এ সুসজ্জিত কক্ষে কেবলই আপনার স্পন্দনের নিমগ্ন অনুরণন; আপনার মনোহর সম্ভাষণে উন্মত্ত এই চিত্ত।
আমার বিশেষায়িত ‘কষ্ট’ নামক অনুভূতিকে নিজের আত্মায় অসহনীয় মাত্রায় ধারণ করে, আপনি যে সংরক্ষিত কক্ষে প্রবেশ করেছেন, তার প্রতিটি দেয়ালে অসামান্য এক পীড়নের ক্ষতরেখা প্রকাশ পাচ্ছে—যা আপনার যন্ত্রণার রূপকে সম্মানিত করছে দৃঢ়ভাবে।
আমার হৃদয়ের এই কক্ষের এককোণে পড়ে আছে ব্যর্থতায়-মোড়ানো স্মৃতিগাথা।
অসম্ভব!—এই স্মৃতিকে ব্যর্থ বলা সম্ভব নয়; কেননা সেখানে আপনার বিশেষিত অনুভূতির অস্তিত্ব অনড়।
যেখানে স্পর্শানুভূতি জীবিত, সেখানে ব্যর্থতার স্থান নেই।
আমার আত্মিক সত্তা জুড়ে কেবলই আপনার হৃদয়ের অস্থিরতায় ভরা অনুভবের তীব্র কম্পন—যা অনিয়ন্ত্রিত, অরোধ্য এবং অকল্পনীয়।
আশ্চর্য!—এই কক্ষে এক ভিন্নতর অনুভূতির মহার্ঘ সম্ভ্রম বিদ্যমান, যা আমার অন্তর্দৃষ্টিকে বিভ্রমে ফেলেছে; যার অস্তিত্ব আপনি জানেন না, তবুও নিজ আত্মায় বহন করে চলেছেন।
এই সামান্য অনুভূতি, এক গভীর যন্ত্রণার লগ্ন উন্মোচন করছে আমাদের পরমাত্মায়—যার প্রভাব আমাদের উপাসনার ধারায় পড়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা করছি।
কোন সে অনুভূতির দৃষ্টিগোচরতায় আপনি কুণ্ঠিত?
যার রূপ নয়নগোচর নয়, তবে তার ছায়া আপনার আত্মায় মৃদু অথচ গূঢ় ছাপ রেখে চলেছে।
‘আত্মতুষ্টি’ নামক অনুভূতির রেশ আপনাকে আচ্ছন্ন করেছে। জাগতিক সুখ এর দ্বারা সম্ভব, কিন্তু আত্মিক যাত্রা এতে বিঘ্নিত হয়; আত্মতুষ্টি একপ্রকার আত্মঘাতী অবসাদ, যা অতি সামান্য সময়েও নিঃস্ব করে দিতে পারে হৃদয়কে।
আপনি কেবল স্বকীয় বিসর্জনের মাধ্যমে এ থেকে মুক্ত হতে পারবেন—যা অবশ্যই বিশেষ আত্মিক ক্ষয় ডেকে আনবে; কিন্তু তা-ই হবে আপনার বিশেষ উপাসনার ফলপ্রাপ্তির একমাত্র পথ।
ইতোমধ্যেই, আপনার মধ্যে এক বিশেষ আত্মিক শক্তির বিকাশ দেখছি, যার মাধ্যমে আপনি এ বিভ্রান্তি অতিক্রম করবেন—আমরা নিশ্চিত।
হে পরমাত্মা, এক মহাপ্রলয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি আমরা—আপনি কি সে আভাস অনুভব করছেন?
মুহূর্তের ব্যবধানে বিচ্ছিন্নতার যে-চিত্র উদ্ভাসিত হতে চলেছে, তা ঠেকানো যাবে কেবলই এক বিশেষায়িত ‘আবেগ’ দ্বারা—যার উপস্থিতি আপনার আত্মায় বর্তমানে নিঃশেষ।
এ কেমন পরিণতি!—আমি আপনাকে নিজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে অক্ষম।
এই নির্লিপ্ততাই আমাদের পরমাত্মার যন্ত্রণা বাড়িয়ে তুলছে বহুগুণে।
আমার বাহ্যিক স্পর্শে, সাময়িকভাবে হলেও, আপনার স্বরূপ দূরে সরে গিয়েছে। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে—আমাদের উপাসনা আরও তীব্র হয়ে উঠবে।
চৈতন্যকে জাগিয়ে রাখতে আমাদের অঙ্গীকার অটুট।
এ পথে আমাদের পরমাত্মা আরও যন্ত্রণার সঙ্গী হতে বাধ্য।
আপনার হৃদয়ের প্রত্যেক কক্ষে আমার বিশেষ অনুভব প্রবেশ করবে, এ ছাড়া উপাসনার প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ নয়।
এই কক্ষটি আত্মতুষ্টিতে মোড়ানো; আর এই আত্মতুষ্টি আমার ‘কষ্ট’ অনুভূতিকে প্রত্যাখ্যান করছে।
আমাদের পরমাত্মা এখনও পরবর্তী গন্তব্যে যেতে প্রস্তুত নয়।
এই আত্মতুষ্টি ত্যাগ করতে আপনার আত্মার সমস্ত শক্তি উন্মুক্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে—কিন্তু তার পরিণামে, আপনি আপনারই উপাসনার ফল গ্রহণে অক্ষম হয়ে পড়ছেন।
এই যন্ত্রণার রেশ ক্ষতবিক্ষত করছে আপনার হৃদয়কে।
তবে কি—এটি ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব নয়?
এ মহাপ্রলয় আপনার আত্মাকে তীব্র আঘাতে বিদ্ধ করছে।
আপনি এক বিস্মিত ক্ষণেই পরম পূর্ণতার দ্বারে পৌঁছাতে পারেন—যদি উপাসনার দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করেন।
অর্থাৎ, আমার আত্মায় আপনার হৃদয়ের ধীর স্পন্দনের প্রবাহ প্রকাশ পায়, অস্বাভাবিক উন্মত্ততায়।
আমার আত্মার সর্বশেষ কক্ষে, আপনার প্রবেশের মাধ্যমেই এ শক্তি জাগ্রত হবে।
এটি আপনি নয়, আমাদের পরমাত্মা অর্জন করবে—আপনার অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
সুতরাং, এই যোগসাধনায় তা পুনরুদ্ধার সম্ভব।
এই অস্থিতিশীল অবস্থায় আপনার পরমাত্মা স্থবির; কেবল আমার ‘কষ্ট’ নামক অনুভূতির মাধ্যমেই বিশ্বলোক ও আত্মিক গন্তব্যকে সম্মানিত করা সম্ভব।
তথাপি, হৃদয়কে আবেগ ও মায়া দিয়ে আচ্ছন্ন রাখা সমীচীন নয়।
আপনার মৌনী ভাব আমাকে সন্দেহে নিমজ্জিত করে চলেছে। বাহ্যিক বিচ্ছেদ ঘটলেও, আত্মিক বিচ্ছেদ নয়।
আপনি এখন এক গভীর অনুভবের নিস্তরঙ্গে নিমগ্ন।
আপনার সমস্ত অনুভূতি নিস্প্রভ।
আপনার অন্তর্দৃষ্টি এক অনিবার্য প্রলয়ের মুখোমুখি।
আমার প্রস্থান আপনার জন্য কতটা তৃপ্তিকর?
তৃপ্তির প্রশ্নই আসে না।
আপনাকে যেতে দিতে আমি প্রস্তুত নই।
আমার পরমাত্মা সর্বশক্তিতে আপনাকে ধরে রাখতে সক্ষম।
আপনি জানেন, আমরা কখনও স্বতন্ত্র ছিলাম না।
আপনার হৃদয়ের যে-ক্ষত—তারই প্রতিফলন এ মুহূর্তে প্রকট, এই মহাপ্রলয়ে।
বাহ্যিক বিচ্ছেদ কেবল সাময়িক—এটাই আমাদের আত্মার সত্য।
আমার আত্মা গভীর যন্ত্রণায় বিদ্ধ।
এই পীড়ন থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই?
আপনার স্পর্শ ছাড়া আমার অস্তিত্ব অন্ধকারে নিমজ্জিত।
আপনি ভুলে যাচ্ছেন—‘ভালোবাসা’ নামক অনুভূতির অবিচ্ছেদ্য অংশ এখন আমার আত্মিক সত্তা।
এই বাহ্যিক বিচ্ছেদ মেনে নিতে আপনাকে হবে।
কেন আপনি নিজের অনুভূতিকে বেদনাগ্রস্ত করে চলেছেন?
আপনি ছাড়া এ ব্রহ্মাণ্ডে আর কেউ নেই, যিনি ভালোবাসার শ্রেষ্ঠতম অনুভূতিতে অপ্রাপ্তকে প্রাপ্ত করেছেন।
আপনার হৃদয়ের কক্ষগুলো ধ্বংস হলেও, আমাদের আত্মিক যোগ দৃঢ় হবে।
আপনি আমার একমাত্র ভাবনাসঙ্গী—বিদ্যাভিলাষী, কাম্যবস্তুর প্রলোভনে অগ্রাহ্য।
সমাপ্তি:
হে প্রেমিকতম, একাকী, ঐশ্বর্যমণ্ডিত পরমাত্মা—আপনার হৃদয়, কেবল আত্মতত্ত্বের শ্রবণে উপলব্ধি করা যায়।
সেই উপলব্ধি সঞ্চারিত হয়েছে অনন্ত উপাসনায়।
এই ব্রহ্মাণ্ডের দ্বার আপনার জন্য সর্বদা উন্মুক্ত।
আমাদের আত্মা সংযুক্ত—চৈতন্য জাগিয়ে রাখতে।
এ আত্মা শাশ্বত, বিশাল থেকে বিশালতর।
বাহ্যিক সত্তা বিলীন হলেও, আত্মিক মিলনের ক্ষয় নেই।
এই বিরাট আত্মিক যুগলবন্দীর সাক্ষী আমাদের জাগ্রত চেতনা।