শৈব কালী: এক-শো পনেরো



তাই “চিত্‌ই বিশ্বং ভবতি”—মানে, চেতনা নিজেই জগৎ হয়ে ওঠে। এটা কল্পনা নয়; বরং বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা—আমরা যা দেখি, তা দেখা-হওয়ার ছন্দেই গঠিত, আর আমরা যা হই, তা সেই হওয়ার প্রক্রিয়াতেই প্রকাশিত।

ভারেলার autopoiesis-এর মতোই শৈব দর্শন বলে—চেতনা নিজেকেই চিনে, রক্ষা করে, আবার ভেঙে নতুন রূপে গড়ে তোলে। এই চলমান লীলা—নিজেকে জানা, বদলানো ও পুনর্গঠন—এর মধ্য দিয়েই জগৎ প্রতিমুহূর্তে জন্মায়, স্থির হয়, আবার নীরবে মিলিয়ে যায়।

দুটো ভাষা, এক অন্তর্দৃষ্টি: অভিজ্ঞতা “ঘটে” না; আমরা-ই তা ঘটাই—কখনো নীরব উপস্থিতিতে (স্থিতি), কখনো সৃজনশীল প্রবাহে (উত্থান), কখনো সীমা অতিক্রমে (বিলয়)। এইভাবেই প্রাচীন তন্ত্র আর আধুনিক নিউরোসায়েন্স পরস্পরকে সমৃদ্ধ করে—একজন দেয় অনুশীলনের শরীর, অন্যজন দেয় ব্যাখ্যার মস্তিষ্ক—এবং একত্রে তারা দেখায় চেতনার চিরন্তন ক্রম।

কালী-তত্ত্বকে যদি আমরা মনস্তাত্ত্বিক ও স্নায়ুবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তবে তিনি কেবল পৌরাণিক দেবী নন, বরং চেতনার স্ব-নিয়ন্ত্রিত, স্ব-রূপান্তরিত গতিশীল নীতি। তাঁর ত্রিগুণাত্মক ক্রিয়া—স্থিতি, উত্থান, বিলয়—চেতনারই তিন অনন্ত মাত্রা: উপস্থিতি, সৃজন, ও আত্মসমর্পণ। এই তত্ত্বে শিব আর বিমূর্ত নন, শক্তি আর কেবল শক্তিরূপ নয়—তারা দু-জনেই সেই এক চেতনার পরস্পর-অবলম্বিত প্রকাশ।

এইভাবে অভিনবগুপ্ত থেকে ভারেলা পর্যন্ত যে-সেতু তৈরি হয়, তা আসলে এক নতুন “অদ্বৈত মনস্তত্ত্ব”-এর সূচনা করে—যেখানে প্রাচীন তন্ত্রের অন্তর্জাগতিক স্পন্দ ও আধুনিক নিউরোসায়েন্সের মাইন্ড-নেটওয়ার্ক এক হয়ে যায়। এবং এখানেই কালী চেতনার চূড়ান্ত প্রতীক: তিনি সেই নিঃশেষ প্রবাহ, যেখানে স্থিরতা ও গতি, ইগো ও শূন্যতা, বিজ্ঞান ও সাধনা—সব একত্রে এক চিরন্তন প্রভাস্বর অদ্বৈতের মধ্যে নৃত্য করে।

শিবই পরম-আত্মন এবং বিশ্বজনীন চেতনা। কাশ্মীর শৈববাদে চূড়ান্ত বাস্তবতা হলো এক, অসীম চেতনা। শিব কেবল অতীত ভিত্তিই নন, তিনি সচেতনতার সারমর্ম নিজেই। স্বামী লক্ষ্মণজু ব্যাখ্যা করেন যে, শিব "আলোতে পূর্ণ"—কিন্তু তা সূর্য বা আগুনের জাগতিক আলো নয়, বরং বিমর্শ (সচেতনতা) দ্বারা সিক্ত প্রকাশ। অন্য কথায়, শিব হলেন প্রাণা-শক্তি, স্ব-আলোকিত চেতনা। লক্ষ্মণজু লেখেন, "ভগবান শিব আলোর প্রতিমূর্তি," "চেতনা (বিমর্শ)-সহ আলো (প্রকাশ)...সেই পরম চেতনার স্বরূপ, ভগবান শিব"।

সনাতন পরিভাষায় শিব হলেন চিত্-চৈতন্য, স্বাতন্ত্র্য, ঐশ্বর্য, কর্তৃত্ব, স্পন্দ, ইত্যাদি—চেতনার মূল "শক্তি" এবং "বিশ্বজনীন গতি" যার দ্বারা মহাবিশ্বের অস্তিত্ব। শিবের চিত্ হলো স্বাভাবিক (আকৃত্রিম) 'আমি'-সচেতনতা, যা অহং দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত; আমাদের সাধারণ অহংকারী 'আমি' হলো সেই বিশুদ্ধ আত্মার একটি সীমিত প্রতিচ্ছবি মাত্র। শিব থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত "৩৬ তত্ত্ব" তাঁর নিজস্ব চেতনার মধ্যে সৃষ্ট ও বিদ্যমান বলে কথিত। লক্ষ্মণজু উল্লেখ করেন, "তিনি তাঁর চেতনার চক্রে এই সমগ্র মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন... যা-কিছু বিদ্যমান, তা সেই চেতনায় বিরাজ করে"।

শিব হলেন পরম-আত্মন—সেই পরম আত্মা, যার মধ্যে সব কিছু অবস্থান করে। শিবের প্রকাশ-বিমর্শ (আলোকিত চেতনা) ছাড়া বিশ্বের কোনো স্বাধীন বাস্তবতা নেই। এমনকি শিবের অস্তিত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা করাও এটিকেই নিশ্চিত করে: "যদি আপনি বলেন, ঈশ্বর নেই... যিনি প্রশ্ন করছেন, তিনিই ভগবান শিব—যিনি প্রশ্ন ওঠার আগেই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান"।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের মূল ভাবনা হলো—“কর্তা” (যে কাজ করছে) আর “কর্ম” (যা করা হচ্ছে)—এদের মধ্যে কোনো বাস্তব ফারাক নেই। আমরা সাধারণত ভাবি, “আমি কর্তা, আমি কাজ করছি, বাইরের জগৎ আলাদা।” কিন্তু এই ভাবনাটাই শৈব মতে মায়াময়—অর্থাৎ আপাত সত্য, কিন্তু চূড়ান্ত সত্য নয়।

এখানে শিব হলেন একমাত্র চেতনা, যিনি একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী (immanent) এবং অতীত (transcendent)।

অন্তর্বর্তী মানে—তিনি সব কিছুর ভেতরেই আছেন, প্রতিটি ভাব, অনুভূতি, বস্তুর মধ্যেই সেই চেতনার দীপ্তি কাজ করছে।

অতীত মানে—তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে, সীমাহীন ভিত্তি, যিনি কোনো রূপ বা ধারণার মধ্যে আবদ্ধ নন।

অর্থাৎ, শিব একাধারে জগতের ভেতর এবং জগতের বাইরে—তিনি আলোও, সেই আলোর উৎসও।

এই দৃষ্টিতে “ব্যক্তি” বা “জীব” কোনো আলাদা সত্তা নয়। জীব মানে শিবেরই সীমাবদ্ধ প্রকাশ। যেমন সূর্যের আলো কাচের টুকরোয় পড়ে ছোটো ছোটো প্রতিফলন তৈরি করে—আলো ভিন্ন হয় না, কেবল প্রতিফলনের আকার ছোটো বা বিকৃত হয়।

তেমনি জীবাত্মা হলো শিবচেতনারই এক সীমিত প্রতিবিম্ব, যা নিজেকে আলাদা বলে মনে করে। কিন্তু মূলে গেলে, সে-ই পরমশিব। তাই সমীকরণ দাঁড়ায়—জীব = শিব = পরমশিব।

কাশ্মীরের আচার্য লক্ষ্মণজু এই সত্যটি খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, আমাদের প্রতিদিনের “আমি আছি” বা “আমি অনুভব করছি”—এই স্বাভাবিক আত্মবোধটাই আসলে শিবচেতনার প্রকাশ। যখন আমরা কোনো কৃত্রিম পরিচয় বা ভাবনার আবরণ ছাড়া কেবল “আমি আছি” বলে অনুভব করি—তখন সেটি বিশুদ্ধ চেতনা, নিখাদ উপস্থিতি। লক্ষ্মণজুর ভাষায়, “এই ‘আমি’-বোধই শিব”—কারণ চেতনা নিজের মধ্যেই নিজেকে জানছে।

কাশ্মীর শৈববাদ আমাদের শেখায়—সৃষ্টি ও স্রষ্টা, কর্তা ও কর্ম, ব্যক্তি ও ব্রহ্ম—এই সব বিভাজন কেবল অজ্ঞানের পর্দা। পর্দা সরলেই দেখা যায়, সবই এক চেতনার লীলা—যেখানে শিবই জানছেন, দেখছেন, কর্ছেন এবং নিজেকেই অভিজ্ঞতা করছেন।

ব্যাবহারিক বা অভিজ্ঞতার স্তরে কাশ্মীর শৈববাদ বলে—শিবকে দূরের কোনো দেবতা নয়, বরং আমাদের নিজের চেতনার অন্তঃস্থ কেন্দ্র বা হৃদয় হিসেবে চিনতে হবে। অর্থাৎ, যে-সচেতনতা দিয়ে আমি এখন ভাবছি, অনুভব করছি, জানছি—সেই চেতনা-ই আসলে শিব।

এই দর্শনের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ ‘ঈশ্বর প্রত্যভিজ্ঞা’ (Īśvara-pratyabhijñā) এই উপলব্ধি দিয়ে শুরু হয়—“চিত্তম্ হি শিবোঽহম্” (“আমি শিব চেতনা”)। এর অর্থ, নিজের আত্ম-সচেতনতা—যে-অনুভূতি “আমি আছি”—সেইটিই প্রকৃত ঈশ্বর বা শিবচেতনা। এই ‘প্রত্যভিজ্ঞা’ মানে হলো পুনরায় চিনে ফেলা, নিজের প্রকৃত সত্তাকে পুনরায় উপলব্ধি করা।

কাশ্মীরি সাধিকা লাল্লা দেবী ও আচার্য আনন্দস্বামীও এই সত্যকে গভীরভাবে বলেছেন। লাল্লা দেবীর একটি বাণী আছে—“তিনি আমার মধ্যে, আমি তাঁর মধ্যে… আমি তাঁকে খুঁজে পেয়েছি, নিজের দেশেই, নিজেকেই।” এর মানে—ঈশ্বর বা শিব কোনো বাহিরে নয়; তিনি অন্তরের গভীরে, সেই আত্মসচেতন উপস্থিতিতে।

এই দর্শনের মূল কথা—মুক্তি বা মোক্ষ মানে নতুন কিছু অর্জন নয়, বরং নিজের চেতনার মধ্যেই শিবকে চিনে ফেলা। যতক্ষণ আমরা শিবকে “অন্য” বলে ভাবি, ততক্ষণ দ্বৈততা থাকে; কিন্তু যখন দেখি, আমার নিজস্ব সচেতনতা-ই তাঁর প্রকাশ, তখনই বিভেদ মুছে যায়।

শিব হলেন সেই সর্বব্যাপী, বিশ্বজনীন চেতনা—যিনি প্রতিটি জীবের হৃদয়ে “আমি আছি” বলে দীপ্ত। তাঁকে বাইরে খুঁজে পাওয়া যায় না; তাঁকে কেবল নিজের সচেতনতার গভীরে উপলব্ধ করা যায়। নিজের মধ্যে শিবকে চিনে নেওয়াই মুক্তি।

যদি শিব বিশুদ্ধ চেতনা হন, তবে কালী হলেন সেই সচেতন ইচ্ছা, যা সেই সচেতনতাকে অভিজ্ঞতা হিসেবে প্রকাশ করে। শৈব পরিভাষায়, কালী হলেন শক্তি—শিবের সৃষ্টিশীল, ধারক এবং রূপান্তরকারী শক্তি। শিব-শক্তি ঐক্যের অর্থ হলো শক্তি (কালী) শিব থেকে আলাদা নন; তিনি তাঁর নিজস্ব শক্তি দৃষ্টিকোণ থেকে: মহাবিশ্ব এবং আত্মা হলো তাঁর লীলা। কাশ্মীর শৈববাদে কালী তাঁর সর্বোচ্চ রূপে কালসংকর্ষণী নামে পরিচিত, সেই ব্যাপক শক্তি যা সময়, পরিবর্তন এবং অস্তিত্বের স্পন্দনকে মূর্ত করে।

বারোটি মহাজাগতিক ভূমিকার মাধ্যমে (Krama (ক্রম)-পদ্ধতির বারো কালী) তিনি "তাঁর নিজস্ব প্রকৃতি থেকে সমগ্র মহাবিশ্ব সৃষ্টি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ধ্বংস করেন"। বারো কালী মূলত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত—১) বাইরের বস্তু বা বিষয়-অবস্থা (objectivity), ২) জ্ঞানের বা অভিজ্ঞতার ধারা (cognition/perception), ৩) অভ্যন্তরীণ বিষয় বা চেতনা-অবস্থা (subjectivity)। একনিঃশ্বাসে কালী সৃষ্টির গর্ভ (সৃষ্টি কালী), ধারক (স্থিতি) এবং সকলের সংহারক (সংহার কালী)।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের ব্যাখ্যাকার আচার্য লক্ষ্মণজুর মতে, ক্রম-ঐতিহ্যের বারো কালী আসলে চেতনার বিকাশের বারোটি ধাপ বা তরঙ্গ, যার মধ্য দিয়ে সীমিত অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে অসীম চেতনার সঙ্গে একীভূত হয়। তিনি এই বারো কালীর পথকে ব্যাখ্যা করেছেন চেতনার অন্তর্গত উন্মেষ, স্থিরতা, বিলয় ও মুক্তির এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসেবে।

প্রথম ধাপে, সৃষ্টিকালী হচ্ছেন সেই মুহূর্ত, যখন উপলব্ধির প্রথম আলো জ্বলে ওঠে—চেতনার মধ্যে “আমি জানি” বা “কিছু ঘটছে” এই সূক্ষ্ম বোধ জেগে ওঠে। এরপর আসে রক্তকালী, যেখানে বস্তু বা বিষয় সরাসরি প্রকাশিত হয়—আমরা কোনো দৃশ্য বা ভাবের সঙ্গে যুক্ত হই। তৃতীয় ধাপে, স্থিতিনাশকালী—এই প্রকাশে স্থিরতা আসে—মন শান্ত, উপলব্ধি স্থির; যেন চেতনা এক ক্ষণিক বিশ্রাম নেয়। চতুর্থ ধাপ—যমকালী, চিন্তার বা মনোপ্রবাহের স্বাভাবিক সমাপ্তি—উপলব্ধি আবার নিজের উৎসে ফিরে যায়, নীরবতায় বিলীন হয়। এই চারটি ধাপ মূলত বস্তুজগতের অভিজ্ঞতা-চক্র নির্দেশ করে: সৃষ্টি, প্রকাশ, স্থিরতা ও লয়।

এরপর শুরু হয় আরও সূক্ষ্ম পর্যায়—যেখানে দ্বৈততার পর্দা ধীরে ধীরে সরতে থাকে। সংহারকালী-তে ব্যক্তি উপলব্ধি করেন যে, “বস্তুজগতের ছায়াগুলো কেবল হালকা প্রতিধ্বনি”—তিনি যেন ঘোষণা করেন, “আমি দ্বৈততা ধ্বংস করেছি।” মৃত্যুকালী-তে এই ছায়াগুলোও মিলিয়ে যায়, এবং আত্মা নিখাদ ঐক্যের অভিজ্ঞতা পায়—কোনো ভেদ থাকে না। রুদ্রকালী-তে শেষ সন্দেহও বিলীন হয়; চেতনা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হয়ে ওঠে, “ঈশ্বর-বোধ” বা ঈশ্বর-চেতনার দিকে পথ খুলে যায়। মার্তণ্ডকালী-তে সমস্ত জ্ঞানের শক্তিগুলি নিজের উৎসে শোষিত হয়—জ্ঞান ও জানার প্রক্রিয়া একাকার হয়ে যায়। এই চারটি স্তর তাই জ্ঞান-সম্পর্কিত রূপান্তর নির্দেশ করে।

এর পরের দুটি ধাপে চেতনা নিজেকেই সম্পূর্ণভাবে অতিক্রম করে। পরমার্ককালী সীমিত অহং বা “আমি-বোধ”-কে বিলীন করেন—যে-অহং আমাদের বারোটি ইন্দ্রিয়ের (জ্ঞানেন্দ্রিয়-কর্মেন্দ্রিয়-মন) জালে বেঁধে রেখেছিল। মহাকালী, যদিও এখনও “সময়ের” পরিসরে রয়েছেন, তবু তিনি সময়কেই হজম করে ফেলেন—পুরো মহাবিশ্বের গতি, পরিবর্তন ও কালপ্রবাহ তাঁর অন্তর্গত হয়। এবং অবশেষে, মহাভৈরব-ঘোরচণ্ডাকালী-তে চেতনা পরম ঐক্যে পৌঁছায়—সব আলো, সব রূপ, সব অভিজ্ঞতা এক অবিভক্ত প্রভায় মিশে যায়; এটি শুদ্ধ পরমচেতনার অবস্থা।

লক্ষ্মণজু এই সমগ্র যাত্রাকে কেবল কোনো দেবী-উপাসনার প্রতীক হিসেবে নয়, বরং চেতনার নিজস্ব অন্তর-অভিযাত্রা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর ভাষায়, “নিজের একাগ্র সাধনার কৃপায় সাধক উপলব্ধি করেন—দিব্য জননী দূরে নন; তিনি আমারই সত্তার মর্মস্থলে।” তাই কালী কোনো বাহিরের দেবী নন; তিনি আমাদের ভিতরের চেতনার গোপন দীপ্তি, ব্যক্তিগত আত্মা (জীবাত্মা)-র অন্তর্গত সত্য। আর যেমন শিব বিশ্বজনীন আত্মা (পরমাত্মা), তেমনি কালী সেই আত্মার অন্তর্লীন রূপ—যিনি নিজের আলোয়, নিজের লীলায়, মুহূর্তে মুহূর্তে জগৎ সৃষ্টি-স্থিতি-বিলয় করছেন।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের প্রতীকময় দিকটি, অর্থাৎ শিব-কালীর ঐক্যের মূর্তিতত্ত্ব এক অনুপম ভাষায় এই দর্শনের সারমর্ম প্রকাশ করে। অভিনবগুপ্ত তাঁর ‘ক্রমাকেলি’ গ্রন্থে এই ঐক্যকে কাব্যিকভাবে প্রকাশ করেছেন—“মহাকালী রূপে কালসংকর্ষণী কালীই ভগবান শিবের দেহের উপর নৃত্য করছেন।” এই চিত্রটি কেবল পৌরাণিক অলঙ্কার নয়; এটি এক গভীর তত্ত্বের প্রতীক। এখানে শিব নিস্তরঙ্গ, অচল, সময়াতীত চেতনার প্রতিরূপ—মহাকাল, আর তাঁর উপরে নৃত্যরত মহাকালী সেই চেতনার গতি, যা সময় ও স্থানের সকল সীমাকে অতিক্রম করে।

শৈবতন্ত্রে বলা হয়—শিব ও কালী আলাদা নন, তাঁরা চেতনার দুটি দিক। শিব হলেন নিঃশব্দ আলোক—প্রকাশ, আর কালী সেই আলোর কম্পন—বিমর্শ। চেতনা কেবল আলো হয়ে থাকলে জগৎ উদ্‌ভাসিত হতো না; আবার কেবল গতি থাকলে স্থির আলোক থাকত না। এই দুইয়ের নৃত্যেই বিশ্ব প্রকাশ পায়। কালী যখন শিবের দেহের উপর নৃত্য করেন, তার মানে—চেতনার স্থির ভিত্তির উপর গতিশীল শক্তি ক্রিয়াশীল। তাঁর নৃত্য মানে সৃষ্টির ছন্দ, পরিবর্তনের গতি, সময়ের প্রবাহ।