মানুষ মূলত অচেনা

কাজলরা এককালে আমাদের প্রতিবেশী ছিল।




আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। ছোটোবেলা থেকে একসাথে খেলাধুলা করেছি। একে অন্যের বাড়িতে যাতায়াত করেছি স্বচ্ছন্দে। একটা স্বাভাবিক সখ্যভাব জন্মেছিল আমাদের মধ্যে। কাছে কাছে থেকে মানুষ হবার মধ্যে মনের কাছেও এসে গেলাম পরস্পরের।




আদর করে কাজলকে আমি ‘লতা’ বলে ডাকতাম।




লতার মতোই অলক্ষে আমার মরমের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল সে। আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম, কিন্তু মুখফুটে সে ভালোবাসার কথা বলিনি কখনও।




সহজ হবার অসুবিধেই বুঝি এখানে। সহজভাবে সহজ করে কিছু বলা যায় না। বলতে গেলে বাধে। কী জানি কাজল যদি কিছু মনে করে?




এমনি করে আস্তে আস্তে আমরা যৌবনের স্বর্গদ্বারে উপনীত হলাম। কাজলের কুঞ্জবনে তখন বসন্তের কোকিল ডাকে; আর আমার হৃদয়-যৌবনে শুধু ফাগুনের মাতাল হাওয়া।




জানি না কী করে সেই মাতাল-দিনে একদিন কাজলকে বলেই ফেলেছিলাম, “লতা, তুমি কাউকে ভালোবেসেছ?”




কাজল সহসা এক বার তার কাজলকালো দু-চোখ তুলে অপাঙ্গে তাকাল আমার দিকে। তারপর বলল, “হ্যাঁ, তোমাদের সবাইকেই তো ভালোবাসি। কেন, তুমি বাসো না?" বললাম, “তা নয়। তেমন করে ভালোবাসা নয়। বিশেষ কাউকে বিশেষভাবে ভালোবাস না? নিজের মতো? মনের মতো?”




সহজ সুরে ও বলল, “দেখো, কোনো মানুষই কোনো নির্দিষ্ট মানুষকে ভালোবাসে বলে আমার মনে হয় না। ভালোবাসে একটা আদর্শকে। যার মধ্যে যতটুকু তার কল্পিত আদর্শের সাক্ষাৎ মেলে, তাকে মানুষ ততটাই আপন করে ভাবে।”




শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আশ্চর্য, কোথায় ছিল এই মেয়ে ওই কাজল-দেহে! এ মেয়ে এত কথাও জানে।




বললাম, “তা, তোমার সে আদর্শের দেখা কি কার‌ও মধ্যে পেয়েছ?”




কাজল বলল, “আমি? আমি যে-আদর্শকে ভালোবাসি, তা হয়তো পাওয়াই যায় না। কিংবা পাওয়া যায়, কে জানে? এই ধরো, তোমার কথাই। তুমি তো আমায় ভালোবাস, কিন্তু এই তুমিই কি কোনোদিন বলেছ—লতা, যখন তোমার কেউ থাকবে না, সমস্ত গানের সুর হারিয়ে যাবে, সেদিন তুমি অন্তত আমার কাছে এসো। অন্তত আমি তোমার জন্যে থাকব। বলেছ কোনোদিন?”




তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। সময়ের আবর্তে জীবনের অনেক কিছু পালটে যায়, অনেক পরিবর্তন হয় মানুষের, আর পৃথিবীর।
কাজলের বাবা বদলি হয়ে কোথায় চলে গেছেন, জানি না।




সে অনেক দিন আগের কথা। কিন্তু আজ‌ও কার‌ও কথা নির্জনে ভাবলে মনের জানালায় শুধু একটা মুখই ভেসে ওঠে, সে মুখ কাজলের। সেদিনের সেই শ্রাবণ সন্ধ্যাটিকে আজও ভুলতে পারিনি।




অথচ কাজলকে আমি কোনোদিনই বুঝে উঠতে পারিনি। কেন সে যাবার সময় বলে গেল না, কিংবা গিয়েও কোনো সংবাদ জানাল না, তা অজ্ঞাতই রয়ে গেল। আজ সে কোথায় আছে, কেমন আছে, এমনকী বেঁচে আছে কি না, তা-ও জানি না। অথচ একদিন মনে করতাম, কাজলকে আমি জানি। ওর সব কথাই আমার জানা।




আশ্চর্য! মানুষকে আমরা কতটুকু জানি, কতটুকুই-বা বুঝতে পারি! প্রতিদিনকার স্পর্শকাতর ও পরিবর্তনশীল মন নিয়ে যাকে কাছে পাই, তাকে সবটুকু করে জানার পরিধি সেই সঙ্কীর্ণ সীমায় সীমায়িত নয়, সে জানাও তার সবটা নয়, তার শেষও নয়। নিত্যজানার সীমানা পেরিয়ে হয়তো অজানা আকাশটাই অনেক বড়ো। মানুষ তাই নিত্যই অজানা থাকে; অজানা এবং অচেনা।