লিলিকে ভালোবাসি

- অ্যাই মানিক, মানিক…!




এ ডাকটাই যাতে শুনতে না হয়, সর্বতোভাবে সেই চেষ্টাই করছিলাম। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই নাকি সন্ধ্যা হয়।




নিউ মার্কেটে ঢোকার মুখেই দেখেছিলাম লিলিকে। অন্যদিন হলে হয়তোবা রাস্তা পেরিয়ে বলাকার ভিড় দেখতাম। সাথে বন্ধুরা ছিল, তাই বইপাড়ার দিকেই ঘোরাঘুরি করছিলাম।




- তামিম, তোরা যা একটু, আমি আসছি।
- আমরা কি আসতে বলেছি নাকি?...মামুনের গলায় কপট-উষ্ণতা…যা না, উলটো দিকে চেয়ে থাকব আমরা।




ঠিক তা-ই করল ওরা; মল্লিক ব্রাদার্সে ঢুকে গেল। ওরা সবাই কিন্তু লিলিকে চেনে।




পৌনে পাঁচ মাস পর লিলিকে দেখলাম। আগের মতোই আছে। আরও ফরসা হয়েছে, স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে, তবে একটু কেমন যেন বিবর্ণ দেখাচ্ছে।




- কেমন আছ?
- ভালো।
- যাও না আমাদের ওদিকে?
- সময় হয়ে ওঠে না। (মিথ্যে বললাম।)




তেইশ নম্বরে প্রায়ই যাই, আর ইচ্ছে করেই ওর ওখানে যাই না। লিলি জানে, তবুও কিছু বলল না।




- জানি, তোমার সময় হবেও না কোনোদিন!




খোঁচাটা সয়ে গেলাম।




- হাতে ওগুলো কী? বইকেনার রোগ তোমায় ছাড়েনি আর দেখছি!
- গরিবের তো ওই একটাই সামান্য বিলাসিতা। ছাড়তে আর পারলাম কই!
- কেন নিজেকে সবসময় ছোটো ভাবো, মানিক!
- ছোটো ভাবি না। তবে নিজেকে নিয়ে…! জানি, এসব বহু বহু-বার শোনা তোমার! তত্ত্বকথা এ সময়ে লিলির মাথায় ঢুকবে না। তারপর বলো, তুমি কেমন আছ?
- এতক্ষণে বুঝি মনে পড়ল!




ঠিক আগের মতো হাসল লিলি। হাসলে ওর ডান গালে একটু গর্তের মতো হয়ে যায়। ভালো লাগল আমার। লিলি তাহলে এখনও হাসতে জানে! লিলির আকর্ষণীয় ব্যাপারগুলির মধ্যে হাসিটা সম্ভবত পহেলা নম্বরে। মাথার উপর তখন মাঝদুপুরের রোদ্দুর। লাইন-ধরা বুকশপগুলির বারান্দায় উঠে হাঁটতে লাগলাম আমরা।




- ভালো। ভালো আছে তোমার লিলি।




টের পেলাম, আমার দিকে একটু আড়চোখে তাকিয়ে বলল কথাটা। কথাটা বলার সময় লিলি কি একটু অন্যরকম করে বলল না? না কি শোনার ভুল? ‘তোমার লিলি’ বলতে ও কী বোঝাতে চাইল?




- বসবে কোথাও? (নভেলটি’র সামনে এসে বলি।)
- এই দুপুরে! না, চলো আমার ওখানে। একদিন মেসের খাবার নাই-বা খেলে!
- তোমার বাসার খাবার কি রুচবে মুখে, লিলি?
- অমন করে বোলো না, মানিক! আমি কষ্ট পাই।
- আসলে আমি অমন করে কিছু বলিনি। স্রেফ ঠাট্টা করেছি।




দু-জন চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। তামিম, মামুনদের খোঁজ নেই। নিশ্চয়ই ধারেকাছে কোথাও ওঁত পেতে আছে।




- লেখালেখি কেমন চলছে তোমার? (জানি, এসব খবর লিলি ঠিকই রাখে।)
- প্রথম বইটা এ মাসেই বের করতে পারব মনে হয়। বেরোলে পাঠিয়ে দেবো।




ওকে বললাম না যে, বইটা ওর নামেই উৎসর্গ করেছি।




একসময় কথা ফুরিয়ে আসে। কিন্তু আগে তো কথা ফুরোতেই চাইত না। লিলি থামলেই আমি; আবার আমাকে থামিয়ে দিয়ে লিলি। তখন কোনো বিষয় খুঁজতে হতো না—কথা কিছুতেই ফুরোতে চাইত না। আজ বলার মতো কিছুই পাচ্ছি না হাতড়ে। তাহলে আমার ভেতরে বা লিলি আর আমার মাঝে কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি?




কোনো অজুহাতই শুনল না লিলি। গাড়িতে করে নিয়ে গেল বাসায়। ওখানেই শাওয়ার নিলাম। ভাত খেলাম।




- জানো, মানিক, আমার মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে…
- কী?
- ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে…এখান থেকে মুক্তি পেতে! যদি কোথাও যেতে পারতাম! এমন কোথাও, যেখানে…




লিলি বোঝাতে পারল না, সেখানটা কেমন। কিন্তু লিলি ওই ‘মুক্তি’ শব্দটা ব্যবহার করল কেন? তা কি ওর অজান্তেই? না কি ইচ্ছে করেই?




তাহলে যা শুনেছিলাম সব সত্যি। আগেই কিছু কিছু ধারণা হয়েছিল যদিও—আর যা রটে, কিছু তো তার বটে!




চুপচাপ সিগারেট টানছিলাম আয়েশ করে। আজ ভীষণ খাইয়েছে লিলি। কোনো বাধা মানেনি—একদম পাকা গিন্নির মতো এটা-ওটা তুলে দিয়েছে পাতে।




- কোনোদিনই তো নিজহাতে রেঁধে খাওয়াতে পারলাম না।




আমার পাশে এসে বসল লিলি। লিলি এত ভালো রাঁধতে জানে আমি জানতাম না।




- আচ্ছা মানিক, তোমার কি মনে পড়ে না, আগেও মাঝেমধ্যে আমি ছাড়া পাবার কথা বলতাম? আর তুমি কথা…
- ওসব পুরোনো কাসুন্দি না ঘাঁটলেই কি নয়! এই তো বেশ আছ!
- তোমার কি মনে হয়, আমি খুব সুখে আছি?




আজকের দিনের মধ্যে প্রথম ভালো করে দেখলাম লিলিকে। লিলির চোখ…যে-চোখ আমার খুব পরিচিত, তা কেমন যেন অন্যরকম। কী যেন একটা আকুতি—একটা না পাবার বেদনা ওই গভীর নীলান্তিক চোখদুটোতে…যেন এক ডানাভাঙা পাখি বাসা খুঁজে ফিরছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। লিলির চোখ হয় আমাকে পুড়িয়ে দেবে, নয়তো কাঁদিয়ে ফেলবে।




- কিন্তু লিলি, এ ছাড়া তো উপায় নেই। তোমাকে এটা মেনে নিতে হবেই।
- কেন মেনে নিতে হবে? আমি তো এটা চাইনি।




বিয়ের আগেও, যখন ওর সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, তখনও এমন কথা বলত লিলি।




এমএ-তে সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড ছিলাম আমি। ভালো একটা বিদেশি ফার্মে জুনিয়র একজিকিউটিভ হয়েছিলাম মোটা বেতনে। আঠারোর জুনে জেলে যেতে হয়েছিল। এখন সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে শুধু লিখি।




আমার ফাইনাল হয়ে গেছে। লিলি থার্ড ইয়ারে উঠবে। আচমকা একদিন কিছু কথা জিজ্ঞেস করে বসল।




- ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেছ কিছু?
- ভবিষ্যৎ! কার ভবিষ্যৎ? কীসের ভবিষ্যৎ?




মনে মনে ভাবলাম, পাশ তো করবই। কিছু-একটাতে ঢুকে পড়লেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল লিলি। তারপর লীলায়িত সুরে বলল—আমাদের।




থ মেরে গিয়েছিলাম আমি। লিলিকে কোনোদিন চুমু-টুমু খাইনি, ভালোবাসার কথা শোনাইনি। ও অবশ্য হাত ধরে হাঁটতে মজা পেত; আমরা সিনেমাও দেখেছি একসাথে। এমনিতেই তো মেয়েদের সাথে কম মিশতাম, তবে লিলির সাথে খুব খোলামেলা ছিলাম—অস্বীকার করব না। কিন্তু লিলি তো আমার রেণু খালার মেয়ে। খালা-খালু আমাকে খুব আদর করেন। যখন-তখন লিলিদের কাঁঠালবাগানের বাসায় গিয়ে হাঁক মারতাম…লি-লি…লিলি কোথায়?




লিলির ছোটোটা শেলি প্রায়ই গাল ফোলাত।




- বাসায় বুঝি লি-আপাই একলা থাকে, মানিক ভাই?




শেলির চুল টেনে ধরতাম আমি। এখনও স্কুল ডিঙোতে পারেনি, অথচ কী বজ্জাতের হাড্ডি হয়েছে মেয়েটা!




- আচ্ছা মানিক, ইচ্ছে করলে তুমি তো পারো।




আমি পারি? কী পারি! কী বলতে চায় লিলি?




 আবার কি আগের মতো হতে পারে না? তুমি আর আমি!




লিলির মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি। বলে কী মেয়েটা!




- প্লিজ, মানিক, একবার ভেবে দেখো!
- কিন্তু লিলি, একবার নিজের দিকটা ভাববে না? সংসার, তোমার স্বামী, আর তোমাদের মেয়ে।




আচ্ছা, লিলির বাচ্চাটার নাম মিলি না?…আমি ঠিক নিশ্চিত নই।




- হয়, সব হয়, মানিক!




এবং, তারপর হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসল লিলি, যার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার পাঞ্জাবিটা খামচে ধরে হু-হু করে কেঁদে উঠল! পাঞ্জাবির নিচের নতুন গেঞ্জিটাও ভিজে যাচ্ছে লিলির চোখের জলে।




- আমায় নিয়ে যাও, মানিক। এই পশুটার কাছ থেকে দূরে কোথাও, মানিক! অনেক দূরে, যেখানে কেউ আমাদের নাগাল পাবে না!




শুনেছিলাম লিলির স্বামী ড্রাগ নেয়, বউ পেটায়, আরও কত-কী! তাহলে সবই সত্যি একেবারে!




বাইরে থেকে ফিরেছে লিলির স্বামী। ভদ্রলোক (বলাটা কি ঠিক হলো?) আমার থেকে খাটো, তবে বেশ ফরসা। একটু হোঁদল-কুতকুত টাইপ চেহারা। লিলি তখন আমার বুকের উপর ওর মুখ ঘষছে। আমার ডানহাত ওর চুলের ভেতর।




- ওঃ! তুমিই তাহলে সেই স্কাউন্ড্রেলটা! মানিক না কী যেন নাম!




এরপর আমি জীবনে প্রথম বারের মতো লিলিকে বিয়ে করার কথা ভাবলাম। আমি, লিলি আর ওর মেয়ে—খুব মানাবে আমাদের! আমি পত্রিকার অফারটা নিয়ে নেব, লিলি এমএ সেরে কোনো স্কুলে ঢুকে পড়বে। আরামসে দিব্যি চলে যাবে। কিন্তু লোকে কী ভাববে? লোকে যা-ই ভাবুক, কী এসে যায়। জীবনটা তো আর লোকের নয়!




আমি সিদ্ধান্ত নিতে একটুও দেরি করলাম না। মনের কথা শুনে মরলে মরব…আমি যে লিলিকে ভালোবাসি!
Content Protection by DMCA.com