শৈব কালী: এক-শো আঠারো



কাশ্মীর শৈব দর্শনের সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টিগুলি আধুনিক মূর্ত-জ্ঞানতত্ত্ব (embodied cognition)-এর সঙ্গে আশ্চর্য মিল রাখে। উভয় ক্ষেত্রেই মনকে কোনো বিমূর্ত, দেহ-বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে দেখা হয় না; বরং শরীর ও পরিবেশের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত এক আত্ম-সংগঠনশীল জীবন্ত প্রক্রিয়া হিসেবে বোঝানো হয়।

দার্শনিক ফ্রান্সিস্কো ভারেলা ও ইভান থম্পসন তাঁদের Enactive Cognition তত্ত্বে ব্যাখ্যা করেছেন—মন আসলে এক autopoietic বা স্ব-উৎপাদনশীল ব্যবস্থা, যা নিজের ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নিজেকে গঠন করে। মন কোনো প্রস্তুত বা স্থির বাস্তবতার প্রতিফলন নয়; বরং সে ক্রমাগত বাস্তবতাকে নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করে চলে। যেমন জীবন নিজেই নিজের কাঠামো গড়ে তোলে—নিজেকে বজায় রাখে, পরিবর্তন করে, আবার নতুনভাবে সংগঠিত হয়—তেমনি চেতনাও এক অবিরাম প্রবাহ, যা প্রতিক্ষণ নিজেকে সৃষ্টি, পুনর্গঠন ও চেনার প্রক্রিয়ায় গতিশীল থাকে।

এই ধারণারই প্রতিরূপ কাশ্মীর শৈব দর্শনে দেখা যায়—শিবের স্বতঃস্ফূর্ত স্পন্দ (svābhāvika spanda)-এ। এখানে চেতনা নিছক স্থির আলোক নয়; সে এক আনন্দময় স্পন্দন, যা নিজের উচ্ছ্বাসে জগৎ সৃষ্টি করে এবং সেই সৃষ্টির মধ্য দিয়েই নিজেকে চেনে। শিব নিজের মধ্যেই সম্ভাবনা, আর সেই সম্ভাবনা যখন গতিশীল হয়, তখন তা হয়ে ওঠে কালী—চেতনার দেহ, শক্তি ও প্রকাশ।

অর্থাৎ, শৈব দর্শনের ভাষায় শিব ও কালী, আর আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় মন ও দেহ—দুটোই একই পরম ঐক্যের দুই দিক। চেতনা কখনোই দেহের বাইরে নয়; দেহও কখনো চেতনার বাইরে নয়। একের ভেতরেই অন্যের অনন্ত প্রতিধ্বনি।

অ্যান্টোনিও দামাসিও তাঁর The Feeling of What Happens গ্রন্থে বলেন, “বিদেহী মনের মতো কিছু নেই; মন মস্তিষ্কে নিহিত, আর মস্তিষ্ক দেহে নিহিত।” অর্থাৎ, মন হলো দেহেরই বর্ধিত রূপ—চিন্তা, অনুভূতি, স্মৃতি—সবই শরীরের স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই দৃষ্টিকোণটি শৈব দর্শনের চেতনা-দেহ সম্পর্কের ধারণার সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে যায়। সেখানে বলা হয়, চেতনা (শিব) কখনোই তার শক্তি বা দেহ (কালী) ছাড়া বিদ্যমান নয়; আর শক্তিও তার চেতনার ভিত্তি ছাড়া অসম্পূর্ণ। এই দুই চিরসংযুক্ত—একই বাস্তবতার দুই দিক: স্থির ও গতিশীল, অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত, আলো ও তার প্রতিফলন।

দামাসিও আরও বলেন, “আত্ম, পরিচয় ও ব্যক্তিত্ব কোনো প্রস্তুত সত্তা নয়; তারা অসংখ্য জৈবিক ও স্নায়বিক প্রক্রিয়ার ফল।” অর্থাৎ, আমাদের ‘আমি’ নামের অনুভূতিটিও শরীর-মস্তিষ্কের ক্রিয়াশীল মিথস্ক্রিয়া থেকে গঠিত। কাশ্মীর শৈব দর্শন একই সত্যকে গভীরতর অস্তিত্বগত স্তরে প্রকাশ করে—‘আত্মা’ কোনো স্থির পদার্থ নয়, বরং শিব (চেতনা) ও শক্তি (গতি)-এর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া থেকেই তার জন্ম। এই আত্মা কোনো বস্তু নয়; এটি এক চলমান সম্পর্ক, এক আত্ম-অন্বেষণশীল ক্রিয়া।

শিবকে বলা হয় স্বাতন্ত্র্য-শক্তি (Svātantrya-śakti)—অর্থাৎ পরম স্বাধীন ইচ্ছা বা আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি। চেতনা নিজেই স্বাধীন, নিজেই সৃষ্টিশীল, নিজেই নিজের নিয়ম নির্ধারণ করে। এটি কোনো বাহ্যিক কারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। এই ধারণা আধুনিক সক্রিয় জ্ঞানতত্ত্ব (enactivism) বা স্ব-সংগঠন তত্ত্ব (self-organization theory)-এর সঙ্গে গভীর অনুরণন রাখে, কারণ উভয়ই বলে—চেতনা বা মন কোনো স্থির সত্তা নয়, বরং এক আত্ম-সংগঠিত, ক্রিয়াশীল প্রক্রিয়া, যা নিজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই নিজেকে গঠন করে।

সক্রিয় জ্ঞানতত্ত্ব (enactivism)-এ বলা হয়, জীব ও মন বাস্তবতাকে নিছক প্রতিফলিত করে না; তারা পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সেটিকে গঠন করে। অর্থাৎ জানা মানে অংশগ্রহণ করা, আর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই “বাস্তবতা” গড়ে ওঠে। চেতনা এখানে এক ক্রিয়াশীল, দেহ-নির্ভর, প্রসঙ্গ-নির্ভর প্রক্রিয়া—যা কখনও বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং ভিতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত।

ঠিক তেমনই, কাশ্মীর শৈব দর্শনও বলে—শিবচেতনা কোনো বাহ্য শক্তির অধীন নয়; তিনি নিজেই নিজের উৎস, নিজের গতি, নিজের নিয়ামক। তাঁর এই স্বায়ত্তশাসিত ক্রিয়াশক্তিকেই বলা হয় স্বাতন্ত্র্য-শক্তি (Svātantrya-śakti)—যেখানে চেতনা নিজেই স্বাধীনভাবে সৃষ্টি করে, ধারণ করে ও বিলীন হয়।

অতএব, যেমন enactivism বলে—“জ্ঞান মানে দেহ ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়া,” তেমনি শৈব দর্শনও বলে—“চেতনা মানে শিব ও শক্তির অন্তঃসংলাপ।” দুটিই একই সত্যের দুই রূপ: চেতনা এক জীবন্ত, আত্ম-সংগঠনশীল নৃত্য—যেখানে জানা, হওয়া ও সৃষ্টি একে অপরের মধ্যে অবিরাম প্রবাহিত।

চেতনা কোনো বাহ্যিক নির্দেশের ফল নয়; এটি এক স্বায়ত্তশাসিত আত্ম-সংগঠন—এক জীবন্ত সিস্টেম, যা নিজেই নিজের ভারসাম্য ও অর্থ সৃষ্টি করে। কাশ্মীর শৈব দর্শনের শিব-শক্তি তত্ত্ব এবং আধুনিক মূর্ত-জ্ঞানতত্ত্ব উভয়েই একই সত্যের দুই দিক দেখায়: চেতনা ও দেহ আলাদা নয়, বরং একে অপরের মাধ্যমে প্রকাশিত। শিব ছাড়া কালী নেই, আর কালী ছাড়া শিবও নেই—চেতনার দীপ্তি ও দেহের গতি এক অবিচ্ছিন্ন স্পন্দনে নৃত্যরত।

জ্ঞানীয় বিজ্ঞান ও কাশ্মীর শৈব দর্শনকে একত্রে ভাবলে এক গভীর সমান্তরালতা দেখা যায়—বিশেষ করে কালীর উত্থান বা চেতনার সৃজনশীল প্রবাহ এবং আধুনিক মনোবিজ্ঞানের প্রবাহ অবস্থা (Flow State)-এর মধ্যে।

মনোবিজ্ঞানী মিহালি চিক্সজেন্টমিহালি “প্রবাহ”-কে ব্যাখ্যা করেছেন এমন এক অবস্থা হিসেবে, যেখানে মানুষ সম্পূর্ণভাবে কোনো কাজে নিমগ্ন হয়ে যায়। মনোযোগ এত নিবিষ্ট হয় যে, আত্ম-সচেতনতা ম্লান হয়ে যায়, সময়ের বোধ বদলে যায়, এবং “আমি” ও “কর্ম” এক হয়ে যায়। এটি এক অনায়াস, শোষিত একাগ্রতার অবস্থা, যেখানে চিন্তা বা চেষ্টার অনুভূতি থাকে না—কেবল স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়া।

এই অভিজ্ঞতা আসলে কালীর উত্থানরূপ শক্তিরই মানসিক প্রতিফলন। কালী, বিশেষত তাঁর রক্তকালী ও সংহারকালী রূপে, চেতনার সেই অবস্থাকে প্রকাশ করেন যেখানে কর্মে সম্পূর্ণ শোষণ ঘটে এবং কর্তা ও কর্মের ভেদ মুছে যায়। প্রবাহে যেমন ভয়, আত্ম-সন্দেহ বা অতিরিক্ত আত্ম-বিচার বিলীন হয়, তেমনি কালীর নৃত্যে অহংকার ও দ্বৈততার সীমা গলে যায়—চেতনা হয়ে ওঠে মুক্ত, সজীব ও আনন্দময়।

আধুনিক নিউরোইমেজিং গবেষণাও এই সাদৃশ্যকে সমর্থন করে। দেখা গেছে, প্রবাহ অবস্থায় মস্তিষ্কের Self-Referential Cortical Network বা Default Mode Network (DMN)—যা আত্ম-মনিটরিং ও আত্ম-পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত—এর কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। এই হ্রাস “অহং-বিলুপ্তি” বা ego dissolution-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে “আমি”-বোধের সীমা সাময়িকভাবে হারিয়ে যায় এবং কেবল সচেতন ক্রিয়া প্রবাহিত হয়।

তাই, প্রবাহ ও উত্থান—দুটি ধারণাই এক চেতনা-প্রক্রিয়ার ভিন্ন ভাষা। আধুনিক বিজ্ঞান বলে, এটি মনোযোগ ও সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ স্তর; আর শৈব দর্শন বলে, এটি চেতনার স্পন্দনের পরম উল্লাস—কালীর নৃত্য, যেখানে জানা, করা ও হওয়া একসঙ্গে মিলেমিশে যায়।

ধ্যান-পরম্পরায় “বিশুদ্ধ চেতনা” বা নির্বিকল্প সমাধি বলতে এমন এক অবস্থা বোঝানো হয়, যেখানে চেতনা কোনো বিষয়বস্তু বা চিন্তার অবলম্বন ছাড়াই বিদ্যমান থাকে। এটি এমন এক গভীর স্থিরতা, যেখানে মন নিঃশব্দ, তবে সম্পূর্ণ জাগ্রত—কোনো চিন্তা নেই, তবু সচেতনতা অক্ষুণ্ণ।

আধুনিক গবেষণায়ও এই অভিজ্ঞতার প্রমাণ পাওয়া যায়। দার্শনিক ও নিউরোবিজ্ঞানী থমাস মেটজিংগার এবং তাঁর সহকর্মীদের গবেষণা দেখায় যে, দক্ষ ধ্যানকারীরা সত্যিই এক ধরনের “pure awareness state” বা বিশুদ্ধ সচেতনতা অনুভব করতে পারেন—যা কোনো অহংবোধ বা আত্ম-মনিটরিং ছাড়াই চেতনার অবস্থা। এই অবস্থাকে তারা চিহ্নিত করেছেন নীরবতা, স্বচ্ছতা, স্থিরতা এবং জাগ্রত উপস্থিতির মাধ্যমে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে, কালীর চূড়ান্ত রূপগুলি—বিশেষত মহাকালী—এই “নিজের মধ্যে বিশ্রাম নেওয়া চেতনা”-রই প্রতীক। মহাকালী সমস্ত ছাপ, চিন্তা, বা মানসিক আন্দোলন শোষণ করে নেন; তখন মন আর কোনো বস্তুর দিকে গমন করে না, বরং শিবের বিশুদ্ধ প্রকৃতি—অর্থাৎ চিত্‌ বা নির্মল সচেতনতার মধ্যে বিশ্রাম নেয়।

আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানেও এর সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। “Minimal Phenomenal Experience (MPE)” তত্ত্ব অনুযায়ী, চেতনার সহজতম ও মৌলিক অবস্থা হলো এমন এক সচেতনতা, যেখানে কোনো বাহ্যবস্তু বা ধারণা নেই—শুধু নগ্ন সচেতন উপস্থিতি।

ঠিক একই কথা কাশ্মীর শৈব দর্শনও বলে। তাদের মতে, প্রতিটি অভিজ্ঞতার অন্তঃস্থলে শিব আছেন—বিশুদ্ধ চিত্, যা কখনও মানসিক ওঠানামা দ্বারা আচ্ছাদিত হতে পারে, কিন্তু কখনো নষ্ট হয় না। ধ্যানের মাধ্যমে সেই আচ্ছাদন সরে গেলে, চেতনা নিজের প্রকৃত রূপে দীপ্ত হয়—এই অবস্থাই শাম্ভবোপায় অনুশীলনের লক্ষ্য, যেখানে সাধক কোনো বাহ্য অবলম্বন ছাড়াই নিজের অন্তর্লীন সচেতনতার মধ্যে স্থিত হন।

এইভাবে, প্রাচীন শৈব দর্শনের “চিত্‌-স্থিতি” এবং আধুনিক নিউরোবিজ্ঞানের “pure awareness state”—উভয়েই এক সত্য প্রকাশ করে: চেতনার গভীরতম স্তর কোনো চিন্তা বা অহং নয়, বরং নিঃশব্দ, অদ্বৈত, স্বচ্ছ উপস্থিতি—যেখানে মন, দেহ ও বিশ্ব এক অখণ্ড দীপ্তিতে মিশে যায়।

কালীর বিলয় বা বিলুপ্তির তত্ত্ব আধুনিক নিউরোথিওলজি ও সামাজিক স্নায়ুবিজ্ঞানে বর্ণিত অহং-অতিক্রম (ego-transcendence) অভিজ্ঞতার সঙ্গে গভীরভাবে মিলে যায়। এই অবস্থায় ব্যক্তি অনুভব করেন যে, তাঁর ব্যক্তিগত “আমি”-বোধ বিলীন হয়ে গেছে—চেতনা যেন সীমাহীন একতার মধ্যে প্রসারিত।

অ্যান্ড্রু নিউবার্গ-এর নিউরোইমেজিং গবেষণা এই বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি গভীর ধ্যানচর্চাকারী ও ভক্ত সাধকদের মস্তিষ্কের স্ক্যান করে দেখেছেন যে, তাঁদের প্যারাইটাল লোব—যা দেহ ও পরিবেশের সীমা নির্ধারণে সাহায্য করে—তাতে কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। এর ফলেই জাগে সেই অভিজ্ঞতা, যেখানে দেহ-মন-জগতের সীমা মুছে যায়, এবং ব্যক্তি অনুভব করেন এক সীমাহীন, পরম সংযুক্তি—যেন “আমি আর জগৎ আলাদা নই।”

সায়াদ মনসুর (২০১৪) ধর্মীয় ও রহস্যময় অভিজ্ঞতাগুলি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, সেগুলিতে প্রায়শই দেখা যায় তিনটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য—

১. এক গভীর আধ্যাত্মিক বিস্ময়,

২. মহাবিশ্বের সঙ্গে একত্বের অনুভব, এবং

৩. সময়, স্থান ও ভয়ের বিলুপ্তি।

এই তিনটি অভিজ্ঞতাই মূলত কালীর বিলয়-নৃত্যর মানসিক প্রতিরূপ—যেখানে সময় থেমে যায়, ভয় মুছে যায়, আর “আমি” নামের সীমা গলে যায়।

জুডসন ব্রুয়ার ও তাঁর সহকর্মীদের ধ্যানসংক্রান্ত গবেষণায় দেখা যায়, দক্ষ ধ্যানকারীদের Default Mode Network (DMN)—যা আত্ম-মনিটরিং ও আত্ম-চিন্তার কেন্দ্র—তা এমনকি সক্রিয় কাজের বাইরেও শান্ত থাকে। এই স্ব-রেফারেন্সিয়াল চিন্তার হ্রাস ঠিক সেই অবস্থাকে নির্দেশ করে, যা তান্ত্রিক ভাষায় কালীর শোষণের নৃত্য নামে পরিচিত—যেখানে অহং, সময়, ও বিশ্বের নির্মিত রূপগুলি একে একে বিলীন হয়ে যায়।

এই অবস্থায় সাধক বা ধ্যানকারী প্রায়শই এমন অনুভূতির কথা বলেন—“আমি কিছুই নই” বা “আমি সব কিছুই।” এই আপাতবিরোধী দুই উক্তিই আসলে এক সত্যের দুই ভাষা—অহং-সীমা মুছে গেলে ব্যক্তি নিজেকে কেবল শূন্য নয়, বরং সর্বব্যাপী চেতনা হিসেবেও অনুভব করেন। এটি মহাকালীর মহাতত্ত্ব-এরই প্রতিধ্বনি—যেখানে বলা হয়, “কিছুই জন্মায় না, কিছুই মরে না; সব কেবল চেতনারই খেলা।”

আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান ও শৈব তত্ত্ব একত্রে নির্দেশ করে যে, চেতনার চরম পরিণতি হলো এই অহং-বিলুপ্তি ও মহাসংযুক্তি—যেখানে ব্যক্তি চেতনা নিজের সীমা অতিক্রম করে, শিবের অনন্ত সচেতনতায় বিশ্রাম নেয়। কালীর বিলয় এই অনন্ত প্রত্যাবর্তনেরই প্রতীক—যেখানে জগৎ ও “আমি” দুটিই শোষিত হয়ে যায় এক অখণ্ড, দীপ্ত চেতনার সমুদ্রে।

ছায়া সংহতকরণ—অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আলোর পথে। কালীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর উগ্রতা—তিনি অন্ধকারকে দূরে ঠেলে দেন না, বরং তাকে আলিঙ্গন করেন। এই প্রতীকী মনোভাব মনোবিজ্ঞানের ভাষায় গভীরভাবে মিলে যায় কার্ল ইয়ুং-এর বিখ্যাত ধারণা “ছায়া (Shadow)”-র সঙ্গে। ইয়ুং বলেন, মানুষের চেতনা যতই সভ্য, নিয়ন্ত্রিত বা যুক্তিপূর্ণ মনে হোক না কেন, তার গভীরে এমন কিছু দিক লুকিয়ে থাকে, যা সে স্বীকার করে না—ভয়, ক্রোধ, লালসা, হীনতা, অপরাধবোধ, হিংসা—সব মিলিয়ে এই অচেতন দিকটিই তার “ছায়া”।