শৈব কালী: এক-শো দশ



৪. আচার থেকে অভিজ্ঞতায় উত্তরণ: কৌল প্রথা বাহ্য আচারে শুরু হলেও, এর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল অন্তরসাধনা। মন্ত্র-যন্ত্র ও আচার আসলে অন্তর-সংহতির প্রস্তুতি। যখন এই আচারগুলি মন ও প্রজ্ঞায় দ্রবীভূত হয়, তখন সাধক উপলব্ধি করেন—কৌল হওয়া মানে কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়া নয়, বরং নিজের মধ্যেই শিব-শক্তির ঐক্য অনুভব করা। কৌলজ্ঞাননির্ণয়-এ বলা হয়েছে—“যো জানাতি আত্মনং কুলেশ্বরং, স কৌলো ন অন্যথা।” অর্থাৎ, যিনি নিজের অন্তরে কুলেশ্বর (শিব-শক্তির ঐক্যচেতনা) উপলব্ধি করেন, তিনিই সত্য কৌল, অন্য কেউ নয়।

৫. দার্শনিক পরিণতি: অন্তঃকৌলিন্যের চূড়ান্ত পরিণতি হলো অদ্বৈত অভিজ্ঞতা। এখানে “উপাসক” ও “উপাস্য”, “শিব” ও “শক্তি”, “জ্ঞান” ও “ক্রিয়া”—সব ভেদ বিলীন হয়ে যায়। এটি কাশ্মীর শৈব দর্শনের “প্রত্যভিজ্ঞা” তত্ত্বের সঙ্গে একাত্ম—যেখানে আত্মা নিজেরই ঈশ্বরত্ব চিনে ফেলে। অভিনবগুপ্ত এই অবস্থাকে বলেছেন “মহাকৌল” স্তর—যেখানে সাধক আর ব্যক্তি নয়, বরং প্রতিটি জীবের মধ্যকার শিব-শক্তি-চেতনার প্রতিধ্বনি।

অন্তঃকৌলিন্য বা Inner Kaula-hood হলো নিজের মধ্যে চেতনার ঐক্য উপলব্ধি করা। এটি এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা, যেখানে শরীর, মন ও আত্মা একই ধারায় প্রবাহিত। ঈশ্বর কোনো দূরবর্তী সত্তা নন; তিনি আমাদের নিঃশ্বাসে, চেতনার আলোয়, প্রেমের কম্পনে বিদ্যমান। যখন এই উপলব্ধি স্থায়ী হয়, তখন মানুষ নিজেই হয়ে ওঠে চলমান মন্দির—যেখানে শিব ও শক্তি অনন্ত মিলনে চিরনৃত্যরত।

শ্রীবিদ্যা প্রথা (Śrīvidyā Tradition): শ্রীবিদ্যা হলো ত্রিপুরসুন্দরী উপাসনাকেন্দ্রিক তান্ত্রিক ঐতিহ্য, যেখানে দেবীকে দেখা হয় চেতনার সর্বোচ্চ সৌন্দর্যরূপে।

প্রধান শাস্ত্র: ত্রিপুরারহস্য, ললিতা সহস্রনাম, নিত্যাষোড়শিকার্ণব তন্ত্র, শ্রীবিদ্যার্ণব তন্ত্র

“ত্রিপুর” মানে তিন চেতনা-অবস্থা—জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। দেবী ত্রিপুরসুন্দরী এই তিন অবস্থার অধিষ্ঠাত্রী এবং তাদেরও ঊর্ধ্বে। শ্রীচক্র এখানে চেতনার প্রতীকী মানচিত্র—প্রতিটি ত্রিভুজ এক একটি শক্তিস্তর, আর কেন্দ্রবিন্দু (বিন্দু) হলো পরম ঐক্যের প্রতিচ্ছবি।

ত্রিপুরারহস্য (১৮.৮৬)-এ বলা হয়েছে—“ত্রিপুরা হি পরা বিদ্যা আত্মবোধপ্রদায়িনী।” অর্থাৎ, ত্রিপুরাই সেই পরাবিদ্যা, যিনি আত্মবোধ প্রদান করেন। এখানে জ্ঞান (বিদ্যা), সৌন্দর্য (শ্রী) ও ভক্তি—এই তিনের সমন্বয়েই সাধনা সম্পূর্ণ হয়। মুক্তি মানে চেতনার আনন্দরূপ উপলব্ধি।

ঐক্যতত্ত্ব: এই পাঁচটি ধারা—শৈব, শাক্ত, বৌদ্ধ, কৌল ও শ্রীবিদ্যা—ভাষা, প্রতীক ও উপাসনায় ভিন্ন হলেও এক অভিন্ন অদ্বৈত সূত্রে বাঁধা।

শৈব বলে—“সবই চেতনা।” (শিবসূত্র, ১.১)

শাক্ত বলে—“চেতনা মানেই শক্তি।” (দেবী সূক্ত, ১০.১২৫)

বৌদ্ধ বলে—“চেতনা মানেই শূন্যতার দীপ্তি।” (মূলমধ্যমককারিকা, ২৪.১৮)

কৌল বলে—“চেতনা মানেই ঐক্যের প্রবাহ।” (কুলার্ণব তন্ত্র, ৯.৮৭)

শ্রীবিদ্যা বলে—“চেতনা মানেই সৌন্দর্যের বিন্দু।” (ত্রিপুরারহস্য, ১৮.৮৬)

এই তুলনা কোনো প্রতীকি মিল নয়—এটি এক গভীর দার্শনিক সেতুবন্ধন। এই পাঁচ ধারার মিলন প্রমাণ করে যে, ভারতীয় তান্ত্রিক ঐতিহ্যের সব পথ—শৈব, শাক্ত, বৌদ্ধ, কৌল ও শ্রীবিদ্যা—একই চেতনার মহাস্রোতে প্রবাহিত। তাদের রূপ ভিন্ন, কিন্তু মর্ম এক: চেতনা সর্বত্র, চেতনা এক, এবং সেই চেতনার আত্ম-জাগরণই মুক্তি।

কাশ্মীর শৈবদর্শনে শিব ও শক্তি অবিচ্ছেদ্য—প্রকাশ (Prakāśa) ও বিমর্শ (Vimarśa)—যেখানে শিব হলেন নিস্তরঙ্গ আলো, আর শক্তি সেই আলোর স্ব-অবগাহন, তার স্পন্দন। এই দ্বন্দ্বহীন ঐক্যই এখানে পরম চেতনার প্রতীক। শাক্ত তন্ত্রে, একই সত্য প্রকাশ পায় কালী বা ত্রিপুরসুন্দরীর মাধ্যমে—যিনি নিজের দীপ্তির দ্বারা বিশ্বকে সৃষ্টি করেন, আবার নিজের গভীরতায় সব কিছু লীন করে দেন।

অন্যদিকে, বৌদ্ধ মহাযান দর্শনে, প্রজ্ঞা (জ্ঞান) ও করুণা (সহানুভূতি) একই অদ্বৈত চেতনার দুই দিক। প্রজ্ঞা বুঝতে শেখায় যে সবই শূন্যতার (Śūnyatā) প্রকাশ, আর করুণা সেই উপলব্ধিকে জীবজগতের কল্যাণে রূপ দেয়। এই দুইয়ের মিলনই প্রজ্ঞাপারমিতা—জ্ঞানের পরম পূর্ণতা—যেখানে জ্ঞান আর প্রেম একত্রে জাগরণের প্রতীক।

কৌল প্রথায় এই ঐক্য প্রকাশিত হয় “কুল” ধারণায়—যার অর্থ “একসূত্রে বাঁধা”। শিব ও শক্তি এখানে এক অনির্বচনীয় ঐক্যে দ্রবীভূত, যেখানে স্থিরতা ও গতি, পুরুষ ও প্রকৃতি, কর্তা ও ক্রিয়া—সব একই মূল সত্তা বা অপরিবর্তনীয় আধার বা অন্তর্নিহিত ভিত্তি (Underlying Substratum)-তে মিলিত। কৌলিকী বা বিসর্গ দেবী সেই অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের প্রতীক—চেতনার শ্বাস, যা কখনো সৃষ্টি, কখনো লয়, কিন্তু মূলত চেতনারই উচ্ছ্বাস।

আর শ্রীবিদ্যা তন্ত্রে, দেবী ত্রিপুরসুন্দরী তিনপুরীর (জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি) অধিষ্ঠাত্রী, যিনি এই তিন অবস্থাকে একত্রে ধারণ করেন। তাঁর বিন্দু-রূপই সেই পরম চেতনা—যেখানে বহুত্ব ও একতা, প্রকাশ ও অন্তর্ধান এক অখণ্ড মহাশক্তিতে মিলিত।

এইসব ধারার ভেতর দিয়ে দেখা যায়—তাদের ভাষা, দেবীর নাম, আচার, প্রতীক ভিন্ন হলেও দৃষ্টির কেন্দ্র এক। সবই এক অদ্বৈত চেতনা, যা কখনও প্রকাশে, কখনও নিস্তব্ধতায়, কখনও করুণায়, কখনও প্রজ্ঞায় নিজেকে দেখছে।

একটি উদাহরণে বোঝা যাক: যেমন সূর্যের রশ্মি আলাদা আলাদা রঙে বিভক্ত হয়, কিন্তু উৎস এক সূর্যই; তেমনি শৈবের শিব-শক্তি, শাক্তের কালী-ত্রিপুরা, বৌদ্ধের প্রজ্ঞাপারমিতা, কৌলের কুলতত্ত্ব—সবই সেই এক চেতনার বিভিন্ন রূপরশ্মি। এক রশ্মি প্রজ্ঞা হয়ে উদ্ভাসিত, এক রশ্মি করুণা হয়ে প্রবাহিত, এক রশ্মি নৃত্য হয়ে স্পন্দিত, আর এক রশ্মি মন্ত্র হয়ে উচ্চারিত।

এই তুলনা কেবল প্রতীকের মিল নয়—এটি এক গভীর দার্শনিক সত্যের প্রকাশ: ভারতীয় তান্ত্রিক ঐতিহ্যের সমস্ত পথ—যতই তারা বাহিরে ভিন্ন দেখাক—সবই শেষ পর্যন্ত মিশে যায় সেই এক চেতনার মহাসাগরে, যেখানে জ্ঞান ও প্রেম, শূন্যতা ও পূর্ণতা, শিব ও কালী, প্রজ্ঞা ও করুণা—সবই এক।

প্রজ্ঞাপারমিতার শূন্যতা (Śūnyatā) এবং ক্রম কালীর পূর্ণতা (Pūrṇatā)—এই দুটি ধারণা প্রথম দৃষ্টিতে বিপরীতমুখী মনে হলেও, আসলে তারা একই অদ্বৈত সত্যের দুটি ভিন্ন প্রকাশ। এই গভীর তত্ত্বগুলো মহাবিশ্বের প্রকৃতি এবং আমাদের চেতনার স্থান সম্পর্কে মৌলিক অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।

প্রজ্ঞাপারমিতার শূন্যতা হচ্ছে মুক্ত সম্ভাবনা। বৌদ্ধ দর্শনের একটি কেন্দ্রীয় ধারণা শূন্যতা কোনো কিছু না থাকা বা অস্তিত্বহীনতা বোঝায় না। বরং, এটি বোঝায় যে, কোনো বস্তু, ভাব, এমনকি আমাদের নিজস্ব পরিচয়—কিছুরই নিজস্ব, স্বাধীন বা স্থির কোনো স্বভাব নেই। এই ধারণা অনুসারে, সব কিছুই "প্রতীত্যসমুত্পন্ন," অর্থাৎ সম্পর্কনির্ভর উত্থান-পতনের এক নিরন্তর স্রোত। এর অর্থ হলো, প্রতিটি সত্তা অন্যান্য সত্তার সাথে পারস্পরিক নির্ভরতার মাধ্যমে অস্তিত্বশীল। একটি টেবিলের অস্তিত্ব তার উপাদান, কারিগর, এবং যে-প্রেক্ষাপটে এটি ব্যবহৃত হয়—সব কিছুর উপর নির্ভরশীল। ঠিক একইভাবে, আমাদের আত্মপরিচয়ও আমাদের সম্পর্ক, অভিজ্ঞতা এবং পারিপার্শ্বিকতার উপর নির্ভরশীল।

শূন্যতা শেখায় যে, একটি বস্তু বা ধারণা তাতে কোনো বাস্তবতা "নেই" বলে অনর্থক নয়; বরং এটি "স্বভাবশূন্য।" এই স্বভাবশূন্যতার ফলেই প্রতিটি মুহূর্তেই অসীম সম্ভাবনা উন্মুক্ত থাকে। যখন কোনো কিছুর স্থির বা পূর্বনির্ধারিত প্রকৃতি নেই, তখন তা পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত এবং নতুন রূপে প্রকাশ পাবার জন্য প্রস্তুত। এটি একধরনের মুক্তি—ধারণা, প্রত্যাশা বা কঠোর সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি। এই অর্থে, শূন্যতা শুধু একটি দার্শনিক ধারণা নয়, এটি একধরনের মানসিক অবস্থা, যেখানে মনের সীমাবদ্ধতাগুলো দ্রবীভূত হয় এবং অসীম সম্ভাবনাগুলি দৃশ্যমান হয়। এটি আমাদেরকে বিদ্যমান কাঠামো বা ধারণাগুলির প্রতি অন্ধ আসক্তি থেকে মুক্ত করে, যা নতুনত্ব এবং সৃষ্টির জন্য পথ খুলে দেয়।

শাক্ত দর্শনের এক শক্তিশালী ধারণা ক্রম কালী এই শূন্যতার গভীরতাকে পূর্ণতায় রূপান্তরিত করেন। তিনি শূন্যতার সেই নিষ্পলক উন্মুক্ততাকে নিজের স্বপ্রকাশমান চেতনার (Self-luminous Consciousness) দীপ্তিতে পূর্ণ করে দেখান যে, সব রূপ-অরূপ এই চেতনার অনন্ত পরিপূর্ণতা (Infinite Wholeness)-তেই ভেসে ওঠে ও ডুবে যায়। ক্রম কালী বোঝান যে, এই অসীম শূন্যতা কোনো শূন্য স্থান নয়, বরং তা হলো আদি এবং অকৃত্রিম চৈতন্য, যা নিজের প্রকাশ রূপে সমগ্র মহাবিশ্বকে ধারণ করে আছে।

কালীর "ক্রম" শব্দটি সময়ের ধারণার সাথে জড়িত। তিনি সময়ের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি এবং বিনাশের চক্রকে প্রকাশ করেন। এই চক্র কোনো শূন্য স্থান থেকে উদ্ভূত হয় না, বরং তা চিরন্তন চেতনার প্রকাশ। যেখানে শূন্যতা বোঝায় যে, কোনো কিছু নিজস্ব স্বভাব নিয়ে বিদ্যমান নয়, সেখানে ক্রম কালী দেখান যে, এই 'স্বভাবশূন্যতা'-ই হলো অসীম চেতনার খেলা—যেখানে সব কিছুই এই একীভূত চেতনার অংশ। তাঁর দৃষ্টিতে, মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা, প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি অস্তিত্ব সেই অনন্ত পূর্ণতার অংশ। দুঃখ, আনন্দ, জন্ম, মৃত্যু—সবই এই চেতনারই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ।

এই দুটি ধারণা—শূন্যতা ও পূর্ণতা—একত্রে আমাদেরকে এক গভীর অদ্বৈত সত্যের দিকে নিয়ে যায়। তারা বোঝায় যে, অস্তিত্বের মূল কোনো দ্বিধা বা বিভাজন নেই। শূন্যতা আমাদেরকে সকল প্রকার সীমাবদ্ধ ধারণা থেকে মুক্তি দেয়, এবং ক্রম কালীর পূর্ণতা আমাদেরকে এই মুক্তির মধ্যে থাকা অনন্ত চেতনার উপলব্ধি করায়। এই চেতনার মধ্যে, আমরা শুধুমাত্র স্বতন্ত্র সত্তা নই, বরং এক বিশাল, অবিভাজ্য সমগ্রের অংশ।

এটি একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, যেখানে আমরা আমাদের ক্ষুদ্র অহংবোধের সীমা অতিক্রম করে মহাবিশ্বের অসীমতার সাথে একাত্ম হই। যখন আমরা শূন্যতার মাধ্যমে সকল বস্তুর অস্থিরতা ও পরস্পর নির্ভরশীলতা উপলব্ধি করি, তখন আমরা উপলব্ধি করি যে, কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। আর যখন আমরা ক্রম কালীর পূর্ণতার মাধ্যমে এই সব কিছুর মূলে থাকা একক চেতনার ধারণা করি, তখন আমরা দেখি যে, এই অনন্ত লীলার প্রতিটি অংশই এক অসীম এবং পরিপূর্ণ সত্তার প্রকাশ। এই উপলব্ধি কেবল জ্ঞানগত নয়, এটি একটি গভীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থবহ করে তোলে এবং আমাদেরকে অস্তিত্বের মূল রহস্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়।

এখানে “শূন্যতা” মানে অনুপস্থিতি নয়, অবাধতা—ধারণাগত কারাগার থেকে মুক্ত পরিসর; আর “পূর্ণতা” মানে ভারী সঞ্চয় নয়, স্বতঃস্ফূর্ত দীপ্তি—চেতনার এমন উপস্থিতি, যেখানে কিছু যোগ করার নেই, বাদ দেওয়ারও নেই। শূন্যতা ধারণার কড়া শল্যচিকিৎসা—“এটিই চূড়ান্ত” বলে চাপিয়ে-দেওয়া যে-কোনো দখলকে কেটে দেয়; পূর্ণতা সেই কাটাছেঁড়ার পরের জাগ্রত প্রাণশক্তি—যেখানে উন্মুক্ত পরিসর স্বয়ং অনুভূত হয় আনন্দ, প্রজ্ঞা ও করুণার একত্র স্পন্দন হিসেবে।

মধ্যমক বোধে, “স্বতন্ত্র অস্তিত্ব” মানে মনের তৈরি মিথ্যা জড়তা; সেটি গলে গেলে জগৎ শূন্য—কঠিন নয়, নৃত্যমান। যোগাচারের দৃষ্টিতে, এই নৃত্য চিত্তেরই প্রতিফলন; আর তথাগতগর্ভ বলে, প্রতিটি জীবের অন্তরে এই জাগ্রত দীপ্তি সদাই আছে, কেবল আচ্ছন্ন। ক্রম-দর্শনের কালী সেই আচ্ছাদন সরান—বিমর্শ (স্ব-পরিচিতি)-র বজ্রকাটার মতো তিনি শূন্যতার পরিসরেই প্রকাশ (prakāśa) ঢেলে দেন। ফলে বোঝা যায়: শূন্যতা হলো “অবাধ ক্ষেত্র”, আর পূর্ণতা হলো “সে-ক্ষেত্রে চেতনার সচেতন উপস্থিতি”—দুই-ই একসঙ্গে সত্য।

একটি ছবি ভাবুন। ক্যানভাস নেই তো ছবি আঁকা যায় না; কেবল ক্যানভাসই যদি থাকে, রং-রেখার খেলা সেখানে নেই। ক্যানভাসের শূন্যতা রঙের জন্য অবাধ ক্ষেত্র, আর চিত্রের পূর্ণতা সেই ক্ষেত্রের জাগ্রত প্রকাশ। বাস্তবে, ক্যানভাস ও ছবি আলাদা নয়—একটার ভেতরেই আরেকটা। তেমনি শূন্যতা ও পূর্ণতা—একই চেতনার অবিচ্ছেদ্য দিক: শূন্যতা দখলহীনতা, পূর্ণতা প্রভাস্বরতা।

প্রজ্ঞাপারমিতার শূন্যতা ও তান্ত্রিক প্রভাস্বরতার ঐক্যকে বুঝতে হলে প্রথমেই ধরতে হবে—“শূন্য” মানে কোনো কিছুর নিস্তরণ বা নৈরাশ্য নয়; শূন্যতা হলো স্বভাবশূন্যতা—কোনো কিছুরই নিজস্ব, অপরিবর্তনীয়, বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা নেই। জগৎ প্রতিমুহূর্তে সম্পর্কনির্ভর উদ্‌ভবে ওঠে-নামে; তাই কোনো ধারণা, পরিচয়, আবেগ বা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরার যৌক্তিক ভিত্তি থাকে না।