শৈব, শাক্ত, বৌদ্ধ, কৌল ও শ্রীবিদ্যা—এই ভিন্ন ভিন্ন ধারাগুলি প্রথমে দেখে আলাদা মনে হয়: কোথাও কালী, কোথাও ত্রিপুরসুন্দরী, কোথাও প্রজ্ঞাপারমিতা, কোথাও কৌলিকী বা মাতৃসদ্ভাব। কিন্তু যখন এই প্রতীকগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ বিশ্লেষণ করা হয়, তখন বোঝা যায়—তারা সবাই এক অভিন্ন নীতিকে প্রকাশ করছে: চেতনার ঐক্য ও আত্মপ্রকাশের নৃত্য।
শৈব, শাক্ত, বৌদ্ধ, কৌল ও শ্রীবিদ্যা—একই ঐক্যচেতনার পাঁচটি রূপ। এই পাঁচটি ভারতীয় আধ্যাত্মিক ও তান্ত্রিক ধারা—শৈব, শাক্ত, বৌদ্ধ, কৌল ও শ্রীবিদ্যা—দেখতে আলাদা হলেও, তাদের অন্তর্লীন দর্শন এক অভিন্ন নীতির দিকে ইঙ্গিত করে। ভাষা, প্রতীক, উপাসনা ও আচার ভিন্ন হলেও মূলত তারা একই সত্যের প্রকাশ—চেতনার ঐক্য ও আত্মপ্রকাশের উপলব্ধি। প্রতিটি ধারা একে অপরের পরিপূরক, এবং একত্রে মিলিয়ে দেয় ভারতীয় তত্ত্বচিন্তার সেই সর্বোচ্চ অদ্বৈত দৃষ্টিকে, যেখানে জ্ঞান, প্রেম, শক্তি ও নীরবতা একই মহাজাগতিক চেতনার ভিন্ন ভিন্ন দীপ্তি।
(১) শৈব দর্শন (Śaiva Darśana): শৈব দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু শিব—যিনি কেবল ব্যক্তিগত দেবতা নন, বরং পরম চেতনার প্রতীক (Parama Tattva)। শিব মানে সেই নির্মল, নিস্তরঙ্গ আলো যা সমস্ত সৃষ্টির ভিত্তি।
প্রধান শাস্ত্র: শিবসূত্র (বসুগুপ্ত), স্পন্দকারিকা (কল্লট), তন্ত্রালোক (অভিনবগুপ্ত), প্রত্যভিজ্ঞাহৃদয়ম্ (কাশ্মীর শৈব দর্শনের সারসংগ্রহ)
কাশ্মীর শৈব দর্শনে বলা হয়েছে—শিব ও শক্তি অবিচ্ছেদ্য। শিব হলেন প্রকাশ (Prakāśa)—চেতনার দীপ্তি, আর শক্তি হলেন বিমর্শ (Vimarśa)—চেতনার আত্মজ্ঞান। যেমন তন্ত্রালোক (১.৮১)-এ অভিনবগুপ্ত বলেন—“অদ্বয়ং তু দ্বয়াভাসং স্বক্রীড়ারূপতাং গতম্।” অর্থাৎ, অদ্বৈত চেতনা নিজের লীলায় দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে।
সেই লীলা বা আন্দোলনই হলো স্পন্দ (Spanda)—চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত স্পন্দন, যার মাধ্যমে সৃষ্টির জগৎ প্রকাশিত হয়। শৈব দর্শনে জগৎ কোনো মায়া নয়; এটি শিবচেতনারই খেলন, তাঁর আত্মবিমর্শের আনন্দময় প্রকাশ।
(২) শাক্ত দর্শন (Śākta Darśana): শক্তিই ব্রহ্ম; দেবী কেবল সৃষ্টিশক্তি নন, তিনিই চেতনার জীবন্ত রূপ। ঋগ্বেদ (১০.১২৫)–এর দেবীসূক্তে বলা হয়েছে—“অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বশূনাম্।” অর্থাৎ, “আমি সেই সর্বব্যাপী শক্তি, যিনি দেবতাদের মধ্যে চলমান।”
প্রধান শাস্ত্র: দেবীভাগবত পুরাণ, রুদ্রযামল তন্ত্র, কালী তন্ত্র, ত্রিপুরারহস্য (বা ত্রিপুররহস্য), নিত্যাষোড়শিকার্ণব তন্ত্র
শাক্ত তত্ত্বে শক্তি ও শিব অবিচ্ছেদ্য—শিব স্থিতি, শক্তি গতি; শিব নীরব, শক্তি নৃত্যশীল। কুলার্ণব তন্ত্র (২.১৩)-এ বলা হয়েছে—“শক্তিহীনঃ শিবো দেবো ন শম্ভুর্ভবতি প্রভো।” অর্থাৎ, শক্তি ছাড়া শিব কার্যক্ষম নন।
কালী, ত্রিপুরসুন্দরী, ললিতা, ছিন্নমস্তা—এই সব দেবীর রূপ চেতনার বিভিন্ন মাত্রা: সৃষ্টি, রূপান্তর, বিলয় ও পুনর্জন্মের প্রতীক। শক্তি চেতনার গতিময় দিক—যার অভ্যন্তরীণ উপলব্ধিই মুক্তির সূচনা।
(৩) বৌদ্ধ দর্শন (Bauddha Darśana): বৌদ্ধ দর্শন চেতনার অন্তর্দৃষ্টি ও অনিত্যতার বোধকে কেন্দ্র করে গঠিত। এটি তিনটি মহাযান ধারায় বিকশিত হয়েছে—মধ্যমক, যোগাচার ও তথাগতগর্ভ।
প্রধান শাস্ত্র: মূলমধ্যমককারিকা (আচার্য নাগার্জুন), যোগাচারভূমি শাস্ত্র (আসঙ্গ ও বসুবন্ধু), তথাগতগর্ভ সূত্র
মধ্যমক দর্শন: নাগার্জুন বলেন—“সব কিছুই শূন্য (Śūnyatā)”; অর্থাৎ, কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, সবই পরস্পরনির্ভর (প্রতীত্যসমুত্পাদ)। (মূলমধ্যমককারিকা, ২৪.১৮)
যোগাচার বা চিত্তমাত্রবাদ: “চিত্তমাত্রমিদং বিশ্বম্”—জগৎ চিত্তের প্রতিফলন, বাহ্য বাস্তব নয়।
তথাগতগর্ভ দর্শন: প্রত্যেক জীবের অন্তরে বুদ্ধত্ব বা জাগ্রত চেতনার বীজ আছে; মুক্তি মানে সেটিকে চিনে ফেলা, নতুন কিছু অর্জন নয়।
এই দর্শনের চূড়ান্ত উপলব্ধি—প্রজ্ঞা (জ্ঞান) ও করুণা (সহানুভূতি) এক ও অভিন্ন। তাদের সমন্বয়ই প্রজ্ঞাপারমিতা—জ্ঞানের পরম পূর্ণতা।
(৪) কৌল প্রথা (Kaula Tradition): “কুল” মানে “একসূত্রে বাঁধা”—তাই কৌল প্রথার সারমর্ম হলো ঐক্য ও অন্তর্লীন সংহতি। এখানে শিব-শক্তি, পুরুষ-প্রকৃতি, স্থিরতা-গতি—সব একই অভ্যন্তরীণ বাস্তবতায় দ্রবীভূত।
প্রধান শাস্ত্র: কৌলজ্ঞানোদয়, কৌলজ্ঞাননির্ণয়, কুলার্ণব তন্ত্র, রুদ্রযামল তন্ত্র
কৌল প্রথায় দেবী হলেন কৌলিকী বা বিসর্গ—যিনি চেতনার নিঃশ্বাসের প্রতীক, অর্থাৎ সৃষ্টি ও লয়ের অবিরাম প্রবাহ। কুলার্ণব তন্ত্র (৯.৮৭)-এ বলা হয়েছে—“দেহে দেহে শিবঃ শক্তিঃ কুলং তত্র প্রসিদ্ধ্যতি।” অর্থাৎ, প্রতিটি দেহে শিব ও শক্তির মিলনই কুল, আর এই মিলনেই দেবত্ব প্রস্ফুটিত।
কৌল দর্শনে মানবদেহই মন্দির; সাধনা মানে বাহিরে ঈশ্বর খোঁজা নয়, নিজের মধ্যে শিব-শক্তির মিলন অনুভব করা। এই মিলনকেই বলা হয় অন্তঃকৌলিন্য (Inner Kaula-hood)।
অন্তঃকৌলিন্য (Inner Kaula-hood): “কৌল” শব্দটি এসেছে “কুল” ধাতু থেকে, যার অর্থ—“একসূত্রে বাঁধা”, “পরিবার”, বা “সম্পূর্ণ ঐক্য”। এই অর্থ থেকেই বোঝা যায়, কৌল প্রথা কখনোই কেবল বাহ্যিক সম্প্রদায় বা আচার নয়; এটি মূলত চেতনার গভীর ঐক্যবোধের প্রতীক। “অন্তঃকৌলিন্য” মানে সেই ঐক্যকে বাইরে নয়, নিজের ভেতরে অনুভব করা—যেখানে শিব ও শক্তি, পুরুষ ও প্রকৃতি, স্থিরতা ও গতি, আত্মা ও বিশ্ব—সব এক অভ্যন্তরীণ চেতনার প্রবাহে মিলেমিশে যায়।
১. বাহ্য কৌলিন্য ও অন্তঃকৌলিন্য: প্রথাগত তন্ত্রে দুটি স্তরের কথা বলা হয়েছে—
(ক) বাহ্য কৌলিন্য—যেখানে সাধক মন্ত্র, যন্ত্র, পূজা, আচার ও দীক্ষার মাধ্যমে ঐক্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন।
(খ) অন্তঃকৌলিন্য—যেখানে এই সমস্ত বাহ্য আচার ধীরে ধীরে মন ও চেতনার গভীরে লীন হয়ে যায়।
তখন সাধক বুঝতে পারেন যে, তিনি নিজেই শিব-শক্তির মিলনক্ষেত্র, তাঁর নিজের শরীরই হলো শ্রীচক্র, আর তাঁর শ্বাসই সেই চেতনার নিঃশ্বাস তথা বিসর্গ।
শ্রীচক্র (Śrīcakra): “শ্রীচক্র” শব্দটি দুটি অংশে গঠিত—“শ্রী” মানে সৌন্দর্য, কল্যাণ, করুণা ও দেবী ত্রিপুরসুন্দরীর প্রতীক, আর “চক্র” মানে বৃত্ত, ঘূর্ণন বা সম্পূর্ণতা। শ্রীচক্র মানে সেই দিব্য ঐক্যের প্রতীকী মণ্ডল, যেখানে চেতনা ও শক্তি, শিব ও দেবী, জগৎ ও আত্মা—সব এক অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ে প্রকাশিত।
তন্ত্রশাস্ত্রে এটি “যন্ত্ররাজা” নামে পরিচিত—অর্থাৎ সমস্ত যন্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। নিত্যাষোড়শিকার্ণব তন্ত্র, শ্রীবিদ্যার্ণব তন্ত্র, ও ত্রিপুরারহস্য–এ এই চক্রের বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়।
গঠন ও বিন্যাস: শ্রীচক্র একটি সূক্ষ্ম জ্যামিতিক চিত্র, যা নয়টি ত্রিভুজের মিলনে গঠিত। এই নয়টি ত্রিভুজ একে অপরকে ছেদ করে ৪৩টি ক্ষুদ্র ত্রিভুজ তৈরি করে। এই ৪৩টি ত্রিভুজ আসলে চেতনার বিভিন্ন স্তর—যেখানে প্রতিটি ত্রিভুজ একটি শক্তির আসন।
এর বিন্যাস ধাপে ধাপে নিম্নরূপ:
১. বিন্দু—চক্রের কেন্দ্রবিন্দু; পরম চেতনা বা অদ্বৈত শিব-শক্তির ঐক্য।
২. ত্রিকোণ—তিন শক্তির প্রতীক: ইচ্ছা (Icchā), জ্ঞান (Jñāna) ও ক্রিয়া (Kriyā)।
৩. অষ্টকোণ স্তর—আট দিকের দেবীশক্তি, যাঁরা চেতনার বিস্তার ঘটান।
৪. দশকোণ স্তর—জ্ঞানের দশ রূপ, যা ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির কর্মে প্রকাশিত।
৫. চৌদ্দ ত্রিভুজ স্তর—উপাদান ও তত্ত্বের সূক্ষ্ম স্তর, জগতের অভ্যন্তরীণ গঠন।
৬. দুটি দশকোণ ও একটি অষ্টকোণ স্তর—প্রাকৃতিক শক্তি, বুদ্ধি ও কালরূপ দেবীদের ক্ষেত্র।
৭. ভূপুর—চক্রের বহিরাবরণ; এটি সংসারের পরিধি বা মায়ার সীমা।
এই বিন্যাসের মধ্যেই মহাবিশ্বের সৃষ্টি থেকে লয় পর্যন্ত সমগ্র গতিবিধি সূক্ষ্মভাবে লিপিবদ্ধ।
দার্শনিক অর্থ: শ্রীচক্র আসলে এক চেতনার মানচিত্র। এটি একইসাথে “জগতের বিন্যাস” এবং “আত্মার যাত্রা”—যেখানে কেন্দ্র থেকে বাইরে যাওয়া মানে চেতনার বহির্মুখতা (সৃষ্টি), আর বাইরে থেকে কেন্দ্রে ফিরে আসা মানে আত্মার অন্তর্মুখ প্রত্যাবর্তন (লয়)।
ত্রিপুরারহস্য (১৮.৮৬) বলে—“যোয়মেকো বিন্দুরূপঃ স সর্বব্রহ্মাণ্ডসংঘটকঃ।” অর্থাৎ, এই এক বিন্দুতেই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড নিহিত। শ্রীচক্রে কেন্দ্রবিন্দু হলো শিব-শক্তির অদ্বৈত ঐক্য, আর বহির্ভাগ হলো তার প্রকাশরূপ জগৎ—দুটিই এক পরম বাস্তবতার ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়।
ধ্যান ও সাধনা: শ্রীচক্রে সাধনা মানে বাইরে নয়, নিজের মধ্যে এই চেতনার স্তরগুলো অতিক্রম করা। যখন সাধক কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হন, তিনি ধীরে ধীরে মন, ইন্দ্রিয় ও ভাবনাকে অতিক্রম করেন, এবং শেষে বিন্দুতে পৌঁছে বোঝেন—“আমি ও দেবী আলাদা নই; জগৎ ও চেতনা এক।”
এ অবস্থাকে বলা হয় শ্রীচক্রবেদন—যেখানে জগৎকে আলাদা না দেখে দেবীস্বরূপে অনুভব করা হয়। শ্রীচক্র উপাসনা এই কারণে কখনো নিছক আচার নয়; এটি এক আধ্যাত্মিক মানচিত্র, যা আত্মাকে কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনে।
নিত্যা দেবী ও সময়চেতনা: শ্রীচক্রের প্রতিটি ত্রিভুজে অবস্থান করেন একেকজন নিত্যা দেবী—ষোলো জন নিত্যা দেবী (যেমন কামেশ্বরী, ভাগমালিনী, নিত্যমধা, ক্লিন্না, নিত্যমধ্রা, জ্বলা প্রভৃতি)। এঁদের বলা হয় ষোড়শ নিত্যা, কারণ তাঁরা “কাল” বা সময়ের ষোলোটি বিভাজনের প্রতীক। শ্রীচক্র কেবল স্থান নয়, সময়েরও মানচিত্র—যেখানে প্রত্যেক মুহূর্তই দেবীর দীপ্তি।
অদ্বৈত তত্ত্বে ব্যাখ্যা: শ্রীচক্রের কেন্দ্রবিন্দু (বিন্দু) হলো অদ্বৈত চেতনা—যেখানে শিব ও শক্তির কোনো ভেদ নেই। ত্রিভুজ ও বৃত্তসমূহ হলো মায়া ও কার্য-কারণ সম্পর্কের প্রতীক—যেমন তরঙ্গ ও সমুদ্র আলাদা নয়, তেমনি জগৎ ও চেতনা এক। ললিতা সহস্রনাম-এ বলা হয়েছে—“শ্রীচক্ররাজনিলয়া শ্রীমৎ ত্রিপুরসুন্দরী।” অর্থাৎ, দেবী ত্রিপুরসুন্দরী নিজেই শ্রীচক্রে অবস্থান করেন; তাঁর অস্তিত্বই এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু।
অভ্যন্তরীণ তাৎপর্য: শ্রীচক্রের সাধনা শুরু হয় বহির্পূজা দিয়ে, কিন্তু এর চূড়ান্ত উপলব্ধি ঘটে অন্তঃচক্রে—অর্থাৎ নিজের হৃদয়মণ্ডলে। তখন সাধক উপলব্ধি করেন, শ্রীচক্র বাইরের কোনো প্রতীক নয়; এটি তাঁর নিজের চেতনার গোপন বিন্যাস। প্রতিটি ত্রিভুজ তাঁর অনুভব, প্রতিটি বৃত্ত তাঁর চিন্তা, প্রতিটি নিত্যা তাঁর সময়বোধ। এই উপলব্ধিই অন্তঃচক্র-দর্শন—যেখানে আত্মা, দেবী ও জগৎ একই পরম দীপ্তিতে বিলীন।
শ্রীচক্র হলো চেতনার সম্পূর্ণ প্রতীক, যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার, তিরোধান ও অনুগ্রহ—এই পাঁচ মহাক্রিয়া একসঙ্গে প্রতিফলিত। এটি দেবী ত্রিপুরসুন্দরীর শুদ্ধতম রূপ—সৌন্দর্য, জ্ঞান ও আনন্দের মেলবন্ধন। শ্রীচক্র কোনো কেবল জ্যামিতিক চিত্র নয়; এটি মহাবিশ্বের ও আত্মার মানচিত্র, যা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়—জগৎ, দেবী, ও আমি—তিনটি আলাদা নয়, তিনিই এক, তিনিই সব, তিনিই শ্রীচেতনার চিরন্তন নৃত্য।
কুলার্ণব তন্ত্র (৯.৮৭)-এ বলা হয়েছে—“দেহে দেহে শিবঃ শক্তিঃ কুলং তত্র প্রসিদ্ধ্যতি।” অর্থাৎ, প্রতিটি দেহেই শিব ও শক্তির মিলনই কুল, এবং সেই মিলনেই দেবত্ব প্রকাশিত হয়। এই বোধই হলো অন্তঃকৌলিন্য—ঈশ্বর কোনো বাহিরের মন্দিরে নন; তিনি মানুষের নিজের চেতনার মধ্যেই বিরাজমান।
২. অন্তঃকৌলিন্যের অভিজ্ঞতা: অন্তঃকৌলিন্য কেবল তত্ত্ব নয়; এটি এক অভিজ্ঞতা। যখন সাধক অনুভব করেন—তাঁর শ্বাসের প্রতিটি ওঠানামা শক্তির স্পন্দন, তাঁর চেতনার প্রতিটি দীপ্তি শিবের প্রতিফলন, তাঁর কামনা, চিন্তা, ও নিস্তব্ধতা—সবই দেবীর লীলার অংশ, তখনই তিনি সত্যিকার কৌল হয়ে ওঠেন।
অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (২.৪)-এ বলেন—“যত্র বিশ্বং তদেকং চ, তত্র কৌলং প্রবর্ততে।” অর্থাৎ, যেখানে বহুতা একত্বে লীন হয়, সেখানেই কৌলত্বের সূচনা।
৩. তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা: অন্তঃকৌলিন্য মানে শরীর (দেহ), প্রাণ (শ্বাস), মন (মনস), বুদ্ধি (বোধ) ও আত্মা (চিত্)—এই পাঁচ স্তরের মধ্যে ঐক্য উপলব্ধি। এখানে শরীর কোনো বাধা নয়, এটি দেবীর মন্দির; মন কোনো বিভ্রান্তি নয়, এটি চেতনার প্রকাশ।
যখন সাধক এইভাবে উপলব্ধি করেন—“আমি আর ঈশ্বর—দু-জন নয়,” তখন তাঁর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে ওঠে সেই এক চেতনার স্পন্দন। তিনি তখন বলেন—“আমি-ই দেবী, আমি-ই শিব, আমি-ই ঐক্যের প্রতিধ্বনি।” এই অবস্থায় তাঁর প্রতিটি কাজ—খাওয়া, কথা বলা, নিঃশ্বাস নেওয়া—সবই হয়ে ওঠে পূজা; প্রতিটি মুহূর্তই উপাসনা।