ডি সিকার ‘শুশাইন’: ধুলোয় জীবন, ধুলোয় যাপন (স্পয়লার অ্যালার্ট)
…………………………………………………………………………………………….
তোমার কী হয়েছে?
কিছু হয়নি। কেন?
নিজের চেহারার দিকে দেখেছো?
আমার চেহারাটাই এমন। পছন্দ না হলে আমার দিকে তাকিয়ো না।
……….যে বাজে লোকগুলি কোনো কারণ ছাড়াই বিনা উস্কানিতে নির্লজ্জের মতো কারো ব্যাপারে নাগ গলাতে আসে, ওদের ডাকা না হলেও রাস্তার ভিখারির মতো দরোজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে আর বিরক্ত করে কিংবা কারো সম্পর্কে না জেনেই ইতরের মতো তাকে জাজ করতে শুরু করে, শেষ লাইনটা তাদের প্রতি একটা তীব্র চপেটাঘাত। সেই ১৯৪৬ সালেই ভিত্তোরিও ডি সিকা ‘শুশাইন’ মুভিতে কিশোর পাস্কোয়ালকে দিয়ে পুরো পৃথিবীর সকল বেহায়া, বেআক্কেল, বেশরম মানুষের গালে চড় মেরেছেন। নিও-রিয়ালিস্ট ঘরানার সফলতম মুভির তালিকায় সেরা পাঁচটির একটি হল ‘শুশাইন’। ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির পরিচালক বিমল রায়, হিন্দি ফিল্মের প্রাণপুরুষ রাজ কাপুর এ সিনেমাকে ফিল্মমেকিং-এর আদর্শ মানতেন। ইতালির রোমের রাস্তাঘাটের জুতোপালিশ-করা কিছু কিশোর—ওদের রাস্তায়ই বসবাস, রাস্তায়ই জীবনের আশ্রয় ও জীবিকার সংস্থান। এই সিনেমা রাস্তার কিশোরদের নানান মনস্তত্ত্ব, বন্ধুত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, হত্যা, অনুশোচনা-সহ মানবীয় প্রবৃত্তির এক সংবেদনশীল আখ্যান। সত্যজিৎ রায়, বিমল রায়, রাজ কাপুর, লুইস বুনুয়েল, অরসন ওয়েলস, স্করসেজি-সহ বরেণ্য চলচ্চিত্রকাররা যাঁকে নতমস্তকে গুরুর আসনে বসিয়েছেন, সেই ডি সিকার এক অনবদ্য সৃষ্টি ‘শুশাইন’। মুভির কাহিনিটা অল্পকথায় জেনে নেয়া যাক।
যুদ্ধ-পরবর্তী রোমে আমেরিকান সৈন্যদের জুতো পালিশ করে পাস্কোয়াল আর জুজেপ্পের পেট চলে। পাস্কোয়ালের বয়স ১৫, তার কোনো ঘর নেই। জুজেপ্পে বয়সে ছোট, তার পরিবার আছে, পরিবারটি উদ্বাস্তুর মতো অন্য অনেক পরিবারের সাথে কোনওমতে থাকে। ওরা দুইজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একসাথে থাকে, একসাথে ঘোরে, একসাথে খায়। ওরা একটা ঘোড়া কিনবে, সে উদ্দেশ্যে টাকা জমাচ্ছে। জুজেপ্পের বড়ো ভাই অ্যাত্তিলিও নানান অপরাধ করে বেড়ায়। সে ও তার কিছু বন্ধু পাস্কোয়াল আর জুজেপ্পেকে বলে, এক জ্যোতিষী মহিলার কাছে কিছু কম্বল বেচে দিতে হবে, এর বিনিময়ে ওরা কমিশন পাবে। কম্বলগুলি চুরিকরা আমেরিকান কম্বল। ওরা জানতো না যে এটা ছিল আসলে সে মহিলার বাসায় ডাকাতির উদ্দেশ্যে ঢোকার একটা বুদ্ধি। ওরা যখন মহিলার বাসায় কম্বল বিক্রি করতে যায়, তখন পুলিশ সেজে কিছু লোক ডাকাতির উদ্দেশ্যে আসে। দুই বন্ধুর হাতে ওরা অনেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে কাউকে কিছু না বলে চলে যেতে বলে। সে টাকা দিয়ে ওরা একটা ঘোড়া কেনে, সে ঘোড়ায় ওরা মনের সুখে চড়ে বেড়ায়। ওদের স্বপ্নপূরণ হয়। পরেরদিন সেই মহিলা ওদের রাস্তায় দেখে চিনে ফেলে ও পুলিশে ধরিয়ে দেয়। ওদের কিশোর অপরাধী হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। মুভির আসল শুরুটা এখান থেকেই। দুই বন্ধুকে দুইটি পৃথক সেলে আটকে রাখা হয়। ওরা নিজেদের মধ্যে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে কোনো অবস্থাতেই পুলিশের কাছে মুখ খুলবে না, কিন্তু পুলিশ কৌশলে পাস্কোয়ালের কাছ থেকে তথ্য বের করে এবং জানতে পারে, জুজেপ্পের বড়ো ভাই ওই অপরাধী চক্রের একজন। সে ঘটনার পর থেকে জুজেপ্পে পাস্কোয়ালের সাথে বন্ধুত্বের সমাপ্তি টানে। এরপর থেকে শুরু হয় দুইজনের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ এবং শেষ পর্যন্ত তা রূপ নেয় ট্র্যাজেডিতে।
এখন চলুন কিছু অপূর্ব দৃশ্যে ঘুরে আসি।
মহিলাটি চুরির জিনিস কেনে, এই অভিযোগে কিছু ভুয়া পুলিশ তার বাসা তল্লাশি করতে আসে। ওরা যখন বলে, আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে, তখন মহিলাটি বলে, বুঝলাম না।…..পুলিশ চিফ আমার পরিচিত, উনিও আমাকে চেনেন। তাঁর স্ত্রী আমার কাস্টমার।……সেই ১৯৪৬ সালের ইতালির দৃশ্যপট এখনো সমান প্রাসঙ্গিক।
কিশোর সংশোধনাগারে যখন পাস্কোয়ালকে একটা সেলে নেয়া হচ্ছে, সে সেলে আর জায়গা নেই বলে জুজেপ্পেকে সেটিতে রাখা যাচ্ছে না, তখন পাস্কোয়াল সেলের ভেতর থেকে আর জুজেপ্পে বাইরে থেকে পরস্পরের হাত ধরে রাখে, কিছুতেই ছাড়ে না, আর চিৎকার করে বলতে থাকে, আমরা একসাথে থাকবো, আমরা আলাদা সেলে থাকবো না। জুজেপ্পেকে সেখান থেকে কলার ধরে টানাহ্যাঁচড়া করে অন্য সেলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটিও খুব বাস্তবানুগ। ওদের এই বন্ধুত্বই পরে শত্রুতায় রূপ নেয়।
পাস্কোয়াল যখন জিজ্ঞেস করে, এখানে ধূমপান করা যায়? তখন সেলের এক কিশোর উত্তর দেয়, না। এটা এখানে নিষিদ্ধ। আর নিষিদ্ধ বলেই আমরা সবাই ধূমপান করি। কিশোরদের যা করতে বারণ করা হয়, জেদ থেকে সেটিই বেশি করে। সে দৃশ্যে আমরা দেখি, এক ছেলে খুব পড়াশোনা করে বলে ওকে সবাই ডাকে ‘প্রফেসর’ নামে, সবাই মিলে ওকে ভেংচি কাটে। এ মুভিতে কিশোর-মনস্তত্ত্বের বেশ কিছু দিক সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
পাস্কোয়াল ও জুজেপ্পেকে পুলিশের বড়কর্তার কক্ষে ধরে নিয়ে আসা হয় অপরাধী চক্র সম্পর্কে কথা বের করার জন্য। যখন কিছুতেই পাস্কোয়াল তথ্য দিতে চাইছে না, তখন জুজেপ্পেকে ধরে পাশের রুমে নিয়ে খুব করে পেটানো হয়। বন্ধুকে মারা হচ্ছে, বন্ধুর কান্নার শব্দ শুনে পাস্কোয়াল তথ্য দিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে পাশের রুমে একটা বস্তার উপর কোমরের বেল্ট খুলে আঘাত করা হচ্ছিল এবং পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে কান্নার অভিনয় করে চিৎকার করছিল। জুজেপ্পেকে পাশের রুমের পেছনের দরোজা দিয়ে বের করে নেয়া হয়েছিল, যা পাস্কোয়াল দেখতে পায়নি। পরে জুজেপ্পের সেলের সামনে গিয়ে পাস্কোয়াল জানতে পারে, আসলে জুজেপ্পেকে পেটানো হয়নি। জুজেপ্পে তখন জিজ্ঞেস করে, তুমি কিছু বলে দাওনি তো? উত্তর আসে, না।
স্নানঘরের দৃশ্যটির কথা বলা যেতে পারে। জুজেপ্পে সবার সামনে পাস্কোয়ালকে পুলিশের গুপ্তচর বলে ডাকে, কারণ পাস্কোয়ালের কাছ থেকে কথা বের করে পুলিশ তার বড়ো ভাইকে গ্রেপ্তার করে। ওদিকে পাস্কোয়ালের রুমে তার বিছানার নিচে একটা ক্ষুর পাওয়া যায়। এ অপরাধে পাস্কোয়ালকে পুলিশ বেল্ট খুলে বেদম প্রহার করে। পাস্কোয়ালের সন্দেহ হয় কাজটা জুজেপ্পের। জুজেপ্পের সেলে আরকাঞ্জেলি নামে বয়সে বড়ো এক কিশোর থাকে, সে বেশ সেয়ানা ধরনের। স্নানঘরে পাস্কোয়ালের সাথে জুজেপ্পের বিবাদের এক পর্যায়ে নেতা গোছের আরকাঞ্জেলিই এগিয়ে এসে পাস্কোয়ালের সাথে মারামারি বাধিয়ে দেয়। এতে সে পড়ে গিয়ে মাথার পেছনে আঘাত পায়। সে সময় দুই পক্ষের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ও পুলিশ এসে ওদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার দৃশ্যটি মনে রাখার মতো।
কোর্টে শুনানির পর জুজেপ্পেকে এক বছরের, পাস্কোয়ালকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। জুজেপ্পের পরিবার তার পক্ষে একজন আইনজীবী নিয়োগ করেছিল, পাস্কোয়ালের পরিবার ছিল না বলে সরকার পক্ষের আইনজীবী তার জন্য কোর্টে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ফিস পাননি বলে প্রস্তুতি নিয়ে কোর্টে আসেননি, ফলে পাস্কোয়ালের পক্ষে বলার মতো তাঁর তেমন কিছুই ছিল না। এখনো কোর্টে পাবলিক প্রসিকিউটাররা অন্যবিধ কোনো কারণ বা চাপ না থাকলে মক্কেলের জন্য বিনে পয়সায় লড়ার তেমন একটা গরজ অনুভব করেন না, কেস স্টাডি না করেই এজলাসে চলে আসেন।
একরাতে কিশোর সংশোধনাগারে একটা মুভি দেখানো হচ্ছিল। সেরাতে আরকাঞ্জেলির পরিকল্পনায় সে সহ জুজেপ্পে তার সাথীদের নিয়ে পালায়। একটা হৈচৈ পড়ে যায়। ছেলেদের হুড়োহুড়িতে পায়ে পিষ্ট হয়ে একটা ছেলে মারাত্মকভাবে আহত হয়। কিশোরদের মধ্যে নানান কথা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের স্বভাবই হল, যা শুনে, তা বাড়িয়ে বলে। তার কল্পনাপ্রবণ মন শোনাকথা নিজের মতো করে ধরে নেয়, ওটাকেই একান থেকে ওকানে প্রচার করে। কানকথা নিতে ও দিতে দারুণ লাগে! কয়জন পালিয়েছে? কেউ বলে ৭, কেউ বলে ২০। যে ছেলেটি আহত হয়েছে, কেউকেউ ছড়িয়ে দিল, সে মারা গেছে। কেউ বলছে, যারা পালিয়েছে, ওরা ধরা পড়ে গেছে। কেউ বলছে, ওদের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছিল, ওরা গাড়িতে পালিয়েছে। জুজেপ্পে পালিয়েছে ঘোড়ায় চড়ে, এটাও শোনা গেল। গুজব কীভাবে ছড়ায়, এ দৃশ্য দেখলে বোঝা যায়।
জুজেপ্পের উপর রাগ থেকে প্রতিশোধস্পৃহায় পাস্কোয়াল পুলিশকে জানাতে চায়, ওরা কোথায় লুকিয়েছে। পাস্কোয়ালকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ ওদের খোঁজে যায়। দেখা যায়, জুজেপ্পে আর আরকাঞ্জেলি ঘোড়ার পিঠে চড়ে পালাচ্ছে। ঘোড়াটা দ্রুত পায়ে হাঁটছে। ছোট একটা ব্রিজের উপর। হাতে একটা ধাতব দণ্ড নিয়ে পাস্কোয়াল ওদের ঘোড়া থেকে নামতে বলে। আরকাঞ্জেলি ঘোড়া থেকে নেমেই দৌড়ে পালিয়ে যায়। পাস্কোয়াল হাতের দণ্ডটি ফেলে কোমরের বেল্ট খুলে জুজেপ্পেকে এলোমেলো পেটাতে থাকে। তাকেও জুজেপ্পের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে এমনি করেই মার খেতে হয়েছিল। আজ সে সুযোগ পেয়েছে প্রতিশোধ নেয়ার। বেল্টের মার থেকে নিজেকে বাঁচাতে সরে যেতেযেতে জুজেপ্পে একসময় ব্রিজের ভাঙা রেলিং দিয়ে নিচে পড়ে যায়। মাথাটা গিয়ে পড়ে বড়বড় পাথরের উপর। ঘোড়াটা ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে। পাস্কোয়াল জুজেপ্পের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতেডাকতে ব্রিজের নিচে গিয়ে দেখে জুজেপ্পে আর নেই। হায়, আমি কী করলাম! হায়, আমি কী করলাম! বিলাপ করে কাঁদতে থাকে পাস্কোয়াল। পুরনো বন্ধুত্বের দায় মৃত্যুতে জেগে ওঠে। পুলিশের লোকজন আসে। ওরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। ঘোড়াটা হেলেদুলে সেখান থেকে চলে যায়। আজ সে স্বাধীন। প্রত্যেকটা দুঃখই একটা করে সুযোগের দরোজা খুলে দেয়। ঘোড়াটার জন্যই এতকিছু, পুরো গল্পের আবর্তন। ঘোড়াটিই ওদের জীবনে দুঃখ ডেকে এনেছে, দারিদ্র্যের এই ফাঁদ থেকে পাস্কোয়াল আর জুজেপ্পে আজ মুক্তি পেয়েছে। পাস্কোয়ালের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বাজছে। ঘোড়াটি চলে যাচ্ছে। ধীর গতিতে। আজ তাকে কেউ আটকাবে না।
‘শুশাইন’ সিনেমাটি মূলত দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, নিরাশ মানুষের জীবনদর্পণ। মুভিটা দেখার সময় মনে হয় যেন মোজার্টের সিম্ফনি শুনছি, কী একটা সুর পুরো মুভিতে ছড়িয়ে আছে। ফিল্মমেকারদের ফিল্মমেকার খ্যাত অরসন ওয়েলস মুভিটা দেখে বলেছিলেন, “ক্যামেরা হাতে আমার সাথে পাল্লা দিতে পারে, আমার সমসাময়িক এমন কাউকেই আমি দেখি না। কিন্তু ডি সিকা যা করে দেখিয়েছেন, তা আমি করতে পারবো না। সম্প্রতি আমি আবারো তাঁর শুশাইন দেখলাম, দেখার সময় মনে হল, ক্যামেরা উধাও হয়ে গেছে, আমার সামনে কোনো স্ক্রিনই নেই; সামনে যা দেখছি, তা মুভি নয়, তা জীবন।” ‘দ্য বাইসেকেল থিফ’ সিনেমায় সাইকেল যেমন, ‘উমবার্তো ডি.’ সিনেমায় কুকুরটা যেমন, ঠিক তেমনই ‘শুশাইন’ সিনেমায় ঘোড়াটি স্বাধীনতা, সৌন্দর্য, স্বপ্ন ও আশার প্রতীক। রাস্তার কিশোররা, যারা ক্রমাগত মিথ্যা বলে, নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, পরস্পরকে ঠকায়, তাদের দিকে যখন আমরা তাকাই, তখন একটু ভাবলে বুঝতে পারতাম, ওরা আসলে আমাদের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার দাম দিয়ে চলেছে। পাস্কোয়াল এবং জুজেপ্পে এ সমাজে বাঁচার প্রয়োজনে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, সে বন্ধন ছিন্ন হয়েছে তাও সমাজেরই ব্যর্থতায়, জুজেপ্পের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বন্ধনটি পুনর্জীবন পেল যেন!