সুচরিতাসু,
আমার ফ্ল্যাটের টুকরো-বারান্দায় গড়িয়ে-পড়া ভোরের নিথর আকাশে নিটোল প্রশান্তি। টবের রজনীগন্ধার স্তবকের শুভ্রতায় ঘুম ঘুম আবেশ। পোষা পায়রাজোড়ার রাঙা টুকটুকে পায়ে স্পন্দিত হতে চায় দিনের চঞ্চলতা। আমি এমন ক্ষণেই আপনার কথা ভেবে কলম তুলে নিই।
হ্যাঁ, আমি জানি, আমার সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাস পাঠকসমাজে আদৃত হয়েছে। জীবনবোধের মূর্তিমান প্রতীক হয়ে উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা পাঠকের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মাঝে মিশে গেছে। পাঠক আমার নিখুঁত জীবনচিত্রের পরিবেশনায় তৃপ্ত। তাই আমার প্রতি তাঁদের অগাধ শ্রদ্ধা। একটা বিশিষ্ট দিনে কোনো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু ফুলের সমারোহে কিছু বা দু-এক টুকরো গানের কলিতে হৃদয়ের কৃতজ্ঞতায় মণ্ডিত করে পাঠকদের প্রতিনিধি হিসেবে আপনি আমাকে অভিনন্দন জানাতে চান। তাই আপনি আমন্ত্রণলিপি পাঠান আমার কাছে। কিন্তু আসল কথা কী জানেন, আপনার আয়োজিত সভায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে কিছু নেবার মতো মানসিক অবস্থা তো আমার নেই। আমার প্রত্যাখ্যান বা সভায় আমার অনুপস্থিতিকে কেউ যদি আমার আত্মম্ভরিতা বা অহমিকায় ফোলানো-ফাঁপানো প্রকৃতি বলে ধরে নেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে আমার প্রতি অবিচার করবেন। যাতে এ ভুল বোঝাবুঝির অবকাশের সৃষ্টি না হয়, তার জন্যই আপনার উদ্দেশে এই কলম ধরা।
কাল আপনার নিমন্ত্রণপত্রটা পাবার পর থেকেই আমার আজন্মলালিত পরস্পরবিরোধী সত্তার সংঘর্ষ আবার প্রবল আকারে দেখা দিচ্ছে। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জগত চিরকাল আমাকে নিয়ে ছোট্ট বলের মত লোফালুফি করেছে, আর আমি প্রতিবারেই বিনা প্রতিবাদে দু-দিকের কাছেই আত্মসমর্পণ করে গেছি; কেননা আমার কাছে দুটো জগতই সমান সত্য। একটা সম্মোহন শক্তি আমার সম্পূর্ণ অগোচরে আমাকে আমার দৈনন্দিন জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যায়। ছোটোবেলায় পুতুল নিয়ে খেলার মতো আমি কল্পনায় আমার সৃষ্ট জীবনের প্রতিচ্ছবি নিয়ে খেলা করি। নিজের খেয়ালখুশিমতো ওদের ভাঙি, গড়ি, নূতন করে সাজাই। একটা নূতন জগতের সৃষ্টি হয়। আমার কাজের শেষ হয়। আমি ফিরে আসি আমার দৈনন্দিন জীবনের চত্বরে, যেখানে আছে আমার স্বামী, সন্তান, আত্মীয়-পরিজন। আমার সৃষ্টিশেষে আমি নায়ক-নায়িকাদের সম্পূর্ণভাবে ভুলে যেতে চাই। কেন, জানেন? কারণ আমি জানি, ওরা আমার স্বামী, সন্তান, আত্মীয়-পরিজন-ঘেরা সংসারে শান্তি ও সুখের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
যখন আমি প্রথম গল্প লিখতে চেষ্টা করি, সেই সেদিনকার ছোট্ট অঙ্কুরটির মাঝেই নিশ্চয়ই আজকের পল্লবিত আমিত্বের জন্ম হয়েছিল, সেদিন কিন্তু আমাকে কেউ অভিনন্দন জানায়নি। কেউ আমার বন্ধুর যাত্রাপথকে কিছুমাত্রও মসৃণ করবার জন্য এগিয়ে আসেনি। বরং চারিদিকের যথারীতি নিয়মকানুনের গণ্ডি ছাড়িয়ে আমার মাঝে একটা নূতন সত্তার আবির্ভাবে সবাই ছিল বিব্রত, কিছুটা-বা বিরক্ত। তার প্রমাণও পেতাম সবসময়ই। অনর্থক ঝুড়ি ঝুড়ি কথা লিখে লিখে সময় অপচয় করতাম ভেবে আমার বাবা তো আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সদাশঙ্কিত ছিলেন। মা অভিযোগ করতেন, আমি ঠিক আর দশটা মেয়ের যোগ্যতা নিয়ে বেড়ে উঠছি না। আর সবাই যেমন নিজেদেরকে ভাবি-সুনিপুণ গৃহিণী করে তোলার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করে তুলছে, আমারও ততটুকু শিক্ষাক্ষেত্রে সীমায়িত থাকাই যুক্তিসঙ্গত। তা না হলে সংসারে দুর্ভোগ আমার সুনিশ্চিত। ভাই-বোন আর বান্ধবীরাও প্রায়ই সেই অভিযোগ করত, আমি নাকি একটা মূর্তিমতী ব্যতিক্রম। আমাকে ওদের ঠিক সমগোত্রীয় মনে হয় না। তাই আমার সাথে চলবার ইচ্ছে থাকলেও চলতে চলতে ওরা হোঁচট খায়, মন ওদের বেঁকে বসে। আমার উপর বিরক্তি আসে।
আমি বুঝি, আমার গণ্ডিতে আমাকে নিয়ে কেউ তৃপ্ত নয়। আমার উপর কেউ আস্থাশীল নয়। আমি কিন্তু আমার পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ছোটোবেলা থেকে মায়ের সাথে থেকে সাংসারিক কাজে মাকে সাহায্য করেছি এবং নিজেও শিখতে চেষ্টা করেছি। ভাই-বোন'দের স্নেহপ্রীতিতে ভরে রাখতে চেয়েছি। বাড়িতে আত্মীয়-পরিজন এলে হাসিখুশিতে আপ্যায়ন করেছি, ঠিক যেমনি আজকের আমি আমার সংসারে স্বামীকে সেবাযত্নে তৃপ্ত রাখার চেষ্টা করি, সন্তানকে স্নেহমমতায় ঘিরে রাখতে চাই। একটা গোটা সংসারের টুকিটাকি থেকে শুরু করে এর সুখ, শান্তি, শৃঙ্খলাকে সুচারু হাতের পরিচালনায় আয়ত্তাধীন রাখতে চাই। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, এ প্রচেষ্টার পরিণতি অতীতেও যেমন ছিল, আজও তেমনই আছে। একটা ব্যগ্র কামনার ফলস্বরূপ আগেও যা পেয়েছি, আজও তা-ই পাই। আমার দুটো পরস্পরবিরোধী জগতের ব্যবধান আজও তেমনি আছে।
আমার চলবার নিজস্ব ধারা, পৃথিবীকে জানবার, দেখবার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আমার মনের অজস্র সুদূর আশা-আকাঙ্ক্ষা আজও আমাকে পরিচিত গণ্ডি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। আজও আমি আমার পরিচিত পৃথিবীতে চলতে চলতে আচমকা ছিটকে পড়ি কোনো এক নির্জন দ্বীপের পরিবেষ্টনীতে। যেখানে আমি চিরনিঃসঙ্গ, নির্বাসিত, অথচ সংসারের প্রতিটি ধূলিবালি, আমার প্রিয়জনদের ভাবনা-কল্পনায় মিশে যাবার জন্য আমার চিরবুভুক্ষ আত্মার আকুতি আমাকে ব্যথিত করে। তাই আমার ব্যক্তিসত্তার তাগিদে, কাজে, দায়িত্বে, কর্তব্যে নিজেকে সংসারের সবার মাঝে বিলীন করে দিতে চাই। সাংসারিক ছোটো-বড়ো কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চাই। আমার সাহচর্যে সংসারের এখানে-ওখানে একটু শ্রী ফুটিয়ে তুলতে, সংসারের প্রতিটি মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তদারকি করে বর্ষার বৃষ্টিধারার সমতুল্য হয়ে বিরাজ করতে চাই।
আমার কর্তব্যপালনের পথে যদি সংসারে কারও স্বার্থবুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, যদি হিংসাদ্বেষে ভরা কুটিল মনের বিষাক্ত সাপটা ফণা তুলে আমাকে দংশনে জর্জরিত করতে চায়, আমি তা মেনে নিতে চাই। দর্শনের বুলি, সৌন্দর্যের মাপকাঠি বা বিবেকের রীতিকে আগ্রাহ্য করতে হলেও তাকে অস্বীকার করতে চাই না। আমার আশে পাশে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে জীবনে অভ্যস্ত মানুষগুলোর মতো হতে চাই এবং যারা এই পৃথিবীর ধূলিমাটির গ্লানিকে, পৃথিবীর ক্লেদাক্ত রূপটাকে স্বীকার করেও নির্বিকার সহজ জীবন কাটাতে পারে, তাদের গ্রহণশীল ক্ষমতাকে মাঝে মাঝে যেন আমি ঈর্ষা করি।
এমনি করেই আমি আমার শিল্পীসত্তার কামনা-বাসনাকে ছেঁটে নিয়ে পৃথিবীর ধূলিকণার সাথে মিশে যেতে চাই। আত্মীয়-পরিজনদের সাথে একাত্ম হতে চাই। নিজের মনের প্রতিবিম্বে ওদের দেখতে চাই। ওদের মনের প্রতিবিম্বে নিজেকে দেখতে চাই। নিজের জীবনের লয়কে সুদক্ষ সংগীতশিল্পীর মতো নিজের আয়ত্তে রাখতে চেষ্টা করি। নিজেকে মুষ্টিবদ্ধ শক্তিতে সংযত রাখতে চাই।
কিন্তু একদিন আমার সব চেষ্টা বিফল হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই দৃঢ়মুষ্টি শিথিল হয়ে আসে। আমার দৈনন্দিন জীবনের আড়ালে-আবডালে সঞ্চিত কোনো সুরের মায়া, কারওবা বেদনাহত জীবনের টুকরো ছবি, কখনো আমার পথের পাশে অবহেলায় বেড়ে-ওঠা কোনো বুনোফুলের চেতনা কোনো এক রন্ধ্রপথে ঢুকে পড়ে আমাকে বিভ্রান্ত করে, আমাকে নিয়ে আবার সেই সম্মোহনী শক্তি নির্জন দ্বীপে অদৃশ্য হয়, যে-দ্বীপের আকাশের অজস্র তারার মালা আমার মণিহার হয়ে দুলতে থাকে। আমি আবার সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে যাই। তখন ইচ্ছে করে, আমার নবউন্মেষিত আলোকে আমার চারিপাশের পৃথিবীটাকে চমকে দিই, নিজেকে নূতন নূতন পরিচয়ে অভিষিক্ত করি।
শুধু দেখি, কেমন করে সন্ধ্যার প্রশান্ত আকাশে একটি একটি করে তারা ফোটে, কেমন করে আমার টবের রজনীগন্ধা আধোলাজে আধোগন্ধে আঁখি মেলে। সব দায়িত্ব, কর্তব্য, সীমায়িত পৃথিবী পেছনে ফেলে আমি শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যাই। আমার শিল্পীসত্তা এবং ব্যক্তিসত্তা, যাদের পরস্পরবিরোধী দ্বন্দ্ব আমাকে যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে সর্বদা—এ দুটোকে কিন্তু আমি এক করে নিতে পারি না এবং পারবও না। দুটোই আমার সমান প্রয়োজন এবং দ্বিধাবিভক্ত জীবনে সমান অনুভূতিশীল।
আকাশ পাড়ি দেবার আকাঙ্ক্ষাটা পাখির কাছে সত্য। কিন্তু পাখি তো সারাদিন-রাত্রি আকাশের বুকে ডানা মেলে কাটায় না। গাছের মাথায় নীড়ের মাঝে ফিরে ফিরে আসে, কেননা এটাও পাখির প্রকৃতির একদিক। দুটো প্রকৃতিই পাখির কাছে সমান সত্য। পাখির মতো আমারও দুইটি সত্তা যদি সমান সত্যতা নিয়ে পরিণতি না পেত, আমার জীবন এত দ্বন্দ্বমুখর হত না।
তাই বলছিলাম, আপনার আয়োজিত সভায় দাঁড়িয়ে অভিনন্দন নেবার মতো মনের অবস্থা তো আমার নেই। কেননা আমি তো এ অধ্যায়কে ভুলে থাকতে চাই। আমার এ অধ্যায় আমার কাছে স্বামী-সন্তান-পরিজন-ঘেরা পরিচিত পৃথিবীটাকে অপরিচিত করে তোলে, আমার মাঝে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে, আমার মনের প্রশান্তি কেড়ে নেয়। আশা করি, এবার আপনি আমার অসম্মতির পেছনের কারণকে বুঝতে পারবেন। আমার অনুপস্থিতিকে আমার আত্মম্ভরিতায় নিজেকে নিয়ে মিথ্যা ফানুসের অবতারণা বলে ভুল করবেন না। ভরসা রাখি, নিজেকে বোঝাবার মতো অন্যের মনকেও বুঝবার ভার নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকে আমাকে মুক্তি দেবেন। আমার হৃদয়ের অজস্র প্রীতি জানিয়ে আজকের মতো সমাপ্তি টানলাম।
ইতি
গীতালি দত্ত