সংগীত প্রার্থনাই

এক। জ্ঞান থেকে গান, আবার গান থেকে জ্ঞান। গান ও জ্ঞানের সম্পর্কটি একেবারেই প্রিয়তম বন্ধুর সম্পর্ক, ঠিক যেন দেহের সাথে আত্মার সম্পর্ক।

কীরকম?

জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ছন্দ ও লয়ে মন ডুবিয়ে দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ চর্চায় গান সৃষ্টি করা যায়। জ্ঞানের সবচাইতে সুন্দর প্রয়োগ হতে পারে আনন্দের উপকরণ তৈরিতেই। গানের চেয়ে আনন্দের শুদ্ধ-সুন্দর উৎস আর কী আছে! জ্ঞানের ঊর্ধ্বলোকে বিচরণ করার সময়ে মানুষ নিজের অন্তরে সুরের পাকাপোক্ত অধিষ্ঠান করতে পারাকেই পরিপূর্ণতার সার্থক অবয়ব হিসেবে অনুভব করে। এভাবেই একসময় নিজের অজান্তেই এই বোধ জন্মে যায়: আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ… আহা, অনন্তের পথে এ-ই তো পথচলার শুরু!

জ্ঞান থেকে গান সৃষ্টি করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ সুরস্রষ্টা-গীতিকার।

গানের রহস্যাবৃত অচিনপুরে বাস করতে করতে শরীর ও মন সুরের মধ্যে আলতো করে ভাসিয়ে দিয়ে প্রতিটি মুহূর্তের যে-যাপন, তা আন্তরিক প্রার্থনার সমতুল্য।

প্রার্থনার মধ্য দিয়ে মানুষ যেভাবে চৈতন্যের জাগরণ ঘটাতে পারে, ঠিক তেমনি গানের ভুবনে নিজের সমস্ত ভাবনা ও ইন্দ্রিয়ের অবগাহনে মানুষ ক্রমেই জীবাত্মার স্তর পেরিয়ে পরমাত্মায় পৌঁছে যায়। ব্রহ্মত্বে অধিষ্ঠিত হবার সাধনায় গানের চেয়ে বড়ো প্রার্থনা আর হয় না। হৃদয়কে ভগবানের পায়ের কাছে সঁপে দেবার শুদ্ধতম মাধ্যম‌‌ই গান।

গান থেকে এমনি করে জ্ঞানের ঊর্দ্ধস্তরে আরোহণ করেছেন যাঁরা, তেমন কিছু সাধক হচ্ছেন লালন সাঁই, ভক্ত রামপ্রসাদ, কৃষ্ণপ্রিয়া মীরাবাঈ, ভক্ত তুলসীদাস, গগন হরকরা প্রমুখ ঈশ্বরে-নিবেদিত মহাত্মা।

আধ্যাত্মিক সাধনায় গান প্রার্থনার সমকক্ষ হিসেবে যুগে যুগে প্রমাণিত, তাই বিবেচিত। মন ভালো করতে গান, মন শান্ত করতেও গান। সৃষ্টিকর্তার সাথে নীরব-নিভৃত বোঝাপড়া ও আলাপনের জন্য গান তথা সুর মনকে পুরোপুরি উপযোগী ও তৈরি করে দেয়। প্রার্থনাও কি ঠিক তা-ই করে না? বিভিন্ন ধর্মমতের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ঘাঁটলে গান ও সুরের এই বিশেষ আদর-কদর খুব স্পষ্ট করেই বার বার চোখে পড়ে। গান ভালোবাসলে স্রষ্টার সাথে কথোপকথনের রাস্তা ধীরে ধীরে খুলে যায়।

দুই। সংগীত হচ্ছে প্রার্থনার সবচাইতে ভালো রাস্তা। গাইবার সময় ঈশ্বর তথা চৈতন্যকে নিজের স্মৃতি ও মননের সরাসরি সংস্পর্শে রাখাটা সহজ হয়ে যায়। এই লেখায় আমি একটি বিশিষ্ট প্রার্থনা-সংগীতের ভাবার্থ বা মর্মার্থ নিয়ে আলোচনা করছি। কোন সংগীতটি নিয়ে কথা হচ্ছে, লেখাটি পড়ে তা বলতে পারলে আপনার জন্য উপহার হিসেবে থাকছে তিনটি বেদান্ত গ্রন্থ। (প্রথম তিন জন সঠিক উত্তরদাতা উপহার পাবেন।)

১. তুমি সংসারের সকল বন্ধনের যন্ত্রণা থেকে আমাদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকো। সারাজগত‌ই তোমার বন্দনা করে। আমরা তোমাকে হৃদয়ের সমস্ত ভক্তি দিয়ে বন্দনা করি। তুমি ভক্তের ব্যাকুলতায় সাড়া দিতে নতুন নতুন রূপ ধারণ করো, অথচ তাতে তোমার অবয়বে কোনো দাগ পড়ে না—তুমি তাই নিত্য, অপরিবর্তনীয়। তুমি নির্গুণ তথা ত্রিগুণাতীত, অর্থাৎ সত্ত্ব (মঙ্গল, ভারসাম্য), রজঃ বা রজস (আবেগ, উত্তেজনা) ও তমঃ বা তমস (নিস্তেজতা বা নিষ্ক্রিয়তা, উদাসীনতা, জড়তা বা অলসতা)—এই তিন গুণের প্রভাব বা মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত; তবু তুমি ভক্তের হৃদয়ের সাথে মেলবন্ধন সৃষ্টি করার প্রয়োজনে সগুণ বা সাকার রূপ ধারণ করো, যাতে ভক্ত তথা উপাসক সবিকল্প সাধনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে নির্বিকল্প সাধনাস্তরে তথা পরব্রহ্মের জ্ঞানস্তরে পৌঁছতে পারে।

২. তুমি এই জগৎ থেকে সকল পাপ তথা মলিনতা দূর করে আমাদের হৃদয়কে নির্মল করে থাকো। তুমি সারাজগতের অলংকার, কেননা তোমার ঔজ্জ্বল্য প্রকাশিত হলেই জীব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তুমি চৈতন্যময়, তাই তোমার প্রকাশ তথা দেহ‌ও মূলত চৈতন্যময়। চৈতন্যের জাগরণ‌ই তোমার জাগরণ। জ্ঞান তোমার চোখের কাজল, আর জ্ঞানের প্রকাশেই তুমি প্রকাশিত হ‌ও। তোমার এমন প্রকাশ যখন জীবের মধ্যে ঘটে, জীব তখন মোহমুক্ত হয়, চৈতন্যের পথে চলতে শুরু করে।

৩. তুমি আধ্যাত্মিকতার এক উজ্জ্বল সমুদ্র, তোমার মধ্যে ডুব দিয়ে নিজের পুরোটাকেই খুঁজে পাওয়া যায়। আধ্যাত্মিকতায় যাত্রা তো মূলত নিজের মধ্যেই ফেরা। তুমি দয়ার সাগর, আমাদের শত-সহস্র ভুল আর অন্যায় ক্ষমা করে দিয়ে আলোর পথ দেখানোর জন্য তুমি যেন সারাক্ষণই অপেক্ষা করে আছ। একমনে একধ্যানে ডাকলে তুমি ভক্তের মনের আশা পূরণ করো, তোমার কৃপা সকল ভক্তের জন্যই অবারিত। তুমিই আমাদেরকে সংসার-সমুদ্রের ঝড়ঝাপটা থেকে উদ্ধার করে পরমশান্তির ঠিকানা জানাবে।

৪. তুমি এই জগতের নিয়ন্তা।‌ সকল জীবের দুঃখকষ্ট দূর করতে এবং তাদেরকে সঠিক পথ দেখাতে তুমি যুগের অবতার হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছ। ধরা যাক, কারও মধ্যে এই ভাবনা এল: এখানে কি যাব? যখনই সে ‘হ্যাঁ, যাব’ বলছে, সেটা সংকল্প, আর ‘যাব না’ বললে সেটা বিকল্প। ইচ্ছা ও অনিচ্ছাকে বিচার করা বুদ্ধির কাজ। আমাদের মধ্যে যে-সকল ইচ্ছা জাগছে এবং আমরা যে সেই অনুযায়ী কাজ করছি, সেই কর্মের ফল কোথায় জমা থাকছে? যেখানে জমা থাকছে, সেটাই চিত্ত। পরের জন্মেও তা ভোগ করতে হয়। আমাদের সকল অতৃপ্ত বাসনা কোথায় মজুত থাকছে? চিত্তে। আমাদের পূর্ব এবং তার‌ও পূর্ব জন্মের কর্মের প্রারব্ধ কোথায় রেকর্ডেড হয়ে থাকছে? হ্যাঁ, চিত্তে এ সবই জমা হয়ে থাকছে। এগুলোর কিছুই যখন থাকে না, সেটাই চিত্তবৃত্তি নিরোধ। মন তা-ও স্থির হতে পারে, কিন্তু চিত্তবৃত্তি নিরোধ আরও গভীর সূক্ষ্ম অবস্থা—সেই সময় চিত্তই থাকে না। এই নিরোধের দ্বারা আমাদের মন সমাধিস্থ; তোমার কৃপায় এই সকল আশ্চর্য বিষয় আমরা অনুভব করতে পারি।

৫. তুমি জীবের দুঃখকষ্ট দূর করে থাকো। জীব তাই অসহায় হয়ে তোমারই শরণাপন্ন হয়। তুমি করুণার সাগর, অথচ আমাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া এবং তার ফল দেবার বেলায় তুমি খুবই নিখুঁত ও কঠোর। জগতের সমস্ত জড় ও জীবের অস্তিত্ব‌ই তুমি, তাই জীবের দুঃখ মুছে দিতে, সুখ ও সমৃদ্ধিকে স্থায়ী করতে এবং মনের দহনের সময়ে শান্তির আশ্রয় জোগাতেই তোমার যত আয়োজন। হে ঈশ্বর, তুমি আমাদেরকে সঠিক পথে রাখো যেন আমরা কলিযুগের সমস্ত পাপ ও দুর্বলতা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে পারি।

৬. তুমি শরীরে ও মনে অনুভূত সকল ধরনের প্রবল চাহিদা, কামনা ও বাসনাজাত আবেগ বা অনূভূতি ত্যাগ করতে বা সেগুলি থেকে মন সরিয়ে নিতে বলেছ, ধনসম্পদের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি ছেড়ে ভগবদ্‌ভক্তিতে ডুবতে শিখিয়েছ, পাঁচ-ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে ওদের ইচ্ছেমতো চলতে বারণ করেছ। ভগবান, যা-কিছু আমাদের দরকার নেই, সেগুলির প্রতি আমরা যেন পুরোপুরি নিরাসক্ত হতে পারি; তোমার পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে তোমারই দেখানো পথে যেন বাকিটা জীবন চলতে পারি।

৭. তুমি নির্ভীক হতে উপদেশ দিয়েছ। তাই আমরা নিজের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছি যাতে মাথা নত করে বাঁচতে না হয়। সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন অপরাবিদ্যার নিবিড় অধ্যয়ন এবং তার মাধ্যমে পরাবিদ্যার দীক্ষা নিতে তুমিই আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছ। তোমার কৃপা পেলে জগতের কোনো গূঢ় তত্ত্ব‌ই আর অজানা থাকে না, অচেনা লাগে না। তাই আমাদের এ হৃদয়ে চৈতন্যরূপে তুমিই আমাদেরকে জাগ্রত করো। সকল জাত, গোত্র, মত, পথ—এবং অর্থে-জ্ঞানে উঁচু কি নিচু, সকল অবস্থানের ভক্তদের প্রতি তুমি সমদর্শী হয়ে বিন্দুমাত্রও পক্ষপাতিত্ব না করে আশ্রয় দিয়ে থাকো।

৮. তোমার পায়ে স্থান পাওয়া আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্য। এর তুলনায় এই সংসার বড়ো তুচ্ছ, নিতান্তই মূল্যহীন। তুমি সকলের‌ই হৃদয়ে ভালোবাসা-প্রেম-ভক্তি-আন্তরিকতা-ভালোত্ব হয়ে আছ; আরও স্পষ্ট করে বললে, হৃদয়ের সেই সকল ঐশ্বর্য তোমারই আরেক রূপ। তুমি ক্লান্তি দূর কর, শান্তি দান কর, আর এতে জগতের সকলের স্বস্তি আসে; তোমার কৃপাতেই মানুষের হৃদয়ে সুখী হবার স্বপ্নের জন্ম হয়।

৯. হে প্রভু, আমরা তোমাকে বার বার প্রণাম করি এবং ধন্যবাদ দিই। তুমি আমাদের সমস্ত বাক্য ও মনের অতীত—তোমাকে কোনো বাক্য দিয়েই প্রকাশ করা যায় না, মনের বৃত্তিগুলি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েও তোমাকে জানতে পারি না; তবু এক তুমিই আমাদের যত কথা ও ভাবনা, এবং তার সমস্ত কিছুর মূল অর্থাৎ অক্ষর; অক্ষর তোমার মতোই সকল সৃষ্টির মূলে আছেন বলে অক্ষরকে অক্ষরব্রহ্ম বলা হয়। তুমি সকল জ্যোতির আদি উৎস, তোমার কোনো উৎস নেই, তাই তুমিই পরমদ্রষ্টা, বাকি সকলেই তোমার দৃশ্য—ওদের কেউই তোমাকে দৃশ্য করতে পারে না। তাই তুমি জ্যোতির‌ও জ্যোতি। তুমি আমাদের সবার অন্তঃকরণকে নানা রূপে ও বর্ণে উদ্ভাসিত করে রেখেছ। তুমি জীবকে কৃপা করে ব্রহ্মজ্ঞান দান করো এবং এভাবেই জীবের মধ্য থেকে সকল অবিদ্যা ও অজ্ঞান নাশ করে দাও।

১০. আমরা সাকারেই হোক, নিরাকারেই হোক, কেবল তোমারই উপাসনা করি। আমাদের এই সমবেত সংগীতের প্রাণ এক তুমিই, আমাদের সকল ধ্যান‌ই এই সংগীতে প্রকটিত। আমরা তোমাকে ভালোবাসি বলেই এই প্রার্থনা-সংগীতের মধ্য দিয়ে তোমার শ্রীচরণে আমাদের চিত্তের একাগ্রতা সাধন করেছি। আজ চারিদিকে সকল গীতবাদ্যে আমাদের হৃদয়ের সমস্ত ভাব নৈবেদ্য রূপে নিবেদিত। তোমার ভক্তবৃন্দের ব্যাকুল আরতি তথা স্তুতিগান‌ই তাদের দেহ ও মনের সম্পূর্ণ সমর্পণ।

উপরের প্রার্থনা-সংগীতটি ঈশ্বরের তথা পুরুষের তথা চৈতন্যের তথা পরব্রহ্মের তথা ব্রহ্মজ্ঞানীর তথা সদ্‌গুরুর চরণে কায়মনোবাক্যে নিবেদন করতে পারাই অনন্ত ব্রহ্মত্বের পথে প্রাথমিক বীক্ষা।