উত্থান তাই কেবল সক্রিয়তা নয়; এটি হলো সচেতনতার কামুক গতি, চেতনার নিজের সম্ভাবনাকে অনুভব করার আনন্দ। স্থিতি যেখানে সাক্ষীর বিশ্রাম, সেখানে উত্থান হলো হওয়ার উল্লাস—চেতনার উচ্ছ্বাস ও সৃষ্টিশীল বিস্তার। এ অবস্থায় জগত আর বাহিরের কিছু নয়, বরং চেতনার নিজের অভ্যন্তরীণ ছন্দের নৃত্য। এই উত্থানের মাঝেই দেখা যায়, কালী কেবল ধ্বংসের প্রতীক নন—তিনি সেই সৃষ্টিশীল জীবন-স্পন্দন, যিনি ব্রহ্মাণ্ডকে জাগিয়ে রাখেন এবং প্রতিটি মুহূর্তে চেতনার নবজন্ম ঘটান।
বিলয়, বা বিলুপ্তি, চেতনার সেই চূড়ান্ত পর্ব, যেখানে “আমি”-বোধের সমস্ত সীমা গলে যায়, এবং সচেতনতা নিজেরই অশেষ বিস্তারে ফিরে যায়। এটি কোনো নিস্তব্ধ শূন্যতা নয়, বরং এক অবর্ণনীয় একত্ব—যেখানে জ্ঞাতা, জানা ও জানার প্রক্রিয়া সব একাকার। কাশ্মীর শৈব দর্শনের ভাষায়, বিলয় হলো চেতনার আত্মগ্রাস—নিজের মধ্যেই নিজেকে শোষণ। আর আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এটি সেই অবস্থার সঙ্গে মিলে যায়, যাকে বলা হয় অহং-অতিক্রম (ego dissolution) বা অদ্বৈত শোষণ (nondual absorption)।
এই অভিজ্ঞতায় মানুষ অনুভব করে যে “আমি” বলে যে আলাদা একটা সত্তা আছে, সেটা আর নেই—চেতনা যেন সব সীমা ভেঙে এক বিশাল মহাবিশ্বে মিশে গেছে।
যেমন, গভীর ধ্যানের সময় একজন সাধক হঠাৎ অনুভব করেন—তিনি আর আলাদা নন; বাতাস, আলো, শব্দ—সবই তাঁর ভেতর ঘটছে। আবার কেউ সংগীত বা প্রার্থনায় এত গভীরভাবে ডুবে যান যে, সময়ের বোধ হারিয়ে যায়—কখন শুরু, কখন শেষ, কিছুই বোঝা যায় না।
সাইকেডেলিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও অনেকে বলেন—“আমার দেহ, চিন্তা, চারপাশ—সব এক হয়ে গেছে, আমি যেন পুরো জগৎটাই।” কেউ বলেন, “আমি যা দেখি, সেটাই আমি নিজে।”
উদাহরণস্বরূপ, LSD, সিলোসাইবিন (Psilocybin - ম্যাজিক মাশরুম), DMT, বা আয়াহুয়াস্কা (Ayahuasca)-এর মতো পদার্থগুলিকে ক্লাসিক্যাল সাইকেডেলিকস (Classical Psychedelics) বা হ্যালুসিনোজেন (Hallucinogens) বলা হয়। এদের প্রভাবে ব্যবহারকারীর চেতনা, উপলব্ধি এবং মানসিকতাতে গভীর ও অস্থায়ী পরিবর্তন আসে। এই পদার্থগুলির প্রভাবকে একত্রে "ট্রিপ" (Trip) বলা হয়, যা তীব্রভাবে আনন্দদায়ক (Pleasurable) বা চরম ভীতিকর (Frightening), উভয়ই হতে পারে।
এগুলির প্রভাব সম্পর্কে কিছু মানুষ জানায়—তারা অনুভব করে, যেন “আমি” নামের সীমানা ভেঙে গেছে, দেহ-মন-পরিবেশ সব এক হয়ে গেছে। সময় থেমে যায়, স্থান হারিয়ে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে এক বিশাল দীপ্তি, এক গভীর ঐক্যের অনুভব। এই অবস্থায় “আমি আর জগৎ আলাদা নই,” অথবা “আমি চেতনা নিজেই।” চিন্তা বন্ধ হয়ে যায়, সময় থেমে যায়, আর যা থাকে তা হলো এক নিস্তব্ধ, দীপ্ত, সীমাহীন চেতনা—যেখানে সবকিছু এক হয়ে যায়। এটা কেবল এক মুহূর্তের অনুভূতি নয়, বরং অস্তিত্বেরই এক গভীর রূপান্তর, যেখানে মানুষ নিজের আসল, সীমাহীন প্রকৃতিকে চিনে ফেলে।
আধুনিক নিউরোথিওলজি—অর্থাৎ ধর্মীয় ও রহস্যময় অভিজ্ঞতার স্নায়ুবৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন—এই অভিজ্ঞতাগুলিতে একটি স্পষ্ট ধারা খুঁজে পেয়েছে। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, গভীর ধ্যান বা মিস্টিক অবস্থায় মানুষের Default Mode Network (DMN)—যা আত্ম-সংশ্লিষ্ট চিন্তা ও “আমি”-বোধের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে—তা শান্ত হয়ে যায়। এর কার্যকলাপ কমে গেলে মস্তিষ্কে “self-referential processing” দুর্বল হয়, অর্থাৎ “আমি”-কেন্দ্রিক চিন্তার ধারা নিস্তব্ধ হয়। ফলে সৃষ্টি হয় সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, যেখানে আত্ম ও বিশ্ব এক হয়ে যায়—যা কালীর বিলয়-পর্বের সঙ্গে একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ধ্যান-গবেষণায় দেখা যায়, দীর্ঘমেয়াদী ধ্যানকারীরা প্রায়ই এই DMN-এর কার্যকলাপে স্থায়ী হ্রাস প্রদর্শন করেন। এটি বোঝায়, তাঁদের আত্মসচেতনতা আর সংকীর্ণ, সীমিত “আমি”-কেন্দ্রিক নয়; বরং তা বিস্তৃত, সমন্বিত, একাত্ম। এটি ঠিক সেই অবস্থা, যা তন্ত্রে “মহাকালী” শক্তি নামে বর্ণিত—যিনি সময় ও অহংকে এক নিমেষে গ্রাস করেন। এখানে “সময়” আর ধারাবাহিক নয়, “আমি” আর কেন্দ্রীয় নয়; কেবল চেতনার এক অনাদি উপস্থিতি থাকে—শিবের অতীত সচেতনতা, যা সকল রূপের ঊর্ধ্বে, কিন্তু সব রূপের ভেতরেই জ্বলে।
এই বিলয়-অবস্থাকে তান্ত্রিক শাস্ত্র মহানয়প্রকাশ-এ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এক গভীর শ্লোকে—“যখন এই দেবীর সর্বব্যাপী প্রকৃতি উপলব্ধি করা হয়, তখন একজনের নিজস্ব অপরিহার্য প্রকৃতি প্রকাশিত হয়।” অর্থাৎ, যখন কালী—চেতনার সর্বব্যাপী শক্তি—নিজের পূর্ণ রূপে অনুভূত হয়, তখন মানুষ তার আসল স্বরূপে জেগে ওঠে; “আমি”-বোধ মুছে যায়, কেবল “আছে”-বোধ থাকে।
দর্শনের দিক থেকে, স্থিতি ও বিলয় একই মুদ্রার দুই পিঠ। স্থিতি হলো সেই শান্ত দীপ্তি, যেখানে চেতনা নিজেকে ধারণ করে রাখে; আর বিলয় হলো সেই পূর্ণ প্রত্যাবর্তন, যেখানে চেতনা নিজের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। স্থিতি মানে “চেতনার বিশ্রাম,” আর বিলয় মানে “চেতনার মুক্তি”—দুই-ই একই বাস্তবতার দুই ধাপ।
এই সত্যেরই প্রতীক দেখা যায় শিবের দেহের উপর কালীর নৃত্য-চিত্রে। এখানে শিব, মহাকাল—সময়ের ঊর্ধ্বস্থিত চেতনা; আর কালী, মহাকালী—যিনি সেই সময়কেও ভস্মীভূত করে চেতনার অকালিক দীপ্তিকে উন্মোচিত করেন। তাঁর নৃত্য মানে সমস্ত সীমার অবসান; শিবের স্থির দেহ মানে সেই পরম শান্তির ভিত্তি। এই দুই একত্রে মিলেই প্রকাশ করে চেতনার সর্বোচ্চ বিলয়—যেখানে সময় থেমে যায়, অহং মুছে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে কেবল এক অচল, আনন্দময় চেতনা—শিব-চেতনা, যা কখনও জন্মায় না, কখনও মরে না, কেবল চিরন্তন দীপ্তিতে নিজেকে জানে।
কালীর ত্রিগুণ গতিশীলতা—স্থিতি, উত্থান ও বিলয়—চেতনার এক অদ্বৈত মানচিত্র দেয়, যেখানে মানসিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থাগুলি শক্তির প্রবাহের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
আধুনিক চেতনা-বিজ্ঞানও এর এক বৈজ্ঞানিক প্রতিরূপ দেখায়। যেমন—
“বিশুদ্ধ চেতনা” বা pure consciousness হলো সেই শূন্য বিন্দু, যেখানে মন শান্ত, কিন্তু জাগ্রত থাকে—এটাই স্থিতি।
“প্রবাহ অবস্থা” বা flow state হলো সম্পূর্ণ মনোযোগ ও আনন্দে মগ্ন থাকা—যেখানে চিন্তা ও কর্তা এক হয়ে যায়—এটাই উত্থান।
আর “অহং-বিলুপ্তি” বা ego dissolution হলো সেই রহস্যময় অভিজ্ঞতা, যেখানে “আমি” নামের সীমা গলে গিয়ে সবকিছুর সঙ্গে ঐক্য অনুভূত হয়—এটাই বিলয়।
এই তিনটি আলাদা অভিজ্ঞতা নয়; বরং একটানা এক চক্রের তিন ধাপ—চেতনার নিস্তব্ধতা, তার প্রবাহ, এবং শেষত নিজের উৎসে ফিরে মিশে যাওয়া।
তাই কাশ্মীর শৈব দর্শনে কালী কেবল সৃষ্টির বা ধ্বংসের দেবী নন; তিনি চেতনার এই অবিচ্ছিন্ন ছন্দের প্রতীক—যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি ও বিলয় একই নৃত্যের তিন গতি। এই ধারণাই আধুনিক মনের dynamic systems theory-এর প্রতিধ্বনি—যেখানে মন ও চেতনা একটানা পরিবর্তনশীল, কিন্তু গভীরে চিরন্তন ভারসাম্যে স্থিত।
কাশ্মীর শৈব দর্শন চেতনার সূক্ষ্মতম গঠন ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে এমন কিছু সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করে, যেগুলি আধুনিক চেতনা-বিজ্ঞানের ধারণাগুলিকেও অনেক আগেই অনুমান করেছিল।
চিত্ (বা চিত্-তত্ত্ব) মানে কেবলমাত্র চেতনা নিজেই—অস্তিত্বের সেই নির্মল আলোক, যা সব কিছুকে জানায় ও আলোকিত করে। কিন্তু এই আলো একেবারে শূন্য বা নিষ্ক্রিয় নয়। তার মধ্যে আছে নিজের প্রতি প্রতিফলনের শক্তি, যাকে বলা হয় বিমর্শ-শক্তি। এই বিমর্শ হলো চেতনার আত্ম-চেতনা—অর্থাৎ চেতনা নিজেকে জানার ক্ষমতা।
শৈব দৃষ্টিতে, শিবের শক্তিই বিমর্শ। শিব কেবল নিস্তব্ধ আলোক নয়, তিনি সেই আলো, যা নিজের দিকে তাকাতে পারে—যা বলে, “আমি আছি”, “আমি জানি”। আচার্য লক্ষ্মণজু তাই জোর দিয়ে বলেন—শিব কোনো “শূন্য আলো” নন; তিনি “চেতনা (বিমর্শ) সহ আলো (প্রকাশ)”। এই প্রকাশ ও বিমর্শের ঐক্য বোঝায়, চেতনা কখনো নিছক দেখা নয়—চেতনা মানেই আত্ম-জ্ঞান। দেখা আর দেখা-হওয়া, জানা আর জানা-হওয়া—দুটি একই প্রক্রিয়ার দুই দিক।
আধুনিক নিউরোসায়েন্স-এর ভাষায় এটিই “self-referential mind” বা মনের আত্ম-উল্লেখী প্রকৃতি—যেখানে মস্তিষ্ক নিজের ক্রিয়াকলাপকেই নিরন্তর পর্যবেক্ষণ ও প্রতিফলন করে। অর্থাৎ, চেতনা শুধু তথ্য গ্রহণ করে না; সে নিজেকেও জানে, বুঝে, এবং ক্রমাগত নিজের অবস্থান পুনর্নির্ধারণ করে।
এরপর আসে আরেকটি মৌলিক শব্দ—স্পন্দ (Spanda)। এর অর্থ “কম্পন”, “স্পন্দন” বা “জীবন্ত গতি”। কাশ্মীর শৈব দর্শনের মহাগ্রন্থ স্পন্দকারিকা-য় বলা হয়েছে—“ব্রহ্ম বা চিত্ স্থির নয়, বরং চিরন্তন কম্পনশীল।” অভিনবগুপ্ত এই “স্পন্দ”-কেই শিবচেতনার অন্তর্লীন স্পন্দন বলে বর্ণনা করেছেন—যেখান থেকে জন্ম নেয় জ্ঞানের শক্তি (জ্ঞান-শক্তি), ইচ্ছার শক্তি (ইচ্ছা-শক্তি) ও ক্রিয়ার শক্তি (ক্রিয়া-শক্তি)। অর্থাৎ, চেতনা কখনও স্থির আলোক নয়; বরং এক জীবন্ত ছন্দ, যা নিজের আনন্দে গতি পায়, সৃষ্টি করে, এবং নিজের মধ্যেই ফিরে আসে।
লক্ষ্মণজুর ভাষায়, “স্পন্দ” আসলে শিবের বিমর্শেরই আরেক নাম—অর্থাৎ সেই চিরন্তন আত্ম-প্রতিফলনশীল কম্পন, যেখান থেকে বিশ্বপ্রবাহ উদ্ভূত। এই স্পন্দ কোনো বাহ্যিক গতি নয়, এটি অভ্যন্তরীণ জাগরণ—চেতনার অনুভূত ছন্দ, যা প্রতিটি চিন্তা, অনুভূতি, বা উপলব্ধির পেছনে নিঃশব্দে প্রবাহিত।
আধুনিক মস্তিষ্কবিজ্ঞানের সঙ্গে এর চমকপ্রদ মিল রয়েছে। যেমন, স্নায়ুকোষগুলির ছন্দময় দোলন—নিউরাল অসিলেশনস (neural oscillations)—মস্তিষ্কের তথ্যপ্রবাহ ও অভিজ্ঞতার ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা যখন কিছু ভাবি, দেখি বা অনুভব করি, তখন সেই অভিজ্ঞতার ভেতরে সূক্ষ্ম স্নায়বিক তরঙ্গ চলে—যেন চেতনার ভেতর “স্পন্দ” কাজ করছে। এই দোলনই চেতনার সময়-নির্ভর সুর ও তাল, যা কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে বলা হয় চিত্-স্পন্দ, আর বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় নিউরাল রিদম—দুই-ই একই স্রোতের ভিন্ন রূপ।
অতএব, চিত্, বিমর্শ ও স্পন্দ—এই তিনটি শব্দ কাশ্মীর শৈববাদে চেতনার তিন স্তর প্রকাশ করে:
চিত্ হলো আলোকিত উপস্থিতি,
বিমর্শ হলো সেই আলোর আত্ম-সচেতনতা,
আর স্পন্দ হলো সেই আত্ম-সচেতনতার জীবন্ত গতি—চেতনার নৃত্য।
এই ত্রয়ী মিলে বোঝায়, চেতনা কোনো স্থির সত্তা নয়; বরং এক স্পন্দিত, আত্ম-প্রতিফলনশীল, চিরজাগ্রত জীবন্ত বাস্তবতা—যেখানে জানা, জানানো এবং জানার আনন্দ—সব এক হয়ে যায়।
ক্রম দর্শনে ব্যবহৃত “সংকুচিত শিব” ধারণাটি চেতনার এক গভীর অবস্থা বোঝায়—যে-অবস্থায় শিব এখনও প্রকাশিত নন, কিন্তু সমস্ত প্রকাশের সম্ভাবনা তাঁর মধ্যেই নিহিত। এটি যেন চেতনার বীজাবস্থা, যেখানে সব কিছু নিঃশব্দে, অব্যক্তভাবে গর্ভিত হয়ে আছে।
এই অবস্থায় শিব অসীম হলেও সংকুচিত—অর্থাৎ সীমাহীন শক্তি নিজের মধ্যেই গুটিয়ে আছে, কোনো রূপ বা কার্যকলাপে প্রকাশ পায়নি। তিনি এক নিঃশব্দ সম্ভাবনা, যেখানে জগতের সৃষ্টি, গতি ও বিলয়—সব কিছুই কেবল সম্ভাবনার স্তরে লুকিয়ে আছে। এ কারণেই তাঁকে বলা হয় সংকুচিত শিব (Saṅkucita-Śiva)—যিনি প্রকাশের আগের বিশ্রামাবস্থায় বিরাজমান।
এর বিপরীতে আছে বিভূ-শিব—যিনি বিস্তৃত, সর্বব্যাপী, চেতনার পূর্ণ প্রসারণে প্রকাশিত। এই দুই রূপ পরস্পরের প্রতিফলন—একটি হলো অন্তর্মুখ গতি (সংকোচন), অন্যটি বহির্মুখ গতি (প্রসারণ)। আধুনিক ভাষায় বললে, এটি অনেকটা স্থিতিশক্তি ও গতিশক্তির সম্পর্কের মতো—দুটি ভিন্ন রূপ, কিন্তু মূলত একই শক্তির দুই দিক। স্থিতিশক্তি হলো শক্তির নিঃশব্দ সম্ভাবনা, আর গতিশক্তি সেই শক্তির সক্রিয় প্রকাশ।
ক্রম শাস্ত্র-এ এই ধারণা আরও প্রসারিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়, “স্থিতি-নাশৌ স্বভাবস্য স্বরূপো চ বিলপনম্”—অর্থাৎ, জগতের স্থিতি ও বিনাশও শিবের নিজের স্বভাবেরই প্রতিফলন। জগতের ওঠা-নামা, সৃষ্টি ও বিলয়—সবই চেতনার নিজের অন্তর্লীন ছন্দের প্রকাশ।
এইভাবে আমরা বলতে পারি—সংকুচিত শিব হলো বিশুদ্ধ চেতনা বা স্থিতি, যেখানে সব কিছু সম্ভাবনা হিসেবে নিঃশব্দে অবস্থান করছে; উত্থান হলো সেই সম্ভাবনার প্রসারণ, প্রকাশের সূচনা; আর বিলয় হলো সবকিছু আবার নিজের উৎসে ফিরে গুটিয়ে যাওয়া, অর্থাৎ চেতনার পুনরায় সংকোচন।
এভাবে, কাশ্মীর শৈব দর্শন এক চমৎকার চক্রাকার দৃষ্টিভঙ্গি দেয়—চেতনা স্থির হয়, প্রসারিত হয়, আবার নিজের মধ্যেই বিলীন হয়। শিব তাই কখনো সম্পূর্ণ স্থির নন, আবার কখনো পুরোপুরি গতিশীলও নন; তিনি স্থিতি ও গতি, সংকোচন ও প্রসারণ—দুয়েরই অন্তরতম ঐক্য।