ভাবনা: তেতাল্লিশ।
……………………..
বৃষ্টিও যে অনেক কাঁদে—কেউ কি তা বোঝে? সবাইই তো বৃষ্টিতে নিজের অশ্রু আড়াল করে বেঁচে যায়—বৃষ্টি তার অশ্রু আড়াল করবে কোথায়? এই পরম বন্ধুটির কষ্টের কথা কেউ কি ভুলেও ভেবেছে কোনোদিনও? সাগরের জল লোনা কেন—কেউ কি তা জানে? বিজ্ঞানের ছেলেভুলানো ফন্দিতে আর কতদিন? পৃথিবীর সব ‘কেন’ এসে মাথায় বাসা বাঁধতে থাকে। মাঝে-মাঝে, মনটা বিদ্রোহ করে বসে—যে করেই হোক, সব ‘কেন’কে হাতের মুঠোয় এনে ছুঁড়ে দেবে উত্তরের ঝুড়িতে। নিজের ভেতরে ‘কেন’র অসীম সমুদ্র বিস্তৃত হতে থাকে। মনের সাথে মনন এসে জুটে, ডুবসাঁতারে-ডুবসাঁতারে মাণিক্যের খোঁজ করে। কুড়িয়েটুড়িয়ে পেয়েও যায় কিছুমিছু। বড় দামি সে রত্নের স্তূপ, তাই আকর্ষণটাও দুর্নিবার। জীবন সেসবের নাম দিয়ে দেয়—অনুষঙ্গ। জীবনের এমন সব অনুষঙ্গের দাম কি জীবনকেই ছাড়িয়ে যায় কখনো-কখনো? একটু ঝেড়ে কাশছি। প্রশ্ন উঠল: লবণ চাই, না, জাফরান!? ব্যস্ হয়ে গেল! নিন্দুকেরা হেসে লুটিপুটি। কোথায় সস্তা লবণ, আর কোথায় কিনা, দামি জাফরান! তুলনা চলে নাকি!? সাগরপাড়ে অবহেলায় পড়েথাকা সস্তা রাশি-রাশি লবণ—চার টাকায়ই তো মেলে অনেকখানি! আর জাফরান মেলে কত কাহিনী করে, কত-কত কষ্টস্বীকারের পরেই তো তবে জাফরান! এই রেড গোল্ডের দামটাও বেশ চড়া—মাত্র এক কেজিতেই প্রায় চার লাখ টাকা পকেট থেকে বেরোয়, পকেটে ঢোকে! যার কাছে ওটা আছে, সে বড় দামি মানুষ। বুঝলাম সবই, জাফরানের রাজকীয় ভাব আছে, ওটা রাজা বানায়ও—কিন্তু তার দাম কি কোনোভাবে লবণের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি? খাবার কি লবণ ছাড়া সম্ভব!? সম্ভব নয়, ফলে, লবণ ছাড়া বাঁচাও সম্ভব নয়। অথচ, জাফরান না হলেও চলে, মৃত্যু পর্যন্ত হেসেখেলে পৌঁছে যাওয়া যায়। কত দামি জিনিসের খোঁজ না রেখেই লোকে ভীষণ দামি একটা জীবন কাটিয়ে দেয়! তাই, লবণ যতই সস্তা কিংবা সহজলভ্য হোক—তার সত্যিকারের মূল্য—জাফরানের চেয়ে কম নয়, বরং ঢের-ঢের বেশি। জীবনটাও কখনো-কখনো এমনই…..মানুষ, জাফরানের লোভে—সত্যিকারের স্বাদটাই হারিয়ে ফেলে। প্রয়োজনের চাইতে, দামটাকেই বড় করে দেখে। এই দেখাই, মানুষকে একসময় অন্ধ করে দেয়। মানুষ অন্ধ হয়ে দরকারিটা ফেলে দামিটার পেছনে ছোটে!……..বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি। এই অনুভূতিটা, যার বাবা আছে, সে বুঝবে না। বাবা আছে, বাবা নেই—এই দুই মেরুর মধ্যে যে দূরত্ব, তা কল্পনার চাইতেও তীব্র। বাবা বেঁচেথাকার সময়ে, মানুষ ধরেই নেয়, বাবাকে অবহেলা করার ঠিক পরমুহূর্তেও বাবা থেকে যাবেন এরপরের অবহেলাটি সহ্য করার প্রতীক্ষায়। অনেক-অনেক জাফরানের ভিড়ে, লবণটাই আর পাত্তা পায় না। লবণ হারিয়ে যায়, মানুষ জাফরান হাতে, প্রবল যন্ত্রণায় কাতরায়। তখন আর কিছুই করার থাকে না।
আজ বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। ১৫ বছর হয়ে গেল। অনেকসময়, অনেকটা সময়, কত সহজেই ফুরিয়ে যায়। মাঝে-মাঝে ইচ্ছে করে, পৃথিবীর সব বাবাদের ডেকে বলি—শুনছ! অনেক-অনেক বেশি ভালোবেসে দাও তোমাদের সন্তানদের—তোমরা না থাকলেও যেন, আর ভালোবাসার অভাব না হয়। আবার কখনো মনে হয়, বলি ওদেরকে—কী লাভ এত ভালোবেসে? থাকবে নাতো আর চিরকাল পাশে। তোমার এই অসীম ভালোবাসা, তোমার সন্তানকে, জীবনভর কেবল যন্ত্রণাই দেবে। যদি তোমার ভালোবাসায় তোমার সন্তান অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, আর সে অভ্যস্ততার পর তুমি চলে যাও, তখন সে স্বর্গের ভালোবাসার খোঁজে, সে কোথায় হাতড়ে মরবে?
ভাবনা: চুয়াল্লিশ।
……………………..
অনেক কষ্ট, তবুও, হেসেই যাবো—এর নামই জীবন। আমি ইচ্ছে করেই মানুষ থেকে দূরে-দূরে থাকি। মানুষের ভিড়ে, আমি বড্ডো বেমানান। আমি মানতে পারি না, মানিয়ে নিতে পারি না। আমি আমার জীবনে মাত্র দুই-তিনজনের সাথে মেসেজে প্রচুর কথা বলেছি। বিশ্বাস হচ্ছে নাতো? আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে মোট ১৪ জন। কারো সাথেই, আমার তেমন একটা কথা হয় না। আমার ভাল লাগে না, শুধু সময় কাটানোর জন্য অনর্গল কথা বলে যেতে—যাকে ভাল লাগে না, তার সাথেও। এমন অসামাজিকতা আমাকে আমার নিজের আর যাদেরকে কাছের মানুষ ভাবি, তাদের ব্যাপারে ভীষণ স্বার্থপর করে তুলেছে। তাই, আমি যাকে মেসেজ দিই, তার উপর আমার এক ধরনের দাবি কাজ করে। আমার ১০০ মেসেজেরও উত্তর যদি কেউ না দেয়, আমার অতো কষ্ট লাগে না, কিন্তু একটা মেসেজও যদি ও না পড়ে, তবে তা, কেন জানি না, কিছুতেই মানতে পারি না, সহ্য করতে পারি না, বুকের ভেতরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতে থাকে, মানতেই পারি না যে, আমার মেসেজ পড়ারও অযোগ্য, কিংবা অ্যাটেনশন দেয়ার মতো কোনোকিছুই আমার মধ্যে নেই! আপনি আমার মেসেজ না পড়ুন, অন্তত সিন হলেও করবেন, প্লিজ। ওতে যদি আমি মিথ্যে সান্ত্বনায়ও ভাল থাকি, আপনার তো আর কোনো ক্ষতিই হচ্ছে না, তাই না? আপনি আমার তেমন কেউ নন। (নিজের মনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভুল বললাম, বুঝতে সুবিধে হওয়ার জন্য।) তাই, আপনার কাছ থেকে, আমি অমন প্রত্যাশা করার মেয়ে নই, অন্তত, ছিলাম না। তবু, আমি চাই বা না চাই, আপনি চান বা না চান, অনেককিছুই বদলে যায়…… বদলে যায়ই…….কারণে কিংবা অকারণে ……..জানায় বা অজানায়…….নীরবে কিংবা সরবে ……….কেন বদলায়, সে উত্তর খুঁজতে গেলে, উত্তরটা পাই-ই বা কই? চোখের সামনেই এমনকিছু একটা ঘটছে আমার সাথে, যা মেনে নেয়া ঠিক নয়, এমনকিছু, যা থেকে চাইলেই বেরিয়েও আসা যায় অনায়াসেই—অথচ, বেরোচ্ছিটা কই? জীবন বদলে যায়, আমিও বদলে যাই……একদিন আকাশ বলেছিল, ছুঁয়ে দেবে আমায়। এখনো, সে স্পর্শের প্রতীক্ষায় আছি। দেয় না, আমি বুড়িয়ে যাই ভাবতে-ভাবতে, তবু দেয় না। মন বলে, ও কিছু না, আকাশ ওরকম বলেই! আমি মনকে বোঝাই, কিন্তু কথা দিয়েছিল যে! সবাই বলে, আমি বিশ্বাস করি, তাই নাকি আমি বোকা। আমি ভাবি, তাহলে যে বিশ্বাস করায়, সে কী? বুদ্ধিমান? নাকি, প্রতারক?
ভাবনা: পঁয়তাল্লিশ।
……………………..
অন্যকিছু তো অনেক পরের কথা, স্রেফ ফোনটা রিসিভ করলে, বা দেখা করলে—মহাভারত সত্যি-সত্যিই অশুদ্ধ হয়ে যাবে!—এটা আমরা দুজনই মনে করছি! বুঝতে পারা আর মেনে নেওয়ার মধ্যে অনেক দূরত্ব। যা মেনে নেয়া যায় না, তা বুঝতে না পারাই ভাল। কিন্তু কেন জানি, কীভাবে যেন বুঝতে পারা হয়েই যায়, কিন্তু মেনে নেয়াটা আর হয় না। আচ্ছা, আমি যে ওকে ভয়েস মেসেজগুলো দিয়েছিলাম, ও কি শুনেছিল? অনেকসময় লিখতে ইচ্ছে করে না, বলতে ইচ্ছে করে। প্রচুর কথা বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু একটা বর্ণও লিখতে ইচ্ছে করে না। এই যেমন, এখন ইচ্ছে করছে, ‘একরাত কথা’ বলি। কিন্তু হায়, রাত ফুরোনোর আগেই, কথা ফুরোয়, কিংবা, সমস্ত শরীর কথা বলতে শুরু করে। শরীরের কথা মনের কথাকে থামিয়ে দেয়, কিংবা শরীরই মনকে কথা বলায়। শরীর যখন মনকে কথা বলায়, তখন মন বড্ডো ভুলভাল কথা বলে! রাত, মানুষের সাথে-সাথে কথাকেও বদলে দেয়। রাতের মানুষ, ভিন্ন মানুষ। রাতের কথা, ভিন্ন কথা। যাকে ভালোবেসে ফেলার ভয় আছে, তার সাথে আর যা-ই হোক, রাতে কথা বলতে নেই। একেকটা রাতের জন্ম হয় নষ্ট করে দেয়ার অসীম ক্ষমতা নিয়ে। তবু, সে ইচ্ছেটা করছে, করেই যাচ্ছে। ইচ্ছের সাথে এটাও শুনতে পারছি, কেউ যেন বলছে, ওরে, তোর কথা শুনবে কে রে!? তোর আছেটা কী? তুই কি ওরকম মেয়ে নাকি যে, তোর সাথে সারারাত ভালোবাসা ছাড়াও কথা বলা যায়? আচ্ছা, আমরা কি কাউকে ভালোবাসি বলে তার সবকিছু ভাল লাগে, নাকি তার সবকিছু ভালোলাগার মতো থাকে বলে তাকে ভালোবাসি? দুটোই সত্য, আবার দুটোই মিথ্যা। দিনের শেষে, কেবল, আমরাই সত্য। বাকি জগতটা, স্রেফ বাকিটা সময়ের জন্য সত্য। কবিতা লেখার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি, কবিতার শরীর আসছে, ভাবটাও আসছে, কিন্তু সে শরীরটা নিছক গদ্যের শরীর থেকে যাচ্ছে, তাকে কিছুতেই কবিতায় শব্দবদ্ধ করতে পারছি না। এমন মুহূর্ত যে কী এক অসীম অসহায়ত্বে ডুবিয়ে মারে, তা কবিতা লেখে না, এমন কেউ কখনো বুঝবে না। পরীক্ষার হলে একটা প্রশ্ন কমন, কিন্তু সেটির উত্তর কিছুই মাথায় আসছে না, এমন মুহূর্তে সেই প্রশ্নটার উপর প্রবল অধিকারবোধের জন্ম হয়। যা আমি জানি, কিন্তু দরকারের সময় মাথায় আসছে না, তার উপর অধিকারবোধ বেড়ে যায়। আর যা আমার অজানা, যা আমার নয়, কিন্তু সেটাকে আমি ততোটাই অনুভব করতে পারি যতোটা অনুভব করতে পারলে তাকে নিজের মতো করে সৃষ্টি করে নেয়া যায়, দরকারের সময় তা মাথায় না এলে রীতিমতো নিজের সমস্ত অস্তিত্বকে অনর্থক মনে হতে থাকে। সবার জীবনেই ওরকম লিখতে-চাওয়া অসমাপ্ত কবিতার মতো একজন মানুষ থাকে, যার উপর বরাবরই তীব্র অধিকারবোধ কাজ করে, তা সে যতোই অজানা, অচেনা কিংবা অন্য কারো হোক না কেন!
ভাবনা: ছেচল্লিশ।
……………………..
বই পড়া হয়েছে—আমার, সংখ্যায় খুব কম। ফিকশন পড়লেই আমার কান্না আসে, গল্পের কাহিনী যা-ই হোক। কেন আসে—তা আমার নিজেরও জানা নেই। যে বইটা আমার নয়, তা আমি কখনোই পড়ি না। যদি এমন হয়, একটা বই আমি মনে-মনে এক বছর ধরে খুঁজছি, কোথাও বেড়াতে গিয়ে, পাঁচ ঘণ্টা অবসর সময় পেলাম, বইটাও সেখানে পেলাম, তবুও সে বই আমি কিছুতেই পড়ব না! অন্যের বই কেন পড়ি না, তার ব্যাখ্যা আমি জানি না। পড়ার চেষ্টা করে দেখেছি, হয়ে ওঠে না। বইয়ে কত রকম মানুষ আর চরিত্রের সন্ধান মেলে, ওদেরকে ভালোবাসা যায়, ঘৃণাও করা যায়। কখনো-কখনো, সে ভালোবাসা এতোটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, লেখককে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। আর প্রবল ঘৃণার জন্ম নিলে, লেখককে খুন পর্যন্ত করে ফেলতে ইচ্ছে করে। বিভিন্ন গল্পের চরিত্রগুলোকে ভালোবাসার একটা সুবিধেও আছে, সাথে আছে অসুবিধেও। এই যেমন, আমার প্রিয় মানুষটি যদি কোনো উপন্যাসের চরিত্র হতো, তবে সে চরিত্রকে নিঃস্বার্থভাবে যতই ভালোবাসি না কেন, দেখা করার বা কথা বলার ইচ্ছেটা জাগত না, কারণ, সে সুযোগই তো নেই! শুধু মনে থেকে যেত, একটা অতৃপ্ত বাসনা—ইশ্! এমন একটা মানুষ কেন বাস্তবে নেই? আবার চরিত্রটি বাস্তবে পেয়েও যদি ইচ্ছেগুলো পূর্ণ না হয়, তখন মনে হয়, এটা উপন্যাসের চরিত্র হয়ে থাকলেই তো ভাল ছিল, আর কিছু হোক না হোক, মুগ্ধতাটুকু নষ্ট হয়ে যেত না! কিন্তু বাস্তবতা বলে, অপূর্ব কিছুর কল্পনা আসলে সবই শূন্য—কেবলই একটা ‘অবচেতনা’কে চেতনমনে ধারণ করে রাখা, আর একরাশ মুগ্ধতায় ডুবেথাকা। সে রাখাটা—হয়তো ঠিক, নয়তোবা ভুল। আর তার চাইতে বড় কথা যা, তা হল….ইয়ে মানে, ঘুম পেয়ে গেছে……রাতের আকাশের বিশালতাকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে……তাই, সবকটা জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়েছি। সত্যি-সত্যি ঘুম পেলে, আবার অতো ভালোবাসাটাসা কীসের বাপু?……শুভরাত্রি……..ও একটা প্রশ্ন—না থাক, আরেকরাত। নাহ্! করেই ফেলি। না করলে, ঘুমই হবে না। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের সময় যদি ফেসবুক থাকতো! হায়য়য়য়……এক গীতাঞ্জলি লেখা, আর হাজার গীতাঞ্জলি সমান কমেন্টস্! তখন উনি কী করতেন? উত্তরটা দিয়ে দিন তো দেখি! আমি ভাবি, রবীন্দ্রনাথ সত্যিই বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন! আহা আহা!….কিছু প্রিয় প্রাণের কাছ থেকে দূরেই যেন থাকতে চাই। এ দূরেথাকা কেবলই দূরে থাকার জন্য নয়, কাছে আসার তীব্র ইচ্ছেই আমাকে দূরে সরিয়ে রাখে…. ওই যে, দূরে থাকলেই খোলা থাকে যে কাছে আসার অপশনটা, আর কাছে আসলেই যে খুলে যাবে দূরে সরে যাওয়ার অপশনটা! প্রথমটাই থাকুক না চিরকাল! মায়া বাড়িয়ে সত্যিই কী লাভ? কিছু মায়া, সত্যি-সত্যি কমে যাক। আমরাও বেঁচে যাই। সবকিছুই যে মিলিয়ে যাবে ওই এক শূন্যতায়ই। আহ্! মায়া……নিঃশ্বাসে-নিঃশ্বাসে কেবলই মায়া……এবার সত্যি-সত্যিই, প্রিয় মানুষের মনটাকে হাগ, মানুষটাকে শুভরাত।
ভাবনা: সাতচল্লিশ।
……………………..
“সাদা ধবধবে শার্টের ভেতর থেকে তার স্তন দুটি ফুটে উঠেছে……..” এই লাইনটা আমার জীবনে বইয়েপড়া প্রথম অশালীন কথা। তখন স্কুলের নির্দিষ্ট বইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই একেবারেই পড়া হত না। তবে, সে বইগুলো যেভাবে পড়তাম—তাতে পরীক্ষার খাতায় নম্বর পেতাম কম, কিন্তু আনন্দ পেতাম অনেক। সেসময় মনে হতো, ওসব নম্বরফম্বর পেয়ে কী হবে? আনন্দই তো সব! যারা আমার পড়া দেখে ভাবত, পৃথিবী উল্টে ফেলব, রেজাল্টের দিন দেখা যেত—যেমন পৃথিবী, ঠিক তেমনই আছে, বরং আমিই উল্টে বসে আছি। ক্লাস ফাইভের পর আর কোনোদিনই আমার রোল এক হয়নি, গুণোত্তর প্রগমনে দুই চার আট হয়ে গেছে। জোড় আমায় বড় কাছে টানত। মনে পড়ে, তখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। ফার্স্টগার্ল মৌরি, খুব ভাল মেয়ে। ওর সাথে আমার সখ্যতা বেশ ভাল। অকারণেই মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবাসত। আমি আমার জীবনে কখনোই কাউকে, সে কে, কী ইত্যাদি দিয়ে বিচার করি না, শুধুই ভেতরের মানুষটাকে দেখি এবং আমিও চাই মানুষ আমার ভেতরের ‘আমি’টাকে ভালোবাসতে পারলেই কেবল আমাকে ভালোবাসুক, অন্যকিছু দেখে নয়। আমি বরাবরই, ভেতরেবাইরে খুবই সাধারণ। ক্লাসে সেসময় আমার বান্ধবীরা আমার চেয়ে অনেক উন্নত জীবনযাপন করত। মৌরি তার জন্মদিনে একটা গিফট পেত যত টাকার, সেই টাকায় আমাদের সারামাসের কাঁচাবাজার হয়ে যেত। বিশেষ কোনো উপলক্ষে কে কত দামি গিফট দিয়ে নিজেকে জাহির করবে, সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আমি কখনোই থাকতাম না, কাউকে কোনো গিফট দিতাম না, কিন্তু ভালোবাসাটা ঠিকই পেতাম—যতটা বান্ধবীদের কাছ থেকে, তার চেয়ে অনেকবেশি, তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে। তবে, সব ভালোবাসাতেই যন্ত্রণা থাকে। ওটাও নিতে হয়েছে প্রচুর। একদিন খুব জোর করে, মৌরি ওদের বাসায় আমাকে নিয়ে গেল। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি, সেটা দামি-দামি শোপিস আর ফার্নিচার দিয়ে সাজানো এক রুম, এক কোণায় বিশাল এক আলমারিভর্তি বই; বাসার সবকিছুই অপরিচিত লাগছিল, ওই বইগুলো দেখেই কেবল আপন মনে হল। “সব বই কি তুই পড়েছিস?” “হুমম্…..তুই পড়বি?” “আমার তো বই পড়ার অভ্যেস নেই। ঠিক আছে দে দুইএকটা।” মৌরি, ফেরৎ দিতে হবে, সেই শর্তে দুইটা বই দিল—একটা রবিনসন ক্রুসোর, আরেকটার নাম মনে নেই……..সেই নাম মনে না থাকা ভ্রমণকাহিনীর বইটা বাসায় বসে-বসে পড়ছি……হঠাৎ চোখে ওই বিশেষ লাইনটা এসে পড়ল। এসেই জ্বলজ্বল করতে থাকল—চোখে, মনে। বারবারই, ওই পৃষ্ঠাটা উল্টে-উল্টে ওই লাইনটাই পড়তাম, আর মনে হতো, কেউ দেখে ফেলছে নাতো আমাকে? নিজেকে অনেকটা জোর করেই ভাবালাম, “ছিঃ ছিঃ! এসব কথা বইয়ে লেখা থাকে নাকি!? মৌরি এগুলো পড়ে? ওকে এত গার্ড দিয়ে কী লাভ হবে!?” বাবা-মার একমাত্র আদরের মেয়ে বলে, মৌরির সাথে সবসময়ই ওর এক চাচা গার্ড হিসেবে থাকতেন। সারাক্ষণই মৌরির সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকতেন। আমার ধারণা ছিল, উনি কেবল বাথরুম করার সময়টাতেই মৌরির পাশে থাকেন না! বাকি সবটা সময় থাকেন। অতি অসহ্য! মৌরির ধারণা, ও যাতে প্রেম করতে না পারে, সেজন্য এই বডিগার্ড। তবে, সেই গার্ড শেষ পর্যন্ত আর কতটা কাজে দিয়েছে জানি না। শুনেছি, ও নাকি ওর মেডিকেলের এক স্যার, মানে, এক ডাক্তারকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে।……..যা-ই হোক, ওই লাইনটা পড়ে ভেতরে-ভেতরে কেমন-কেমন যেন একটা কিছু ফিল করলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো, হঠাৎই যেন বড় হয়ে গেলাম! কিছু একটা যেন হল……..কিছু একটা…….লিখে বোঝানো যায় না, এমনকিছু একটা। বইটা সাথে-সাথেই লুকিয়ে ফেললাম! অন্য কারো কাছ থেকে না, নিজের কাছ থেকে বাঁচতেই বইটা লুকালাম। আজ কতগুলো বছর পার হয়ে গেল……সময়ে-সময়ে ইচ্ছেয়, অনিচ্ছেয় কিংবা উদার আধুনিকতার কল্যাণে কত কী যে দেখা হল, পড়া হল, জানা হল, শোনা হল। কিন্তু, সেই একটা লাইনের অনুভূতি এখনও একই অবিকৃত অবিনশ্বর অবস্থায় আছে। এমনটাই থাকবে বোধহয় সবসময়ই। কিছু-কিছু প্রথম অনুভূতি, শরীর আর মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলাটা সম্ভব নয়। এখন আমি নিজের বই না হলে, সে বই পড়িই না, কিন্তু আমার প্রথমপড়া বইটিই ছিল অন্য কারো, এবং বইটা……..। এসএসসি’র পর মৌরি ঢাকায় চলে গিয়েছিল। ওর সেই বই দুটো ফেরত দিয়েছিলাম কিনা মনে নেই। যদি না দিয়ে থাকি, সত্যিই খুব খারাপ কাজ করেছি! আপনাকে সাক্ষী রেখে, মৌরিকে ‘সরি’ বলে দিচ্ছি! “সরি বোন, সত্যিই সরি…..” বই ফেরৎ না দেয়াটাও একটা সিরিয়াস ক্রাইম! মানুষ, কতটা অন্যের ভাল চেয়ে, ওকে বিশ্বাস করে একটা বই পড়তে দেয়, আর সেটা যদি ও মেরে দেয়, তবে ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না? কেউ-কেউ বই ফেরত দিতে ভুলে যায়। সেটাও এক ধরনের ভ্রান্তিবিলাস। ওটারও শাস্তি হওয়া উচিত। আমার একমাত্র শাস্তি—আমাকে স্প্রাইট দিয়ে ভিজিয়ে মুড়ি খেতে হবে…..হিহিহিহি……..
ভাবনা: আটচল্লিশ।
……………………..
রাগ হলে, কার কী করতে ইচ্ছে করে জানি না, আমার ইচ্ছে করে, ভালোবাসার মানুষটিকে, খুব করে আদর করে দিই—যতটা করা যায় ততটা, যতটা করা যায় না, ততটাও। হয় ন্যায়ভাবে শরীরী আদর, নয়তো শুধুই মনের আদর। মনের আদর অনেকেই বোঝে না, ভাবে, শরীরই সব—তখন রাগ হয়, সত্যিই ভীষণ রাগ হয়। মনচোরের স্থান, শরীরচোরের অনেক উপরে। মনচুরিটা সারাজীবনের জন্য, আর শরীরচুরি? সে তো ক্ষণিকের। এ সহজ সত্যটাই কেউ বোঝে না। এসব মাথায় এলে, রাগে, দুঃখে নিজের মাথার চুল যে ছিঁড়ব, তারও উপায় নেই, কারণ, আমার চুল সংখ্যায় খুবই কম! কত কম, বলছি…….গোনা যায় না, তবে দেখলেই গুনতে ইচ্ছে করে—এমন। রাগ হয় খুউব। রাগ করতে ভালোবাসা লাগে, কিন্তু রাগ প্রকাশ করতে যে অধিকার লাগে! অধিকার ছাড়াই রাগের প্রকাশ, মানুষকে ছোট করে দেয়—নিজের কাছে, রাগটা যার সাথে, তার কাছেও। ভালোবাসা থেকেও এক ধরনের অধিকারবোধ জন্মায়, তবে সে অধিকার-বেচারা বড়ই অসহায়—তাকে দিয়ে সব হয় না। উফফফ্! এসব লিখছি আর হাতটা জ্বলছে। প্রায়শই, হাত পুড়েযাওয়াটা—নিয়ম হয়ে গেল নাকি! আশ্চর্য! আমি উজবুক এতো সুন্দর করে হাত পুড়েযাওয়াটাকে মহিমান্বিত করছি কেন? বার্ন ইউনিটের রোগীদের অসীম কষ্ট, একবিন্দু বুঝতে পারা ছাড়া এর আর কোনোই ভাল দিক নেই। ইদানিং হয়েছে কী, আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই, সবাই উত্তর দেয়, “জানি না।” “জানি না” তো একটা তির্যক কথা! এর মানে, আমি তির্যক কথা শোনার যোগ্য। কান্না পায়—হুহুহুউউউ…….কাঁদতে পারি না, কাঁদলে আমার চোখের জল চেটেপুটে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। চোখের জলের কী দারুণ স্বাদ!
টেবিলের সুন্দর গ্লাডিওলাস- কেন মনটাকে ভাল না করে খারাপ করে দিচ্ছে, সেটা মাথায় আসতেই ফুলগুলোর ওপর রাগ হলো! দূর ছাই! আমি ওদিকে আর তাকাবোই না!
ভাবনা: ঊনপঞ্চাশ।
……………………..
মানুষকে হয়তো অনেক ভালোবাসা যায়, কিন্তু সব রংয়ের ভালোবাসা, চাইলেই সবাইকে দেয়া যায় না। এটা খুবই স্বাভাবিক একটা সীমাবদ্ধতা—জীবনের। কেন জানি এই চিরচেনা সীমাবদ্ধতাটাই বড় বেশি কষ্ট দেয়। জীবনরঙের বিচ্ছুরণটা, প্রায়ই, ভালোবাসার নানান সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকে। আমি আমার মাকে অনেক-অনেক ভালোবাসা দিতে পারি—কিন্ত যেহেতু আমার বাবা বেঁচে নেই, তাই তার কাছ থেকে না পাওয়া ভালোবাসার কষ্টটা আমি মাকে কীকরে ভুলা্বো? আমি আমার ভাইকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোনের ভালোবাসাটাই না হয় দিলাম, কিন্ত তাতে তার প্রিয়জনকে হারানোর কষ্ট একটুও কমবে না, প্রিয়জনের কাছ থেকে ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট থেকেই যাবে। আমার ভাইয়া আমার বোনকে ভালোবেসে নিজের সাধ্যমতো পৃথিবীর সমস্ত বাহ্যিক সুখের ব্যবস্থাই নাহয় করে দিল, কিন্ত যে মানুষটি তার জীবনের সাথে জীবনভর মিশে থাকবে, সে যদি তাকে ভালোবেসে আগলে না রাখে, তখন যে আর অন্যকিছুই ভাল লাগে না। ওরকম কিছু হলে, জীবনযাপনকে, স্রেফ ঘুমভেঙে রাতের প্রতীক্ষা ছাড়া আর অন্যকিছু মনে হয় না। প্রিয় কোন বন্ধুর একাকিত্বে নাহয় নিজের জীবনের অনেকটা সময় দিয়ে দিলাম, কিন্তু তার আপনজনদের ভালোবাসা দেবো কীকরে? ছোট্ট শিশুটাকে সকল দামি খেলনা, প্রিয় সব খাবার আর ইচ্ছেপূরণের রমণীয় স্তূপে হয়তো ফেলে রাখতে পারি, কিন্তু তাকে মা-বাবার ভালোবাসা দেবো কীকরে? প্রার্থনা করি, প্রত্যেকটা মানুষ তার সাথে জুড়েথাকা প্রতিটা সম্পর্ককে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিক, ভালোবাসা দিক। আর না পারলে, দূরে বসে-বসে মিরিন্ডা দিয়ে ভিজিয়ে চানাচুর খাক! আর নতুন কোনো সম্পর্ক করা থেকে বিরত থাকুক। আছে কিছু মানুষ—পুরোনো সম্পর্ক ভাঙতে ওস্তাদ, নতুন সম্পর্ক গড়তে মহাওস্তাদ! হুহহহ্…… একটা কথা। বিশেষ কাউকে নিঃস্বার্থভাবে অনেক-অনেক ভালোবাসতে পারি, কিন্তু তাকে, ইয়ে মানে……….না থাক, কিছুনা, কিছুনা! ভেবে দেখলাম, নাহ্! মরীচিকা তো মিথ্যে নয়, মিথ্যে তো তা—যা মরীচিকা না হয়েও, মরীচিকার মতোই আচরণ করে। কাউকে আজ বলেছি…..মানুষকে ভালোবাসা আর সাহায্য করা—এই দুটো জিনিস, ফিরে পাবে না, এটা ভেবেই করবে। যদি ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা চাও, সাহায্যের বিনিময়ে সাহায্য চাও, তবে কেবল কষ্টই পেতে হবে। তাই, হয় নিঃস্বার্থভাবে কর, নয়তো একদমই কোরো না—যদি ভাল থাকতে চাও। কোনোকিছু এক্সপেক্ট করলেই, কষ্ট অবধারিত। মনে হল, আমার এই কথাটায় মেয়েটা কষ্ট পেল। কিন্তু, আমি তো ভুল কিছু বলিনি। তবে কেন পেল? কেউ-কেউ, সত্যটাকে নিতে পারে না, তবে সত্যটার যন্ত্রণার জন্য প্রতীক্ষায় থাকতে পারে। থাকগে! আর বলবো না কাউকে ওরকম করে। পৃথিবীর সব ভালোলাগা, ওদের নিয়মেই, ভাল থাকুক, ফিরে-ফিরে আসুক।……মাঝে-মাঝে মনে হয়, মানুষকে ভালোবাসা দেয়া এবং নেয়া—দুটোই ভীষণ অন্যায়! এমনই অন্যায়, যে অন্যায় ক্ষমা করে দেয়া যায় না! মানুষকে ছাপিয়ে যেন, ভালোবাসাটার উপরই বড় অভিমান হয়। আসলে, সবচাইতে বড় সত্য—সে সত্যটাই, যা সত্যের মনে লুকিয়ে থাকে। এক সত্যের মধ্যে অনেক মিথ্যে লুকানো থাকে, কিছু সত্যও লুকানো থাকে। ওইসব মিথ্যের এবং সত্যের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই সত্যটাকে শেষ পর্যন্ত সত্য করে তোলে।…….হায়! রাত পালিয়ে সকালই তো হয়ে গেল…..তবুও, ঘুম কেন আসছে না? নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। রাগে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।