মেসেঞ্জার-ফ্রেন্ড

“এই সম্পা! সম্পা! সন্ধে যে হয়ে এল, আর কত ঘুমোবে? ওঠো, ওঠো।”




ভাবির ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে সম্পা। জানালার পরদার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে, গোধূলির ম্লান আলোর রেশটুকু এখনও যেন যাই যাই করেও যেতে পারছে না ওদের বাড়ি থেকে। বারান্দার এককোণে টিয়াপাখির খাঁচাটার উপর লুটোপুটি খাচ্ছে সেই মিষ্টি রোদটুকু, টিয়াপাখিটা তখন একমনে শিস দিতে আরম্ভ করেছে। ভারি ভালো লাগল এই বিকেলটা সম্পার।




হঠাৎ মনে পড়ল, ঘুমোবার আগে সে ঠিক করেছিল, শান্তাদের বাসায় যাবে আজ। হ্যাঁ, ঠিক করতে হলো তো! হঠাৎ করেই করতে হলো। কী করবে সে? কাল বিকেলের আব্বা-আম্মা’র কথাগুলো যে সে মোটেও ভুলতে পারছিল না। বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছিল। পাশের ডাইনিংরুমে আম্মার গলায় নিজের নামটা শুনে নিজের অজান্তেই সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। স্পষ্ট শুনেছে সে, আব্বা বলছিলেন, “কিন্তু তাহলে ওর মতটাও তো একবার নেওয়া উচিত।” আম্মা সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছিলেন, “কী বললে? আমরা বিয়ে ঠিক করব আর সম্পা অমত করবে? নিজের মেয়েকে তুমি আজও চিনলে না?”
“না, না, ভুলে যাচ্ছ কেন, আজকালকার মেয়ে ওরা...।” আব্বার কথার মাঝখানেই আম্মা বলেছিলেন, “কী বলছ? আজকালের আর পাঁচটা মেয়ের মতো ওর কি পাঁচ-দশটা ছেলেবন্ধু আছে?”




মা যেন আরও কী কী বলেছিলেন, কিন্তু আর কিছুই শোনেনি ও, সোজা উঠে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। বন্ধু... বন্ধু... বন্ধু। এই একটা মাত্র শব্দই তার কানে বাজছিল বার বার। হ্যাঁ, এই বিশ্বসংসারে এই একটা সম্বোধনই তাকে আকুল করে তুলেছে।




“এ কী! এখনও বিছানায় বসে যে? হাতমুখও ধোওনি, ব্যাপার কী?”




ভাবির ডাকে চমকে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সম্পা, কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে শান্তাদের বাড়ির উদ্দেশে। ইস্, এত দেরি হয়ে গেল! শান্তা কী ভাবছে!




হ‌ইহ‌ই করে বেরিয়ে এল শান্তা ওকে দেখে। কিন্তু ওর গম্ভীর মুখ দেখে হাসি বন্ধ করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল ওকে। ঘরে ঢুকেই ছোটোবোন নীতাকে বলল, “দু-কাপ চা পাঠিয়ে দে তো ওপরে।”
“তারপর কী খবর বল তো? তোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন তোর মাথায় তোর ওজনের দ্বিগুণ, তিনগুণ, কি তারও বেশি ভারী একটা বোঝা চাপানো রয়েছে। মানে বিরাট একটা সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তোকে!” তর্জনী তুলে শাসনের ভঙ্গিতে বলে, “নয় কি?”
ওর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে সম্পা। “দেখ, সবসময় ফাজলামি ভালো লাগে না।”
“তোর তো কিছুই ভালো লাগে না, তবে চুপচাপ বসে না থেকে বলেই ফেল না তোর বক্তব্য।”
গতকাল বিকেলের আব্বা-আম্মার কথাগুলো খুলে বলতেই লাফিয়ে ওঠে শান্তা। “মিষ্টি, মিষ্টি কই?”
“তুই থাম তো, এ বিয়ে আমি করব না।”
চোখ কপালে তুলে শান্তা জিজ্ঞেস করল, “এ বিয়ে করবি না, মানে?”
সম্পা কুণ্ঠিত হয়, লজ্জা বোধ করে। সংকোচের সঙ্গে বলে, “জামান…আমার বন্ধু জামান…” অসমাপ্ত থাকে কথাটা।
“এই সেরেছে! এটি আবার কে?”
“আমার মেসেঞ্জার-ফ্রেন্ড।”
“মেসেঞ্জার-ফ্রেন্ড! তোর আবার মেসেঞ্জার-ফ্রেন্ড ছিল নাকি? কোথায় থাকে সে? তুই দেখেছিস তাকে?”
“উঁহু। সাউথ কোরিয়া থেকে মাত্র কয়েক দিন হলো ঢাকায় এসেছে।”
“কী বললি? দেখিসনি? অথচ ভাবের সাগরে লক্ষ লক্ষ প্রদান-পর্ব শেষ! সত্যি অবাক করলি। তুই একজন আধুনিকা, শিক্ষিতা। এতদিনে যদিও একটা রূপকথার সূত্রপাত হল, তা-ও অচিন সে লোক!”




তখন খুলে বলে সম্পা। “দু-বছরের মেসেঞ্জার-ফ্রেন্ড। ঢাকায় আসার পর দূতের কাজ করছে মোবাইল ফোন; এর আগে ছিল লিপিকা। চিরদিনকার লাজুক সম্পাও একদিন বলেছে—একদিন আমাদের বাসায় এলে খুশি হব।
“কেন? বন্ধুত্বের আয়ু কি শেষ হয়ে আসছে? না, আমায় দেখতে ইচ্ছা করছে? সত্যি করে বলো তো কোনটা…?” কথা শেষ না করেই হো হো করে হেসে উঠেছে জামান। আর এদিকে ফোনের অপর প্রান্তে লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে সম্পা। লোকটার স্পষ্টবাদিতায় অবাক হয়ে আর লজ্জায় রাঙা হয়ে ভেবেছে, “ইস্, আচ্ছা তো মানুষ! ভাগ্যিস্ সামনেই বলে বসেনি কথাটা। দেখা হলে কি এরকম করেই কথা বলবে নাকি তার সঙ্গে? কিন্তু সবার মতে এই বদরাগী সম্পা সেদিন মোটেই রাগ করেনি জামানের কথায়। বরং কেমন যেন ভালো লেগেছিল জামানের প্রাণখোলা ওই হাসিটা।




কয়েক দিন পর জামানের টেক্সট পেয়েছিল সম্পা।




“সুচরিতাসু,
অনেক দূর থেকে আমি এলাম।
ভেবেছিলাম,
ক্লান্তি আমার মুছিয়ে দিতে তুমি নেবে ডেকে।”
আরও লিখেছে, “আগামী উনিশে ডিসেম্বরে দেখা পাবে আমার।”
ইতি
বন্ধু




চিঠিটা পাবার পর থেকেই কি সেই দিনটারই প্রতীক্ষায় ছিল না সম্পা? বার বার ভেবেছে…আমি চিনব কেমন করে? আমি তো ওর ছবিও দেখিনি। আমার ছবি নাহয় দেখেছে, তবুও যদি আমাকে চিনতে না পারে? নাহ্, তা কি হয়? না পারলে কি আর এমনি এমনি লিখেছে ওই কথাগুলো?




এ কয়দিন যেন প্রতিমুহূর্তে ওর পদধ্বনি আশা করে ছিল। দু-বছরে কেবলই টেক্সটের মাধ্যমে সম্পার মন জানাজানির কথা শুনে অবাক হয়ে গেল শান্তা। গাম্ভীর্যের আবরণে এ মেয়ে নিজেকে সবসময় ঢেকে রাখে, কো-এডুকেশন কলেজে পড়েও যে-মেয়ে এক দিনও একটা ছেলের সঙ্গে যেচে কথা বলেনি…




কিছুক্ষণ চিন্তা করে শান্তা বলে, “তাতে কী হয়েছে? তোর ভাবিকে সব খুলে বল। তোর অমত থাকলে তাঁরা নিশ্চয়‌ই এখানে তোর বিয়ে দেবেন না।”
"পাগল হয়েছিস তুই? আজ সকালে ভাবির মুখে যেটুকু শুনলাম, তাতে স্পষ্ট বোঝা গেল, আতিককে সবারই ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এমন মেধাবী সুপুরুষ, সচ্চরিত্র ছেলে নাকি আজকাল দেখাই যায় না। অতএব বুঝতেই পারছিস, সবার এমন মনোনীত পাত্রকে সহজে আমি রিফিউজ করতে পারব না। তুই বরং অন্য উপায় বল।”
“আচ্ছা, তোর কোনো চিন্তা নেই। আতিকের আর জামানের ঠিকানাটা তুই আমায় দিয়ে যা।”
“আতিকের ঠিকানা জানি না, তবে ভাবি সকালে আমাকে ওদের ফোন নম্বরটা দিয়ে বলছিল, “ফোন করে এখন থেকে ভাব করে নাও, বুঝলে?” নম্বরটা এই, আর জামানের ঠিকানাটা এই নে।” শান্তা দেখল, এ জামান, বনবীথি আবাসিক, ব্লক ডি, হাউজ নম্বর ৪৮৭, ঢাকা।




বাড়ি এসে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে সম্পা। কী হবে এখন! কী করে দেখা করবে সে জামানের সঙ্গে, ফোন নম্বরটাও জানা নেই ওর! মাঝে মাঝে জামানই ফোন করে ইচ্ছে হলে, তা-ও মেসেঞ্জারে।




শান্তাটা যে একটা বুদ্ধু, তা ওর জানা ছিলো না। পাঁচ দিন হয়ে গেল, স্পষ্ট করে কিছু বলে না। "আমি সব ব্যবস্থা করছি, তুই নিশ্চিন্ত-মনে ঘুমা।” এটুক বলে আর কিছু বলার আগেই ফোন ছেড়ে দেয়।




বিয়ের এদিকে সব ঠিক। ওর মতামতের প্রয়োজন হলো না। মৌনাবলম্বন সম্মতির লক্ষণ বলেই ধরে নিলেন ভাবি। শান্তা এল বিকেলে। গম্ভীরভাবে বলল, “শোন, আমি দু-জনের সঙ্গেই দেখা করেছি। একেবারে বিপরীত দু-জনে। তোর মেসেঞ্জার-ফ্রেন্ডটা যে কী, একেবারে অপদার্থ। তাকে মেসেঞ্জার-ফ্রেন্ডের পদেই বহাল রাখা যায়, অন্য পদে উত্তীর্ণ করা যায় না। আর মিস্টার আতিক! আহা, কী চমৎকার উজ্জ্বল, অতুলনীয়! আমি বলছি, তুই সুখী হবি এখানে।”




রাগে সম্পা কথাই বলেনি আর শান্তার সঙ্গে। কী আশ্চর্য! এই কয়দিনে জামান একটাও নক দিল না। এক বার ফোন পর্যন্ত করল না। শান্তা বলছিল, ওর বিয়ের কথা শুনে নাকি মিষ্টি খেতে চেয়েছে! আচ্ছা অমানুষ তো! আর একেই কিনা এতদিন বন্ধু ভেবেছে। সে দীর্ঘ দু-বছরের মধুর স্মৃতির মেলায় অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করে, কেমন করে যে ধীরে ধীরে সুদূরের ওই অদেখা মানুষটা একেবারে তার অন্তরের অন্তস্তলে আশ্রয় নিয়েছে!




চিঠির জবাব পেতে দেরি হওয়াতে একবার চমকে নিজের দিকে ফিরে তাকিয়েছিল সে অনেক দিন আগে। অভিমান…অভিমান করেছে সে অদেখা, অচেনা ওই সুদূরের মানুষটির সঙ্গে। এ অধিকার সে পেল কেমন করে? ছিঃ ছিঃ! আজকের এই শুভদিনে এসব কী ভাবছে সে! আজ সে নববধূ হয়ে স্বামীর ঘরে…।




“আপু, তোমার ফোন এসেছে।”
ছোটোবোনটার কথায় কেঁপে উঠল বুকটা। ফোন, আবার ফোন! তবে কি জামান? কী বলবে সে এখন জামানকে? কিন্তু জামান তার নম্বর পেল কীভাবে!




“কে?”
“আমি, জনাব এ জামান। কী খবর?”
আশ্চর্য! লোকটা একটা কথা শুনেই চিনতে পারল ওকে!
“কী? কথা নেই যে?”
“না, মানে এতদিন পর বুঝি মনে পড়ল…?”




এ কী! কী বলছে সে! মুঠোফোন-ধরা হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল। জামানের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে…”এতদিন মানে? মাত্র তো ক-টা দিন। একটা ইংরেজি ‘এ’ নিয়ে রহস্যে পড়েছিলাম। খুব ব্যস্ত? হ্যাঁ, আমিও আমার বিয়ের তারিখ ওই দিনেই করলাম। দাওয়াত না করলেও বিনা নিমন্ত্রণেই উপস্থিত হব কিন্তু।”




নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে হলো, আচ্ছা।




সমস্ত দিনই কেঁদে কেঁদে দু-চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে সে। গুরুজনের আদেশ-উপদেশ বান্ধবীদের হাসি-ঠাট্টা সব কিছুতেই অকারণে বিরক্ত হয়ে উঠেছে সম্পা। তার উপর পাশের ঘরে সমস্ত দিন ছোটো ছেলে-মেয়েগুলো একটানা স্পিকার বাজিয়েছে। ভীষণ বিরক্তিকর ব্যাপার। ছেলেপক্ষ আসার সময় সেটা বন্ধ হলে একটু স্বস্তিবোধ করছিল ও। কিছুক্ষণ পরই দ্বিগুণ উৎসাহে শুরু হলো বান্ধবীদের হাসিতামাশা। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তখন সম্পার।




শাহনজরের সময়ও চোখ বন্ধ ওর। হঠাৎ পেছন থেকে বেশ জোরে বলে উঠল শান্তা, মিস্টার আতিকুজ্জামান, মানে এ জামান সাহেব, শুনছেন? ভালো করে দেখে নিন এই সময়টা।” আর সম্পার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “কী রে বোকা মেয়ে, চিনলি তোর বন্ধুটিকে? রূপসাগরের অরূপরতনটিকে না দেখে, পুরো নামটুকুও না জেনে ভগ্নাংশের খেলাতেই এত? বাপস্!”




পাশের ঘরে এত ভিড় অগ্রাহ্য করে কোন দুষ্টুছেলে একটা অদ্ভুত টাইপের বিচ্ছিরি গান ছেড়ে দিয়েছে। তবু এত যে ভালো লাগছে সুরটা!