এই পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর জায়গা। এখানে কোনো সতীসাধ্বী রূপসী মেয়ে কবিতা পড়ে না। কিন্তু কবিতা পড়ে না, এমন মেয়েকে ঘুম ভেঙে দেখবে, এটা সে কখনওই চায়নি। অল্পবয়সের অদ্ভুত অহংকারি ইগো। ওই বয়স যা কিছুর কোনও মানে নেই, তা কিছু রাজ্যের মানে নিয়ে সামনে এসে হাজির হওয়ার বয়স। ভোর ৬টায় ঘুম ভেঙে এইসব ভাবতে ভাবতে চয়ন আড়মোড়া ভাঙতে থাকে। কাঞ্চির ঘুম ভাঙতে এখনও আরও দেরি আছে। চয়ন ভোরবেলা উঠে জগিংয়ে বের হয়। আজকে যেতে ইচ্ছে করছে না, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। ফেসবুকে বসে-বসে প্রত্যেকটা হৃদয়হীনা নারীকে নক করতে করতে একটা সময়ে সে হাঁপিয়ে উঠল। আজকের সব হাই হ্যালো শুধু সিন হচ্ছে, কোনও রিপ্লাই আসছে না। ফেসবুকের এই সিন ফিচারটা বাদ দেয়া উচিত। এতে রিপ্লাই না পেলে অন্তত মন খারাপ হবে না, ধরেই নেয়া যাবে, ও টেক্সটটা এখনও পড়েনি। নির্দয় সুন্দরীদের টেক্সট দিয়ে রিপ্লাই না পেলে মেজাজ খারাপ হয় না, মন খারাপ হয়। ঘুমিয়ে থাকা কাঞ্চির দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে সে ভাবল, তার নিজের চেহারাটা দেখতে আরেকটু বাজে হলে সেও একটা সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করতে পারতো। দেখতে ভাল’রা দেখতে ভাল’দের দেখা পায় না, এটাই নিয়ম। সে একটা সময় কবিতা পড়তে ভালোবাসতো। কাঞ্চির সাথে পরিচয়টা কবিতার হাত ধরেই। একই আবৃত্তি স্কুলে ওরা ছিল। কাঞ্চির কথা বলার ধরনটা ভাল ছিল, বেশ ভাল; কথা শুনলেই প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে, এমন ভাল। চয়নের পাশে কাঞ্চিকে বেশ মানায়, এটা অন্যরা বলতে-বলতে কাঞ্চি আর চয়ন একটা সময়ে কীভাবে যেন নিজেদের মধ্যে মানিয়ে নিয়েছিল। সেটা অবশ্য অনেক আগের কথা। এর মধ্যে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। কাঞ্চি এখন কবিতা ছেড়ে গল্প ধরেছে, চয়ন এখন কবিতা ছেড়ে চাকরি ধরেছে। কাঞ্চি সারাদিন বই পড়ে, চয়ন সারাদিন বসের ঝাড়ি খায়। কাঞ্চি বই পড়তে ভালোবাসাতে যে লাভটা হয়েছে সেটা হল, ওর সময়টা সারাদিন বেশ কেটে যায়। ওর মানে, চয়নের। বইপড়া মেয়েরা বরদের সাধারণত বিরক্ত কম করে। বিয়ের আগে কথা ছিল, ওরা ফেসবুকের পাসওয়ার্ড কেউ কাউকে দেবে না, কেউ খুঁজবেও না। বিয়ের পর কাঞ্চি অনেক পেইন দেয়ার পরও চয়ন তার পাসওয়ার্ডটা কাঞ্চির সাথে শেয়ার করেনি। কাঞ্চি অবশ্য অনেকটা জোর করেই চয়নকে পাসওয়ার্ড দিয়ে বলেছে, দেখো, আমার মধ্যে কোনো দুর্বলতা নেই। তুমি আমার অ্যাকাউন্টে ঢুকে যা ইচ্ছা দেখতে পার। চয়ন মুখে “প্রশ্নই আসে না তোমার অ্যাকাউন্টে ঢোকার!” বললেও পরে কাঞ্চির অ্যাকাউন্টে ঢুকে দেখেছে এবং এটা বুঝেছে, রূপসীর বর না হতে পারাটা আসলে নিজের এবং অন্যদের জন্যে শান্তির ব্যাপার। আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। কাঞ্চিকে ইনবক্সে কেউ বিরক্ত করে না, এমনকি চয়ন নিজেও করে না। ফেসবুকে নিজের বউয়ের সাথে যে গল্প করতে পারে, সে তো মহাত্মা! চয়ন শুধু একবারই মহাত্মা হয়েছিল; প্রেমে পড়ার সময়। কাঞ্চিকে ভেবে লেখা অখাদ্য কবিতাগুলো কাঞ্চি খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছে। পৃথিবীর সকল স্ত্রীর মতই সেও স্বামীর যেকোনো বাজে প্রতিভায়ও বিস্মিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। চয়ন এইসব ভাবতে-ভাবতে ২ মগ ব্ল্যাক কফি বানায়। ল্যাপটপ অফ করে কাঞ্চির চুল নিয়ে খেলতে থাকে। কাঞ্চি রাতে না খেয়েই ঘুমিয়েছে। খুব তুচ্ছ কারণেও না খেয়ে থাকার ক্ষমতা কাঞ্চির অসীম! কেন, বলছি।
: এই জানো, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো রচনাতেই কৃষকের কোনও চরিত্র নেই! অদ্ভুত না?
: হুমমম……..
: হুমমম…… মানে? এই, তুমি কী ভাবছো বলো তো?
: আমি ভাবছি, সানি লিওন হুট করে সিনেমায় এসে এতো দারুণ অ্যাক্টিং কীভাবে করে!
যা হওয়ার তা-ই হলো। কুরুপাণ্ডব-সমর বারতা! ২ জন পুরুষের মুখ থেকে অন্য মেয়ের প্রশংসা শুনে হজম করার ক্ষমতা মেয়েদের দেয়া হয়নি। এক। নিজের বাবা। দুই। নিজের বর। চয়ন ইদানীং ঠাট্টা করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। তার অনেক দুঃখের একটা হলো, সে সানি লিওনকে খুব পছন্দ করলেও কাঞ্চিকে কখনওই সেটা বলতে পারে না। কাঞ্চি একেবারে ছোটো-ছোটো রসিকতাও সহজে নিতে পারে না। অথচ বিয়ের আগে কাঞ্চির সেন্স অব হিউমার কখনওই কম ছিল না।
খুব জরুরি কিছু বলবে বলে চয়ন কাঞ্চিকে ধাক্কা মেরে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। কাঞ্চির ঘুম ভাঙতেই চয়ন প্রথমেই যে কথাটা বলল, সেটা হল, জানো, দিল্লিতে নাকি ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে ট্যুরিস্ট কমে গেছে। এরপর সে টানা কয়েকটা ধর্ষণ জাতীয় খবর দিতে লাগলো। কাঞ্চি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল। স্টপ! জাস্ট স্টপ ইট! এই অসভ্য মানুষটাকে নিয়ে আমি আছি! যত্তোসব!
চয়ন এরকম মজা করেই থাকে। সমস্যা হলো, ইদানীং কাঞ্চির টলারেন্স কমে যাচ্ছে। হাহাহা করে ঘরদোর কাঁপিয়ে হাসতে-হাসতে চয়ন কাঞ্চির দিকে কফির মগটা এগিয়ে দেয়। ওরা দুজনে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মর্নিংওয়াকে বের হওয়া লোকদের দেখে। শ্রাবণরাত শেষের ভেজাভেজা স্নিগ্ধ সকাল। এইসময় কলিংবেল বাজল। কাজের বুয়া।
ওরা পড়ত ঢাকা ভার্সিটিতে। চয়ন অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে, কাঞ্চি ম্যাথে। কবিতার হাত ধরে ওদের পরিচয়।
আবৃত্তি স্কুলে শেখার সময় একদিন সন্ধের দিকে কাঞ্চিকে চয়ন বলেছিল, চলো, শহীদুল্লাহ হলের সামনে দিয়ে সন্ধ্যায় হাঁটতে-হাঁটতে পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’ থেকে আবৃত্তি করি। বাদামের দামটা না হয় আমিই দেবো। ওরা হাঁটছিল দিঘির গা ঘেঁষে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় ওড়া কাঞ্চির চুল ছুঁয়ে দেখতে-দেখতে, ঘ্রাণ নিতে-নিতে চয়নের মনে হতে লাগল, দিঘির স্বচ্ছ জলে আটকে-পড়া চাঁদের রুপোলি ছায়াকে ঠিক এই মুহূর্তে না ছুঁয়েও থাকা যায়। কাঞ্চি হাঁটছিল শূন্যে পা ছুঁড়ে-ছুঁড়ে। “এই কাঞ্চি! দেখে হাঁটো! পড়ে যাবে তো!” “তুমি তো খেয়াল রাখছই! কীভাবে পড়ব?” চয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ওর মনে হচ্ছিল, এরকম একটা স্বর্ণালী সন্ধ্যার স্বপ্নে বিভোর হয়েও জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়! “হাসছো কেনো? বলো, হাসছো কেনো?” ‘কথোপকথন’ চলছিল। চয়ন এই লাইনটা বলতেই কাঞ্চি কলকল শব্দে হেসে উঠছিল। চয়ন ইচ্ছে করেই বারবার ওই লাইনটাই ঘুরেফিরে বলতে লাগল। ঝর্ণার জলের শব্দের মতো, সন্ধ্যার বধিরকরা নৈঃশব্দ্য ভেঙে চয়নকে সেই হাসি সেই সন্ধ্যায় মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। দিঘির স্বচ্ছ জলে ছোটো-ছোটো পাথর ছুঁড়ে দিয়ে পানির বৃত্ত দেখতে-দেখতে কাঞ্চি ফোনে কথা বলছিল। হঠাৎ, বাবা! বলে চিৎকার করে ঘাসের উপর পড়ে গেল।
এর বেশকিছু দিন পর কাঞ্চির বাসা থেকে চাচ্ছিল না ও আর ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ুক। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর বাড়ি থেকে ওর জন্যে খরচ পাঠানো বন্ধ হয়ে গেল। ওর বাবা একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন, জমানো টাকা প্রায় ছিল না বললেই চলে। কাঞ্চি রাজশাহীর কোনও একটা কলেজে ভর্তি হয়ে যাক, এটাই কাঞ্চির চাচাদের ইচ্ছা। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, এক ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিতেই ওরা কাঞ্চিকে রাজশাহীতে নিয়ে যেতে চাইছিল। কাঞ্চি ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালে থার্ড হয়েছে। ও সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু করতে না করতেই এত কিছু ঘটে গেল।
: তুমি রাজশাহী চলে যাবে ঠিক করেছ?
: হ্যাঁ, আমাকে যেতে হবে। মা আমার ছোটো বোনকে নিয়ে খুব সমস্যার মধ্যে আছে। বাবার কিছু সম্পত্তি নিয়ে চাচারা ঝামেলা করছেন মনে হয়। মা তো আমাকে কিছুই বলে না। আমি মা’র পাশে থাকব। আর চাচারা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। ছেলের বাড়ি আমাদের পাশেই।
: যদি বলি, তুমি যাবে না? এইখানেই থাকবে?
: না, আমি যাব।
: পড়াশোনা ছেড়ে দেবে?
: না, আমি বিয়ের পর চালিয়ে নেবো।
: মানে? তুমি কী বলছ এসব? তোমার মাথা ঠিক আছে?
: আমি ঠিকই বলছি। আর তাছাড়া, আমি টিউশনি করে পড়ার খরচ চালাই, এটা চাচারা চাইছেন না।
: আমি যদি তোমার খরচটা দিই, তুমি ঢাকায় থাকবে?
: তুমি দেবে মানে? প্রশ্নই আসে না! তুমি কোন যুক্তিতে দেবে? কোত্থেকে দেবে?
: তোমাকে আমি ভালোবাসি, এই যুক্তিতে। আমি আরও দুইটা টিউশনি করব। হয়ে যাবে। তুমি ভেবো না।
: এই মুহূর্তে ভালোবাসা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে খোঁড়া যুক্তি। আমি যাবই। আমাকে যেতে হবেই!
এর পরদিনই ওরা কোর্ট ম্যারেজ করে। থার্ড ইয়ারে পড়া একটা ছেলের পক্ষে ব্যাপারটা মোটেও সহজ ছিল না। ওরা রাজশাহীতে যায়। এবং কাঞ্চির মা আর ওর ছোটো বোনের সমস্ত খরচ এখন থেকে চয়ন চালাবে, চাচাদের সাথে এরকম কথা বলে আসে।
চয়নের বাড়ি কুষ্টিয়াতে। বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। ওর পারিবারিক আবহ ছিল উদার। ওর দাদাজান ছিলেন এলাকার নামকরা বাউল এবং লালনসাধক। ওদের পরিবার থেকে এই বিয়েটা সহজেই মেনে নেয় এবং কাঞ্চির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে। এতে করে চয়নের জন্যে কাজটা সহজ হয়ে যায়।
চয়ন পাস করে চাকরি নেয় পূবালী ব্যাঙ্কে। সিনিয়র অফিসার। সাড়ে তিন বছর চাকরি করার পর একটা ছোটো বাসা নিয়ে কাঞ্চিকে রোকেয়া হল থেকে বাসায় তুলে নেয়। কাঞ্চি জবের জন্যে ট্রাই করছে। ওর কাজ ছিল, অ্যাপ্লাই করে যাওয়া আর বাসায় পড়াশোনা না করে ঘুমানো। ঘুম থেকে উঠে রান্নার বই পড়ে আর রান্নার অনুষ্ঠান দেখে রান্না করা, ফেসবুকে পিকচার আপলোড করা, কে কয়টা লাইক দিল গোনা, কী কমেন্ট করল দেখা; সেদ্ধ ডিমের ছবিতে লাইক দিলেও অট্টহাসির ইমো দিয়ে থ্যাঙ্কস লিখে দেয়া। বাঙালি মেয়েমাত্রই বয়স নির্বিশেষে রূপের আর রান্নার প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে। এর অবসরে কাঞ্চি ফিকশন পড়ে। এভাবেই করেই দিন বেশ কেটে যাচ্ছিল।
ছুটির দিনটা ওদের কাটে খুনসুটিতে। ভালোবাসার মানুষটাকে খ্যাপানোর মতন আনন্দ দুনিয়াতে কমই আছে। এটা একটা ব্যাধির মতো। এর একমাত্র দাওয়াই, খ্যাপানো।
ফেসবুকে কোনও সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তার সাথে রসিকতা করাকে চয়ন দায়িত্ব মনে করে। এভাবেই বন্ধুত্ব চিত্রলেখার সাথে। ওর ডাক নাম চিত্রা। বর ব্যবসা করে। নতুন ব্যবসা, ভয়ানক রকমের ব্যস্ত। বর সারাদিন অফিস করে, চিত্রা সারাদিন ফেসবুকিং করে। ব্যস্ত লোকের সুন্দরী বউ মানেই সুখের বিষয়। A lovely wife of a busy man is a joy forever. কথাটা কিটসের না, চয়নের। ঘরোয়া বউ, বর খুশি। ব্যস্ত বর, সবাই খুশি। চয়নের সাথে চিত্রার কীভাবে পরিচয়, সে কথায় পরে আসছি।
চয়ন ভার্সিটিতে পড়ার সময় দেখত, মেয়েরা দুই শ্রেণীর ছেলেদের ভালোবাসুক আর নাই বা বাসুক, ভালোবাসা দেয়। ফটোগ্রাফার আর দর্জি। ফটোগ্রাফার হতে হলে যে সেন্স থাকতে হয়, সেটা চয়নের কখনওই ছিল না। তবে ফটোগ্রাফার হওয়াটা এমন কঠিন কিছু নয়। বানরের গলায় মুক্তোর মালা, ফটোগ্রাফারের গলায় ডিএসএলআর-এর ফিতা। গলায় একটা ডিএসএলআর ঝুলিয়ে দাও, ব্যস্! হয়ে গেল! সবাই ভাবে, গলায় ওটা ঝুললেই ফটোগ্রাফার। স্ট্যালিনের বেশিরভাগ ছবিই চুরুট মুখে তোলা। অথচ তিনি চুরুট খেতেন না। এইসব কিছুতেই ভাবা যাবে না। যে যত বেশি ভাবে, সে তত বেশি সিঙ্গেল। চয়ন বলে, I think, therefore I am single. তাই সে বহুকষ্টে একটা ডিএসএলআর কেনার টাকা জমিয়েছিল। কিনল, এবং মনেমনে ঠিক করে ফেলল, এখন থেকে ফটোগ্রাফি তার নেশা। ফেসবুকে অ্যাবাউট মি’তেও এটা জানিয়ে দিল। সে লিখল, I live by photography, with photography, for photography. ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এমন সৌন্দর্য কিংবা সাহস খুব কম মেয়েরই থাকে। এখন যুগটাই হচ্ছে ফেসবুক লাইকের যুগ। চেহারার সৌন্দর্যে সবাইকে মুগ্ধ করার যুগ; ঈশ্বরপ্রদত্ত, কিংবা ক্যামেরাপ্রদত্ত। চয়ন চেয়েছিল, তাকে কেউ ভালো বাসুক আর নাই বা বাসুক, অন্তত ভালোবাসা দিক। ফটোগ্রাফার হতে হলে দুইটা জিনিস থাকতে হয়। ডিএসএলআর আর ফটোগ্রাফার-ফটোগ্রাফার ভাব। চয়নের দুটোই আছে। তবে ছেলেদের প্রোফাইল পিকচার তুলে দেয়ার সময় দ্বিতীয়টা একটু বাড়ে, সে নিজে না চাইলেও নিজের অজান্তেই কীভাবে যেন বেড়ে যায়। কাঞ্চির বেশিরভাগ প্রোফাইল পিকচারই চয়নের তোলা। চয়নের প্রতি কাঞ্চির কড়া নির্দেশ ছিল, ও বাদে শুধু ছেলেদের ছবি তোলা যাবে। অবশ্য, পাখি-গাছ-নদী এসবের ছবিও তোলা যাবে। তাই চয়নকে অনেকটা বাধ্য হয়েই মাঝেমাঝে ফটোশপ দিয়ে ফর্সা করে দিয়ে কাঞ্চিকে চুপ করিয়ে দিতে হত। যে ফটোগ্রাফার মেয়েদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকে ফটোগ্রাফার হয়, ন্যাচারাল ভিউতে তার কিছু এসে যায় না। অবশ্য, চয়ন যে একেবারেই পাখি-গাছ-নদী’র ছবি তোলে না, তা নয়। প্রোফাইল পিকচারের ব্যাকগ্রাউন্ডে ওসব না চাইতেই চলে আসে। এসব নিয়ে অনেক ঝগড়া করেও কাঞ্চি কিছু করতে পারেনি।
: ভাইয়া, এই স্ট্যাচুর সামনে আমাদের একটা কাপল ছবি তুলে দেবেন, প্লিজ?
: ওহহ শিওর শিওর!
এভাবেই শুরু। চিত্রাদের সাথে আলাপ করে জানতে পারল, ওদের বিয়ে হয়েছে চয়নদের বিয়ের ঠিক দুই দিন আগে। চয়ন-কাঞ্চি’র মতো, ওরাও বুদ্ধগয়া-সারনাথ ঘুরতে এসেছে। চিত্রার বর স্মার্ট হাসিখুশি খোলামনের মানুষ। ‘ভাই, আমি কিন্তু আপনার সিনিয়র। বিয়ের কাজটা আপনার দুইদিন আগেই সারলাম কিনা! হাহাহাহা……’ চয়ন ঢাকায় ফিরে চিত্রাকে ছবিগুলো মেইল করে দিয়েছিল। চিত্রা সে কী খুশি! ফেসবুকে আপলোড করেই চয়নকে ফ্রেন্ডলিস্টে অ্যাড করে নিয়েছে। সেই থেকে ফুসুরফাসুর চলছেই। সুখের বিষয়, কাঞ্চি এসবের কিছুই জানে না। বোকা মেয়েদের বিয়ে করার অনেক শান্তি। বোকা মেয়ে দেখতে একটু কম সুন্দর হলেও পুষিয়ে নেয়া যায়। চয়নের পপুলারিটি সব জায়গাতেই বেশি। কী অফিসে, কী বাইরে। কেউ যখন তাকে ফটোগ্রাফার বলে, তখন কিছুতেই সেটাকে তার গালি ভাবতে ইচ্ছে হয় না। সে বলে, সে অ্যামেচার ফটোগ্রাফার, ফটোগ্রাফি তার শখ। এটা নিয়ে কাঞ্চি মহাবিরক্ত! বলে, মেয়ে পটানোর ধান্দা! চয়ন অবশ্য এসব কথা গায়ে মাখে না। তার মত বড় হৃদয়ের মানুষদের সবকিছু গায়ে মাখলে চলে না। এত লজ্জাশরম নিয়ে তো আর পরনারীসেবা করা যায় না!
দরোজার কাছে গিয়ে চয়ন কাজের বুয়াকে বিদায় করে দিল। আজকে ওরা লংড্রাইভে আশুলিয়ার দিকে যাবে। কাঞ্চিকে ম্যানেজ করার সবচেয়ে সহজ অব্যর্থ বুদ্ধি এটা। কাঞ্চিকে না খেপিয়ে চয়ন থাকতে পারে না। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রেয়সীকে কাঁদাতে হয়। এটা ওর নিজস্ব থিওরি। মেয়েদের খুশি করা আর খ্যাপানো, এই দুই ক্ষমতাই চয়নের অসীম। এই ক্ষমতার বড় একটা উৎস ফটোগ্রাফি কিংবা ডিএসএলআর। ইদানীং কাঞ্চি একটা নতুন শাস্তি শিখেছে। বেশি রাগ করলে রাতে সত্যিসত্যি ঘুমিয়ে পড়ে। তাই, চয়নকে মাঝেমাঝে গাড়ি ভাড়া করে লংড্রাইভে যেতে হয়। কাঞ্চিকে আর আগের মতো বোকা-বোকা মনে হয় না। সমস্যাটা কোথায়, সেটা চয়ন বের করতে পারছে না। বোকা মেয়ে বোকামি না করলে অসহ্য লাগে।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি। গাড়িতে চলছে ইউফোরিয়ার ‘আব না জা’, সিটি এফএম থেকে। কাঞ্চির খুব প্রিয় গান ওটা। ওই সময়ে চয়ন তার এক্সপেরিয়া জেডে ইউটিউব থেকে মিলিন্দ ইংগলের ‘ও প্রিয়া’ গানটা চালালো। কাঞ্চিকে রাগানোর যতগুলো বুদ্ধি আছে, এটা তার একটি। ও যখন কোনও গান মন দিয়ে শুনে, ঠিক তখনই অন্য একটা ট্র্যাক ছেড়ে দেয়া। বউকে রাগানোর অপরাধে নরকে যাওয়ার শাস্তি থাকলেও এতে চয়নের কোনও আপত্তি নেই।
: তুমি আমাকে গানটা শুনতে দেবে?
: কেন? এই গানটা সুন্দর না?
: আচ্ছা, সত্যি করে বল তো, তুমি গানটা শুন, নাকি প্রীতি জাঙ্গিয়ানিকে দেখ? ফালতু চেহারার ফালতু একটা মেয়ে! (প্রত্যেকটা মেয়েই মনে করে, ওর হাজব্যান্ড ওকে ছাড়া যেসব মেয়েকে পছন্দ করে তাদের সবাই-ই ফালতু। মেয়েরা তাদের প্রিয় মানুষকে দোষ দিতে পারে না, তাই সব দোষই অন্য কারও ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। এই অক্ষমতা তাদের মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। নিজের খোঁড়াকানা ছেলেও যেকোনো মায়ের কাছেই রাজপুত্র।)
: আরে না না, আগুনের সামনে সাত পাকে ঘুরছে তো, তাই চেহারার গ্ল্যামার একটু কম মনে হচ্ছে। ও জাস্ট একবার গোসল দিলেই দেখবে সব ঠিক—ফকফকা! তুমি সারাজীবন গোসল দিলেও ওই চেহারা আনতে পারবে না।
রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে কাঞ্চি চয়নের এক্সপেরিয়া জেড’টাকে কেড়ে নিয়ে ওর মাথায় ছুঁড়ে মারল।
: এরকম ইতরের সাথে কোনো মেয়ে থাকে! উফফফফ্……… তুমি একটা খারাপ লোক! বেশি খারাপ!
: ঠিকই বলেছ! তুমি আজই আব না জা’র মোটকুটার কাছে চলে যাও। নো প্রবলেম! আই হ্যাভ সেট ইউ ফ্রি!
: সেদিন তন্বী ভাবীকে নিয়ে কোথায় ঘুরতে গিয়েছিলে?
: মানে?
: আমি দেখলাম, উনার ফটোর নিচে তোমাকে ফটো ক্রেডিট দেয়া। বল, কোথায় গিয়েছিলে? আমাকে সাথে নাওনি কেন?
চয়ন একেবারেই চুপ! তন্বীকে বারবার রিকোয়েস্ট করা সত্ত্বেও পিকচার পোস্ট করার সময় প্রাইভেসিতে ‘এক্সসেপ্ট কাঞ্চি’ দিতে ভুলে গেছে। শিট! ও পুরাই একটা টিপিক্যাল স্টুপিড বিউটি!
: ইয়ে মানে, সেদিন আমাদের অফিস থেকে সবাই একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। তুমি শুধু-শুধু আমাকে সন্দেহ কর। এই এই এই কণা সোনা! …….. আবার কী শুরু করলে? কান্নাকাটি করতে এখানে এসেছ? …… ভাই, আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনার ভাবি একটু এরকম………
: কী? তুমি কী বললে? আমি এরকম, না? দাঁড়াও, তোমার ফটোগ্রাফিগিরি আমি ছোটাচ্ছি! বাসায় গিয়ে যদি তোমার ক্যামেরা আছাড় না মারি তো আমার নাম…….. (কাঞ্চি প্রায়ই চয়নের ডিএসএলআর’টা মুখ দিয়ে আছাড় মারে।)
: কণাই না! এ-ই তো? আচ্ছা-আচ্ছা, ঠিক আছে, ওই নামে তোমাকে আর কখনও ডাকবো না।
কাঞ্চিকে চয়ন মাঝেমাঝে আদর করে ‘কণা’ নামে ডাকে। ওকে শান্ত করার আরেকটা ওষুধ হচ্ছে, কণা নামে ডেকে রঙঢং করতে থাকা। চয়ন আলতোভাবে কাঞ্চির গালে ওর ডান হাতের আঙুলগুলোর উল্টো পিঠ বোলাচ্ছে। সামনের চুলগুলোকে নাকের কাছে এনে পেঁচিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। কাঞ্চি এবার চুপ। মিটিমিটি হাসছে শুধু।
: এই শোনো না শোনো না……… চিত্রলেখা কে? মিথ্যে বলবে না প্লিজ। আমি একটুও রাগ করব না। বলো না বলো না, ও কে?
চয়ন কথাটা পাশ কাটিয়ে যায়। ওর কপালে ফোঁটায়-ফোঁটায় ঘাম জমতে থাকে। চিত্রার কথা কাঞ্চি জানল কীভাবে? চিত্রা কাঞ্চিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট-টিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বসেনি তো আবার? পাঠাতেও পারে। বেকুব না হলে চিত্রা সুন্দরী হবে কোন দুঃখে? এইসব ভাবতে-ভাবতে চয়ন ক্যামেরায় ক্লিক করতে থাকে। ক্লিক্! ক্লিক্!! ক্লিক্!!!
স্বচ্ছ নীল কাঁচের মত আকাশের গা পিছলে-পিছলে আসা শ্রাবণবিকেলের মেঘভাঙা রোদে কাঞ্চিকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। কাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে নানান ঢঙে পোজ দিচ্ছে। চয়ন চোখ নাচাচ্ছে, গানের সুর তুলে শিস দিচ্ছে—ইউ ফিল আপ মাই সেন্সেস……… কাঞ্চি হাসছে। ওকে দেখাচ্ছে শাদা রাজহাঁসের মতো। শেষ বিকেলের সোনাসোনা হলদে রোদে কাঞ্চিকে আজকের জন্যে সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দেয়া যায়। চয়ন ভাবতে লাগল, পৃথিবীটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর! এই পৃথিবীতে শুধু কাঞ্চিকে ভালোবাসার জন্যেও আসা যায়, থেকে যাওয়া যায়। লাইফ ইজ রিয়েলি বিউটিফুল। আজকের বিকেলে জীবনের সবটুকু গতি থেমে যাক, এভাবেই থেমে থাকুক অনন্তকাল।
: এই শোনো! তোমাকে দেখতে সেই মেয়েটার মতো লাগছে।
: হিহিহি…..… আমাকে রাগানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ নাই। এখন আমার আর রাগতে ইচ্ছে করছে না। বলো, কোন মেয়ে?
: বেইলি রোডে কোনো এক বর্ষার দুপুরে সুইসে বার্গার খাওয়ার সময় ওকে দেখেছিলেম। বিশ্বাস কর, একেবারে ধারালো রূপসী! স্কুলের মেয়ে হয়তো। তোমাকে আজকে ঠিক স্কুলের মেয়েদের মতো দেখাচ্ছে! অপূর্ব! একেবারে পরস্ত্রীর মতো সুন্দরী! ……….. এই নীল শাড়িটা আগে পরনি?
: তুমি সত্যিই অনেক ভাল ফটোগ্রাফার, জানো? আজকে থেকে তুমি শুধুই আমার ফটোগ্রাফার। তুমি আর কখনওই অন্য কারও ছবি তুলবে না, কেমন? শুধু তোমার জন্যে আমি চিরসুন্দর হয়ে থাকব; যেভাবে বলবে, সেভাবে। একদম প্রমিজ! তুমি আমায় তোমার মনের মত করে সাজিয়ে রাখবে সারাজীবন। আজকের পর আর কোনও সুন্দরকেই তোমার চোখে জড়াতে দেবো না। তুমি দেখো!
: এই কথায় চয়ন নিজেকে হারিয়ে ফেলল যেন! রাস্তার অনেকটা মাঝখানে এসে চিৎকার করে পৃথিবীকে জানিয়ে দিলো, এই দ্যাখো, আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা আমাকে ফটোগ্রাফার বলেছে! হাহাহাহা …….. আমি ফটোগ্রাফার আমি ফটোগ্রাফার…….!!
রাস্তায় ছড়িয়ে বসে কাঞ্চি চয়নের দিকে তাকিয়ে রইল; চয়ন আর কখনওই হড়বড় করে কথা বলে কাঞ্চিকে খ্যাপাবে না। কাঞ্চি কাঁদছে না, নিথর হয়ে গেছে হঠাৎ থমকে যাওয়া সেইদিনের সোনালী বিকেলটার মত। ঠোঁট উল্টে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদলেই বা আজ কে তাকে শান্ত করবে? অন্যের ফটো তোলার অপরাধে তাকে কাউকে আর কখনওই বকতে হবে না। তার ফটোগ্রাফার তাকে সারাজীবনের জন্য বাঁচিয়ে দিয়ে চলে গেছে।
গাড়ির ড্রাইভার ছুটে পালানো পিকআপ ভ্যানটার দিকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে-করতে দৌড়াচ্ছে।
পুনশ্চ। চয়ন মৃত্যুর আগে তীব্রভাবে একবার ফটোগ্রাফার হয়ে বেঁচেছিল। ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ মুভিতে বাবাকে সেনারা হত্যা করার আগমুহূর্তেও জীবনটাকে সহজভাবে নেয়ার সহজাত ইশারায় বাবা পুত্রকে যেভাবে বিশ্বাস করিয়েছিলেন, জীবনটা বেঁচে থাকার ছোট্টো সময়টাতে ফাঁকিটাকি মেরে ফাঁকফোকর দিয়ে একটুখানি হেসেখেলে বেঁচে থাকার জন্যই, ঠিক সেভাবে করেই চয়ন তার ভালোবাসার সবটুকু দিয়ে ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচেছিল। ওর মত করে মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তে কজনই বা বাঁচতে পারে? সে পরম ভাগ্যবান। ফটোগ্রাফার না হতে পারার যন্ত্রণা নিয়ে তাকে মরতে হয়নি। মৃত্যুর আগেই ফটোগ্রাফিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটা তার ভাগ্যে জুটে গেছে।