বৃথা নৈবেদ্য


এই করুণ নেক্রোপলিসের শুনশান নীরবতায়…
তোমার বুকের পাঁজরে, আমার আশ্রয়স্থল বেশ শক্তপোক্ত হলো;
আমার প্রকৃত সুখ কীসে, তা আমি আবিষ্কার করে ফেললাম—
আমার আত্মা শান্তি পেতে শুরু করে কেবল তখনই…যখন আমি লিখতে থাকি;
এই লেখালেখির মধ্যেই আমার সমস্ত অনুভূতি পুঞ্জীভূত—
যার সমস্ত গ্লানির সুর এই শব্দগুলোর সাথে প্রবলভাবে মিশে আছে।

কিছু চিঠি আমি লিখেছিলাম ঠিকই—
তবে তা কক্ষনো তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি।
সেই সময় মনে হয়েছিল, আমার মনের অনুভূতিগুলো প্রকাশের হয়তো এ-ই একমাত্র উপায়।
অনেকটা সময় পরে গিয়ে বুঝতে পারি—
ওসব কেবল সস্তা আবেগ ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমি যা লিখেছিলাম তোমায়…তা কি আদৌ অনুভব করতে পেরেছিলে তুমি? কখনও?
অবশ্য, এর সত্যতা জানা তেমন জরুরি নয়।

এই সহজলভ্য শব্দগুচ্ছের বাইরে চোখ রাখলে বোঝা যায়—
তোমার অদেখা পৃষ্ঠাগুলোই প্রকৃতপক্ষে আমার জীবন। তোমার এ কর্মব্যস্ত জীবনে, কিংবা বইয়ের ভাঁজে…
যাকে রোজ তুমি ছুঁয়ে দেখো পরম যত্নে…
সেই মুগ্ধতায় আমার জায়গাটাই-বা কোথায়?

কোত্থাও নেই আমি—মুহূর্তেই এক দমকা হাওয়ায় সমস্ত অনুভূতি ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেল।
যতবারই তুমি ভেঙে দিয়েছ আত্মদুয়ার—
আমি সৃষ্টিতে মগ্ন থেকেছি, তোমাকে গভীরভাবে ছুঁয়েছি—
এটি কখনও শিল্প হতে পারে না, এটি কেবলই অপারগতা।

শুভ্র! এই একটা জায়গাতেই আমি তোমার এত কাছাকাছি থেকেছি, দীর্ঘদিন…
ধীরে ধীরে তোমাকে স্পর্শ করেছি অনেকক্ষণ, ভীষণ যন্ত্রণায়!
এ সব কিছু কেবল তুমিই জানতে।
কিন্তু কই, এত কিছু জানা সত্ত্বেও তো একটি বারের জন্যও আমার ভেতরটাকে খুব গভীরভাবে আঁকড়ে ধরোনি!

তবুও, আমি কী ভয়ংকর নিবিড়তায় ভালোবেসে গিয়েছি তোমায়!
হঠাৎ, আমি এক আত্মবিধ্বংসী পরিকল্পনা করে বসলাম—এর জন্য আমাকে বহুদিন ধরে অনেকটা সাহসের সঞ্চার করতে হয়েছে।
তবে, আমার এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পারেনি কেউই, এমনকি তুমিও না।

আমি নিজেকে এতটা কষ্ট দিয়ে মারার পক্ষপাতী নই—এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
তবে শান্তিপূর্ণ এক সমাপ্তি তো ঘটতেই পারে, তাই না?

শুভ্র, দেখো…একদিন আমাদের মাঝে সব ঠিক হয়ে যাবে—এত এত অভিমান আর জমা থাকবে না, দীর্ঘসময়ের জন্য অপেক্ষাও করতে হবে না…
কিন্তু সেদিন তোমার বুকে মাথা রেখে…শান্তিতে অশ্রুবিলাস করার সুযোগটুকু আমি ঈশ্বরের কাছে চাই না, কী অদ্ভুত!

এই যে আমাদের মধ্যকার দূরত্বটা একনিমিষেই কমে গিয়েছে, খেয়াল করেছ?
কেননা, এই দূরত্বটা এখন আর আমাকে ভোগায় না।
এই আমিই কতই-না ভয় পেয়েছিলাম…
তোমাকে হারানোর;
তোমার থেকে নিজেকে সামান্যতম দূরে সরিয়ে রাখতেও…কতগুলো দিন কী যে ভীষণ দমবন্ধ লেগেছে, তোমায় বলতে পারিনি…
তুমি যে কখনও জানতেই চাওনি; বলি কী করে!

‘ভালোবাসা’ শব্দটিই খুব ওভাররেটেড! এই শব্দটি মুখেও এনো না।
আমি জানি, তুমি নিশ্চিতভাবেই এর অর্থ জানো না। এ নিয়ে এত মাথাব্যথা করার আছেটাই-বা কী?

আমি তোমাকে আর কক্ষনো ভালোবাসতে চাই না—শেষে তুমি বলে বসবে…”তুমি যা করেছ নিজের জন্যই করেছ, আমাকে ভালোবেসে…নিজেকেই ভালো রেখেছ।”

সত্যিই কি তা-ই? কাউকে ভালোবাসলেই কি নিজেকে ভালো রাখা যায়, শুভ্র?
আমার তো মনে হয়, কাউকে ভালোবাসলে বরং…
তোমাকে কেবল তারই ভালোতে কিংবা মন্দতে বসবাস করতে হবে—যার কোত্থাও তুমি নেই, একেবারেই নেই!
তার অনুপস্থিতিতে নিজেকেই তীব্র যন্ত্রণায় রাখতে হয়…যতক্ষণ অবধি তোমার দীর্ঘশ্বাস ভারী হয়ে না আসছে!
এক্ষেত্রে মৃত্যুযন্ত্রণা বেছে নেওয়াটাই বোধ হয় সহজ।

তবুও, বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসা ‘প্রত্যাশা’ ছাড়াই বেঁচেছিল কিন্তু!
ধুর! ওসব এক্সেপশনাল; ব্যতিক্রম কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিশ্চয়ই আদর্শ কিছু হতে পারে না।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কি তবে ভালোবাসার নিয়মকানুনও বদলে গেল? কে জানে!

আমার ভীষণ হাসি পায় আজকাল—কেউ যখন বলে, ভালোবাসি…
ওই যে বললাম, ইটস ওভাররেটেড!
আর এই একটা মাত্র অনুভূতি নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করারই-বা কী আছে?
কই…দুঃখ, ব্যর্থতা, গ্লানি—এই দামি অনুভূতিগুলো নিয়ে কেউ কথা কেন বলে না?

নিজের মধ্যেই রাখো, এগুলো কেউ শুনতে চায় না…
তবে তুমি যে আমায় ভালোবাসো…তা শুনতেই-বা চাইছেটা কে?

আচ্ছা, ‘ভালোবাসি’ শব্দটা শুনে শুনে অভ্যস্ত হবার মধ্যে কি আলাদা কোনো সুখ আছে নাকি? হাস্যকর!
অনেকে আবার শুনেছি পর্যাপ্ত আবেগ ছাড়াই খুউব করে ভালোবাসতে জানে—এই প্রজাতিকে নাকি পরিপক্ব মানুষের কাতারে ফেলা হয়ে থাকে! হা হা হা! এ-ও সম্ভব?

“সবই সম্ভব, প্রিয়।”
কাছের মানুষের স্পর্শতেও…ভীষণ রকমের ভালোবাসা ঘিরে আসে, সমস্ত শরীরজুড়ে…
এতে শুনেছি, শরীর ও মন দুই-ই সাময়িক সময়ের জন্য পরিতৃপ্ত ও চনমনে থাকে।

এই ব্যাপারটা কিন্তু বেশ ভালো—দু-জন মানুষ কত কাছাকাছি, কিংবা একাধিক মানুষ কত কাছাকাছি! আসলেই?
এভাবে কতখানি গভীর পর্যন্ত ছুঁয়ে থাকা সম্ভব? জানা নেই।
ওসব আধ্যাত্মিক কথা বলে সময়ের অপচয় করবেন না—এই মাধ্যমটিই মূলত শরীরের সাহায্যে ভালোবাসার নিরুপণ এবং নিঃসন্দেহে স্বীকৃত।

এতে নিরুৎসাহিত হওয়ার কিছুই নেই—এই একমাত্র শরীরটি ব্যবহার করে ঠিক কতজন মানুষকে ভালোবাসা যায়? আই মিন, এটিও একধরনের এক্সপেরিমেন্ট। আপডেটেড লাভ! অ্যাঁ…!
ওয়ান-সাইডেড লাভ বলেও একটি কনসেপ্ট রয়েছে; এই মনে করুন, দূর থেকে ভালোবাসার শক্তি উপলব্ধি করতে পারা।

তবে, এই বিরল প্রজাতির প্রাণীদের বেছে বেছে খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। কেননা, ভাবুন একবার…দূর থেকে আজীবন ভালোবেসে যাবার মতন মহৎ কাজটি তারা করছে, এতে নিজের কোনো ক্ষতি কিন্তু নেই—বরং লাভ…
নো, নো! লাভ মানে প্রফিট—অন্যকে ভালোবেসে নিজেকে অনুপ্রাণিত রাখা!

তবে, সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষেত্রে কিন্তু ভালোবাসা ব্যাপারটা বেশ অনুকূলে কাজ করে।
আমার ভীষণ পছন্দের একটা মিউজিকের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে—জন ডেনভারের বিখ্যাত একটা গান—ইউ ফিল আপ মাই সেন্সেস…সব থেকে প্রিয় মানুষটিকে কল্পনায় এনে লেখা এক অসাধারণ সৃষ্টি!

যখন ছোটো ছোটো বরফের স্ফটিকগুলো তাঁর গায়ে এসে পড়ে, তখন তিনি তাঁর প্রিয়তমার কথা কল্পনায় এনে এই গানটি লিখেছিলেন; তাই বলা যায়, ভালোবাসার নিজস্ব শক্তিও আছে, যা অদৃশ্য!
আবার, নিজেকে যন্ত্রণায় রেখেও ভালোবাসার মানুষটিকে অনুভব করা যায়—এর মধ্যে এক পৈশাচিক সুখ রয়েছে। মহাকাল ধরে রেখেছে এমন অনেক সৃষ্টি—যা আমরা পেয়েছি কেবল বিচ্ছেদের ফলে।
প্রকৃতপক্ষে, এটি দু-জন মানুষের আত্মার বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং জাগতিক বিচ্ছেদ—সময়ের পরিক্রমায় মায়ার বিকল্পে…এক বিষাদময় জীবন বেছে নেওয়া।

ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে না রাখলেও কিন্তু ঠিকই বেঁচে থাকে—অন্য কোনো সুরে, অন্য কোনো মোহনীয়তায়, অন্য কোনো স্পর্শে, তোমাতে না হোক—অন্য কোনো জগতে।

শুভ্র, জানো, আমি আজ ভীষণ ক্লান্ত…আজ তোমাকে ছুঁয়ে দেখার সময়টায়—এক অসম্ভব সুন্দর চোখজোড়া আমার মস্তিষ্কের পীড়ন বহুগুণে বাড়িয়ে দিল…

কী যে বলো এসব! এমন হেয়ালি কথাবার্তা আমার ভেতরটায় এক অসহ্য আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
তুমি জানতে চাও, আমার সাথে কী ঘটেছে? কিন্তু, তোমার জানার অধিকারটাই যে আজ নেই। তুমি কেন আজ আমার এত কাছে আসতে চাইছ—তা-ও এমন সর্তকতার সাথে?

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমার থেকে এত বেশি দূরে নিজেকে সরিয়ে নেব—যেন তোমার মনে হয়…আমি কক্ষনো তোমার ছায়াও ছুঁয়ে দেখিনি!

যত বেশি বুকের ভেতরটায় এক অসহ্য চিনচিন ব্যথা অনুভব করি—ততক্ষণে তোমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে মরিয়া হয়ে উঠি;
যেদিন আচমকা ব্যথাটা ধীরে ধীরে তীব্র হয়েছিল, তোমায় বুঝতে দিইনি—অথচ, তুমি আমার কী ভীষণ কাছে শুয়ে আছ!

নো ওয়েজ, তোমার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে বাঁচতে চাই না…তুমি বরং নিজের যত্ন নাও, ভালো থাকো।
আর রোজ এখানে কেন আসছ নিয়ম করে? এই জায়গাটি তেমন সুবিধের নয়—পোকামাকড় বুকের মাংসপিণ্ডটা কুরে কুরে খায়।

সম্ভব হলে, এই পচা ফুলগুলো মাটিতে ছুড়ে ফেলো, যেভাবে বিবর্ণ হয়েছে আমাদের জমানো মুহূর্তগুলো।
আমি আর তোমাকে সহ্য করতে পারছি না—তোমার এই অশ্রু যেন আমার প্রার্থনায় বৃথা নৈবেদ্য।