক্ষ্য’ দুই বানানই সঠিক, তবে ‘উপলক্ষ্য’-ই বেশি সংগত। কয়েকটি বানান খেয়াল করি: লক্ষণীয়, লক্ষ্যভেদ, লক্ষ্যমাত্রা, লক্ষ্যচ্যুত ইত্যাদি।]
সুবিধেমতো যে-কোনও দিন এসো। (সুবিধেমত যেকোনো দিন এস।) [‘যে’-এর পর একটি হাইফেন চিহ্ন দিয়ে অন্য শব্দ যুক্ত করা যেতে পারে। যেমন যে-লোকটি, যে-কথা, যে-দিন ইত্যাদি। অনুরূপ: সে-দিন, সে-কথা, সে-দুই দিন, সে-কাজ, এ-দিক, এ-কথা ইত্যাদি।]
সম্পর্কের মধ্যে কিছু দেওয়া-নেওয়া থাকেই। (সম্পর্কের মধ্যে কিছু দেয়া-নেয়া থাকেই।) [‘ও’ বসবে।]
তা ছাড়া, ওদেরও সে-বিয়েতে মত ছিল না। (তাছাড়া ওদেরও সে বিয়েতে মত ছিল না।) [অনুরূপ: এ ছাড়া, যা হলে, যার পর ইত্যাদি। কিন্তু তারপর, এরপর, তাহলে ইত্যাদি।]
সবাই জানত না, কেউ-কেউ/কেউ কেউ জানত। (সবাই জানত না, কেউকেউ জানত।) [অনুরূপ: কখনও-কখনও, কোনও-কোনও, যা-যা, যে-যে, যাকে-যাকে, এক-এক, যেমন-তেমন, যখন-তখন, যখন-যখন, এদিক-ওদিক, যেরকম-সেরকম, যা-তা, যাকে-তাকে ইত্যাদি। হাইফেন না দিয়ে আলাদা দুই শব্দেও লেখা যায়, ওতে ভুল নেই।]
যেতে পারি, তবে/কিন্তু কেন যাব? (যেতে পারি তবে/কিন্তু কেন যাব?)
যাই/যা-ই হোক, সে কিন্তু লোক ভালো। (যাই হোক সে কিন্তু লোক ভাল।) [যাহাই>যাই/যা-ই]
তার গাড়ি, বাড়ি, সম্পত্তি সবই আছে। (তার গাড়ি, বাড়ি, সম্পত্তি, সবই আছে।) [শেষের কমাটা বসবে না।]
সে চলে যাবে, না কি থেকে যাবে, তা বোঝা যাচ্ছে না।/সে চলে যাবে, না কি থেকে যাবে বোঝা যাচ্ছে না। (সে চলে যাবে, নাকি থেকে যাবে, বোঝা যাচ্ছে না।) [বিকল্পপ্রকাশে ‘না কি’ হবে, ‘নাকি’ নয়।]
শুনেছি, তার নাকি অনেক টাকা? (শুনেছি, তার না কি অনেক টাকা?) [সংশয়প্রকাশে ‘নাকি’ হবে, ‘না কি’ নয়।]
যাবে না তো কী করবে? (যাবে নাতো কী করবে?) বললে না তো কখন আসবে! (বললে নাতো কখন আসবে!)
দুপুরের পর ছুটি আমার চাই-ই, কেননা আজ আমার বিয়ে। (দুপুরের পর ছুটি আমার চাইই, কেননা, আজ আমার বিয়ে।) [অনুরূপ: তাকে কেউ সাহায্য করেনি। বরং সে-ই সবাইকে পথ দেখাচ্ছে। উল্লেখ্য, তাহাই>তাই/তা-ই, যাহাই>যাই/যা-ই, কিন্তু সে-ই ও সেই (কিংবা এ-ই ও এই) একই অর্থ প্রকাশ করে না। উদাহরণস্বরূপ: ব্যাপারটা সে-ই জানে। (‘ব্যাপারটা সেই জানে।’…এটি অশুদ্ধ।) সেইদিনের পর তাকে আর দেখিনি। (‘সে-ইদিনের…’ এটি অশুদ্ধ।)]
তার চাকরি হলো; চেহারায় দীপ্তি এল; ঘরে সচ্ছলতা ফিরল। [তার চাকরি হলো। চেহারায় দীপ্তি এল। ঘরে সচ্ছলতা ফিরল।---এভাবেও লেখা যায়, তবে সেমিকোলন ব্যবহার করে লেখাই সংগত। ‘হলো, না কি হল?’ এটা নিয়ে পরে আলোচনা করেছি।]
এক জ্যোৎস্না-ধোয়া রাতে তার কথা ভাবছিলাম। (এক জ্যোৎস্না ধোওয়া রাতে তার কথা ভাবছিলাম।)
হঠাৎ মনে এল, কী সুন্দর করেই না সে কাজটা করে যাচ্ছে। (হঠাৎ মনে এল, কী সুন্দর করেই না সে কাজটা করে যাচ্ছে!) [principal clause-কে মাথায় রাখলে বাক্যটির শেষে দাঁড়ি বসবে, বিস্ময়সূচক চিহ্ন নয়। অনুরূপ: আপনি নিশ্চয়ই জানেন না, কবে আমি সেখানে যাব। বাক্যে শেষেও প্রশ্নবোধক চিহ্ন হবে না principal clause-কে মাথায় রেখেই।]
কীভাবে ওঁরা ওখানে গেলেন, আর কী করেই বা জায়গাটা খুঁজে নিলেন, সে এক বিস্ময় বটে! (কিভাবে ওঁরা ওখানে গেলেন আর কীকরেই বা জায়গাটা খুঁজে নিলেন, সে এক বিস্ময় বটে!)
যে সহে সে রহে। (যে সহে, সে রহে।) [‘যে সহে সে রহে।’ বাক্যে কমা অনাবশ্যক, তবে ‘যে…সে’, ‘যারা…তারা’, ‘যেখানে…সেখানে’ ইত্যাদি দিয়ে গঠিত বাক্য একটু দীর্ঘ হলে কমা দিলেও ক্ষতি নেই, বরং বাক্যের বোধগম্যতা বাড়ে। যেমন যে আমাদের এখানে এনেছে, সে-ই আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়।]
তার ঠিকানা ১৭ সি আর দত্ত লেইন, ঢাকা। (তার ঠিকানা ১৭, সি আর দত্ত লেইন, ঢাকা।) [একাধিক লাইনে ঠিকানা লিখলে কোনও লাইনের শেষেই কমা বা দাঁড়ি বসবে না। যেমন ১৭ সি আর দত্ত লেইন, ঢাকা।-কে দুইটি লাইনে লিখলে ‘লেইন’ ও ‘ঢাকা’-এর পর কমা, দাঁড়ি কিছুই বসবে না। যেমন কোনও দরখাস্তে বা চিঠিতে কোনও সম্বোধন লিখে, তার নিচে উক্ত ব্যক্তির পদবি ও ঠিকানা এক-এক লাইনে লিখলে প্রতিটি লাইন অবশ্যই শেষ হবে কমাবিহীনভাবে। এটা খুবই সাধারণ একটা ভুল, যা আমরা হরহামেশাই করে থাকি।]
কাজটা ত্বরিতগতিতে হয়ে গেল! (কাজটা তড়িৎগতিতে হয়ে গেল!)
আমাদের দাবি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-সরবরাহ/ বিদ্যুতের সরবরাহ। (আমাদের দাবি নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ।)
আমি তাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ জানাই। (আমি তাকে অন্তরের অন্তস্থল/অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই।)
তিনি মৌনপালন করছেন। (তিনি মৌনতাপালন করছেন।) [মৌনতা, সখ্যতা বলে কোনও শব্দ নেই।]
এতদ্দ্বারা সকলকে জানানো যাচ্ছে যে… (এতদ্বারা সকলকে জানানো যাচ্ছে যে…)
তিনি একটা ছোটখাটো/ছোটোখাটো ডিপার্টমেন্ট-স্টোরে চাকরি করেন। (তিনি একটা ছোটখাটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চাকরি করেন।) [ছোট, ছোটো দুই-ই সঠিক। তবে ছোট/ছোটো-এর সাথে কোনও শব্দ যুক্ত করলে ‘ছোটো’ বানানটিই বহুলব্যবহৃত। যেমন ছোটোলোক, ছোটোবেলা, ছোটোগল্প ইত্যাদি। আর-একটা মজার জিনিস মাথায় রাখা যায়। ইংরেজি শব্দকে সরাসরি বাংলায় ব্যবহার করলে যদি একাধিক শব্দ দ্বারা একটিই অর্থ প্রকাশ পায়, তবে সেগুলিকে একসাথে বা মাঝখানে হাইফেন দিয়ে লেখা যৌক্তিক। বাংলা শব্দের ক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক শব্দ দিয়ে যদি সমাসবদ্ধ পদ প্রকাশ পায়, তবে একই নিয়ম খাটে। এই লেখার শুরুতে এ কারণেই প্রয়োগসংক্রান্ত শব্দটিতে ‘সংক্রান্ত’কে আলাদা করে লেখা হয়নি। একই কারণে ‘বিদ্যুৎ-সরবরাহ’ লিখেছি, ‘বিদ্যুৎ সরবরাহ’ নয়। এটা নিয়ে পরে আরও আলোচনা করব।]
ধৈর্য ধরো, তোমার কাজ হবে। [অনুরূপ: কার্য, সূর্য ইত্যাদি। খেয়াল করতে হবে যে, বানানে য-ফলা নেই।]
তুমি অন্তত এমন করে বোলো না। (তুমি অন্ততঃ এমন করে বলো না।) [শব্দের শেষে বিসর্গ হবে না। অনুরূপ: ক্রমশ, সাধারণত, ইতস্তত (ইতস্ততঃ/ইতঃস্তত নয়) ইত্যাদি। তবে শব্দের মাঝে বিসর্গ বাদ যাবে না। যেমন অন্তঃকরণ, অন্তঃপুর। বোলো, না কি বলো, না কি বল…এ নিয়ে পরে আলোচনা করেছি।]
সে কী এক ভঙ্গিতে কথা বলে! (সে কী এক ভঙ্গীতে কথা বলে!) [অনুরূপ: সূচি (সূচী নয়), উর্বর (ঊর্বর নয়), প্রত্যুষ (প্রত্যূষ নয়), উষা (ঊষা নয়), উষ্মা (ঊষ্মা নয়), উর্বশী (ঊর্বশী নয়), ঊষর (উষর নয়), ঊর্মি (উর্মি নয়), অন্তরিক্ষ (অন্তরীক্ষ নয়), হিন্দি (হিন্দী নয়), সরকারি (সরকারী নয়), রচনাবলি (রচনাবলী নয়) ইত্যাদি। ব্যতিক্রম: চীন, কাশ্মীর।]
সে ফেসবুকে পোস্ট করল: এই একাকিত্ব আর ভালো লাগে না। (সে ফেসবুকে পোষ্ট করল: এই একাকীত্ব আর ভালো লাগে না।) [অনুরূপ: চমৎকারিত্ব, প্রতিযোগিতা, পারদর্শিতা ইত্যাদি। বিদেশি শব্দের কোথাও ‘ষ’-কে জায়গা দেওয়া যাবে না, তাই ‘পোস্ট’ হবে, ‘পোষ্ট’ নয়।]
ব্রিটেনের রানির নাম কী? (বৃটেনের রাণীর/রাণির/রানীর নাম কী?) [রানি, পূজারিনি, বাঘিনি, সিংহিনি, চাকরানি শুদ্ধ। কিন্তু তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ‘র’-এর পর ‘ণ’: হরিণী। বাকি ক্ষেত্রে আবার: গোপিনী, ঠাকরুন (‘ণ’ নয়)। এককথায়, ণত্ব-বিধানের নিয়মে যেখানে যেখানে ‘ণ’ হওয়ার কথা, অতৎসম শব্দের ক্ষেত্রে, সেখানে সেখানে ‘ন’ হবে। যেমন ঠান্ডা, লন্ঠন, লন্ডভন্ড, গন্ডগোল, গন্ডার ইত্যাদি। (‘ণ্ড’ নয়।) এ নিয়ে পরে আরও আলোচনা আছে।]
কী এক জাদু আছে তাঁর কথায়! (কী এক যাদু আছে তাঁর কথায়!) [অনুরূপ: জাদুঘর, জাদুকর, জোগাড়, জুঁই, জাঁতা, নামাজ, জোগানদার ইত্যাদি। ‘য’ দিয়ে লিখলে ভুল হবে না, তবে সংগত বানান ‘জ’ দিয়ে। তবে যূথী/যূথিকা শব্দদুটিতে ‘য’।]
সে যখন-তখন যা-তা বলে ফেলে। (সে যখনতখন যা তা বলে ফেলে।)
যা-কিছু বললে, তা-কিছু আমার মনে থাকবে। (যা কিছু/যাকিছু বললে, তা কিছু/তাকিছু আমার মনে থাকবে।)
ওঁদের সাথে ভালো ব্যবহার করো/কোরো। (ওঁদের সাথে ভাল ব্যবহার কর।) হলে ফিরে বইটা পোড়ো। (হলে ফিরে বইটা পড়।) [বর্তমানকালে পালনীয় অনুজ্ঞার ক্ষেত্রে অ-কারান্ত+ও-কারান্ত। ভবিষ্যৎকালের ক্ষেত্রে ও-কারান্ত+ও-কারান্ত।]
কাউকে বোলো না। (কাউকে বল/বলো না।) [না-বোধক বাক্যের অনুজ্ঞার ক্ষেত্রে ও-কারান্ত+ও-কারান্ত।]
আগে বলোনি/করোনি/শোনোনি কেন? (‘আগে বলনি/করনি/শোননি কেন?’…হবে না।) [দ্বিতীয় পুরুষের ক্রিয়াপদের না-বোধক অতীতের ক্ষেত্রে অ-কারান্ত+ও-কারান্ত+-নি]
মনে রাখার টেকনিক: অ-কারান্ত+অ-কারান্ত কেবল তুই তোকারি করা বাদে অন্য কোথাও ব্যবহার করার তেমন দরকার নেই। যেমন তুই কবে যাবি বল। তুই এটাই কর। ইত্যাদি। উপরে উল্লিখিত দুইটি ক্ষেত্র বাদে অন্য সকল ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়পুরুষের অনুজ্ঞা-ক্রিয়াপদে অ-কারান্ত+ও-কারান্ত। এটা মাথায় রাখলে অনেক অনেক ভুল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
তুমি ওঁদের চেন? (তুমি ওঁদের চিনো/চিন/চেনো?)
ওই দোকান থেকে কখনও কিছু কেন? (ওই দোকান থেকে কখনও কিছু কিন/কিনো/কেনো?)
জোরে ছুটো/ছোটো, সময় অল্প। (জোরে ছুট/ছোট, সময় অল্প।) [অনুরূপ: উঠো/ওঠো, জুটো/জোটো।]
আর কখনও রুইমাছ খেয়ো না। (আর কখনও রুই মাছ খেও না।) [অনুরূপ: আমগাছ, আঙুরফল; যেয়ো, দিয়ো, নিয়ো, গেয়ো, চেয়ো ইত্যাদি।]
মাঝেমধ্যে/মাঝে-মধ্যে চিঠি লিখো। (মাঝে মধ্যে চিঠি লেখো।) [অনুরূপ অনুজ্ঞা: শিখো। লক্ষণীয়: মাঝে মাঝে, মাঝেমধ্যে, মাঝেসাঝে।]
বাজার থেকে একটা অ্যারোসল আনিয়ো (=আনিয়ে নিয়ো)/আনো (=এখন নিয়ে এসো)/এনো (=পরে সময় করে নিয়ে এসো)। (বাজার থেকে একটা অ্যারোসল আনিয়/আন/এন।)
নিজেকে প্রশ্ন করো আমায় ভালোবাস/ ভালোবাসো কি না। (নিজেকে প্রশ্ন কর আমায় ভালবাসো কিনা।)
তুমি তো কখনও ভালোবাসোইনি! (তুমি তো কখনও ভালোবাসইনি!)
কিছু আলোচনা করা যাক। আনো, এনো দুইই শুদ্ধ হলেও ‘আসো’ লিখব না, ‘এসো’ লিখব। বর্তমান অনুজ্ঞা 'আইস' ও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা 'আসিয়ো' দুটি থেকেই স্বরসঙ্গতি/অপনিহিতি যোগে তৈরি হয়েছে 'এসো'। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে 'এসো হে বৈশাখ, এসো এসো', 'আসো' নয়। আইস>(স্বরসঙ্গতি/অভিশ্রুতি) এসো। 'আসো' আঞ্চলিক প্রয়োগ, প্রমিত রূপ 'এসো'। 'আনো' বর্তমান অনুজ্ঞা। 'আস' আছে, সেটা তুমি-র জন্য সাধারণ বর্তমান কাল। উদাহরণ: কখন আস, কখন চলে যাও, কিছুই খেয়াল করতে পারি না। 'এনো' ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা, আনিয়ো>(অপিনিহিতি) আইনয়ো>(ই-লোপ) আইনো>এনো (স্বরসঙ্গতি/অভিশ্রুতি)।
ওরা গেয়েছিল, “আমরা করব জয়।” (ওরা গেয়েছিলো, “আমরা করবো জয়।”) [‘_ছিলো’ হবে না। প্রথম-/দ্বিতীয়পুরুষের ভবিষ্যৎকালের ক্ষেত্রে (অনুজ্ঞা ব্যতীত) ক্রিয়ার শেষে ও-কারান্ত হবে না। দেখবো নয়, দেখব; জানাবো নয়, জানাবো; খাবো নয়, খাব; বলবো নয়, বলব; এগোবো নয়, এগোব; বলাবো নয়, বলাব; করছো নয়, করছ; বলাচ্ছো নয়, বলাচ্ছ ইত্যাদি। তবে অন্য কাউকে দিয়ে…আনানো, করানো, খাওয়ানো, বলানো, দেখানো ইত্যাদির ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎকালের প্রয়োগ নেই বলে শেষে ও-কারটা হচ্ছে। অতীতের নিত্য-অভ্যাস বোঝাতে কিংবা সাধারণ অতীতকালে তৃতীয় পুরুষের ক্রিয়ার শেষে ও-কার হবে না। বলাত, বলাতো নয়; করাত, করাতো নয়; যেত, যেতো নয়; গাইত, গাইতো নয়; খেলত, খেলতো নয়; এগোত, এগোতো নয়; বলল, বললো নয়; খেল, খেলো নয়; করল, করলো নয়; এগোল, এগোলো নয় ইত্যাদি। এটা বোঝার একটা সহজ টেকনিক আছে, যে-সকল ক্রিয়ার সাধু রূপটিতে শেষে ও-কারান্ত নেই, সে-সকল ক্রিয়ার চলিত রূপটিতেও ও-কারান্ত হবে না। এখানে প্রত্যেকটি ক্রিয়ার সাধু রূপটি মাথায় এনে দেখুন, একটিতেও শেষে ও-কার নেই। করিব, দেখাইব, জানাইব, খাইব, বলিব, এগোইব, বলাইব, করিতেছ, বলাইতেছ, বলাইত, করাইত, যাইত, গাহিত, খেলিত, এগোইত, বলিল, খাইল, করিল, এগোইল ইত্যাদি।]
বাজারে গিয়ে কী কী সবজি আনবে, সে তোমাকে তা-ই জিজ্ঞেস করেছিল কি? (বাজারে গিয়ে কি কি সব্জি আনবে, সে তোমাকে তা-ই জিজ্ঞেস করেছিল কি?) [কবজি, সবজি (সব্জি, কব্জি নয়)। বানান লক্ষণীয়।]
একটা গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক: ‘কি’, না কি ‘কী’? কখন ‘কি’ আর কখন ‘কী’ বোঝা খুব সহজ। কি/কী-কে প্রশ্ন করে হ্যাঁ/না উত্তর পেলে হবে ‘কি’, অন্য সব ক্ষেত্রে ‘কী’ বসবে। যেমন কী বলতে কী বলে ফেলি। (প্রশ্ন করে দেখুন, হ্যাঁ/না উত্তর পাবেন না।) বাড়ি কি গাড়ি কিছুই ছিল না তার। (প্রশ্ন করুন, হ্যাঁ/না উত্তর পাবেন। কীরকম? দেখা যাক। তার বাড়ি ছিল? তার গাড়ি ছিল?) আর কিছু নয়, শুধু প্রশ্ন করে দেখুন হ্যাঁ/না উত্তর আসে কি না। যদি না আসে, তবে ‘কী’ হবে, ‘কি’ নয়।
সে ওখানে যাবে কি না জিজ্ঞেস করো।/সে ওখানে যাবে কি না, তা জিজ্ঞেস করো। (সে ওখানে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করো।)
তার মতো একটা মানুষ কিনা আমার সাথে টক্কর দিতে আসে! (তার মতো একটা মানুষ কি না আমার সাথে টক্কর দিতে আসে!)
সে রাতে কিছু খাবে না কি জিজ্ঞেস করে দেখো।/সে রাতে কিছু খাবে না কি, তা জিজ্ঞেস করে দেখো। (সে রাতে কিছু খাবে নাকি জিজ্ঞেস করে দেখো।)
শুনলাম, সেও নাকি পরীক্ষায় পাস করে ফেলেছে? (শুনলাম, সেও না কি পরীক্ষায় পাস করে ফেলেছে?)
মনেরাখার টেকনিক: যখন প্রশ্ন করলে হ্যাঁ/না উত্তর পাওয়া যাবে, তখন হবে ‘কি না’। যদি হ্যাঁ/না উত্তর পাওয়া না যায় এবং বাক্যটি দিয়ে তাচ্ছিল্য বা সংশয় প্রকাশ পায়, তখন হবে ‘কিনা’। ‘না কি’ আর ‘নাকি’-র ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার।
সে বড় মানুষ কিনা, তাই অত ভাব! (সে বড়ো মানুষ কি না, তাই অত ভাব!)
অফিসে কি-না-কি ঝামেলা বেধেছে! (অফিসে কী-না-কী ঝামেলা বেঁধেছে!) [‘ঝামেলা বাধা’, ‘ঝামেলা বাঁধা’ নয়।]
সে তো মুখে-মুখেই গান বেঁধে ফেলে! (সে তো মুখে-মুখেই গান বেধে ফেলে!)
তাহলে, তুমি কাজটা করলে কী করে? (তাহলে তুমি কাজটা করলে কি করে?) [অনুরূপ: কীভাবে, কীরূপে, কীরকম, কীজন্য, কীজন্যে, কীরকমভাবে, কীসে, কীসের ইত্যাদি।]
আরও বলো, শুনতে ভালো লাগছে। (আরো বলো, শুনতে ভাল লাগছে।) [অনুরূপ: ‘কোনো, আজো, কালো, এখনো, এমনো, কখনো, তখনো, তারো’ না লিখে লিখব ‘কোনও, আজও, কালও, এখনও, এমনও, কখনও, তখনও, তারও’। তবে ‘কখনো, কোনো, এখনো, কোনোই, কোনোভাবে, কখনোই, কোনোমতে, কোনোক্রমেই’ এসব শব্দে ও-কে আলাদা করে দিলেও চলে, ও-কার আকারে রেখে দিলেও চলে। কোনোই, কোনোভাবে, কখনোই, কোনোমতে, কোনোক্রমে শব্দগুলিতে ‘-ও’-কে আলাদা করলে কেমন জানি জবড়জং লাগে দেখতে। উল্লেখ্য কারু, কারুর, কারো, কারোর শব্দগুলি অপ্রমিত, লিখতে হবে ‘কারও’। ‘কাউকে’ লিখতে হবে, কারুকে, কাওকে, কারোকে নয়। ‘যখনই, তখনই’ লিখব, ‘যখনি, তখনি’ লিখব না।]
…তার অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে। (…তার অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে যেনো কীর্তিনাশার দিকে।) [‘যেনো, কেনো, অতো, যতো, এতো, কতো, ততো, নয়ত, হয়ত’ ইত্যাদি বলে কোনও প্রমিত শব্দ নেই। আমরা ‘যেন, কেন, অত যত, এত, কত, তত, নয়তো, হয়তো’ লিখব। ভালো কথা। এগুলির মধ্যে ‘কেনো’ শব্দটি দ্বিতীয়পুরুষের অনুজ্ঞার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ: মনে করে আজকেই একটা ঘড়ি কেনো।]
এ তো রাগ নয়! (এতো রাগ নয়!)
ওরা এত কিছু জানে না। (ওরা এত কিছু জানেনা।) ওরা এতদিন জানতেই পারেনি। (ওরা এত দিন জানতেই পারে নি।) [‘না’ লিখতে হবে বিযুক্ত অবস্থায়, ‘নি’ লিখতে হবে যুক্ত অবস্থায়। ‘এত’-এর পর কয়েকটি শব্দ একসাথে বসে। যেমন এতদিন, এতটুকু, এতবার, এতসব ইত্যাদি।]
দুটোই অংকই একই রকম/রকমের। (দুটো অংকই একইরকম/একইরকমের।)
এইজন্যই এইটুকুও খেতে পার না। (এই জন্যই এই টুকুও খেতে পার না।)
কিছু আলোচনা।
১। একসাথে বসে এমন কিছু শব্দ: এইক্ষণে, এক্ষণে, এজন্য, এইজন্য, এইটুকু, এইবার, এবার, এইভাবে, এইমাত্র, এইপ্রকার, এমাত্র, এঁকেবেঁকে, এবেলা, একইভাবে, [‘ভাবে’ শব্দের অর্থ যদি হয় ‘রকমে’, তবে তা কখনওই আলাদা বসবে না, আগের শব্দের সাথে একসাথেই বসবে।] এককণা, এককালে, একচিত্তে, একচুল, একছুটে, একজাতীয়, একগুচ্ছ, একচিলতে, একজোট, এটুকু, এইরকম, এরকম, এইরূপ, এরূপ, এইসব, এসব, একগাল (হাসি, ভাত), এককাল, একতরফা, একতিল, একজোট, একনজরে, একনাগাড়ে, একবাক্যে, একবার, একবিন্দু, একটুকু, একজন্মে, একটুক্ষণ, একটুখানি, একতলা, একমাত্র, একরকম, একরাশ, একরূপ, একসঙ্গে, একসাথে, একসুরে, এমুখো, একহাঁটু, একহাজার, একহাত, একাগ্রচিত্ত, একাল, একাধিকবার, একশত, এককাট্টা (একাট্টা নয়), এক্ষেত্রে, একবর্ণ, একপেট, একপ্রকার, একফালি, একবার (সময় করে একবার এসো।), এক বার (যা বলার, এক বারই বলেছি, আর বলতে পারব না।), একবারে, একবিন্দুতে, একভাবে, একমত, একমনে, একমাত্র, একমুঠ, একমুঠো, একমুহূর্ত, একযোগে, একরকম, একরূপ, এপার (এ পার নয়, এ-পার নয়), এবড়োখেবড়ো (এবড়োথেবড়ো/এবড়ো-থেবড়ো নয়), এযাবৎ (এ যাবৎ নয়, এ-যাবৎ নয়।), একটুআধটু, একদম, একদমে, একদণ্ড, একদৃষ্টিতে, একদৌড়ে, একহৃদয়, একনজরে, একনাগাড়ে, একনিঃশ্বাসে।
এসব ‘এক’ দিয়ে সংখ্যা বোঝায় না, সংশ্লিষ্টতা বোঝায়। বোঝার সহজ নিয়ম হলো, ‘এক’ দিয়ে সংখ্যা বোঝালে ‘এক’-এর পর একটা গ্যাপ হবে, অন্যথায় হবে না। যেমন ‘সময় করে একদিন এসো।‘ ‘সে এখানে এক দিনই এসেছিল।’ শুধু ‘এক’ নয়, যে-কোনও সংখ্যাবাচক শব্দ দিয়ে সংখ্যা না বোঝালে সেই শব্দের পর কোনও গ্যাপ হয় না। যেমন ‘দুইদিনের দুনিয়া, এত ভেবে কী হবে?’ ‘এটা তো সোজা কাজ, আমি এটা দুইসেকেন্ডেই করে ফেলতে পারি!’ ‘আমি চাইলে দুইমিনিটেই তোমাকে বোকা বানিয়ে দিতে পারি।’ কিন্তু ‘মাইক্রোওভেনে সময় দুই মিনিট দেওয়া আছে।’ ‘আগের প্রতিযোগী পরেরজনের চাইতে দুই সেকেন্ড পরে গিয়ে পৌঁছলেন।’ একটা মজার জিনিস এখানে শিখিয়ে রাখি। ‘ট্রেনটা পৌঁছাতে আর কত সময়/কতক্ষণ লাগবে?’ ‘আমার সেখানে পৌঁছতে আরও এক ঘণ্টা লাগবে।’ বস্তুবাচক+পৌঁছা-, ব্যক্তিবাচক+পৌঁছ-। মনে রাখা ভালো: কতকাল, কতক্ষণ, কতদিন, কতদূর, কতরকম, কত রকমের, (রকম-এর আগে গ্যাপ নেই, রকমের-এর আগে আছে) কত সময় ইত্যাদি।
২। একসাথে বসে না এমন কিছু শব্দ: এই বেলা, এক আঁটি (শাক), এক পশলা (বৃষ্টি)।
৩। একইরকম মাঝখানে হাইফেন-যোগে বসে এমন কিছু শব্দ: এক-আধটা, এক-আধদিন, এক-এক করে, এক-একটি, এক-তৃতীয়াংশ, একে-একে, এখন-তখন (অবস্থা), এপাস-ওপার, এপিঠ-ওপিঠ, এদিক-ওদিক, এধার-ওধার, একথা-সেকথা, একটা-কিছু, একটা-দুটো, এখানে-ওখানে, এদেশ-ওদেশ, এখতিয়ার-বহির্ভূত (এক্তিয়ার নয়)।
উনি একজন এম বি বি এস ডাক্তার। (উনি একজন এম.বি.বি.এস./এমবিবিএস ডাক্তার।) [ডিগ্রি লেখার ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্তরূপের পর ডট দিতে হবে না। অনুরূপ: পিএইচ ডি (পি এইচ ডি নয় (‘Ph.D.’, ‘P.H.D.’ নয়।)), এম কম, এম ডি ইত্যাদি। তবে ‘ডট’-ও চলতে পারে। পি-এইচ. ডি., এম. কম., এম. ডি., এম. বি. বি. এস. এসবও শুদ্ধ।]
এমন-কী/এমনকি, এমনি করেও কেউ-কেউ বেঁচে থাকে! (এমনকি, এমনই করেও কেউকেউ বেঁচে থাকে!) [বোঝার সহজ উপায়: এমনি+অসমাপিকা ক্রিয়াপদ, এমনই+বিশেষ্যপদ/সমাপিকা ক্রিয়াপদ কিংবা এমনই (‘এতই’ অর্থে), আর এমনি (‘এমনিতেই’/‘একে তো’/‘আসলেই’/‘অকারণে’ অর্থে)]
কথাটা তো আর এমনি এমনি বলিনি। (কথাটা তো আর এমনিএমনি বলিনি।)
আমি ওখানে এমনিই গিয়েছি। (আমি ওখানে এমনিতেই গিয়েছি।) [এমনি অর্থ ‘কোনও কারণ ব্যতীত’, এমনিতে অর্থ ‘সাধারণভাবে বা সচরাচর’]
শুভ কামনা, বন্ধু! (শুভকামনা বন্ধু।) শুভ জন্মদিন, সাধনা! কিংবা আমি সাধনাকে শুভজন্মদিন জানালাম। (শুভ জন্মদিন সাধনা! কিংবা আমি সাধনাকে শুভ জন্মদিন জানালাম।) [শুভ জন্মদিন, শুভ কামনা, শুভ সকাল/দুপুর/বিকাল/সন্ধ্যা/রাত্রি ইত্যাদির ক্ষেত্রে মাঝখানে স্পেস লাগবে না, যদি তা noun (বিশেষ্য) বা noun phrase (বিশেষ্য-শব্দবন্ধ)-এর কাজ করে। আর-একটা উদাহরণ দিই---'শুভ সকাল! কী খবর? কেমন আছেন?’ কিংবা ‘আপনাকে শুভসকাল জানাচ্ছি। কী খবর? কেমন আছেন?’ আরও সহজ টেকনিক শিখিয়ে দিই, কেমন? Optative Sentence-এর বেলায় ‘শুভ’র পর গ্যাপ হবে, অন্য ক্ষেত্রে হবে না।]
(চলবে…)