শ্রীঅঙ্গন নিয়ে

শাস্ত্রের অনুবাদ ও ভাষ্য বা ব্যাখ্যা লেখার চেষ্টা করেন এবং করেছেন অনেকেই, তবে সবারটা পড়তে নেই। ভুলভাল তাৎপর্য পড়ার চেয়ে ঘুমোনোও ভালো। কিছু তাৎপর্য বেশ ভালো, তবে বেশ দুর্বোধ্য। (যেমন দুর্গাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখাগুলি) কিছু তাৎপর্য বেশ ভালো এবং বেশ সহজ। (যেমন ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর লেখাগুলি) কিছু তাৎপর্য বেশ খারাপ, তাই এড়িয়ে চললেই ভালো। (যেমন ‘যাঁর নাম নিতে নেই’)

গীতার ভালো অনুবাদ নিয়ে বলতে গিয়ে ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী শ্রীজগদীশচন্দ্র ঘোষের গ্রন্থটির কথা বলতেন। তাঁর নিজের লেখা ‘গীতা-ধ্যান’ গীতার খুবই সহজবোধ্য এবং অথেনটিক অনুবাদ। (গীতার আরও কিছু ভালো অনুবাদ: স্বামী রঙ্গনাথানন্দের গীতা (৩ খণ্ড), সাধক-সঞ্জীবনী, স্বামী অমৃতত্বানন্দের গীতা, স্বামী জগদীশ্বরানন্দের গীতা, স্বামী অপূর্বানন্দের গীতা ইত্যাদি) মহানামব্রতের উপনিষদ-ভাবনা, ব্রহ্মসূত্র-সহ বিভিন্ন ছোটো ছোটো গ্রন্থ, ভাষণ ও প্রবন্ধসমূহ অধ্যাত্ম-অন্বেষু আর দর্শন-পিপাসুদের কাছে বড়ো আদরের। বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, অনির্বাণ, আনন্দমূর্তি প্রমুখ মনীষীর লেখা যে-কোনো গ্রন্থ‌ই দ্বিতীয় বার না ভেবেই কিনে ফেলা যায়—এক‌ই কথাটি ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর লেখা গ্রন্থের বেলাতেও খাটে।

আমার সেজোমাসিদের পুরো পরিবার প্রভু জগদ্‌বন্ধু সুন্দরের দীক্ষিত। সেজোমেসোর কাছ থেকেই প্রথম ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী সম্পর্কে শুনি। তখন আমি অনেক ছোটো। আমাদের পরিবারে যে কয়জন মানুষ খুবই বিদ্বান ও পড়ুয়া ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সেজোমেসো অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় অগাধ দখল আছে, আমার দেখা এমন তিন জন মানুষ: বাবা, সেজোমেসো, হরিসাধন স্যার। (স্যার সম্পর্কে জানতে আগ্রহীরা তাঁকে নিয়ে আমার লেখাটি ওয়েবসাইট থেকে পড়তে পারেন।)

সেজোমেসোর কথা আমরা সবাই খুব গুরুত্ব দিয়ে শুনতাম। তিনি প্রায়ই মহানামব্রত ব্রহ্মচারী সম্পর্কে বিভিন্ন আলাপ করতেন, তাঁর দর্শনভাবনা নিয়ে বলতেন। মেসোর কাছ থেকে ধার করে আমি প্রথম মহানামব্রত পড়া শুরু করি। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, তিনি ছিলেন অসীম পাণ্ডিত্যের অধিকারী। একদমই নিখুঁত ও যথার্থভাবে সনাতনধর্মের দর্শন নিয়ে তিনি বড়ো প্রাঞ্জল আলোচনা করেছেন, যা আমি তেমন বেশি উৎসে পাইনি।
ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর গ্রন্থ পড়ার সুযোগ পেলে কাজে লাগাতে পারেন, সময়টা ভালো কাজে খরচ হবে। স্বাধীনতা-উত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্নির্মাণে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যে-আরাধ্যদেবের পদস্পর্শে মহানামব্রত বিশ্ববরেণ্য হয়েছেন, তাঁর (প্রভু জগদ্‌বন্ধু সুন্দরের) লীলাভূমি ফরিদপুরে অবস্থিত শ্রীঅঙ্গনধাম খুবই শান্তির একটা জায়গা। আশ্রমের প্রসাদ সত্যিই অমৃতসম! (ট্রাই করে দেখতে পারেন।) আমি একবার একাদশীর প্রসাদ পেয়েছিলাম—কাউন চালের পোলাও, সাথে কয়েক রকমের অপূর্ব স্বাদের তরকারি। অতটা সুস্বাদু খাবার খেতেও অনেক ভাগ্য লাগে।

আশ্রমবাসীদের আন্তরিকতা আপনাকে মুগ্ধ করবেই! আজকের বৈকালিক ভোগ-সহ এ নিয়ে প্রভুর আশ্রমে দুই বার প্রসাদ পেলাম। প্রথম বার বন্ধু কিশোর দাদা তাঁর নিজের লেখা গ্রন্থ-সহ বেশ কিছু গ্রন্থ উপহার দিয়েছিলেন, আজকেও কিছু উপহার পেলাম রুদ্র বন্ধু দাদার কাছ থেকে।

একটা মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। বন্ধু কিশোর দাদাকে প্রথমদেখায় ‘প্রভু’ বলে সম্বোধন করলে তিনি আমাকে সবিনয়ে অনুরোধ করলেন ‘দাদা’ ডাকতে। কারণ হিসেবে গীতার নবম অধ্যায় থেকে দুইটি শ্লোক আবৃত্তি করলেন:

পিতাহমস্য জগতো মাতা ধাতা পিতামহঃ।
বেদ্যং পবিত্রম্ ওঙ্কার ঋক্ সাম যজুরেব চ।। ১৭।।

গতির্ভর্তা প্রভূঃ সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃৎ।
প্রভবঃ প্রলয়ঃ স্থানং নিধানং বীজমব্যয়ম্।। ১৮।।

পদের অর্থ: অহম্‌ (আমি), অস্য জগতঃ (এই জগতের) পিতা, মাতা, ধাতা (পালনকর্তা), পিতামহঃ, বেদ্যং (একমাত্র জ্ঞেয় বস্তু), পবিত্রম্, ওঙ্কারঃ (সকল ধ্বনির মূল), ঋক্ (ঋক্‌বেদ), সাম (সামবেদ), যজুঃ এবচ (এবং যজুর্বেদ)। (১৭)

আমি গতিঃ, ভর্তা (পোষণকর্তা), প্রভুঃ (নিয়ন্তা), সাক্ষী (শুভাশুভ দ্রষ্টা), নিবাসঃ (স্থিতিস্থান), শরণং (রক্ষক), সুহৃৎ (উপকার-কর্তা), প্রভবঃ (সৃষ্টিকর্তা), প্রলয়ঃ (সংহর্তা), স্থানং (আধার), নিধানং (লয়স্থান), অব্যয়ং বীজং (অবিনাশী কারণ)। (১৮)

প্রথম বাঙালি সিভিল সার্ভেন্ট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়োভাই সুসাহিত্যিক সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদ্যানুবাদে পাই:

জগতের পিতামহ,
পিতা, মাতা, ধাতা সবাকার,
ঋক্ যজুঃ সামবেদ,
সর্ববেদ্য পুরুষ ওঁকার। (১৭)

গতি, ভর্তা, প্রভু, বন্ধু,
সর্বসাক্ষী, নিবাস, আশ্রয়,
নিধান, অক্ষর বীজ,
জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়। (১৮)

বন্ধু কিশোর দাদা হাতজোড় করে হেসে সেদিন বললেন, আমি তো আপনাকে পথ দেখাতে পারব না, উদ্ধার করতে পারব না, আপনার আশ্রয় হতে পারব না—আপনাকে ধারণ বা পালন করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে আমি আপনার ‘প্রভু’ হ‌ই কোন যুক্তিতে? আপনি আমাকে ‘প্রভু’ বলে সম্বোধন করলে যে পাপটা আমার‌ই হবে, যদি আমি আপনার সম্বোধনটা গ্রহণ করি।

(গীতার শাঙ্করভাষ্যের সাহায্যে অবশ্য এই শ্লোকদুটোর অন্য ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়, সে আলোচনা আরেক দিন হবে।)

প্রভু জগদ্‌বন্ধু সুন্দর প্রতিষ্ঠিত শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনে গেলে সময়টা বড়ো আনন্দে কাটে। বুকস্টলে গিয়ে ব‌ই ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভালো লাগে, দাদাদের সাথে আধ্যাত্মিকতা ও দর্শন নিয়ে আলাপ হয়, দাদারা খুব যত্ন করে প্রসাদ পাওয়ান, তাঁদের সাথে শাস্ত্রের নানান গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে আড্ডা চলে; তবে ওখানে কার‌ও আচরণে বা কথাবার্তায় কখনোই এমন কিছু দেখিনি, যাতে প্রকাশ পায়—অ্যাই, জানো জানো, আমরা-না স্বর্গ থেকে এসেছি! তুমিও জয়েন করো আমাদের এখানে, আমরা তোমাকে স্বর্গে নিয়ে যাব! তুমি তো ভুল পথে আছ! আমাদের লাইনে আসো, দেখবে, তোমার জীবনটাই বদলে গেছে! আমাদের মলমটাই মাখো, বাকি সব মলম তো ভুয়া!


প্রভু জগদ্‌বন্ধু সুন্দরের মতন আরাধ্যদেবের ভাবাশ্রিত ও কৃপাশ্রিত যাঁরা, তাঁদের পক্ষে ওরকম গায়ে-পড়া স্বভাবের সংকীর্ণ চিত্তের মাথামোটা মানুষ হ‌ওয়া অসম্ভব!

শ্রীঅঙ্গনের কোথাও কোনো দেখানেপনা নেই, কোনো অহেতুক বাড়াবাড়ি নেই, কোনো কপট আচরণ নেই। প্রভুর অশেষ কৃপাধন্য ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী তাঁর ‘সনাতনধর্ম’ প্রবন্ধে লিখছেন:

“প্রায় সকল নদীর জন্ম পর্বতে, গতি সাগরে, কিন্তু পথ লইয়াছে ভিন্ন ভিন্ন। মহিম্ন স্তোত্রে:

রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিল
নানা পথ জুষাং
নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি
পয়াসামর্ণব ইব।

রুচির বৈচিত্র্য হেতু ঋজু, কুটিল নানা পথবাহী নদীর গম্যস্থল সাগরের মতো, সকল মতের গন্তব্যভূমি তুমিই—শ্রীভগবানই।

অতএব, সনাতন ধর্ম একটি মত নহে। ইহা অগণিত মতের অপূর্ব সমন্বয়।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব যে সর্বমত সমন্বয়ের বাণী বলিয়াছেন, তাহা কোনো নূতন কথা নহে—সনাতনধর্মের অন্তরের কথা।

এই সমন্বয়ের মহাবাণীই স্বামী বিবেকানন্দের কম্বুকণ্ঠে নিনাদিত হইয়া শিকাগো পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়নস-এ পাশ্চাত্য দেশবাসীকে চমক লাগাইয়াছিল।
ধর্মে ধর্মে অশেষ সংঘর্ষের যুগে সনাতনধর্মের এই সমন্বয়ের বাণী সকলেরই প্রণিধানযোগ্য।”

মহাত্মা মহানামব্রত ব্রহ্মচারী বিবেকানন্দ-স্মরণে বলছেন:

“একজন মানুষের কানে মন্ত্র দিয়া তাঁহার স্বর্গপ্রাপ্তির বিধান সহজসাধ্য। প্রায় সকল সাধু-সন্ন্যাসী তাহাই করেন। কিন্তু একটা জাতিকে জাগরণের মন্ত্র দিয়া স্বর্গমুক্তির সাধনা হইতে মানবসেবায় উন্মুখি করা অনেক কষ্টসাধ্য। বিবেকানন্দ শিষ্যসংখ্যা বাড়াইতে আসেন নাই; জাতিটাকে স্বৰ্গমুখী হইতে মানবসেবামুখী করিয়াছেন। স্বামীজির এই উদাত্ত ডাক জাতি শুনিয়াছে। এইটি তাঁর মহাদান।”

উপরের বক্তব্য দুইটি পড়লে খুব স্পষ্ট করেই বোঝা যায়, আজকের দিনে নির্বোধের দল যখন নিজদলে টানাটানির সাধনাকেই ধর্মচর্চা বলে ধরে নিয়েছেন, তখন একজন ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর আকাশসম পাণ্ডিত্য, ঔদার্য ও মনুষ্যত্বের ছায়াতলে নিজেকে রাখতে পারা অসীম স্বস্তির। আগে বীক্ষা, পরে (মন চাইলে) দীক্ষা। রামকৃষ্ণ, নিগমানন্দ, অরবিন্দ, আনন্দমূর্তি-সহ আরও এমন যাঁদের জীবনদর্শন আমরা জানি—যাঁরা তাঁদের শিষ্যদের গায়ে পড়ে অন্যকে বিরক্ত না করে বরং নীরবে-নিভৃতে একাগ্রচিত্তে নিজের কর্মরূপী সাধনা করে যেতে বলেছেন, তাঁদের পাশে আমি পরম শ্রদ্ধায় আরেকটি নাম সবসময়ই রাখি: প্রভু জগদ্‌বন্ধু সুন্দর। প্রভুর পাঁচটি মহান বাণী আপনাদের সাথে শেয়ার করে লেখাটি শেষ করছি:

এক। ভ্রষ্টবুদ্ধি হয়ে মাতা-পিতার মনে কষ্ট দিতে নেই।

দুই। যে সংসারে শান্তি পায় না, সে সংসার ত্যাগ করলেও শান্তি পায় না।

তিন। কেউ মূর্খ থেকো না। মূর্খ আমার কথা বুঝতে পারবে না। অজ্ঞানের হরিভক্তি হয় না।

চার। পরচর্চা কর্ণে বা অন্তরে স্থান দিয়ো না। পরচর্চা-পরনিন্দা ত্যাগ করো। ঘরের দেয়ালে লিখে রেখো: পরচর্চা নিষেধ।

পাঁচ। জীবদেহে নিত্যানন্দের বাস। কোনো জীবকে আঘাত করলে নিত্যানন্দকে আঘাত করা হয়।