তোমাকে যত বারই বলেছি, এবার একটু পড়োটড়ো, চাকরির বইগুলি ওলটাও, আমাকে বিয়ে করতে হবে না? তুমি মৃদু হেসে হেসে তত বারই বলেছ, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি মেধাবী মানুষ, কত কী-ই তো জানতে, বুঝতে! শুধু বোঝোনি কখনও, এই দেশে লোকে মেধাবী বলে চাকরি পায় না, বরং চাকরি পেলেই তবে মেধাবী হয়!
আমার জন্য নানান রকমের অপূর্ব সব ফুল এনে দিতে, খুঁজে খুঁজে এনে দিতে এমন প্রতিটি মুহূর্ত, যা যা আমার পছন্দের। তোমার পুরোটা ভাবনাজুড়ে এক আমিই ছিলাম। তোমার সাথে দেখা হবার চাইতে সুন্দর কোনও ঘটনা আমার এ জীবনে আর কখনও ঘটেনি।
প্রায়ই বলতাম, আমাকে নিয়ে ভাবা বাদে তোমার আর কোনও কাজ নেই? বলতে, না, নেই। তো? ফের বলতাম, নিয়তি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, তা আমরা কেউই জানি না। তবু এর উপর ভর করে বসে থাকলে হয়, বলো? খুব শব্দ করে করে হেসে বলতে, অত ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে! আজ হারিয়ে নিশ্চয়ই তুমিও আমার মতো অনুভব করতে পারো, ওরকম করে একতুড়িতে কথাকে উড়িয়ে দেওয়া যায়, জীবনকে নয়।
আমাকে কোন রঙের পোশাকে মানাবে, ম্যাচিং করে কী কী অলংকার পরতে হবে,...এমনকি আমার জুতোর ডিজাইনটা পর্যন্ত তোমার মাথায় থাকত! আমি কী করব, আমার কী কী লাগবে, আমার কখন কী ইচ্ছে করে---সবই তোমার ভাবনায় লেপটে থাকত। থাকত না শুধু, তোমাকে একটা চাকরি পেতে হবে, এই পরম সত্য কথাটি!
তোমার বাবা সৎ ছিলেন, তার চাইতে বড়ো কথা, তিনি বৈষয়িক মানুষ ছিলেন না। যা হয় আরকি, চলে যাবার সময় তিনি তোমাদের জন্য তেমন কিছু রেখে যাননি। এসব তুমি জানতে, তবু আমায় ভালোবাসতে বাসতে মাথায় আনবার সময়ই পেতে না!
সত্যিই কাউকে ভালোবাসলে ভালোবাসা বাদেও আরও অনেক কিছু করার থাকে। মানুষ তো আর চাঁদের আলো খেয়ে বাঁচে না! ভালোবাসায় দাবি যেমন থাকে, তেমন থাকে দায় ও দায়িত্ব।
তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছ, ইংরেজিতে ছিলে বরাবরই কাঁচা। অঙ্কটা নাহয় না পড়েও পারতে, তবু ইংরেজিটা তো পড়তে হতোই! পড়তে কি আদৌ? চাকরির পরীক্ষা যা দিয়েছ, তার একটিতেও তো সেই প্রমাণ কখনও দেখিনি!
আমার চুল তুমি খুব ভালোবাসতে। বইয়ের পাতায় পাতায় আঁকতে আমার এলোমেলো চুলের নানান বিন্যাস। এসব দিয়ে চাকরি হয়, বলো? ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে যা যা লাগে, তার প্রত্যেকটি নিয়ে ভাববার নামই ভালোবাসা। কেন সেসময় মাথায় আসেনি এসব? এত অল্প বুঝে ভালোবাসা হয় না। সত্যিই হয় না গো!
আমাদের গোটা একটা জীবন একসাথে কাটাবার কথা ছিল। তা হলো আর কোথায়! তোমার বয়েসি একটা মেয়েকে কোন বাবা বিয়ে না দিয়ে রেখে দেয়, যদি যোগ্য পাত্রের সন্ধান মেলে? তোমার একটা বোন থাকলে তুমি নিজেও কি দিতে রেখে? আমাদের বন্ধুত্ব ছিল, চমৎকার বোঝাপড়াও ছিল, শুধু বোধটা ছিল না। অবশ্য, আমার যে একেবারেই ছিল না, তা কিন্তু নয়। অসংখ্য বার আমি তোমাকে এসব বলেছি। মনে করে দেখো।
আমি বোধ হয় কিছু সত্য আগে থেকে আঁচ করতে পারি। আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকে চাই। তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না, এরকমই বিশ্বাস করেছি সবসময়। আমার সমস্ত ভাবনার দায়িত্বটুকুও তোমারই ছিল। যখন এসব মনে আসত, তখন ভাবতাম, আমার অনুভূতি আর আমার বাবার অনুভূতি তো এক নয়! আমি তোমাকে যতটা ভালোবাসি, আমার বাবাও তো আমাকে ঠিক ততটাই ভালোবাসে! বাবার কাছে আমার ভাবনার নয়, আমার দায়িত্ব যে মানুষটি নিতে পারে, একমাত্র সে-ই জরুরি।
হাতজোড় করে বার বার বলেছি, আমার বাবার সাথে দেখা করো। করলে না। তোমার সংকোচ দেখে আমার মোবাইল থেকেই মায়ের সাথে কথা বলতে অনুরোধ করেছি। বললে না। তোমার বয়েসি একটা মেয়ের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব আসার পথটা বন্ধ করে দিতে পারে, এক তুমি বাদে পৃথিবীর আর কোন শক্তি? তুমিই বলো!
হয়তো ভেবেছিলে, কোন মুখে যাবে আমাদের বাসায়! এক বারও ভাবোনি, আমার মতন একটা মেয়ে তার বাবার সামনে কোন মুখে সমস্ত লজ্জার মাথা খেয়েছে তোমার জন্য! আমার কথা বাসায় কখনও বলোনি পর্যন্ত! বলতে আর হবেও না, বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছ! জানো, একজন পুরুষের ভালো হবার চাইতে অনেক বেশি জরুরি সাহসী হওয়া!
তুমিই বলো, আমি এর বাইরে আর কী করতে পারতাম? আমি অন্য কারুর হয়ে যেতেও পারি, তা তুমি বড্ড বেশিই অবিশ্বাস করতে! ভাবতে, সব ঠিক হয়ে যাবে! অথচ দেখো, নিজে নিজে কিছুই ঠিক হয় না, সব কিছুই ঠিক করতে হয়!
আচ্ছা, এখনও বিয়ে-থা করছ না কেন? এখন তো তোমার চাকরি আছে, পায়ের নিচে দাঁড়াবার মতো মাটি আছে। মা কিছু বলেন না তোমাকে? আমি বেঁচে আছি। আমার ছেলেটা বড়ো হচ্ছে। ওর জন্য প্রার্থনা কোরো, বড়ো হবার পর ও যেন কক্ষনো ওর প্রেমিকাকে না বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে! এই চারটি শব্দ আমাদের দুজনকে চার আলোকবর্ষ দূরে সরিয়ে দিয়েছে!
আমি আজ জানি, সব ঠিক হয়ে যায় না। আমাদের সব ঠিক হয়ে যায়নি, দুজনের দুরকমের জীবন হয়েছে শুধু। ভবিষ্যতটা ঠিকঠাক পেতে চাইলে বর্তমানটা ঠিকঠাক করতে হয় নিজেকেই, কেননা সব ঠিক করে দেবার বিন্দুমাত্রও দায় ঈশ্বরের নেই।