ভাবনা: দুইশো উনচল্লিশ।
……………………………………..
মানুষ বিয়ে কেন করে?
বাবা বলে, বিয়ে কর। মা বলে, বিয়ে কর। সবাই বলে, বিয়ে কর। বিয়ে করার চাইতে জরুরি কাজ আর নেই।
এমন নয় যে, আমরা খুব গরিব, আমাকে আমার বাবা-মা খাওয়াতে-পরাতে পারছেন না, তাই আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতেই হবে। আমি যে পরিবারের টাকায় চলি, তাও না। আমি স্টুডেন্ট পড়াই, সে টাকায় নিজের সমস্ত খরচ চালাই। তবু, আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতেই হবে। আমার পরিবারের চোখে আমি যেন পরশুরামের ‘অচিন্তনীয়া অরক্ষণীয়া বিশ্বতরুণী’ এক! সবার মুখেই একটাই কথা………বিয়ে দিয়ে দাও! ভাবখানা এমন যেন আমাকে বিয়ে দিলেই আমাদের ফ্যামিলির প্রত্যেক সদস্যই কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়ে যাবে!
একদিন একটা ছেলে আসবে, আমাকে দেখবে, পছন্দ করবে! বলবে, ওয়াও! উইল ইউ ম্যারি মি?
ওকে দেখে সবাই বলবে, কী ভাল জব করে! কী হ্যান্ডসাম! ওর সাথেই বিয়ে দিয়ে দাও! ওর সাথে বিয়ে হলে ও কত সুখে থাকবে! এমন ছেলে হাতছাড়া হয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না! ব্লা ব্লা ব্লা…………
আমি তো খারাপ স্টুডেন্ট, প্রতি পরীক্ষায়ই হাসিমুখে সেকেন্ড ক্লাস পাচ্ছি! আমার কোনও লজ্জা নাই, আমার কোনও মেধা নাই। আমাকে দিয়ে আর কিচ্ছু হবে না! অতএব, আমার বিয়ে হবে………যাকে দিয়ে কিছুই হয় না, তাকে দিয়ে জগতসংসারের একটা কাজই হয়, সে কাজের নাম বিবাহ। আমার বিয়ে হবে, তারপর বাসর হবে। আহা, আহা! কী আনন্দ আকাশেবাতাসে! যে আমি কখনওই অন্য সবার মত হতেই পারিনি, সেই আমাকে অন্য সবার মতই, হাজার যুগের লক্ষ কোটি মেয়ের মতই………স্রেফ ঘর বাঁধতে হয় বলেই ঘর বাঁধতে হবে! বাজাও তালিয়া! সানাই বাজাও! সবাই মিলে আনন্দ করো!
আমার ভেতরের আমি’টাকে হত্যা করে আমাকে নকল মানুষ হয়ে বাঁচতে হবে। গভীর রাতে লিকলিকে একটি হাত আমার দিকে এগোবে, জড় পদার্থের মত আমাকে সে ধর্ষণ সহ্য করতে হবে, কেউ জানবে না, কোনও নারী নির্যাতন মামলা হবে না, আমার ভেতরের ‘আমি’ হত্যার কোনও বিচার হবে না। এর নাম সমাজের নিয়ম। বিয়ে কি তবে সমাজনন্দিত পতিতাবৃত্তি? এ কি বিয়ের মঞ্চ, নাকি বলির বেদী?
আমি নাকি একদিন সুখী হবো। সবাই নাকি সুখী হয়! সবাই সুখী হলেই আমাকেও সুখী হতে হবে? কিংবা, যা করলে সবাই সুখী হয়, ঠিক তা-ই করলে আমি সুখী হবোই হবো? এ রায়ই কি আমার জীবনচর্যা? নাকি সমাজের সংস্কারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শনের ফ্যাশন মাত্র? সবাই কি একই ধাতুতে গড়া? সবাই কি কেবল বিয়ে করার জন্যই বাঁচে?
বিয়ে করলে কী হবে? অন্য সবার মতই আমাকেও সংসার করতে হবে! সন্ন্যাসীর সংসার! আমাকে তার মত করে চলতে হবে, তার বাবা-মায়ের মত চলতে হবে। হবেই তো, না? এটাই তো নিয়ম, সমাজ আমার জন্য এটাই রেখেছে! আমি যে মেয়ে!
আমার সব স্বপ্ন কী সুন্দরভাবে নষ্ট হয়ে যাবে! আমার লেখিকা হবার স্বপ্ন, মানুষ হবার স্বপ্ন, মানুষের অশ্রু মোছানোর স্বপ্ন! সব হারিয়ে যাবে!
এ সমাজ কেমন সমাজ? প্রিয় মানুষটির হাত ধরলেও সমাজ তেড়ে আসে, আর একজন অপরিচিত মানুষের সাথে একই খাটে রাতের পর রাত কাটালেও সমাজ বলে, এইতো চাই!
যখন থেকে আমি বুঝতে শিখেছি, মানুষের চোখে জল আসে তার কষ্ট হয় বলে, তখন থেকেই আমি চেয়েছিলাম, একদিন আমি বড় হব শুধু ওদের জন্যই। মনে হত, ঈশ্বর যেন আমাকে কানেকানে বারবার বলে যান, “এ জন্যই তোকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছি। তুই মানুষের দুঃখ ঘোচাবি।” আমি যে বেঁচে আছি শুধু স্রষ্টার জন্যই, তাঁর নির্দেশ পালন করার জন্য। তা না করে আমাকে এখন কী করতে হবে? বিয়ে করতে হবে! বাহ্! বাহ্!
আমি জানি, বিয়ের পর সে কখনওই বুঝবে না আমাকে, সে আমাকে জানবেই না কখনও। কয়টা ছেলে স্ত্রীর দেহের সাথেসাথে মনের খোঁজও রাখে?
বিয়ের আগে হয়তো বলবে, তুমি যা চাও, তা-ই করবে। আমার কোনও আপত্তি নেই।
বিয়েটা হল। এরপর? নিজের আসল রূপটাই তো দেখাবেন পতিদেবতা, না?
কেন বিয়ে করতে হয় মানুষকে?
আমি কিচ্ছু চাই না, আমার যৌবনকে সফল করার জন্য কোনও পুরুষের দরকার নেই!
আমার শরীরের জন্য কোনও সঙ্গীর দরকার নেই!
আমি মেয়েমানুষ হয়ে বাঁচতে চাই না। আমি মানুষের সকল অধিকার নিয়ে বাঁচতে চাই।
আমি তো বৃত্তের ভেতরে বাঁচতে পারবো না! পারবোই বা কেন? আমি কি জানোয়ার? কেন জোর করে ওরা আমায় ওই অচেনা বৃত্তে বাঁধতে চায়?
আমি জানি, আমি বাঁধা পড়তে পারবো না, কারণ আমি তো মুক্ত হয়েই জন্মেছিলাম। তবু ভয় হয়। জানি, আমি দেবতা নই, শয়তানও নই, তবু এ সমাজ আমি মানি না। ওরা বলে, আমি নাকি আমার ইচ্ছে মত চলি! আমার তো ইচ্ছে, আমি অকুমারি হই, ওদের মতো প্রেম করি, আর বুকভরে দহনের স্বাদ নিই।
বাঙালি গোপনে চুরি করে, কোনও দোষ হয় না, আর ধরা পড়লেই ফাঁসিটাসি হয়ে যায়!
আমার কত কিছুই তো করতে ভাল লাগে না, তাও তো করি! আমার এইসব সার্টিফিকেট পাওয়ার পড়াশোনা ভালই লাগে না, কই, তাও তো পড়ি! আমার কাছ থেকে আর কী চাও তোমরা?
হ্যাঁ, আমি খুব বদমেজাজি! আমার যা ভাল লাগে না, তা আমি কেন করব, যা আমার ভাল লাগে, তা যদি করতে না পারি? আর ভুলের কথা বলছ? জীবনটা তো ভুল করার জন্যই! এ জীবনটা আগে কখনও কাটিয়েছি নাকি? জানব কীকরে, কোনটা ভুল নয়? আমাকে যদি শাস্তি দাও, মেনে নেবো। শাস্তি পাওয়ার সুব্যবস্থা আছে, কিন্তু ভুল করার অধিকার কি নেই?
আমি এ বৃত্ত থেকে বেরোতে চাই, আমি আমার হৃদয়ের স্বাধীনতা চাই!
ভাবনা: দুইশো চল্লিশ।
……………………………………..
আজ আমি তোমার কতটা জুড়ে আছি, হয়তো তুমি টের পাচ্ছ, কিংবা পাচ্ছ না, তবে যেদিন আমি হারিয়ে যাব, হৃদয়ের গহীনে আমার অস্তিত্ব ঠিক টের পাবে বহুগুণে!
আজ আমার বুকের হাহাকারটুকু হয়তো টের পাচ্ছ, হয়তো পাচ্ছই না, যেদিন হারিয়ে যাবো, সেদিনও কি তোমার হাহাকারটুকু কবিতায় ঢেলে দিয়ে চুপ মেরে থাকবে?
তুমি থাকো জুড়ে সকল ভাবনায় আমার,
এ মন কেমন বুঁদ হয়ে থাকে তোমাতেই শুধু,
কোন যাদুমায়ায় টানছ যে আমায়,
অদ্ভুত এক শিহরণ জেগে মনকে ভাসায়………
ওই দুটি চোখ কেমন যে পোড়ায়, জানতে যদি!
আমি পুড়ে যাই, আমার ছাইটা কবিতা হয়ে যায় তোমারই খাতায়,
এ প্রেম কেমন, এ টান কেমন, যায় না যে মাপা কিংবা ধরা!
তোমার কবিতা বাড়ে, আমি আরও পুড়ি, সে ছাই তোমার কবিতা হয় যে পাতায়-পাতায়,
এ দহন আমার শেষ হয় না, তোমার কবিতাও হয় নাকো শেষ!
বোঝোনি কিছুই? ওগো প্রিয় তুমি এত বোকা কেন?
তোমার মনের আবেগ যত, আর ভালোবাসা,
সবই যদি কাগজে পোড়াও, তবে বলো প্রিয়, আমার কী আছে?
এই আমি যে ভেতরে বাইরে যতই পুড়ি, এই তুমি তো ততই পুড়,
আমার ছাইটা যায় না যে রাখা,
তোমার যে ছাই, যায় নাতো দেখা!
তুমি যত পুড়, কবিতা আসে,
আমি যত পুড়ি, কবিরা হাসে।
এই যে শোনো, তুমি খুব বড় মাপের একজন মানুষ। হাজারহাজার মানুষের ভালোবাসা পাওয়া সহজ কথা নয়। তুমি একদিন অনেক বড় হবে, দেখো! একদিন অনেক বড় একজন লেখক হয়ে যাবে। যদিও আমার কাছে তুমিই সেরা লেখক। তোমার প্রতিটি লেখা কতটা শিহরিত করে মানুষকে, তুমি কি জানো?
আমি জানি, তুমি কতদূর যেতে চাও, কতটা পথ হাঁটতে চাও, কোথায় গিয়ে পরিশ্রান্ত হতে চাও। দেখো, তুমি একদিন ঠিক সেখানে পৌঁছে যাবে। আমি আজ তোমায় যতটা ভালোবাসি, সেদিনও তোমায় ততটাই ভালোবাসব। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বাড়বে বৈ কমবে না।
তুমি যেদিন বুড়ো হয়ে যাবে, মৃত্যু আসিআসি করবে, তোমার মনে হতে থাকবে, তোমার এতশত গল্পকবিতা কি হারিয়ে যাবে তোমার মৃত্যুর পর? নাকি তোমার এই অর্জনগুলিকে ভেতরে ধারণ করবে কেউ একজন? হয়তো সেসময় তোমার ছেলেমেয়েদের কথা তোমার মনে পড়বে। কিংবা, এমন কেউ তোমার মনে আসবে যে তোমায় অনেক ভালোবাসে, তোমার লেখাকে ভালোবাসে। তুমি বুড়ো হয়ে যাবে, তবু তোমার প্রেমিকা কখনও বুড়ো হবে না। আর যদি সত্যিই তোমার স্ত্রীর কোলজুড়ে তোমার বাবুসোনারা পৃথিবীতে আসে, এবং তোমার ভ্রূণের জোরে তোমারই মত কিউট আর মাথাভর্তি কিলবিল করা প্রতিভা নিয়ে আসে, তবে কী যে হবে! ওরাই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। তুমি ভেবো না…………
আমাকে কি তুমি চেনো? সত্যিই জানো আমাকে? আমি তো তোমার জীবন হতে ছিটকেপড়া এক নক্ষত্র। তোমার বাস্তবে আমার কোনও ঠাঁইই নেই। কোনওদিনই আমি গলাউঁচু করে বলতে পারব না, তুমি যে আমার কে হও! তুমি আমার কতটা জুড়ে থাকো!
আমি তোমায় যতটা ভালোবাসি, ততটা ভালোবাসি তোমার পরিবারকে। যতটা ভালোবাসি তোমার কবিতাকে, তোমার প্রতিটি লেখাকে, যতটা ভালোবাসি তোমার তপ্ত নিঃশ্বাসের উমটাকে, যতটা ভালোবাসি তোমার হাসিটাকে, যতটা ভালোবাসি তোমার শরীরের ঘ্রাণটাকে, যতটা ভালোবাসি তোমার প্রতিটি কথাকে, আর কেউ কি বাসে তোমায় এমন ভালো? ভেবে বলো তো!
তোমার মনে পড়ে, আমি তোমার কাছে একটা সন্তান চেয়েছিলাম? কেন চেয়েছিলাম, জানো? যাতে ওর শরীরে আমি তোমার ঘ্রাণ খুঁজে পাই, যাতে তার হাসিটা, তার চোখদুটো, তার হাতদুটো………তার সবকিছুই যাতে তোমার মত হয়। যাতে ওকে দেখলে আমার মনে হয়, এইতো আমার প্রিয়র কার্বনকপি! কে বলেছে আমি পাইনি তাকে?
শোনো, তোমার ভ্রূণের সন্তান লাগবে না আমার, দিয়ো না আমায় ওই অধিকারটুকুও। আমি আমার হৃদয়ের পুরোটা জুড়ে তোমায় রেখেছি। আমার চারপাশ জুড়ে তোমার অস্তিত্ব ঘুরে। অন্য কারও ভ্রুণে জন্ম নিলেও আমার বাচ্চা দেখো, ঠিক তোমারই মতন হবে। আমার সবটুকু জুড়ে যে তুমি, আর সবটা নিয়েই তো ও এই পৃথিবীতে আসবে, তাই না, বলো? ও ঠিক তোমারই মত হবে, দেখো! তোমার সবকিছুকে আত্মস্থ করাব আমি ওর মাঝে। এটাই আমার প্রার্থনা।
এমন মায়াভরা একটা সকাল প্রতিদিনই হলে মন্দ হত না। শুধু আজই নয়, যেদিন প্রথম তোমার কণ্ঠ শুনেছি, সেদিনই মনে হয়েছিল, এই কণ্ঠটার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে! মাকে একদিন এটা বলায়, মা আমাকে পাগলি বলেছে। হাহাহাহা……… আচ্ছা, ওসব বাদ। লজ্জা লাগে আমার। এখন তোমার একটা লেখা পড়লাম। ভাল থাকতে শেখা, খারাপ থাকতেও। অসম্ভব সুন্দর। জানো, তোমার প্রতিটি লেখা হৃদয়ে অন্যরকম ভাললাগা সৃষ্টি করে। যদি কেউ নিবিড় মনে তোমার যেকোনও লেখা পড়ে, সত্যি সে প্যারালাইজ্ড হলেও উঠে বসবে! এতটাই হৃদয় কাড়ে………এতটাই!
কাল সকালে পরীক্ষা আছে, আসি।
ভাবনা: দুইশো একচল্লিশ।
……………………………………..
আমার মনে হচ্ছে, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। একাকিত্ব, মানুষের নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, সবকিছু মিলিয়ে আমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। এত চেষ্টা করেও কষ্টগুলোকে ছাপিয়ে উঠতে পারছি না।
আশেপাশের মানুষগুলো আমার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলছে। চারপাশের মানুষ যেন আমাকে সহ্যই করতে পারে না। আমি বুড়ি হয়ে গেছি, ডিভোর্সি লোক লাগবে আমাকে বিয়ে দিতে, আসছেন উনি……পড়াশোনা করে জজব্যারিস্টার হবে, দেখবো আমরা! আরও কত কথা, এতই যে, বলে শেষ করতে পারব না। বাবা-মা’কে নানান কথা শুনতে হয় তাদের কাছে। বাবা পাউবি’র রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ার। তারা বলে, মেয়েকে পার করতে পারল না, বড় চাকরি করে কী লাভ হল? একটা মানুষও কেন যেন সহ্য করতে পারে না আমাকে! শুধু বাবা-মা’র কাছ থেকেই সাপোর্ট পাই আমি।
বাবা-মা হজ্জ-এ গেলেন। সবাই বলল, হজ্জ-এ গেলে তাদেরকে মৃত ধরে নিতে হয়, সেখান থেকে ফিরে আসাটা নাকি বোনাস!
আমার ভাইয়া, সে সারাদিন অফিসে থাকে। রাতে আসে। সারাদিন বাসায় একা পাগলের মত লাগে।
এত কিছুর মাঝে, আমার বয়ফ্রেন্ড, যাকে সবচে আপনজন আর বড় ভরসা ভেবেছিলাম, হুট করে সে আর সম্পর্ক রাখবে না জানিয়ে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। ৬ বছরের সম্পর্ক, এমনিতেই বাবা-মা পাশে নেই বলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি, আর সে আমার কথা একবারও ভাবল না।
আমার কোনও বন্ধু নেই, ছেলে বা মেয়ে। তার কথায় কারও সাথেই মিশতাম না, তাই বন্ধু নেই। আর সে-ই আজকে আমায় ছেড়ে চলে গেল!
কোনও কিছুই ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে, আমি একা একটা অন্ধকার কবরে পড়ে আছি, আর সবাই আমাকে ইচ্ছামত খোঁচাচ্ছে, কষ্ট দিচ্ছে।
আমার কথাগুলি শোনারও কেউ নেই আমার। দুনিয়াটা যেন আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে, আমার দিকে হাসছে আর বিদ্রূপ করছে। যতক্ষণ জেগে থাকি, কাঁদি। কেউ নেই আমার পাশে, কেউই না।
“নীল তিমি গেমস্টার মতই আমি নিজে আমার জীবন নিয়ে খেলে চলেছি! যদি বলি, আমিই সেই গেমের অ্যাডমিন…………হাহাহাহা………সবাই জীবন নিয়ে খেলতে পারে না। সেই মাত্রার বুদ্ধিমত্তা আর সাহস সবার থাকে না। কারণ, নিজের জীবন নিয়ে খেলতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষই মারা পড়ে।
কে কী বলল, তাতে আসলেই আমার কিছু এসে যায় না, কারণ আমি জানি, আমি নিজে কী, কতটুকু পারি।
কিন্তু তুমি কিছু বললে সেটা অন্য কিছুই হয়ে দাঁড়ায় আমার জন্য। তোমার বলা প্রতিটা শব্দের গুরুত্ব আমার কাছে অন্য এক মহৎ মাপকাঠিতে বিচার্য। সেটা তুমি জানো। আর জানো বলেই এতটা কঠিন কথা, এমনভাবে বলতে পারলে? এত বেশি অবহেলা করছ আমাকে?
বাসায় ফিরেছি মাত্র। তোমাকে পাঠানো প্রথম ছবিটা খেয়াল করলে তুমি বুঝবে আমি মাথায় ঘোমটা দিয়েছি। অনেকে এটাকে বিদআত বলবেন হয়তো। কিন্তু আমি তা মনে করি না। তোমাকে ভালোবাসি বলেই মাথায় ঘোমটা দিয়ে তোমার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছি। তাই এটা আমার জন্য বিদআত নয়, ইবাদত। তোমাকে ভালোবেসে ফেলার পর আমি আর আগের আমি তো নেই। তাই এই পরিবর্তন এনেছি নিজের মধ্যে।
আজকে এক স্যার ডেকে নিয়ে আমাকে বললেন, “আমি বড় ভাই হিসাবে কথাটা বলছি। আপনি ভেবে দেখেন, বাসায় জানান……ছেলে খুব ভাল সদ্বংশীয়, মা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, বাবা ব্যবসায়ী। ছেলে উঁচালম্বা আছে, কৃষি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার।
আর বেশি শুনতে ভাল লাগে না। আমি তো আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম। আমি তোমার চেয়ে যোগ্য কাউকে ছাড়া বিয়ে করবো না। আর এখন যোগ্য বা অযোগ্য কাউকেই করবো না। তোমার কাছে যাবার আগে অনেকবার ভেবে তবেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। আমার কোনও টিনেজারের মতন ঝোঁক ছিল না। এটা ঠিক, তোমার পরিচয় আমি কাউকে দিব না। কিন্তু আমার মনের পরিবর্তন যা ঘটে গেছে, তাতে তো আগের আমি’টা আর ফিরে পাবার নয়, তাই না? আমি জেনেবুঝে পরিণাম ভেবে তবেই এগিয়েছিলাম। তুমি আমাকে বাজে মেয়ে, ফালতু, যা খুশি বলতে পার, কিন্তু সত্য এটাই যে যা হয়েছে, তা হয়েই গেছে। আর আমি কখনওই চাই না আর কাউকে গ্রহণ করতে। স্যারের কথা বাসায় জানানোর প্রশ্নই আসে না। আস্তে করে ওই স্যারকে বলে দিব, আমার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”
চিঠিটা ওকে লিখেছিলাম কয়েকদিন আগে, দেয়া হয়নি, অপ্রকাশিতই ছিল। আজ প্রকাশ করলাম।
ভাবনা: দুইশো বিয়াল্লিশ।
……………………………………..
আচ্ছা, সকল নারীবাদী নারী কি একে অপরের সাথে কপালের বড় টিপ দ্বারা সংযুক্ত? সবাইকেই কি কপালের চেয়েও বড় এক টিপ পরতেই হবে? কিছু নারীবাদীকে দেখেছি, নিজস্ব তেমন কোনও মতামত থাকে না। আমার ধারণা, অধিকাংশ নারীবাদীরা নিজেরাও জানেন না, আসলে তারা কী চান! তারা কেবল অন্যদের সাথে অর্ধেক বুঝে, না বুঝে সুর মেলান। নারীদের যে সুবিধা, স্বাধীনতা, বা অধিকার……যা-ই বলি না কেন, এইসবের জন্য তাঁরা নারীবাদের চর্চা করেন, তবে আমার কাছে মনে হয়, তারা সেই সুবিধার আনার চাইতে বরং আরও বেশি অসুবিধাই তৈরি করেন। অনেককেই দেখেছি, নারীবাদচর্চা করতে গিয়ে উনাদের অনেকেই এক-একজন পুরুষ হয়ে ওঠেন। কেন এমন হতে হবে? নারীর বেশে থেকে নারীর অধিকারের জন্য কাজ করা যায় না?
পুরুষের মতন নির্লজ্জ হওয়ার মধ্যে যে স্বাধীনতা নিহিত, সেটা নারীবাদ নয়, বড়জোর পুরুষতান্ত্রিক সুবিধাবাদ। মুখের কোণায় সারাক্ষণই নিভানো সিগ্রেট গুঁজে ব্যক্তিগত অভিরুচির প্রকাশ ঘটানো যায় বটে, তবে নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যৌন স্বাধীনতা কিংবা যৌন স্বেচ্ছাচারিতা কোনও নির্দিষ্ট বলয় কিংবা গোষ্ঠীর নিজস্ব মতামত আর জীবনযাপনের আদর্শ হতে পারে, তবে তা কোনওভাবেই ব্যাপক অর্থে নারীবাদ নয়। বিয়ে, কিংবা বিয়ে বহির্ভূত যেকোনও সমকামী কিংবা বিপরীতকামী সম্পর্ককে বৈধতাদানের প্রক্রিয়া সমাজের একটি অংশের নারীদের ব্যক্তিগত অভিমতের প্রতিফলন ঘটায়, মানছি; তবে তা সমাজের সংখ্যা-মহাগরিষ্ঠ অংশের জীবনযাপন ও বিশ্বাসের সাথে বেমানান বিধায় সেটিকে আমার কাছে নারীবাদের শিশুতোষ সংস্করণ বলেই মনে হয়েছে সবসময়। নারীবাদের এমন রূপের প্রতি বীতস্পৃহ হয়ে যদি কেউ বিকল্প প্রস্তাব দেন, তবে অনেক পুরুষ নারীবাদীদের দেখেছি, একেবারে হৈহৈরৈরৈ রবে তেড়ে আসেন। ওইসব পুরুষের এ নারীবাদ অনুরাগের পেছনের কারণটা একটু ভেবে দেখলে কোনও বিশেষ অবারিত সুবিধা কিংবা দিকের প্রতি তাঁদের ঐকান্তিক আগ্রহের বিষয়টিই সঙ্গত কারণেই সামনে চলে আসে। অনেকে আবার নারীবাদের নামে নাস্তিকতার চর্চা করেন! নারীবাদ ও নাস্তিকতার এই খিচুড়ি উপাদেয় কিংবা কেতাদুরস্ত হতে পারে, তবে কোনওভাবেই প্রমাণসিদ্ধ কিছু নয়। নারীদের উন্নয়নের প্রকৃত ইচ্ছে যাঁর মধ্যে আছে, তিনি কখনওই সমাজের নির্দিষ্ট অংশের নারীদের মানসিক সান্নিধ্যে আসার জন্য কাজ করবেন না, বরং তাঁর উদ্দেশ্য ও কাজ হবে বাস্তবানুগ, নৈর্ব্যক্তিক, কেবলই প্রচারসর্বস্ব আর অসাড় নয়। অমন ভণ্ড স্ববিরোধী প্রচারবাতুল নারীবাদীদের হাতে নারীসমাজের কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন দেখার দুরাশা করি না। নারীবাদের প্রকৃত রূপ বিকশিত হতে দেখেছি বাহুতে কিংবা গলায় নয়, মগজে। নীরবে, তীক্ষ্ণ সপ্রতিভ চাহনিতে যখন কোনও নারীর ব্যক্তিত্ব কারও সম্মান ও মনোযোগ অর্জন করতে পারে, নারীর যথার্থ শক্তির প্রকাশ সেখানেই।
ভাবনা: দুইশো তেতাল্লিশ।
……………………………………..
কোনও এক উনিশে এপ্রিলে একটা ছোট্ট মেয়ে পৃথিবীতে এল। ওদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, তবে পরিবারে সুখ ছিল। মেয়েটির বয়স যখন ১ বছর, তখন ওর আরেকটি ছোটবোন হল। একে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল না, তার উপর আরেকটি সন্তানের জন্ম, তাই মায়ের কষ্ট একটু হলেও কমাতে বড় মেয়েটিকে ওর নানাবাড়িতে রেখে আসা হল। যখন থেকে মেয়েটি বুঝতে শিখল, তখন থেকে মেয়েটি বুঝল, সে একটি পরিবারের বোঝা হয়ে বেঁচে আছে। সে পরিবারের সকল সদস্যের রাগী চোখ, বিরক্তিমাখা মুখ, আর খোঁটা শুনে যাওয়া—এটাই ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন। কিন্তু সে ভেবে পেত না, সে এসব কাকে বলবে? কে বিশ্বাস করবে তার কথা? তাই মুখ বন্ধ করে সব সহ্য করে যেত সে, এখনও যাচ্ছে। খেতে বসলে সামনে মামি দাঁড়িয়ে থাকেন, তাকে খেতে হয় চোরের মতন, একটু বেশি খেয়ে ফেলে ভুলে, এ উদ্বেগ মাথায় রেখেই খেতে হয়ে ওকে। লোকে যে কতটা খারাপ ব্যবহার করতে পারে, তা সে খুব ভাল করেই জানে। এরপর সে বাড়ি থেকেই শুরু হয় তার স্কুল জীবন। সে প্রায়ই ভাবত, কার সাথে তার দুঃখের কথা শেয়ার করবে! কেউ যে নেই তার পাশে! ওর বাবার সময়ই নেই ওকে নিয়ে ভাববার। ওর নানুভাই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, ওর দিকে তাকানোরই অবসর নেই। তবু মেয়েটি তার নানুভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ, উনি ওকে বড় তো করছেন! এখন নাহয় ওকে অবহেলা করেন, কিন্তু একসময় তো ভালোবাসতেন। মেয়েটি খুব করে ওর মায়ের কাছে থাকতে চাইত, এখনও চায়, কিন্তু থাকতে পারে না। লুকিয়ে-লুকিয়ে ভীষণ কান্না করে প্রতিদিন। ওতে অবশ্য কিছুই বদলায় না। এসএসসি পাস করার পর মেয়েটি ভাবল, এইবার বোধহয় সে মায়ের কাছে থাকতে পারবে, কিন্তু ওর সে সৌভাগ্য হল না। ওর বাবা কিছুতেই চায় না মেয়েকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখতে। ওর নানাবাড়ির কাছেই একটা কলেজ আছে, সেখানে সায়েন্সের ভাল শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু ওকে সেখানেই ভর্তি করিয়ে দেয়া হল। কারণ একটাই, ওখানে পড়ার খরচ কম। সেই ছোটবেলা থেকেই মেয়েটার কত স্বপ্ন, সে একদিন বড় হবে, বাবা-মা’কে ভাল রাখবে। ও তো জানত না যে ওর জন্য স্বপ্ন দেখাও পাপ! ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় থেকেই মেয়েটা টিউশনি করে পড়ার খরচ চালায়, পুরনো ছেঁড়া জামাকাপড়েও দিব্যি চলে যায় ওর, ঈদ এলে কখনও কারও বাসায় গিয়ে জামা চেয়ে নিয়ে আসে, বাসা থেকে কখনওই ওকে পোশাক কিনে দেয়া হয় না। এসবেও ওর তেমন কোনও কষ্ট নেই, ওর দিন কেটে গেলেই তো হল, একদিন তো সে বড় হয়ে যাবে, ততদিন পর্যন্ত যে অপেক্ষা করতেই হবে! ওর কাজিনরা জিজ্ঞেস করে, কীরে, তুই এত খ্যাত্ কেন? হাহাহা…… ও কিছুই বলে না, শুধু হাসিমুখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ও খুব ভাল করেই জানে, টিউশনির টাকা দিয়ে নতুন জামা কিনে ফেললে যে পড়ার খরচটাই ও আর চালাতে পারবে না! কে ওকে টাকা দেবে? তাছাড়া, ওর মা যদি পুরনো কাপড় পরতে পারেন, তবে ও কেন পারবে না? ওর মা যদি শুধু ওদের দুই বোনের দিকে তাকিয়ে ওর বাবার হাতে মার খেয়েও দিনের পর দিন মুখ বুজে সব সহ্য করতে পারে, ১৬ বছর ধরে নিজের মেয়েকে অন্য বাসায় রেখে কষ্ট গিলে-গিলে নিজেকে কী এক স্বপ্নে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, তবে ও কেন পারবে না? মায়ের কথা মনে এলে ওর আর কোনও কিছুতেই একটুও কষ্ট হয় না, সব সহ্য করে নিতে পারে। ও এমনই এক দুঃখী সন্তান, যে কখনও বাবার আদর পায়নি, মায়ের আদর নেয়ার সৌভাগ্যটাও যার কখনও হয় না। ও জানে, ওর জীবনে এক কষ্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। ও লোকমুখে শোনে, ওর বাবা নাকি আরেকটা বিয়ে করেছে। সে ঘরে নাকি একটা ছেলেও আছে। বাবা সে ছেলের পেছনেই সব টাকা খরচ করে ফেলে। ওদের দুই বোনের জন্য টাকা খরচ করে কী লাভ? মা কখনও-কখনও টাকা জমিয়ে ওকে পড়ালেখার কিছু খরচ দেয়। ও এমনই এক সন্তান, যার পড়ালেখার খরচ যোগাড় করতে ওর মাকে নিজের স্বামীর মার সহ্য করতে হয়, অন্য লোকের বাড়িতে লুকিয়ে কাজ করতে হয়। যখনই মা সুযোগ পায়, বাবার পকেট থেকে কিছু টাকা সরিয়ে রাখে। কী আর করবে, বেচারি মা? আর কোনও উপায় নেই যে! মেয়েটা মাঝেমাঝে ভাবে, বাবার কাছে অনেক অভিমানভরা একটা বড় চিঠি লিখে সে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। দুইবার আত্মহত্যা করতে চেয়েও সে করতে পারেনি। ওর কীসের যেন ভয় করে! ও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে ওর মায়ের কী হবে? ও চলে গেলে মা যে আর বাঁচবেই না! এ ভয় কি না, কে জানে! মেয়েটার বাবা যে খুব গরিব, তা কিন্তু নয়। তবে ওর মা আর ওর ছোটবোনের জন্য বাবার কোনও টাকা নেই। মেয়েটি এখন আর তেমন কিছুই চায় না। ওর কোনও স্বপ্ন পূরণ হওয়ার দরকার নেই। ওর শুধু চাওয়া, যাতে ওর বাবা একটু ভাল হয়, ওর মাকে একটু ভালোবাসে, সৎ হয়ে জীবনযাপন করে, ওর মা আর ছোটবোনটা একটু ভাল থাকুক। মেয়েটার এইটুকু চাওয়াও কি আল্লাহ্ পূরণ করবেন না? কিছু মানুষের অনেক টাকা, গাড়ি, বাড়ি কিছুই লাগে না, এমনকি ওরা নিজেও সুখী হতে চায় না, স্রেফ ভালোবাসার কাউকে সুখী দেখতে চায়। আর কিছুই চায় না ওরা। তবু এটাও কেন হয় না? মানুষের এক জীবনে নাকি সব চাওয়া পূরণ হয় না। আর কিছু মানুষ থাকে যাদের কোনও চাওয়াই পূরণ হয় না। মেয়েটি কোন অপরাধে ওদেরই একজন হয়ে বেঁচে আছে? ও যে জন্মের পর থেকে কখনও কোনও অপরাধ করারই সুযোগ পায়নি! তবে কেন ওর জীবনটা এমন হয়ে গেল?
ভাবনা: দুইশো চুয়াল্লিশ।
……………………………………..
অ্যাইইইই…………
হুঁ।
শুন নাআআআ………অ্যাইইই শুনছ?
হুম্ বলো।
শ্যামল অফিসের জরুরি কাজ করছে বিছানায় বসে-বসে, আর পাশেই শরীর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে মায়া। কোনও কাজ না থাকলেও শ্যামলের সাথে জেগেথাকা মায়ার বহুদিনের অভ্যেস। কোনওভাবেই তাকে ঘুম পাড়ানো যায় না, এমনকি সে প্রচণ্ড অসুস্থ থাকলেও না। মায়া শুধু জেগেই থাকে না, প্রচণ্ড জ্বালায়ও। শ্যামল মাঝেমাঝেই রাগ করে, বিরক্ত হয়, বকাঝকাও করে, কিন্তু মায়ার মায়ায় সেসব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
বেশি জরুরি কোনও কাজ করছ, হুঁ?
হুঁ।
একটা কথা বলি?
শ্যামল একটা শক্ত ধমক দেবে ভেবে মায়ার দিকে তাকালো, কিন্তু ওর ক্লান্ত শরীর, প্রচণ্ড ঘুমে লাল হয়েযাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে ধমক দিতে আর ইচ্ছে হল না।
হুম্ বলো।
আমার নূপুরগুলি খুলে আবার একটু পরিয়ে দেবে?
আমার পাগলি একটা! রোজরোজ সেই এক কথা………এতে কী যে এক মজা আছে! সেটা কী, জানো? তুমি রোজ কথাটা এমনভাবে বল যেন আজকেই বলছ!
হিহিহিহি ভাল হইসে………
ভাল হইসে, না?!…………বলেই শ্যামল মায়ার পা দুটো কোলে এনে, আদর করে চুমু খেয়ে, প্রতিদিনের মত নূপুরগুলি খুলে, এক পায়ে নুপূর পরিয়ে দিতেদিতে মায়ার দিকে তাকিয়ে ওর দুষ্টমিষ্টি হাসিটা উপভোগ করছিল।
এমন সময় মায়া বলল, শ্যাম, আমি তোমায় খুব জ্বালাই, না? এমন একদিন তো সত্যিই আসবে যেদিন আমি তোমায় আর জ্বালাবো না, কিংবা নুপূর পরার ইচ্ছেরা কোথায় যেন পালিয়ে যাবে, তাই না, বাবু? আগেপিছে একজনকে তো সত্যিই একদিন চলে যেতে হবে, তাইতো, না? আচ্ছা শ্যাম, আমরা দুজন কেন এক সাথে যেতে পারব না? পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেন, বলতে পারো?
শ্যামল দুই হাতে প্রায় জাপটে ধরে মায়াকে বুকের কাছে টেনে এনে বলে, আমার মায়া, আমি বিশ্বাস করি না, তোমার এমন কথাগুলো আমাকে কতটা কষ্ট দেয়, সেটা তুমি বোঝো না। তবে কেন আমায় এভাবে আঘাত কর?
শ্যামলের চোখের জল শ্যামলের বুকে জড়িয়ে ধরেরাখা মায়ার মুখ হয়ে গড়িয়ে পড়ে………
মায়া জানে, শ্যামল নিজেকে কতটা লুকিয়ে রাখতে জানে………এমন করে নিজেকে ছেড়েদেয়া শ্যামলকে সহজে দেখা যায় না। শ্যামলকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়া প্রায় চিৎকার করে কাঁদতে থাকে………
কতটা রাত অবধি দুজন কেঁদেছে, কেউই তা জানে না। মায়া শুধু একবার খেয়াল করেছিল, ওর এক পায়ে নুপূর নেই……….
সকালে ঘুম ভাঙলে, ঘড়িতে চোখ পড়তেই মায়া দেখল, অনেক বেলা হয়ে গেছে। শ্যামল অফিসে যাওয়ার সময় মায়াকে আর ডাকেনি, নিজেই ডিম-পাউরুটি বানিয়ে খেয়ে নিয়েছে, আর বালিশের পাশে মায়ার জন্য বক্সে করে দুপিস রেখে গেছে। পাশে একটা কাগজে লেখা আছে—আমার মায়া পাগলি……….ভালোবাসি তো! একদম বেশিবেশি ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি!
ইসসস্ অ্যাত্তো ভালোবাসায়ও কেউ কাঁদে? আর কাঁদবো না, কোনদিনও কাঁদবো না!………এই ভেবেভেবে একটা ভাললাগার ঘোর নিয়ে মায়া বিছানা ছাড়তে গিয়ে দেখে……ওর দুপায়েই নুপুর………
মায়ার দুচোখ আবারও ভিজে উঠে………
ভাবনা: দুইশো পঁয়তাল্লিশ।
……………………………………..
১।
ডাক্তার যদি চেকাপের উদ্দেশ্যে শরীরে হাত দিয়েই পুরোপুরি এক্সাইটেড হয়ে চেয়ারে বসে পড়ে এবং ইয়ে! হয়ে গিয়ে তা প্যান্টের উপর পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়ে যায়!………তাইলে তো মহাসমস্যা!
ডাক্তার ডাক্তারি করবে কীকরে?
রোগীরা ডাক্তার দেখাবেও বা কীকরে?
“আমি দুঃখিত, আসলে আমি একটু এক্সাইটেড হয়ে গেসিলাম। আসলে আপনি অতিরিক্ত মাত্রায় ইয়ে মানে, ইয়ে………সেক্সি, শরীর এবং কথা, দুটোতেই।”
আজব ডক্টর কি গজব কাহানি!
২।
চিপা থেকে আবার ৭ হাজার টাকা পাইসি! মাঝেমাঝে এমন পাই………গ্যাবন ছুন্দর!
………হেহ্ হেহ্ হেহ্ এমন চিপাচাপার খোঁজ মিললে ভালই লাগে! তখন মনে হয়, ভুলেযাওয়া ব্যাপারটা দারুণ! টাকা কোথায় রাখি, সেটা ভুলে না গেলে কি এমন হঠাৎ-হঠাৎ পেতাম?
কিন্তু আসল কাহিনি হইলো, এই ৭ হাজার কেন, ২৭ হাজার পাইলেও, এই আমার যা, তা-ই থাকে, কিছুই হয় না………না লাভ, না লস।
টাকার প্রতি আমার কেমন যেন একটা অনীহা! নির্দিষ্ট খরচের বাইরে টাকা থাকলেই আমার অস্থির লাগে! ছোটবেলায়ও এটা ছিল। যেদিন স্কুলে কম টাকা নিতাম কিংবা টাকা নিতামই না, সেদিন ভালই থাকতাম, কিন্তু যেদিন বেশি টাকা নিতাম, সেদিন টাকা দিয়ে কী না কী কিনবো, সেটা ভেবেভেবে অস্থির আর বিরক্ত হয়ে অবশেষে কিছুই না কিনে বাসায় ফিরতাম।
এখনও নিজের হাতে নিজের টাকা থাকলে কেমন-কেমন জানি লাগে! তখন সব টাকা সংসারের কাজে খরচ করে ফেলি……আহ্ শান্তি!
এজন্য বরাবরই আম্মা বলে—ফইন্নি কোথাকার!
আমার কোনও কিছু কেনার প্রতি আগ্রহ খুব কম থাকলেও, আমি প্রায়ই শপিং সেন্টারে-সেন্টারে ঘুরি। সুন্দর-সুন্দর জিনিস দেখতে ভাল লাগে। সুন্দর ড্রেস, গয়না, ক্রোকারিজ বা শোপিস দেখলে, যারা এগুলোর ডিজাইন করেছে, তাদেরকে মনেমনে ধন্যবাদ দিই, তাদের সুন্দর মনের প্রকাশ দেখে আনন্দিত হই। এ আনন্দের দাম অনেক।
খুব দামি কিছু বা এমন কিছু, যা কেনার সামর্থ্য আমার নেই, এমন কোনও কিছু দেখে, কখনওই মনে হয় না, ইসস্ কেন আমার এটা নেই, ওটা নেই………আমি শুধুমাত্র দেখাটা উপভোগ করি। উপভোগ করে নয়, স্রেফ দেখেই আনন্দ খুঁজে নেয়া—এ অনেক কাজের একটা আর্ট!
৩।
একেবারে নির্দিষ্ট কিছু সম্পর্কের কথা বাদ দিলে সম্পর্ক বলতে হয়তো আসলে কিছুই নেই। সম্পর্ক হল, সময়কে সময় দেয়ার অসংখ্য উপাদানের মধ্যে একটা উপাদান মাত্র। সময় পার হয়……..উপাদান বদলায়………উপাদান বদলায়………সময় বয়ে চলে……কোনও উপাদানের স্থায়িত্ব বেশি, কোনওটার হয়তো কম। কিন্তু এদের কোনওটিই চিরন্তন নয়………..এ সত্যটা বুঝতে পারলে জীবনের অনেক কষ্ট কমে যায়।
কৈমাছ—আঘাত পেয়ে, মরে গিয়েও লাফায়………
তেলাপোকা—আঘাত পেলে, বেঁচে থাকলেও, মরার ভাণ ধরে…………(যাতে, সে মরে গেছে, এটা ভেবে, তাকে আর আঘাত করা না হয়…….)
কৈমাছ এবং তেলাপোকার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। জীবনে কখন কৈমাছ, আর কখন তেলাপোকার মত আচরণ করতে হবে, এটা বুঝতে পারলে, অনেক মঙ্গল…………