সংগীত আমাদের মধ্যে মূলত ৩ ধরনের অনুভূতি জাগায়: আনন্দ, স্বস্তি, বেদনা। সুখ বা কষ্টের সাথে সংগীতের সত্যিই কি কোনো সম্পর্ক আছে? শেক্সপিয়ারের টুয়েলফথ্ নাইট-এ অরসিনো অতি-ভালোবাসায় মোহাবিষ্ট হয়ে নিজেকে ভালোবাসার মায়াজাল থেকে ছাড়িয়ে নিতে বলে ওঠেন, “যদি ভালোবাসা সংগীতে বাঁচে, তবে আরো গান হোক!” বেশি খেলে যেমন খাবারের প্রতি আকর্ষণ কমে যায়, তেমনি বেশি ভালোবাসার আবেশে ভালোবাসার প্রতি বীতস্পৃহ হওয়ার অভিলাষেই অরসিনো ও কথা বলে উঠেছিলেন। মানে, সংগীতের সাথে ভালোবাসার একটা সম্পর্ক সেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এখনো আছে, সামনেও থাকবে। আমাদের প্রবল আবেগের ভাষাই সংগীত। আমরা সংগীতের মূর্ছনায় বিজয় উদযাপন করি, প্রিয়জন হারানোর ব্যথায় সংগীত, আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্বাচ্ছন্দ্য বা টানাপোড়েনেও সেই সংগীতই। সংগীতকে বাদ দিলে, জীবন কীভাবেই বা চলে? প্রকৃতির যেকোনো ধরনের শব্দ এবং আমাদের আবেগের মধ্যে খুব নিবিড় এক সম্পর্ক আছে। মজার ব্যাপার হল, ভিন্ন দেশের, ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন পরিবেশের, ভিন্ন কৃষ্টির, ভিন্ন রুচির ভিন্ন-ভিন্ন মানুষের কাছেও সংগীতের মিলনাত্মক বা বিয়োগান্তক রূপের ধরন কমবেশি একইরকমের। একটা সংগীত শুনলে কেমন অনুভূতি হয়, সেটা নিয়ে ভাববার আগেই কোনো না কোনো অনুভূতি আপনাআপনিই আমাদের মস্তিষ্কে তৈরি হয়ে যায়। একই সংগীত যাদের মধ্যে একই ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি করে, সে মানুষগুলো মোটামুটি একইরকমের মানসিকতার। মন খারাপ হলে আমরা গান শুনি। গানের মন ভালো করে দেয়ার ক্ষমতা আছে। কেমন গান শুনি আমরা? যাকে ছেড়ে তার প্রিয়জন চলে গেছে, সে বিচ্ছেদের গানেই ডুবে থাকে। কেমন হয়ে গেল না ব্যাপারটা? খুব বিষণ্ণ হয়ে আছে মনটা? কানে হেডফোনটা লাগিয়ে শুনতে থাকুন বিটোফেনের মুনলাইট সোনাটা। এ সুরটি বিশ্বের সবচাইতে বিষণ্ণ সুরগুলির একটি। সুরের বিষণ্ণতায় স্নান করলে বিষণ্ণতা দূর হয় আবার কীকরে? বিষাদেবোনা কিছু সংগীত শুনেই দেখুন না কী যাদু অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্য!
বিষণ্ণতা কি শুধুই দুঃখবোধ থেকে আসে? কিংবা, কোনো প্রতিকূলতা থেকে? সবসময়ই তা নাও হতে পারে। খুব জনপ্রিয় যারা, তারা প্রায়ই বিষাদে ডুবে থাকেন। ওদের এমন দুঃখবিলাসের ব্যাখ্যা কী? অনেক সুর, নাটক, মুভি, বই, চিত্রকর্ম আমাদের বিমর্ষ করে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন। আশ্চর্য ব্যাপার হল, কখনো-কখনো আমরা নিজেরাই সে বিষণ্ণতার চাদর থেকে বের হয়ে আসতে চাই না। আমরা বেছে-বেছে সেসব দুঃখ-জাগানিয়া শিল্পের দিকেই ছুটে যাই বারবার। গানের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা ঘটে সবচাইতে বেশি। দুঃখ আর কষ্টের গান রহস্যময়ভাবে সুখই জাগায় বেশি। এসব গানের সহজিয়া প্যাথোস হৃদয়ের একেবারে গভীরে নাড়া দেয় খুব সহজেই। মানুষ চায় না তার জীবনে কষ্ট আসুক, তবু কেন সুখ খুঁজে নিতে মানুষ কষ্টের সংগীতের কাছেই ফিরে যায় বারবার? ভাবা যাক, দুঃখের গান কেন সুখ জাগায়! কেন বেদনার সুর মানুষকে ইতিবাচকভাবে ভাবতে শেখায়! সুরে বিষণ্ণতা কেন ভালোকিছু ভাবার প্রেরণা দেয়? বিষাদমাখা সুর এলোমেলো ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে দেয়, যখন: এক। সে সুর যেমনই হোক, সেটা ভয়ের উদ্রেক করে না। যেমন, এক্ষেত্রে ভূতের চিৎকার শোনা যাবে না, কেননা সে সুর শুনে হৃদয়ে সুখের দোলা জেগে ওঠার কোনো কারণ নেই। দুই। সুরটি শুনতে মধুর হয়। তিন। ওই সুরের মায়ায় ডুব দিলে অতীতের কোনো স্মৃতি জেগে ওঠে হৃদয়ে। একে বলে নস্টালজিয়া। আমাদের মন সবসময়ই খুঁজতে থাকে এমন কোনো একটা নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে চট্ করে লুকিয়ে গেলে ফিরে যাওয়া যায় সুখের কোনো পুরনো সময়ে, প্রিয় কোনো জায়গায়, ভালোবাসার কোনো স্মৃতিতে। অতীতের কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কীভাবে করে মনের জোর আর সাহসিকতায় নিজেকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে, এমন সুখস্মৃতিতে ডুব দিতে মানুষ শান্তি পায়।
একটু ভাবুন তো, এই দুঃখের বাংলা গানগুলো কেন আমরা খুঁজে-খুঁজে বারবার শুনি? ‘তুমি আজ কতদূরে……..’ ‘এতো সুর আর এতো গান………’ ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি……..’ ‘তুমি যাকে ভালোবাসো…….’ ‘তোমার সমাধি ফুলে-ফুলে ঢাকা……….’ ‘এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে………’ ‘বড় সাধ জাগে……..’ ‘একটা গান লিখো আমার জন্য…….’ ‘হয়তো কিছুই নাহি পাবো……..’ ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার…….’ ‘দশ মাস দশ দিন……..’ ‘সে তারাভরা রাতে……..’ ‘যখন নিঝুম রাতে সবকিছু চুপ……….’ ‘কী ছিলে আমার……..’ ‘কখনো জানতে চেয়ো না…….’ ‘তোমার চোখের আঙিনায়………….’ ‘অন্ধকার ঘরে, কাগজের টুকরো ছিঁড়ে………’ ‘ওই আকাশের তারায় তারায়………..’ ‘এই দূর পরবাসে……..’ ‘যেখানেই যাও, ভালো থেকো…………’ ‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে…….’ ‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতেই………’ ‘তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে……..’ ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো……..’ ‘মনে করো যদি সব ছেড়ে হায়……….’ ‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো………..’ ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা……..’ আচ্ছা থাক, এইবেলা থামি! আধুনিক বিজ্ঞান হতাশ বিষণ্ণ বিমর্ষ বিষাদগ্রস্ত দুঃখী অসুখী মানুষকে মিউজিক রিহ্যাবিলিটেশন বা মিউজিক থেরাপির সাহায্যে সুস্থ করে তুলছে। একটু খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, সে আরোগ্য-নিকেতনের ঐন্দ্রজালিক সুরগুলির বেশিরভাগই বিষাদের সুর। এমন নয় যে, ওই কষ্টের সুরগুলি আনন্দের অনুভূতিই জাগায়, এমনও হতে পারে, ওই সুরগুলি মানুষের হৃদয়ের সেই সংগুপ্ত ঘরটিকে খুলে দেয়, যে ঘরে আশ্রয় নিয়ে মানুষ কষ্টের পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার মতো সাহস আর শক্তি পায়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানুষ সেই আর্টটাই সৃষ্টি করতে ও উপভোগ করতে বেশি ভালোবাসে, যেটাতে যন্ত্রণা মিশে আছে। আর্টের জন্মভূমি প্রাচীন গ্রিসে মঞ্চস্থ করার ক্ষেত্রে ট্র্যাজেডিই ছিল সবচাইতে জনপ্রিয়। আজকের দিনেও, যে মুভিগুলো কষ্টের, সেগুলো হয় সুপারডুপার হিট, যে উপন্যাসগুলো বেদনা জাগিয়ে তোলে, সেগুলোই সবচাইতে বেশি বিক্রি হয়। এমনকি, সমালোচকরাও সেসব সিনেমা-উপন্যাস নিয়ে পত্রিকায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখেন। ক্লাসিক্যাল মিউজিক কিংবা ফোক মিউজিকের বেলায়ও একথা খাটে। এসব সংগীতের অমরাবতীতে কোনো জরা নেই, সেখানে একজন্মের স্বচ্ছন্দ বিচরণেও কোনো ক্লান্তি আসে না। আধুনিক অনেক জনপ্রিয় গানই মূলত পুরনো এসব গানের নতুন সংস্করণ। মানুষের মৌলিক আবেগ ৬টি: ভয়, সুখ, ক্রোধ, বিস্ময়, বিরক্তি আর বিষণ্ণতা। বিষণ্ণতা—কে চায়! বিষণ্ণতার জন্ম কীভাবে? কোনো প্রিয় জিনিস হারিয়ে গেলে, স্বাস্থ্যহানি ঘটলে, কোনো সম্পর্ক নষ্ট হলে, কিংবা কাছের মানুষটি দূরে চলে গেলে বিষণ্ণতা আমাদের ছেয়ে ফেলে। এতে আমাদের শরীর ও মন, দুইই ভেঙে পড়ে। মানসিক শক্তি ও আত্মসম্মানবোধ কমে যায়, সামাজিকভাবে অবাঞ্ছিত হতে হতে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলিও আস্তে-আস্তে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পড়ে। এর প্রাপ্তি কী তবে? দুঃখের মধ্যে আবার কীসের মহত্ত্ব? জীবনে কিছু না পাওয়ার চাইতে দুঃখ পাওয়াও ভালো। সত্যিই কি ভালো? কতটুকুই বা ভালো?
বিষণ্ণ সুর আসলে কী? ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিচার করলে বলা যায়, সুরস্রষ্টা যে আবেগটা দিয়ে সুরের মধ্যে কোনো এক বিষণ্ণতা জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন, সেটা যদি শ্রোতার হৃদয়ে ঠিক সেই বিষণ্ণতাই জাগিয়ে তুলতে পারে, তবেই স্রষ্টা সার্থক। এ কাজটি করতে গিয়ে সুরস্রষ্টা যে সকল বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখেন, সেগুলি হলো, নিম্ন স্বনকম্পাঙ্ক, স্বনকম্পাঙ্কের ক্ষুদ্র সীমা, ধীর লয়, লঘু রাগের ব্যবহার, কিছুটা একঘেয়ে সুরের কাজ, শব্দের কোমল মাত্রা, অবিরাম স্বচ্ছন্দ সুরপ্রবাহ, এবং সুরের সঞ্চরণটা যাতে খুব উপভোগ্য হয়। একটা সুর আমাদের আবেগের কোন জায়গাতে নাড়া দেয়, সেটা নির্ভর করে আমাদের অনুভূতির সাথে ওই সুরটা কতটুকু মেশে, কীভাবে মেশে, এবং মেশার পর সেটা আমাদের ভেতরে কোন ধরনের আবেগ জাগায়, তার উপর। যে সুর বিষণ্ণতার, সে সুর আমাদের মস্তিষ্ককে স্বাভাবিকভাবেই অতোটা উত্তেজিত করে তোলে না। সুর থেকে বিষাদের সৃষ্টি হয় দুইভাবে: হয় সুরটি বিষণ্ণতার অনুভূতিই জাগায়, কিংবা ওই সুরে এমন কোনো আবেগের জন্ম হয় যেটা শরীরমনে বিষণ্ণতার রেশ ছড়িয়ে দেয়। কোন ধরনের সুর বিষণ্ণ? জন্মদিনের সুর আর মৃত্যুদিবসের সুর কেমন হবে? এ নিয়ে আমাদের সবার মধ্যেই কমবেশি কিছু পূর্বধারণা বদ্ধমূল হয়েই আছে। অতীতের কোনো অনুশোচনা বা হৃতপ্রেমের জন্য আফসোস জাগায় যে সুর, কিংবা কোনো একসময়ে তেমন অনুভূতি জাগিয়েছে যে ধরনের সুর, সেই একই ঘরানার সুর শুনলেই, যতদিন পরেই হোক না কেন, তা বিষাদের অনুভূতি বা রেশ ছড়িয়ে দেবেই।
বিষাদ ব্যাপারটা সুখের কিছু নয়। তবে কীভাবে তা সুরের মধ্য দিয়ে আনন্দের আবেশ ছড়িয়ে দেয়? মানুষ তার জীবনের বেদনা দূর করতে যাকিছু করে, তাকিছু করতে গিয়ে সে একধরনের আনন্দ খুঁজে পায়। নান্দনিকতার বিচারে সে আনন্দের মূল্য অসীম। এধরনের রহস্যময় বৈপরীত্যকে বলা হয় ‘ট্র্যাজেডি প্যারাডক্স’। মানুষের নেতিবাচক আবেগগুলো ফুটিয়ে তোলে এমনসব আর্ট, মানুষকে কষ্ট ভুলতে, সুখের খোঁজ দিতে, বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। প্রাচীন গ্রিক নাটকের কথা ভাবুন। সেগুলির বেশিরভাগই ছিল ট্র্যাজেডি। সেসব নাটকের দর্শকরা নাটক দেখার পর দীর্ঘ সময়ের প্রবল অবদমিত কোনো কষ্টের অনুভূতি, অপ্রাপ্তি, বেদনাবোধ, বা ক্ষোভ থেকে মুহূর্তেই যেন মুক্তির আনন্দ লাভ করতেন। বিয়োগান্তক আর্টফর্মের মিলনাত্মক প্রাপ্তির মোহে মানুষ বারবার ওরকম বিষাদ-কলার দিকে ছুটে-ছুটে যায়। বিষাদমাখা সুর আর আনন্দের অনুভূতির মধ্যে সত্যিই কি কোনো সম্পর্ক আছে? এ নিয়ে ৩ ধরনের মতামত পাওয়া যায়। কেউ কেউ মনে করেন, যে সুর শুনলে বিষণ্ণ মনে হয়, সে সুর মনের মধ্যে আদৌ কোনো বিষণ্ণতা জাগায় না। শাদেনফ্রয়েডা (Schadenfreude) শব্দটি জার্মান থেকে ইংরেজিতে এসেছে। এর মানে হল, অন্যের দুর্ভাগ্য, ব্যর্থতা বা কষ্ট দেখে কিংবা তা সম্পর্কে শুনে আনন্দলাভ করা। গবেষকদের অনেকেই ধরেই নিয়েছেন, বিষণ্ণতার সুর থেকে সুখের অনুভূতি সৃষ্টি হওয়াটাও একধরনের ‘শাদেনফ্রয়েডা’। বিষাদের সুর বিষাদই জাগিয়ে তোলে, এবং পরবর্তীতে আমাদের মস্তিষ্ক সেখান থেকে আনন্দ তৈরি করে গ্রহণ করে। আমরা যখন গান শুনি, তখন সে গানের সুর, নাকি কথা আমাদের অনুভূতিকে বেশি প্রভাবিত করে, কিংবা সে প্রভাব আমাদের আবেগের জায়গাগুলিকে কতটা নাড়া দেয়, এসব নিয়ে খোঁজখবর নিলেই দুঃখের সুর আর মনের সুখের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া নিয়ে কিছুটা হলেও জানা যাবে।
সুরের কাজ হল অতীতের কোনো স্মৃতির রাস্তায় হাঁটার সময় ট্যুর-গাইড হিসেবে কাজ করা। প্রকৃতপক্ষে, আমরা যতোই সুরে ভাসি, ততোই পুরনো দিনগুলিতে ফিরে যাই। সে দিনগুলি সুখের হতে পারে, কষ্টেরও হতে পারে। যদি সুখের হয়, তবে সেটার রোমন্থন আমাদের শান্তি দেয়। যদি কষ্টের হয়, তবে সে কষ্ট থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারার যে ক্ষমতা আমরা দেখিয়েছি, সে গল্প মনে করেও আমরা শান্তি পাই। সুরের মধ্যে যে বিষাদ লুকিয়ে থাকে, সেটা অনুভব করতে হলে তেমন বিষাদঘন পরিবেশ ওই সুরটা শোনার সময়ই দরকার। কিন্তু, তা তো আর হয় না। তাই, আমরা সে সুরে ভাসার প্রয়োজনীয় রসদ ওই মুহূর্তের চারপাশের পরিবেশ থেকে সাধারণত পাই না। তখন আমরা অবচেতন মনেই সেই পরিবেশ থেকে পালিয়ে যাই, এবং আশ্রয় খুঁজে নিই অতীতের অর্জন বা ভবিষ্যৎ স্বপ্নের এমন কোনো মনোগৃহে, যা আমাদের শান্তি দেয়। সুর থেকে আমাদের মনের মধ্যে যে বিষণ্ণতার সৃষ্টি হয়, তার ৮টা ভালো দিক আছে। এক। বুকের ভেতরে জমেথাকা পুরনো কোনো গ্লানি বা দুঃখবোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। দুই। আর্টের মধ্যে যে যন্ত্রণা লুকানো, তার খোঁজ নিতে গিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়ে। তিন। আর্টের অর্থ বুঝে হোক, না বুঝে হোক, স্রেফ আর্টটা উপভোগ করতে-করতে মনের মধ্যে একধরনের আনন্দের জন্ম হয়। চার। আমি কী ভাবি, কেন ভাবি, কীভাবে ভাবি, এসব সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানা যায় সুরের সাগরে ভাসতে-ভাসতে। পাঁচ। হ্যাঁ, আমিও সুরকে অনুভব করতে পারি একেবারে হৃদয় দিয়ে—এ অনুভূতির জন্ম হয়। ছয়। ধরুন, মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। রবীন্দ্র সংগীত শুনুন। শুনতে-শুনতে একসময় দেখবেন, মনটা কেমন যেন শান্ত হয়ে আসছে। সুরের মাধ্যমে আমরা আমাদের আবেগগুলিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সাত। গান শোনার সময় মাথাটা দোলাচ্ছেন, হাত-পা ছুঁড়ছেন, শরীর নাচাচ্ছেন। কেন? গানটাকে শরীর দিয়ে অনুভব করতে পারছেন বলেই তো, না? এ আনন্দ কেবল গানেই সম্ভব। আট। আপনি যে ধরনের সুর পছন্দ করেন, কিংবা আপনার মতো আরো অনেকেই ঠিক ওই ঘরানার সুরই পছন্দ করেন, এ দুই ধরনের মানুষের সাথে ওই সুরের স্রষ্টার এক ধরনের অদৃশ্য আত্মীয়তার সৃষ্টি হয়। একই মানসিকতার বিষাদ-সুরের যাত্রীরা একে অপরকে চিনে নিতে পারে খুব সহজেই। এ বন্ধন সুরের বন্ধন। সুখের সুরের চাইতে দুঃখের সুর কেন মানুষের মধ্যে বেশি সুখ জাগায়, এর কোনো যথার্থ ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত পাওয়া না গেলেও একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, বিষাদমাখা সুর শ্রোতার হৃদয়ের সাথে কোনো ঘটনা, কোনো ধারণা, কোনো প্রিয় বস্তুর সরাসরি সংযোগ ঘটায়, যা শ্রোতাকে আনন্দ দেয়।
যন্ত্রণার ঘটনা আর যন্ত্রণার সুর একইরকমের আবহ সৃষ্টি করে না। প্রথমটির সাথে নান্দনিকতার কোনো সংযোগ নেই, কিন্তু দ্বিতীয়টির সাথে নান্দনিকতার প্রত্যক্ষ সংযোগ আছে। যাকিছু নান্দনিক, তাকিছু, আর যা-ই হোক, ক্ষতিকর নয়। মানুষ যখন দুর্দশার মধ্যে থাকে, প্রচণ্ড কাজের চাপে থাকে, নিজের সন্তানদের কাঁদতে দেখে, প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোকাভিভূত থাকে, তখন শরীর থেকে প্রোল্যাক্টিন নামক একধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। এ হরমোনের কাজ হল, মানসিক যন্ত্রণা থেকে স্বস্তি দেয়া। এ হরমোন বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থার মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করে। বিষাদমাখা সুর মস্তিষ্কে প্রবেশ করার পরও এ হরমোনটি নিঃসৃত হয়। কিন্তু যেহেতু ওরকম সুর বাজার মুহূর্তে সাধারণত বাহ্যিক পরিবেশ-পরিস্থিতি সুরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে না, স্বাভাবিকই থাকে, স্বাভাবিক করার জন্য বাড়তি কোনোকিছুই করতে হয় না, সেহেতু ওই হরমোনটির কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। তখন হরমোনটা মানুষকে দীর্ঘসময়ের কোনো বেদনা বা চাপাকষ্ট থেকে নিমিষেই মুক্তি দেয়। তবে হ্যাঁ, যাদের জীবনে অতীতের সুখস্মৃতি বলে তেমনকিছু নেই, তাদের ক্ষেত্রে প্রোল্যাক্টিনের নিঃসরণ বরং মনের মধ্যে আরো নতুন-নতুন কষ্টের জন্ম দিতে পারে।
বিষাদের সুর প্রায়ই মানুষের মধ্যে একধরনের নস্টালজিয়া সৃষ্টি করে। তবে সবসময়ই যে কষ্টেবোনা সুর মানুষকে আনন্দ দেয়, এমন নয়। ব্যক্তিত্ব, মনমেজাজ, চারপাশের পরিবেশ—এসবের উপরও নির্ভর করে কোনো একটা সুর কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে কী হচ্ছে না। সুরের সার্বজনীনতা অতোটা দেখা যায় না। একই সুর একেকজনের কাছে একেকরকমের মনে হতে পারে। শিক্ষা, অভিরুচি, অভ্যাস, দৃষ্টিভঙ্গি, শৈশবের স্মৃতি, বেড়ে ওঠা, এসবকিছুর উপর মানুষের পছন্দ-অপছন্দ নির্ভর করে। সমুদ্র যখন ঝড়ে উত্তাল থাকে, তখন মনে হয়, এ ঝড় বুঝি আর কখনোই থামবে না। এ ঝড়ের গতি বাড়তে বাড়তে একসময় ঝড় থেমে শান্ত সমাহিত সমুদ্রের দেখা মেলে। আমাদের মন যখন অশান্ত থাকে, যন্ত্রণায় পুড়তে থাকে, তখন বিষাদের সুরের সহজিয়া প্যাথোস খুব সহজেই আলতোভাবে মনকে স্পর্শ করে যায়। মনের অভ্যন্তরীণ বিষণ্ণতার সাথে সুরের বাহ্যিক বিষণ্ণতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন মনটা একটা স্তব্ধ-শান্ত স্তরে নেমে আসে। দুঃখবোধের সমাপ্তিতে কোমল সুখের ছোঁয়ায় মন প্রশান্তি লাভ করে। কেউ-কেউ আছেন, যারা এমনিতেই লঘু লয়ের ধীর সংগীত শুনতে ভালোবাসেন, এর সাথে মন ভালো বা খারাপের কোনো সম্পর্কই নেই। কেউ-কেউ মন খারাপ থাকলে আনন্দের সংগীত শোনেন, কেউ-কেউ মন খারাপ থাকলে বিষাদের গান শোনেন। এটা নির্ভর করে যার-যার ব্যক্তিগত অভ্যাস আর রুচির উপর। আবার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতির উপরও সংগীতের নির্বাচন নির্ভর করে। কেউ-কেউ বিষাদমাখা সংগীতে শান্তির আশ্রয় খুঁজে নেন যখন তারা একা থাকেন, একাকিবোধ করেন, কিংবা অতীতের বা বর্তমানের কোনো কষ্ট তাকে গ্রাস করতে থাকে। যখন নিজের সাথেই গল্প করতে ইচ্ছে করে, নিজের পৃথিবীটাতে একা-একা একটু ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে, কিংবা প্রকৃতির সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটাতে ইচ্ছে করে, তখনও কেউ-কেউ বেদনাবিধুর সংগীতসাগরে ডুব মেরে বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দিনের কোন সময়টাতে সংগীত শোনা হচ্ছে, তার উপরও নির্ভর করে ওইসময়ে বিষণ্ণ সুর বাজবে কিনা। দেখা যায়, অফিসটাইমেও কেউ কেউ ক্লান্তি ভুলতে বা অবসাদ দূর করতে ওরকম সুরে খানিকটা সময়ের জন্য হারিয়ে যান। শোকগীতি, প্রার্থনা-সংগীত, জাতীয়-সংগীত বাদে অন্যান্য কোমল লয়ের সংগীত সাধারণত মানুষ একাকিই শুনে থাকে, নতুবা সে সংগীত অনুভূতির জায়গাটা ঠিকভাবে ছোঁয় না।
আমরা কেমন সংগীত শুনতে ভালোবাসি, তা দেখে বোঝা যায়, আমরা কেমন লোকের সাথে মিশতে ভালোবাসি। আমাদের আর্থিক, পারিবারিক, সামাজিক অবস্থানও সংগীতের রুচি নির্ধারণ করে দেয়। আমরা কী বই পরি, কী মুভি দেখি, কী গান শুনি, তা দিয়ে বোঝা যায়, আমরা আসলে কেমন ধরনের মানুষ। আমাদের সবচাইতে প্রিয় ২০টি গানের তালিকা বানালে দেখব, সে তালিকার ১৫টি গানই কষ্টেঘেরা গান। এটা কেন? কেন বিষাদের সুরই সবচাইতে মধুর? একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, কষ্টের গানের কথাগুলি খুব যত্ন করে লেখা। অনেক সুন্দর-সুন্দর শব্দের গাঁথুনিতে হৃদয়ের সবটুকু অনুভূতিকে যেন লিখে দেয়া হয়েছে। কথাগুলি নিয়ে ভাবলেই শ্রোতার মনে হয়, একেবারেই তার নিজের কথাগুলিকেই আর্টিস্ট সুরে-সুরে বলছেন যেন! বঞ্চনা, প্রত্যাখ্যান, ক্ষতি, ব্যর্থ প্রেম, দুর্ভাগ্য—এসবকিছুই থাকে সে কথাগুলিতে। যখন পাশে প্রিয় বন্ধুটি বা প্রিয় মানুষটি থাকে না, তখন সে কথাগুলিকেই পরম বন্ধু মনে হয়, ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। অন্যের দুঃখ যখন আমাদেরকে গভীরভাবে স্পর্শ করে, তখন আমরা নিজেদের দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পারি। সঠিক সময়ে সঠিক সংগীতটি ম্যাজিকের মতো কাজ করে! কোনো একটি সময়ের সাথে যে গানটি পুরোপুরি মিলে যায়, সে গানটি হল অনেকটা টিউনিং ফর্কের মতো, আমাদের মানসিক অবস্থা আর গানের কথা ও সুর যেন একই অনুরণনে বাজতে থাকে। শুধু গান নয়, মুভি, পেইন্টিং, বই, এই সবকিছুই যেন একেকটি সূক্ষ্ম টিউনিং ফর্ক। শুধু সৃষ্টি উপভোগ করার ক্ষেত্রেই নয়, সৃষ্টি করার সময়ও স্রষ্টা যদি বিষাদকে সঙ্গী করেন, তবে অনেকক্ষেত্রেই মাস্টারপিস সৃষ্টি করা সম্ভব। জগতের সকল আনন্দের আঁতুড়ঘর যন্ত্রণা। যন্ত্রণা আমাদের মধ্যে পরিশ্রম করার মানসিকতা তৈরি করে দেয়। যন্ত্রণা অনেকসময়ই সঠিক কাজটিতে মনোযোগ বাড়ায়। প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ হয় কষ্টভোগে, সুখভোগে নয়।
ব্রেকআপের পর কোন কাজটিতে সবচাইতে বেশি শান্তি মেলে? কোনো প্রিয় বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে? নাকি, বিচ্ছেদের সুরে ভাসলে? দ্বিতীয়টিতেই! ডেনভারের ‘I’m Sorry’, ব্রুনো মার্সের ‘When I Was Your Man’, বিজর্কের বিচ্ছেদগীতি, বা টেইলর সুফটের অ্যালবাম ‘Red’ বারবার শুনলে বিচ্ছেদের অসীম বেদনায় ছটফট করতে থাকা মেয়েটির মনে করতে ভালো লাগে, যেন সে গল্প করছে তার সবচাইতে প্রিয় বন্ধুটির সাথে যে কিনা তার মতো একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ঠিক ওই মুহূর্তে! মানুষ সমব্যথীর সাথে সময় কাটাতে ও কাঁদতে ভালোবাসে। ব্রেকআপের পর সাময়িকভাবে মনে হয়, আমার পৃথিবীটা তো ধ্বংসই হয়ে গেছে! সেসময় একমাত্র গানই সে দুঃখী মানুষটিকে কাঁদতে সাহায্য করে, বাঁচতে শেখায়। কষ্টের সময়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে-কেঁদে নিজেকে হালকা করতেও জীবনে একজন বন্ধুর প্রয়োজন। কিন্তু সবসময় তো আর অমন বন্ধুভাগ্য সবার হয় না। তখন গানই পরম বন্ধুর মতন পাশে থাকে। খেয়াল করলে দেখা যায়, খ্যাপাটে সুর ক্ষেপে-যাওয়া মানুষকে শান্তি দেয়। আবার, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বিধুর মানুষ শান্তি খুঁজে ফেরে ‘নয়ন সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাই…….’ এমন ধরনের গানে। গানে কষ্টের অনুভূতি কমে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ যদি জীবনের শেষ দিনগুলিতে কষ্টের গান শোনে, গান শুনে-শুনে নীরবে কাঁদে, তবে তাদের শেষ দিনগুলি ভালোভাবে কাটে। মানসিক শরীরকে সুস্থ রাখতে সংগীতের চাইতে ভালো পথ্য আর হয় না। নিজের মতো করে নিজকে খুঁজে পেতে সংগীতের কাছে আমাদের আসতেই হয়। আমরা আসি, বারবার ছুটে আসি। আত্ম-সঞ্চরণের বিশ্বস্ত বাহন হল সংগীত।
অ্যাডিলির ‘Someone Like You’ ওয়ার্ল্ড মিউজিক টপচার্টের এক নম্বরে থাকে, মোজার্টের ‘Requiem’ শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ হৃদয়ে রেখে দিয়েছে পরম আদরে। এ দুটো সংগীতই ক্ষতি, বঞ্চনা আর কষ্টের অমর গাথা। তবে আমরা কেন বারবার ফিরে যাই যন্ত্রণার কাছে? জেনেশুনে বিষপান করতে কী এমন সুখ? ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে: এমপ্যাথি, যার মানে হল, আরেকজন মানুষ যেভাবে করে কোনো কষ্ট অনুভব করে, ঠিক সেভাবে ওর মতো করে নিজে সে কষ্টটা অনুভব করা। বিষণ্ণতায় ঘেরা সংগীত আমাদের মধ্যে এই ধরনের অনুভূতি জাগায়। অনেকক্ষণ অঝোরে কাঁদার পর যে শান্তি আসে, একই ধরনের শান্তি বিষাদের সুর আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এ সুর শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ না করেও কাল্পনিক তীব্র যন্ত্রণায় আমাদের বিদীর্ণ করে দেয়। এমন যন্ত্রণার অনুভূতি ভাবনাকে পরিশুদ্ধ করে। যন্ত্রণার সুরে ডুবে থাকার সময়টাতে যে কষ্ট অনুভূত হয়, তা পরবর্তীতে প্রবল মানসিক শক্তি দেয়। সে শক্তি অনুভবের সুখ অসীম! করুণ সুরের যে নান্দনিকতা, তা শ্রোতার শরীরমন গভীরভাবে স্পর্শ করে, তার চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে, এবং জীবনটাকে সুন্দরভাবে দেখতে শেখায়। সেই সুর আর নিজের অস্তিত্বকে এক করে মিশিয়ে জীবনে পরম আনন্দ লাভ করা যায়। ছোট্ট একটা জীবন! এমন বিষণ্ণ সুরযজ্ঞের মঞ্চে চিরঅতিথি হয়ে থাকাতেই তো আনন্দ!