আমার বন্ধুবর অনেক আগেই একজন মহিলার পাণি গ্রহণ করেছে। তার মতে, এই সভ্যজগতে নারীর ভূমিকা নাকি সর্বাধিক। হঠাৎ একদিন সে আমাকে মিষ্টির দোকানে নিয়ে গেল। বসে বসে গোটা আটেক গিললাম। মিষ্টিমুখের কারণ জানতে চাইলে সে সহাস্যবদনে গর্বোৎফুল্ল মনে সাধুভাষায় বলতে লাগল, “আমার গৃহে একটি সুশ্রী কন্যাসন্তান অল্প দ্বিপ্রহরে জন্মগ্রহণ করিয়াছে।” ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বললাম, "আরে ভাই, মেয়ে হয়েছে, করবে দুঃখ, তা না করে করছ গর্ব! প্রত্যক্ষ উৎকোচ, মানে পণের টাকার কথার খেয়াল আছে? বিয়ে না দিয়ে তো আর নিস্তার নেই!"
আমার কথা শেষ হতে না হতেই বন্ধুবর গর্জে উঠে বললে, “তুমি আসলে এ সভ্যজগতে একটা আস্ত অসভ্য।” হতভম্ব হয়ে মুখ নিচু করে সামনের চায়ের কাপের রূপ দেখতে লাগলাম। তখন বন্ধুকে আর দেখলাম না। একটু বিস্মিত হলাম, কারণ অসভ্য হিসেবে এই সভ্য পরিবেশ থেকে চলে যাবার কথা আমার, অথচ চলে গেল সে।
সভ্যতা, অসভ্যতা সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা নেই, তবুও বন্ধুর কাছে শুনেছি, নিউ মার্কেটে নাকি সভ্যতার কিছু ছোঁয়াচ আছে; সুতরাং আনমনা হয়ে সে দিকেই পা বাড়ালাম। ভাবলাম, একটু দেখে আসি আমার মতো একটা অসভ্য এবং সেই সভ্যতার মধ্যে তফাত কোথায়! একটু অগ্রসর হয়ে একটা সিগারেট বের করলাম। সাথে আগুন ছিল না, পাশেই একজন মাঝারি সাইজের ভদ্রলোক দেখলাম—হাতে ছোটোখাটো একটা ব্যাগ, চেহারা সুন্দর, গায়ে সুন্দর কাজ-করা শার্ট এবং পরনে বেমালুম মোটা কাপড়ের প্যান্ট।
বললাম, "এই যে ভাই, একটা দেশলাই হবে?" আমার কথা মুখ থেকেও বেরোয়নি, সেই ভদ্রলোক কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে চাপা কণ্ঠে, নাকটাকে উঁচু করে বললেন, “ইডিয়ট!” সিগারেটটা হাত থেকে পড়ে গেল। সামনাসামনি হওয়ায় তাঁর রঞ্জিত ঠোঁট আর কণ্ঠস্বর শুনে বুঝলাম, আমার সামনের সেই ভদ্রলোক আসলে আসলে পুরুষই নন, একজন ষোড়শী যুবতী।
এইবার একটু টের পেলাম, সভ্যতা কী!
এতক্ষণ ‘অসভ্য’ ছিলাম, এবার ইডিয়ট হয়ে হাঁটতে লাগলাম। এক নম্বর গেইটের কাছে এসে দেখলাম, তিন জন যুবক মাথা তিনটি একত্রিত করে একই দেশলাইয়ে আগুন থেকে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করছে; দেখে ভাবলাম, এ আবার কেমন সভ্যতা!
অগ্রসর হলাম। দেখলাম, ফিসফিস করে তারা কী যেন বলছে, এক বন্ধু একজন যুবতীর গিকে আঙুল উঠিয়ে বলল, “ওই আসছে।” কিছুই বুঝলাম না। যুবতীর দিকে তাকালাম। দেখলাম, ইঞ্চি চারেক উঁচু একজোড়া জুতো মেয়েটির পায়ে। পিঠ-সহ উদরের অর্ধাংশ পর্যন্ত কাপড়ের লেশমাত্র নেই। উঁচু জুতোর তালে তালে দেহের এই অংশের মেদবহুল এলাকাটা বেশ দুলছে। ঝিরঝিরে পাতলা কাপড় ভেদ করে রূপের আগুন জ্বলছে!
যুবকদের নিকটবর্তী হতেই তাদের একজন অন্যমনস্কতার ভান করে এই তরুণীকে ঈষৎ ধাক্কা দিল। তাল সামলাতে না পেরে যুবতী খানিকটা হড়কে গিয়েই আবার উঠে দাঁড়াল।
তিন জনের বাকি দু-জন কপট সহানুভূতির সঙ্গে মেয়েটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। তাদের চোখে-মুখে অর্থপূর্ণ হাসি। শুধু পাশ থেকে আমি, ইডিয়ট আর অসভ্যটাই, চুপ করে রইলাম। যুবাদের মধ্য হতে যে ধাক্কা দিয়েছিল, সে কপট অনুতপ্ত মন নিয়ে যুবতীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করতেই যুবতীটি চিৎকার করে তাকে বলে উঠল, ইডিয়ট, অসভ্য! তখন অমার মনটা আনন্দে ভরে উঠল; ভাবলাম, ছেলেটির সাথে বন্ধুত্ব করা চলতে পারে, কারণ আমরা দু-জনই এখন অসভ্য এবং ইডিয়ট। অধিকন্তু, আমি ও আমার বন্ধু, সেই পুরুষবেশী যুবতী ও এই যুবতীর কাছ থেকে এটাই শিখলাম যে, ভদ্র হতে হলে মানুষকে অসভ্য ও ইডিয়ট বলতে হয়।
পরক্ষণেই, ওই তিন যুবকের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন, “আহ্ ম্যাডাম, রাগ করছেন কেন? নিউটনের তৃতীয় সূত্র তো জানেন। সকল ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। সুতরাং আমার বন্ধু যদি আপনাকে ধাক্কা দিয়ে থাকে, তবে আপনিও নিশ্চয়ই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তাকে আর একটি সমান পরিমাণের ধাক্কা দিয়েছেন। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় উঁচু জুতোর দরুন নিজেকে আপনি সামলাতে পারেননি, আমার বন্ধু পেরেছে, কারণ তার পায়ে আছে অপেক্ষাকৃত নিচু জুতো। এবার বলুন, দোষটা কার, আমার বন্ধুর, না আপনার ওই উঁচু জুতোর?”
এ কথায় যুবতী প্রায় হেসে ফেলল। বলল, “যাক, যা হবার হয়েছে। তবে এভাবে মেয়েদের সঙ্গে আর কখনও ব্যবহার করবেন না। কেমন!” আরে, এ আবার কেমন কথা! এ দেখি, এদের মধ্যে ভাব হবার মতো একটা অবস্থা ঘনিয়ে আসছে! তখন মনটা খারাপ হয়ে গেল; বুঝলাম, যার সাথে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছি, তার সঙ্গেও বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। কারণ সে একটা ‘সভ্য অসভ্য’, আর আমার দরকার একটা ‘অসভ্য অসভ্য’-কে। এমন অদ্ভুত সভ্যতার নিদর্শন দেখে, তখন আমার সভ্য হবার আশার জীবন্ত সমাধি ঘটল।
কিছুদিন পর একদিন সেই বন্ধুর বাড়িতে গেলাম। তাদের খাটের ওপরে বিভিন্ন রকম প্রসাধন দ্রব্য রাখার একটি সুন্দর তাক ছিল। যে-দড়ি দিয়ে তা খাটের সাথে বাঁধা, তা এখন পুরোনো হয়ে গেছে। আমি গিয়েই আগের অভ্যাসমতো সেই দড়িতে হেলান দিয়ে বসলাম। পাশেই বন্ধু বসা; ছ-জনে গল্প করছি। এমন সময় বন্ধুর বড়ো মেয়েটি এসে বলতে লাগল, “হ্যালো, হ্যালো!”; কিছুই বুঝলাম না। বন্ধু বলল, “কী রে মা বিউটি, কী বলবি?” মেয়েটি বোয়াল মাছের মতো হাঁ করে করে কী যেন বলল। যতটুকু বুঝলাম, সে বলল, “আমি তোমাকে আর বাবা বলব না।” বন্ধু বলল, “কেন?” সে জবাব দিল, “বাবা বললে ঠোঁটের লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু ড্যাডি বললে মোছে না। তাই আজ থেকে তোমাকে ড্যাডি বলে ডাকব।” সগর্বে বন্ধু বলল, “ঠিক আছে, মা, ঠিক আছে।”
এবার বুঝলাম, মেয়েটি প্রথমে কেন হাঁ করে কথা বলছিল। কিন্তু এইসব শুনে আমার দেহ ঢলে পড়ল, মনে হলো যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। বন্ধু যখন আমাকে ধরে ওঠাল, তখন দেখি, মাথার ওপরে আকাশ নয়, সভ্যতার মূর্ত প্রতীক প্রসাধন-সমেত সেই তাকটি দড়ি ছিঁড়ে আমার দেহের উপর পড়ে আছে। দড়িটা একটু পুরোনো হয়েছিল কিনা!
এরপর বন্ধুকে লক্ষ করে বললাম, “হায়রে বাবা! সভ্যতার চাপে পড়ে হয়েছিস ড্যাডি, কখন আবার ‘গদা’ হয়ে মাথার ওপর পড়িস কে জানে, কাজেই আমি চললাম।”