আধো বোলে খেলার ছলে যে মানুষটি গাঁথল আমার কথার মালা, যার বুকের উষ্ণ বোধে ভালোবাসা কী, বুঝেছি প্রথম, সে মানুষটিকে হয়নি বলা কখনও এমন: ‘ভালোবাসি, মা!’ যার হাতটি ধরে হাঁটতে শিখি, যার গলাটি ধরে দাঁড়িয়েছি উঠে, নিজের পথটি রুদ্ধ করে শিখিয়েছে যে পথ চলতে, বড়ো হলাম, তবু সে মানুষটিকে বলিনি হেসে, ‘চলো না মা, একটু হেঁটেই আসি বাইরে থেকে!’ এক-একটা দিন ফুরোল, মা বেচারি চোখের সামনে বুড়িয়ে গেল, আমার জমিয়ে-রাখা একাজ ওকাজ, ছড়িয়ে-রাখা এটা কি ওটা, তার সবটা গোছাতে গিয়ে নিজের চামড়া-মাংস কুঁচকে ফেলে, আমায় এতটা বড়ো করল যে মা, তাকে কখনও বলিই তো নি, ‘মা, ইদানীং, তোমার বুঝি খুব ক্লান্ত লাগে?’ আমার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখতে চেয়ে, বিনা কুণ্ঠায় যে রেখেছে জীবন বাজি, আমায় ভালো রাখতে গিয়ে ঝরিয়ে দিল রক্ত-স্বেদের শেষ ফোঁটাটাও, সে মায়ের জন্য, দেবার মতো একটু সময়ও হয়নি আমার! যখন ছোট্ট ছিলাম, তখন আমায় ঘুম পাড়াতে, কিংবা বড়োবেলাতে, আমার জ্বরের ঘোরে, যে থেকেছে বসে না ঘুমিয়ে রাতের স্রোতে, আমার ফিরতে একটু দেরি হলে, যে মানুষটি দরজা ধরে, প্রতিরাতই, ছিল অপেক্ষাতে, তাকে কখনও শুধাই তো নি, ‘মা, রাতের ঘুমটা ভালো হয় তো…প্রতিদিনই?’! আমার শখপূরণে যে বিলিয়ে দিল সারাটি জীবন, আমার জন্য একলা ঘরে বন্দিত্বও নিয়েছে মেনে, আড্ডা- কিংবা পার্টিশেষে বাসায় ফিরে সেই মাকে আমি কেন বলিনি, ‘মা, কখনও কি…তোমার একা লাগে খুব?’! আমাকে ঘিরেই ব্যস্ত থেকে যার ক্ষয়েছে জীবন, হায়, সে মায়ের জন্য সময় আমার হয়নি আজও! তবু আমি হই যেমনই, চোর কি সাধু, অন্ধ খোঁড়া, হই যদিও খুনি কি ডাকাত, মা তবু যে ভালোটা বেসে চোখে চুমু খায়! ভালো যে মাকে বাসতেই হয়,---মা জাতটাই বেয়াড়া এমন! আমি সময় পাইনি সময় দেবার। আমি কথা পাইনি কথা বলবার। আমার ইচ্ছে হয়নি ইচ্ছে জানবার। মা-টা তবু দিনের শেষে, মা-ই থাকে! সূর্য ওঠে, ফুলটা ফোটে, পাখিও ওড়ে,--- যেমনি এসব ধ্রুব থেকে যায় প্রলয় হলেও, ঠিক তেমনি, সন্তান মাকে যেখানেই রাখুক, যেমনই করে, শত ঝড়েও, প্রেমে মমতায় সন্তানকে মা বুকেই রাখে!