ওরা এসেছিল।
ওরা অনেক কথার কাকলি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চলে গেল। চলেই গেল কি? হ্যাঁ, ওরা ওই চলে যাচ্ছে ধাপে ধাপে, সিঁড়িগুলো ভেঙে ভেঙে।
আমরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। আমি আর পারু। আমরা দু-বোন, আমি বড়ো।
পারু কী ভাবছে জানি না, কিন্তু আমি ভাবছি…অনেক অনেক কিছুই ভাবছি। ভাবছি আর ভাবনার অন্তস্তলে হাবুডুবু খাচ্ছি।
ওদেরকে আমরা যদি আটকে রাখতে পারতাম! কিন্তু পারতাম কি? পারতাম না। আর তাই আমাদের অক্ষমতা আমরা অকৃপণভাবে জানালাম। ওদের হাস্যদীপ্ত মুখ কটা মুহূর্তেই কালো-ম্লান হয়ে গেল। ওরা ফিরে চলে গেল। কোথায় গেল? জানি না। হয়তোবা অন্য কোথাও, কিংবা নিজেদেরই কুঞ্জছায়ায়।
ছুটির দিন।
অফিসের তাড়া নেই। তাই বেশ বেলা করেই বিছানা ছেড়ে মুখ-হাত ধুচ্ছি, এমনি সময় ওরা এল। ওরা তিন জন।
আমরা ওদেরকে চিনি না।
আর তাই আমরা আমাদের অচেনা দৃষ্টিকে মেলে ধরলাম। সুশ্রী-সুন্দরী-সাবালিকা মেয়েটি কোলে মাসকয়েকের আরও সবুজ-সরল-অবুঝ-সুন্দর একটা কচি কিশলয়-সহ এগিয়ে এল। হেসে বলল, মাফ করবেন, আপনাদের গ্রামের বাড়ি কি বগুড়ায়?
: হ্যাঁ।
: আপনারাই তো পোস্টঅফিসে চাকুরি করেন, কেমন?
: ঠিক তা-ই।
সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে যাচ্ছিলাম। মেয়েটি এবার আর-একটু অপ্রতিভ হয়ে বলল, দেখুন, আপনারা নাকি একটা ঘর ভাড়া দেবেন? আমাদের বাড়িও বগুড়ায়। আপনারা যদি দয়া করে…
: বুঝেছি। কিন্তু ঘরভাড়া দেবো, সে খবরটা আপনারা জানলেন কোথা থেকে? এটা সরকারি ফ্ল্যাট।
: আপনাদের নিচের ফ্ল্যাট থেকে।
ভদ্রতা রক্ষা করতে গিয়ে আমরা ওদেরকে ঘরে এনে বসালাম। সঙ্গের ছেলেটি এতক্ষণে মুখ খোলে। "দেখুন, যে-ঘরের কথা জানতে চাইছেন, সেটা আদতে বাসাই নয়, বরং বলা চলে ঝুপড়ি। কাঁচা মেঝে, বেড়ার চালা, আর বর্ষার পানিতে টেকা একেবারে দায় হয়ে ওঠে! অথচ ভাড়া ৬০০০ টাকা। তাই বলছিলাম…"
আমরা শেষ পর্যন্ত আমাদের অপারগতা প্রকাশ করাতে ওরা নির্জীবের মতো নির্বিকার থেকে ধীরে ধীরে সিঁড়ির ধাপগুলো ভেঙে ভেঙে চলে গিয়েছিল।
একুশ-বাইশ বৎসরের ছেলেটি, সতেরো-আঠারো বছরের মেয়েটি, আর মাসকয়েকের বাচ্চাটা। ওরা স্বামী-স্ত্রী। বাচ্চাটা কত সুন্দর। কী মোলায়েম বাচ্চার চোখ, মুখ, নাক, গাল, সারাশরীর।
আমরা দু-বোন ওদের দুই জনের চেয়েই বয়সে বড়ো। আমার তো এবার ত্রিশের বসন্ত পেরিয়ে একত্রিশ, আর পারুর আটাশ; অথচ আমরা দু-জনের কেউই আজও পূর্ণ হতে পারলাম না। অথচ ওরা…!
ওদের ফিরিয়ে দিতে আমরা বাধ্য হয়েছি। সরকার বাহাদুরের অজস্র করুণায় স্টাফ কোয়ার্টার্সের দুটো মাত্র ঘর পেয়েছি দু-জনে। দু-জনই আমরা চাকুরিজীবী, সেই বাবা মারা যাবার পর থেকে।
২০১৩ সালে বাবা মারা যান। আর সেই থেকে আজ এগারোটা বসন্ত আমরা দু-বোন কাটিয়ে দিয়েছি চাকুরির হালখাতায় চোখ-কান বুজে, মন-বনবিহারিণীকে শক্ত শেকলে বেঁধে রেখে। আমাদেরও পৃথিবীর রং-রূপ-রস দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু আমরা নিরুপায়।
ছোটো ভাই-বোন আরও সাত জন রয়েছে। ওরা সবাই নাবালক, মা অসহায়। আমরাই তাই ওদের সবেধন নীলমণি।
রফিক, তুমি কত কত নিষ্ঠুর! তুমি কি পারতে না আমার জীবনটা পূর্ণতায় ভরে তুলতে…ঠিক ওদের মতো…ওই যারা একটু আগে চলে গেল?
পারতে, আমি জানি।
কিন্তু তুমি তা করোনি, এটাই আজকের সবচেয়ে বড়ো সত্য।
ওদের কচি বাচ্চাটা কত সুন্দর, কত মোলায়েম। ওরা স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান মিলে ওদের জীবনটা কত হাসি-কান্না পরিপূর্ণ, কত সজীব, কত জীবন্ত।
আর আমরা? একটা ছকে-বাঁধা মানচিত্র। ব্যর্থ জীবনের হাহাকার। মুঠো মুঠো ব্যর্থতাই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের একমাত্র সম্বল।
অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের মেয়ে আমরা। বাবা মফস্বল শহর বগুড়ার একটা কলেজেই পড়াতেন। রফিক ছিল বাবার প্রিয় ছাত্র।
বাবা বেঁচে থাকতে রফিক কতই-না স্বপ্নের মায়াজাল আমার সামনে তুলে ধরেছিল। রফিকেরই একান্ত আগ্রহে আমাদের পরিচয়। ও ছিল শহরের নামকরা কন্ট্রাক্টর হাসান সাহেবের বড়ো ছেলে।
আমরা ছিলাম নিম্নমধ্যবিত্ত। বাবার সামান্য আয়ের উপরই আমাদের সংসার চলত। সেই আয়ের তুলনায় আমাদের সংসার ছিল অনেক বড়ো। ন-ভাই-বোন আর বাবা-মা, মোট এগারো জন ছিলাম আমরা খানেওয়ালা। আমরা দু-জন পড়তাম কলেজে, ছোটোরা সব স্কুলে।
বাবা-মা সবাই জানতেন, রফিক ভালোবাসত আমাকে, আর তারিক ভালোবাসত পারুলকে। কিন্তু বাবা মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্য যখন আষ্টেপৃষ্ঠে আমাদেরকে নিষ্পেষিত করতে এগিয়ে এল, ঠিক তখনই ওরা হারিয়ে গেল আমাদের জীবন থেকে, কিংবা বলা যায়, পালিয়ে বাঁচল।
সুদীর্ঘ এগারোটা বছরে অফিসের সহকর্মীদের অনেকেই হাত বাড়িয়ে তুলে নিতে চেয়েছে আমার বা পারুলের নিঃসঙ্গ জীবনকে, কিন্তু আমাদের জীবনবীণার যে-তন্ত্রী একবার ছিঁড়ে গেছে, সেটাকে আর কখনও আমরা জোড়া লাগাতে পারিনি।
আমরা স্বচ্ছন্দে মেনে নিয়েছি আমাদের সঙ্গীহীন জীবনকে। তাহলে আজ এ কী হলো?
পারু সেই তখন থেকে ঝিম মেরে বসে রয়েছে। আমি বুঝতে পারছি, সে-ও হয়তো আমারই মতো ডুবে রয়েছে অন্তর্দ্বন্দ্বের হাবুডুবুতে, অতীতের স্বপ্নাচ্ছন্ন পাতায়, তারিকের মায়াজালে। কিন্তু কেন…কেন?
ওরা এসেছিল। ওরা চলেও গেছে। ওদের ওই কচি কিশলয় জীবন্ত ছোট্ট প্রাণটা কত জীবন্ত, কত সজীব!
রফিক আর আমি কত কত স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্ন দেখেছি একটা ছোট্ট নীড়ের। দুটো-তিনটে কচি কিশলয়ের। গাড়ি নয়, বাড়ি নয়, শাড়ি-গহনার ঝকমারিও নয়—রাজ্য নয়, রাজধানী নয়—ছোট্ট নির্ঝঞ্ঝাট একটা ভালোবাসাপূর্ণ নীড়ের। ব্যস্ আর বেশি কিছু নয়।
পারুও হয়তোবা তারিককে জড়িয়ে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে গুনগুনিয়ে উঠেছিল এমনি ছোটো ছোটো স্বপ্নে। কিন্তু নাঃ! যা হবার নয়, তা-ই হলো। ওরা পালিয়ে গেল। হারিয়ে গেল।
পরে শুনেছি, রফিক বিয়ে করেছে জনৈক খ্যাতিমান ব্যারিস্টারের সুন্দরী আধুনিকা কন্যাকে। আর তারিক বিয়ে করেছে এক কোটিপতি পাট ব্যবসায়ীর একমাত্র কন্যারত্নকে। ওরা সুখী হোক। ছোটোমুখে ‘অসুখী হোক’, এমন অভিশাপ কী করে দিই!
কিন্তু আমরা কী এমন মহাপাপ করেছি, যার জন্য এভাবে ব্যর্থতার পুষ্পাঞ্জলি ছড়িয়ে বেঁচে আছি জন্মজন্মান্তর ধরে?
ওরা এসেছিল। ওরা চলেও গেল। ওদের কোলের ছেলে—কচি কিশলয়টি কত সুন্দর! ওরা কত পূর্ণ, স্নিগ্ধ! ওদের স্বপ্ন কত জীবন্ত, সত্য, সার্থক!