ভদ্রলোকমাত্রই নিজের বউকে ভয় পান। খোঁজ নিয়ে দেখুন, বাইরে সিংহের মতন গর্জন করতে-থাকা অনেক পুরুষই ঘরের ভেতরে বেড়ালের মতন মিউমিউ করেন। সামাজিক ও মানসিকভাবে যে পুরুষ যত বেশি দুর্বল, সে পুরুষের ঘরোয়া বাহুজোর তত বেশি। পুরুষের পৌরুষ ঘরের বাইরেই বেশি মানায়। স্ত্রীকে অসম্মান কিংবা অমর্যাদা করার মধ্য দিয়ে অনেক পুরুষই নিজের অক্ষমতা লুকাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। যে পুরুষ নিজে বড়, তিনি কখনওই স্ত্রীকে ছোট করেন না। ঘরের মধ্যে পুরুষের চাইতে নারীর দাপটই বেশি সুন্দর দেখায়। এর উল্টোটা ঘটে তখনই, যখন ঘরের স্ত্রী তার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হন। আর যদি এ ব্যাপারটা ঘটে দেশের বাইরে, তখন সংসার টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়ে। মেয়েরা বিয়ের পর অসুর প্রকৃতির স্বামীর সাথে বিদেশে চলে গেলে প্রায়সময়ই খুব অসহায় হয়ে পড়ে। সমস্যা হল, বিয়ের আগপর্যন্ত ছেলেদের অসুর চেহারাটি মেয়েদের কাছে তেমন ধরা পড়ে না।
বিয়ের পর ১২টি বছর কেটে গেছে। দুই ছেলেও আছে। একজনের বয়স ১০, আরেকজনের ১১। বিয়ের মাত্র এক মাস পরেই বড় ছেলেটির ভ্রূণ নদীর শরীরে আসে। সেই অবস্থাতেও সফির অত্যাচার বন্ধ হয়নি। ওর সমস্ত পৌরুষ ছিল নদীর উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্যেই। সফি কখনওই স্বীকার করতো না যে ও নদীকে ওরকম অত্যাচার করতো। “এমনিতেই দুষ্টুমি করে তোমাকে দুএকবার ধাক্কা দিয়েছিলাম। সব স্বামীই ওরকম করে। এটা নিয়ে বলার কী আছে?” কথায়-কথায় খুব তুচ্ছ কারণেও ওর মেজাজ চরমে উঠত। বাইরে থেকে দেখে ওর এই দিকটি সম্পর্কে বোঝার কোনও উপায়ই ছিল না। বিয়ের আগে নদী কিংবা ওর পরিবারের কেউই এটা বোঝেনি। সফির সাথে আলাপ করলে একেবারেই নিপাট ভদ্রলোক বলে মনে হয়। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ হওয়ায় বিয়ের আগে ওর সাথে মেশার কোনও সুযোগই হয়নি নদীর। ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, বুয়েট থেকে পাসকরা, আমেরিকায় থাকে, এরকম সমন্ধ এলে অনেক বাবা-মা’ই সেই ছেলের ঘরে মেয়েকে গলাধাক্কা দিয়ে পাঠানোর আগ পর্যন্ত অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ধুয়ে পানিখাওয়া মেয়ের গার্ডিয়ানের অভাব নেই বাংলাদেশে। তার উপর প্রবাসী ছেলে, এর চাইতে বড় যোগ্যতা আর কী-ই বা হতে পারে? বিদেশ মানেই তো স্বর্গরাজ্য! বিয়ের পর মেয়ে সেই রাজ্যে থাকবে, এই সুখের নেশায় অনেক ফ্যামিলিই লাফাতে-লাফাতে তেমন কোনও খোঁজখবর না নিয়েই মেয়েকে ছেলের হাতে তুলে দেন। আমি নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। একবার এক বিয়েতে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে মেয়েপক্ষের এক আত্মীয়কে জিজ্ঞেস করলাম, “ছেলে কী করে?” উত্তর এল, “ছেলে কানাডায় থাকে।” শুনেই ধাক্কা খেলাম! এটা আবার কোন ধরনের পরিচয় দেয়ার স্টাইল? যিনি উত্তরটা দিয়েছিলেন, উনি একটা বেসরকারি কলেজে পদার্থবিদ্যা পড়ান। কথাপ্রসঙ্গে উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কী করেন?” হেসে বললাম, “আমি বাংলাদেশে থাকি।” (ওই সময়ে আর কী-ই বা বলতে পারতাম উনাকে!) এটা শোনার পর উনার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দেখার মতো হয়েছিল। যেসব মেয়ে প্রবাসী ছেলে বিয়ে করে, তাদের সবাইই যে ছেলেটিকে বিয়ে করে তা নয়, কেউ-কেউ প্রবাস জীবনযাপনটাকেই বিয়ে করে। কত বিয়েই তো বিদেশে থাকার বুদ্ধি ছাড়া আর কিছু নয়। হ্যাঁ, কিছু মেয়েও আছে, এমন। ওরা প্রবাসী ছেলে পেলেই বিদেশের আলোবাতাসে খেলে বেড়ানোর ভাবি সম্ভাবনায় লাফাতে থাকে। যা-ই হোক, সফির ব্যবহার ছিল খুবই মধুর আর অমায়িক, ওর সাথে কথা বলে ওকে পছন্দ না করাটা সত্যিই কঠিন। যারা ওর সাথে ভালোভাবে মিশত, শুধু তারাই ওর বদমেজাজের কথা জানতে পারত। এমনকি ওর নিজের ফ্যামিলির কেউই ভয়ে ওকে এমন কিছু বলতো না, কিংবা করতো না, যেটার কারণে ও রেগে উঠতে পারে।
বিয়ের পর নদী এরকম নির্যাতন সহ্য করতে-করতে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের ঠিক ৭ বছর পর ওদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সেরির দিনে খুব তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে নদীকে নির্দয়ভাবে পিটাতে-পিটাতে ওর দুই হাতে অসংখ্য কালশিটে দাগ ফেলে দিয়েছিল সফি। বলেছিল, “আর কোনওদিনও এরকম করলে তোকে আর তোর দুই ছেলেকে একেবারে খুন করে ফেলবো।” কারণটি ছিল এই, আগেরদিন চাচাত ভাইয়ের প্রথম মেয়ের জন্মের পর ওকে দেখতে দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে নদী হসপিটালে গিয়েছিল এবং বাসায় ফিরতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। বছর দুয়েক আগে নদীর সাথে দুর্ব্যবহার করা নিয়ে সফির সাথে নদীর ভাইয়া-ভাবির কথা কাটাকাটি হওয়ার কারণে ওদের সাথে সফি কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং সফিকে নদীর ভাইয়া ফোন করে প্রথম সন্তান জন্মের খবরটি দেয়ার পরেও মেয়েটিকে দেখতে যায়নি। “নদী কেন দেখতে গেল? দেরি করে বাসায় ফিরল কেন?” এই ইস্যু নিয়ে সফি মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। যেদিন নদীকে মেরেছিল, সেদিন দুই ছেলেকে নিয়ে সফি ঘুমাতে গেলে ওরা কী একটা কারণে যেন কাঁদছিল। ছোট মানুষ, কাঁদতেই পারে। কিন্তু এটা নিয়ে নদীর সাথে ইচ্ছে করেই চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে ওভাবে পিটিয়েছিল। পরের দিন সকালে ওর ৫ বছর আর ৬ বছরের ছেলে দুটোর মাথায় হাত রেখে সফি নদীকে বলেছিল, “ওদের কসম, গতরাতে আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছিল, তাই তোমার সাথে একটু দুর্ব্যবহার করে ফেলেছি। তুমি কিছু মনে কোরো না। সরি।” সারা শরীরের ব্যথায় নদী ওকে কিছুই বলতে পারছিল না। এ ভয়ও ছিল, যদি কিছু বললে আবারও পিটায়! সফি অফিসে চলে গেলে নদী ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে ওর দুই ছেলেকে নিয়ে ভাইয়ার বাসায় চলে গেল। সেখানে সে এক মাস থেকে চিকিৎসা নিয়েছিল। সফি মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন উপহার নিয়ে নদীকে দেখতে ওর ভাইয়ার বাসায় চলে যেত। যাদের সাথে ওর এই দুই বছর কোনও কথা হয়নি, তাদের সাথে হঠাৎ করেই খুব অমায়িক ব্যবহার করা শুরু করল। ও যা করেছে, তার জন্য ক্ষমা চাইল, এবং ওদেরকে আবার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় নদীর মাথায় হাত রেখে ভাইয়া বলেছিলেন, “বোন কী করবি বল! ওর একটু মাথাগরম, কিন্তু মানুষটা খারাপ না। মানিয়ে চলিস।” মেয়েরা চিরকালই কি মার খেয়েও ‘মানিয়ে’ চলবে? আমার মাথায় ঢোকে না, যে পুরুষ বউ পিটায়, সে পুরুষ ‘মানুষটা ভাল’ হয় কীকরে?
এর সপ্তাহখানেক পর। সফি সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখল, পিঠাপিঠি দুই ভাই কী একটা নিয়ে যেন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে। ওদের উপর ক্ষেপে গিয়ে ছোট ছেলেটাকে তুলে আক্ষরিকভাবেই আছাড় মারল। বড়টাকে কোমরের বেল্ট খুলে পিটাতে শুরু করল। নদী ওকে আটকাতে গেলে ওর চুলের মুঠি ধরে চড় মেরে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মারল। বেল্টের বাকলেস লেগে বড় ছেলেটির গালের ডানদিকে গভীর ক্ষত হয়ে গেল। “ওকে এই দাগটা না সারা পর্যন্ত বাইরে যেতে দিয়ো না। এই কয়দিন স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই, বাসায় পড়ুক।” সফি চাইছিল না, ও যা করেছে তা কেউ জেনে যাক। সফি অস্বাভাবিক রকমের বেশি মিথ্যা কথা বলতো, নিজের আসল রূপটি পুরো পৃথিবীর কাছ থেকেই লুকিয়ে রাখত। ওর যখন কোনও উদ্দেশ্য হাসিল করার প্রয়োজন হতো, তখনই সে নানান ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে থাকত। পরবর্তীতে উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেলে সেগুলি নিয়ে জিজ্ঞেস করলে খুব অবাক হয়ে বলতো, “কই? আমি তো এটা কখনওই বলিনি!”
সফির সাথে কয়েক বছরের সংসারে নদী এটা খুব ভাল করেই বুঝে গিয়েছিল যে, সফির উপর কখনওই বিন্দুমাত্রও আস্থা রাখা যাবে না। কিন্তু শুধু দুই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে ওর সাথে থেকে গিয়েছিল। প্রথম সন্তানের জন্মের ছয় মাসের মাথায়ই দ্বিতীয় সন্তানটি নদীর গর্ভে আসে। নদী প্রায়ই ভাবত, আল্লাহ্ ওকে দুই ছেলে দিয়েছেন শুধু এ কারণেই, যাতে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে হলেও সে কোনওদিনই সফিকে ছেড়ে চলে না যায়। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর নদী আগের চাকরিটি ছেড়ে আরেকটি চাকরি নেয়, যেটি ছিল পার্টটাইমের, যেখানে কাজের চাপও অনেক কম ছিল। এতে করে ও বাচ্চাদের যত্ন নিতে পারত আর ঘরের সব কাজকর্মও গুছিয়ে করতে পারত। সফি একটা আইটি ফার্মে চাকরি করার পাশাপাশি ওর এক দূর সম্পর্কের খালাত ভাইয়ের সাথে শেয়ারে একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছিল। রেস্টুরেন্টের ব্যবসা জমে উঠলে সফি চাকরি ছেড়ে ব্যবসার দিকে আরও ভালভাবে মন দিতে শুরু করে। আস্তে-আস্তে সে দোকানটির তিনটি আউটলেট হল। ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেয়ার পর সেটি পুরোটা শোধ না করায় ব্যাংক ওকে বাড়ি কেনার জন্য লোন দিচ্ছিল না। তাই সে বাধ্য হয়ে নদীর নামে হোমলোন নেয়। নদী আর সফি মিলে যুগ্ম মালিকানায় একটা ফুলের দোকানও খুলেছিল। সে দোকানের লোনের টাকাও নিয়েছিল নদীর নামে। যে ভাইয়ের সাথে সফি ব্যবসা করতো, সে ভাইয়ের বাড়ি কেনার লোনের টাকাও ওরা নদীর নামে নিয়েছিল, কারণ ওদের নিজেদের নামে লো-রেটে লোন ম্যানেজ করতে পারছিল না। এভাবে করে ব্যবসার সিংহভাগ টাকাই লোন-করা ছিল নদীর নামে, কিন্তু ব্যবসার সব কিছুই চলত সফির নামে। নদীর মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গিয়েছিল, সে সফিকে ছেড়ে চলে গেলে যদি সফি এই বিশাল ঋণের বোঝা নদীর কাঁধে চাপিয়ে দেয়, তখন ও কী করবে?
সফি অনেক টাকা আয় করলেও ভীষণ রকমের কৃপণ ছিল। সেটা নিয়ে ওকে কিছু বললেই অসম্ভব ক্ষেপে উঠত বলে ভয়ে নদী ওকে কিছুই বলতো না। সে প্রায়ই বলতো, “তোমাদের জন্যই তো আমার সব টাকাপয়সা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে বাড়ির সব খরচ মেটাতে হয়, ইউটিলিটি বিলটাও তো আমিই দিই। তোমাদের খাওয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, ছেলেদের পড়ার খরচ, তোমার সাজগোজের জিনিসকেনা, এসবের পেছনে প্রতিমাসে আমার কত টাকা নষ্ট হয়, জানো?” বিয়ের পরের ১২ বছরে সফি ওর পরিবার নিয়ে যেখানে-যেখানে ঘুরতে গিয়েছিল, সেগুলি হল: ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে, কারণ ওর ক্রেডিট কার্ডের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই কার্ডেথাকা মাইলেজটা ওকে খরচ করে ফেলতে হচ্ছিল। ওরা প্রতি বছর হারশে পার্ক এবং অন্যান্য অ্যামিউজমেন্ট পার্কে ঘুরতে যেত, কারণ সফি তার ফুড বিজনেসের সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে ফ্রি এন্ট্রি-টিকেট পেত। ২০০৭ আর ২০১৪ সালে সফি ওদেরকে বাংলাদেশে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল, কারণ কিছু জায়গাজমি কেনা আর ঢাকায় ওর ফুডশপের একটা আউটলেট খোলার ব্যাপারে একটু খবরাখবর নেয়া দরকার ছিল। সফি ফ্যামিলি নিয়ে ২০১২ সালে কানাডায় গিয়েছিল, কারণ ওর বড়বোন কানাডিয়ান ভিসা পেয়ে কানাডায় গিয়েছিল, কিন্তু ভাইয়ের সাথে দেখা করতে আমেরিকায় আসার সময় পাচ্ছিল না। ওদের প্লেনের টিকেট ওর বড়বোনই স্পন্সর করেছিল। এভাবে সফি ওর ফ্যামিলিকে নিয়ে যত জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিল, সব জায়গাতেই ওর কোনও না কোনও কাজ থাকত, কিংবা কোনও একটা ফ্রি অফার পেত। ও কখনওই পরিবারকে নিয়ে বাইরে কোথাও খাওয়াদাওয়া করতে যেত না, কোথাও ঘুরতে গেলে ছেলেদের খেলনাটেলনা কিনে দিত না, নদীকে কিছু কিনে দেয়ার কথা তো ওর মাথাতেও আসত না। কিছু-কিছু দর্শনীয় স্থান আছে, যেখানে ঘুরতে গেলে কোনও টিকেট কিনতে হয় না, এই যেমন, কোনও একটা মন্যুমেন্ট দেখা, খোলাপার্কে হাঁটাহাঁটি করা, ওরকম জায়গাগুলিতে সে ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে যেত। যদি কখনও দেখত, কোনও জায়গা ঘুরে দেখার জন্য টিকেট কিনতে হয়, তবে সে ভেতরে না ঢুকে বাইরে সবাইকে নিয়ে দুটো ম্যাকডোনাল্ড বার্গার কিনে ভাগাভাগি করে খেয়ে ঘরে ফিরে আসত। এটাই ছিল ওর পারিবারিক প্রমোদভ্রমণের স্টাইল। কিপ্টে ছেলের সাথে প্রেমকরা কিংবা ঘরকরা, দুটোই অতি অতি অতি বিরক্তিকর!
সফির কিপ্টেমির কথা ভেবে নদী কখনওই ওর চাকরিটা ছাড়ার কথা ভাবতে পারত না। সফি সবাইকে বলে বেড়াত, “নদীকে আমি চাকরি করতে নিষেধ করি, কিন্তু ও কথা শোনে না। ওর যখন যা লাগে, সেটা আমি সবসময়ই চাওয়ার আগেই কিনে দিই, ওকে তো কোনও অভাবেই রাখিনি আমি। ও তো চাকরি ছেড়ে বাচ্চাদের সময় দিতে পারে। কেন যে শুধু-শুধু চাকরি করে, আমি সেটাই বুঝি না!” নদী কাউকে কিছুই বলতো না। মনে-মনে ভাবত, কাজলকেনার পয়সা চাইলেও যে স্বামী সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “চোখে এতো কাজল দেয়ার কী আছে?”, সে স্বামীর ঘর করতে হলে চাকরি করেই করতে হবে। স্ত্রীর ছোটোখাটো শখপূরণের পয়সা দেয়ার সময় অহেতুক জেরা করলে স্ত্রী যে কতটা মনখারাপ করে, সেটা আরও অনেক পুরুষের মতন সফিও কখনও বুঝতে চাইত না। নদী নিজেও কারোর মুখাপেক্ষী হয়ে জীবন কাটানোর দর্শনে বিশ্বাসী ছিল না। যার কাছে হাত পাতলে পয়সার সাথে খোঁটা আর কৈফিয়ততলবও মিলে, তার কাছে হাত পাতার চাইতে বরং নিজহাতের জোরে তার কিছু খরচ বাঁচিয়ে দিলে বরং বেশি সম্মান পাওয়া যায়। বাড়িকেনার মর্টগেজের টাকা আর ইউটিলিটি বিলটা শফি দিত, আর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ওর নিজের, স্বামীর আর বাচ্চাদের পোশাকআশাক, রান্নাঘরের নানানকিছু, বাচ্চাদের স্কুলের বেতন আর সব জিনিসপত্র, ওদেরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, ওষুধপত্রের খরচ, অতিথি আপ্যায়নের খরচ, এরকম বিভিন্ন ধরনের খরচ নদীই সামলাত। তা সত্ত্বেও ওকে শুনতে হতো, “এই সামান্য কয়টা টাকা খরচ করেই এতো বাড়াবাড়ি করার কী আছে?” ওদের দুজনের একটা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট ছিল, কিন্তু নদী সব খরচই করতো ওর পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট থেকে; ভয়েই কখনও সেই জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে হাত দিত না। ওরকম কিছু করলে সফি ক্ষেপে গিয়ে ওকে গালাগাল করতে ছাড়ত না। নদীকে ওরকম করতে হয়েছিল শুধু একবার। একটা চ্যারিটি ফান্ডে বেশ কিছু টাকা সাহায্য হিসেবে দিয়ে দেয়ায় নদীর হাতে টাকা ছিল না। তখন সে বাধ্য হয়ে ওদের জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে সামান্য কিছু টাকা তুলে বড় ছেলের স্কুলের বেতন দিয়েছিল। সফি এটা নিয়ে খুব রেগে গিয়ে ওকে চোর বলে গালাগালি করেছিল। বলেছিল, “তোমার লজ্জাও করল না এরকম চোরের মতন আমার টাকা নিতে? তোমাকে বিশ্বাস করে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টটা খুলেছিলাম। আর তুমি কিনা! ছিঃ!” ওর নিজের ছেলের স্কুলের বেতনের টাকা নিয়ে নিজের স্ত্রীর সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করেছিল। এরপর থেকে নদী আর কোনওদিনও সেই জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে হাত দেয়নি। নদীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সফি সেই জয়েন্ট অ্যাকাউন্টটা খুলেছিল শুধু এই কারণে যে, ওটা ব্যবহার করে ব্যবসার প্রয়োজনে নদীর নামে লোন নিতে সুবিধা হতো।
নদী কখনওই অন্য মেয়েদের মতো নিজের শখআহ্লাদ পূর্ণ করতে বাড়তি কাপড়, গহনা, জুতো, কসমেটিক্স, এসব কিনতে পারত না। জীবনের প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে-করতে ওর চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গিয়েছিল, ওকে দেখতে ওর প্রকৃত বয়সের তুলনায় বয়স্কা দেখাত। সেটা নিয়ে সফির কোনও মাথাব্যথা ছিল না। নিজের এবং সন্তানদের জন্য যতটুকু না কিনলেই নয়, শুধু ততটুকুই কিনত নদী। তাও কিনত পুরোপুরি নিজের পরিশ্রমে উপার্জিত টাকায়। অথচ এটা নিয়েও ওকে কথা শুনতে হতো। সফি নিজের জন্য কিংবা ওর ফ্যামিলির জন্য কখনওই কোনও কেনাকাটা করতো না, নদীর সামান্য কেনাকাটা দেখলেও ওর উপর ক্ষেপে উঠত। “এতো রংঢং কেন কর, সেটা কি আমি বুঝি না ভেবেছ? তোমার মতন মেয়ের পাল্লায় পড়ে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল। বাজে খরচ করা ছাড়া আর কিছু করতে পারো না তুমি? যেখানে স্রেফ দুই জোড়া ড্রেস হলেই চলে, সেখানে তুমি ড্রেসের দোকান সাজিয়ে ফেলেছ! ভবিষ্যতের চিন্তা করা কি শুধু আমারই দায়িত্ব? তোমার নিজের কোনও দায়িত্ব নেই? লজ্জাও করে না তোমার?” কখনও-কখনও নদী আর দুই ছেলেকে গালাগালির এক পর্যায়ে আলমারি খুলে ওর নিজের সব ড্রেস মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিত সফি, আর বলতো, “আমার লাগবে না তোমার দেয়া ড্রেস! আমাকে এ ক’টা ড্রেস কিনে দিয়ে দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলেছ! এগুলি সব আমি আগুনে পুড়িয়ে ফেলবো।” এটা বলেই মেঝেতে ছড়ানো ড্রেসগুলিতে লাথি মারতে-মারতে পাশের রুমে চলে যেত। মেয়েরা নিজের টাকায় তাদের প্রিয় মানুষটির জন্য কিছু কেনার সময় অনেক যত্ন আর ভালোবাসা নিয়ে কেনে। আর সেটি নিয়ে প্রিয় মানুষটি বাজে কথা বললে ওদের বুকের ভেতর থেকে প্রচণ্ড কান্না পায়। মাথা নিচু করে চোখের জল মুছতে-মুছতে নদী সফির ড্রেসগুলি কুড়িয়ে নিয়ে আবার আলমারিতে গুছিয়ে রাখত। সে সময় দুই ছেলে ভয়ে দরোজার পেছনে লুকিয়ে থাকত।
২০১৪ সালে দেশে আসার সময় জেদ করে নদীকে ১২টি ড্রেস কিনে দিয়েছিল সফি। দেশে আসা উপলক্ষে নদী একটা ইন্ডিয়ান অনলাইন শপ থেকে পছন্দ করে ৬টী ড্রেস অর্ডার করেছিল, কারণ ও চাচ্ছিল না যাতে দেশে কেউ জানতে পারে, সফি ওকে ড্রেস কিনে দেয় না। বিয়ের ১২ বছরের মধ্যে সেইবার প্রথমবারের মতো নদী নিজের জন্য একসাথে অতোগুলি ড্রেস কিনেছিল। সফি ধরেই নিয়েছিল, যেহেতু নদী নিজেই টাকা আয় করে, সেহেতু ওকে ড্রেস কিনে দেয়ার কোনও দরকারই নেই। স্ত্রী চাকরি করে বলে স্ত্রীকে হাতখরচ দেয় না যে পুরুষ, সে পুরুষ মুখে যা-ই বলুক না কেন, মানসিকভাবে স্ত্রীর আয়ের উপর পুরোপুরিই নির্ভরশীল। চাকরি করুক আর না-ই করুক, প্রত্যেকটি মেয়েই চায়, ওর ভালোবাসার মানুষটি ওকে মাঝেমধ্যে কিছু হাতখরচ দিক। এই চাওয়াটা প্রয়োজন থেকে নয়, ভালোবাসার দাবি থেকে। স্ত্রীর সব ধরনের খরচ নির্বাহ করার ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছে নেই যে পুরুষের, সে পুরুষের বিয়ে করাই অনুচিত। নদী ড্রেস অর্ডার করার ব্যাপারটা জানার পর সফি প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে ওকে আজেবাজে কথা বলা শুরু করল। “ও আচ্ছা, আমি তোমাকে ড্রেস কিনে দিই না, তাই না? দুই পয়সা কামাচ্ছ, সেটা বাংলাদেশে গিয়ে সবাইকে জানাতে হবে। আমাকে ছোট না করলে তোমার শান্তি হয় না। ইন্ডিয়া থেকে কেন তোমাকে ড্রেস কিনতে হয়, সেটা কি আমি বুঝি না? কোন ইন্ডিয়ান বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছ যে তোমাকে ওই ড্রেসগুলি শিপমেন্ট করে দেবে?” সেদিনই ওকে ১২টি ড্রেস কিনে দেয় সফি। পরবর্তীতে প্রায়সময়ই খোঁটা দিয়ে বলতো, “খবর্দার! আমার কিনেদেয়া ড্রেসগুলিতে হাত দেবে না! নতুন-নতুন ড্রেস পরে-পরে কাকে ইমপ্রেস করতে ঘুরে বেড়াও? সব ড্রেসই এখুনিই পরে পরে নষ্ট করে ফেলতে হবে কেন?” স্ত্রীকে কোনওকিছু কিনে দেয়ার সময় শুধু হৃদয়ের ভালোবাসা আর শান্তি থেকেই কিনে দেয়া উচিত, লোকজনকে দেখানোর আর বলে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু সফি দ্বিতীয় কাজটিই করতো। নদীকে কোনওকিছু কিনে দিলেই সেটার ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করে সবাইকে জানিয়ে দিত। পরিচিত জনদের সাথে সে জিনিসের দাম বাড়িয়ে-বাড়িয়ে শেয়ার করতো। পুরোই মেয়েলি স্বভাব! ১২ বছরের বিবাহিত জীবনে নদীকে সফি একজোড়া হিরেবসানো কানের দুল আর দামি ঘড়ি কিনে দিয়েছিল। নদী যখনই সেগুলি পরে কোথাও যেত, তখনই সে সবাইকে বলতো, “দেখ তো, আমার নদীকে ওই হিরের দুল আর ঘড়িতে খুব মানায় না?” ওর উদ্দেশ্য ছিল এই, সবাই যাতে বিশ্বাস করে, ও নদীকে ভীষণ ভালোবাসে আর নদীর জন্য সবসময়ই দামি দামি উপহার কিনে দেয়। সবাই ভাবত, নদী কোন কারণ ছাড়াই চাকরি করে, বাসায় সময় দেয় না, বাচ্চা দুটোর ঠিকমতো যত্ন নেয় না। সফির মতো ছেলে বলে নদীর এই স্বেচ্ছাচারিতা সহ্য করছে। অন্য ছেলে হলে কবেই ডিভোর্স দিয়ে দিত!
যখনই নদী সফিকে বলতো, “এতো কিপ্টেমি করে চলার কী দরকার? আল্লাহ্ তো আমাদের ভালই রেখেছেন।” তখনই সফি ক্ষেপে গিয়ে বলতো, “ঠিক আছে, তুমি তাহলে বাড়িকেনার মর্টগেজের টাকা মাসে মাসে পে কর। আমার উপরে সব চাপিয়ে দিয়ে তো নিজে সুখে আছ!” সফি খুব ভাল করেই জানত, নদী চাকরি করে যে সামান্য টাকা পায়, তা দিয়ে কোনওভাবেই মর্টগেজের টাকা পরিশোধ করতে পারবে না। সফি নদীকে বলতো, “তোমার পার্টটাইম কাজ করার দরকারটা কী? এতো আরামে জীবন চলে না। ছেলেরা তো বড় হয়ে গেছে! ফুলটাইম কাজ করলেই তো পারো! পুরো চাপটা আমার একার উপর না দিয়ে আমাকে কিছু-কিছু হেল্প করলেও তো হয়! প্রয়োজনে বাসার রান্না আর কাপড়ইস্ত্রি আমি করে দেবো।” অনেক স্বামীর মতো সফিও কখনওই বুঝতে পারত না, বাচ্চাদের মানুষ করা, ঘরের সমস্ত ধোয়ামোছা, রান্না, বাজারকরা, এসব কাজে একজন স্ত্রীর যে কী পরিমাণ সময় আর শ্রম দিতে হয়! “ঠিক আছে, এখন থেকে বাজারটাও আমিই করবো।” সফি এটা যতবারই বলতো, ততবারই নদী বুঝতে পারত, এইমাত্র আরেকটা প্রমিজ করা হল যেটা ভাঙার অপেক্ষায় আছে! যে মানুষটি সন্ধ্যা ৭টায় বাড়ি ফিরে কোনওদিনই তার নিজের দুই সন্তানের সাথে ২ মিনিটও সময় কাটায় না, সে মানুষটির মুখ থেকে এ ধরনের কথা বিশ্বাস করাটা সহজ নয়। বাসায় ফিরেই সফি হয় ল্যাপটপে বসে, নাহয় ভিডিও গেমস খেলতে থাকে, টিভি দেখে, কিংবা ঘুমিয়ে পড়ে। স্ত্রীর আর দুই ছেলের কোনও প্রকারের খরচ নিয়েই সফিকে কখনও চিন্তা করতে হতো না, সে ভোর ৫টায় বেরিয়ে ৭টায় বাড়ি ফিরে আসত এবং এ পরিশ্রমের ফলে যা আয় করতো তার কিছু অংশ খরচ করতো মর্টগেজের টাকা পরিশোধ করতে। এর বাইরে যা থাকত, সেটা বাংলাদেশে জমি কিনে বিল্ডিং বানানোর জন্য বিনিয়োগ করতো। ওর প্ল্যান ছিল, বিল্ডিং হয়ে যাওয়ার পর ফ্ল্যাটগুলি ভাড়া দিয়ে যে টাকা পাবে, সে টাকা দিয়ে সে আরও ব্যবসা করতে পারবে। “তোমার দুই ছেলেই তো এখানে। তুমি সব টাকা দেশে না পাঠিয়ে ছেলেদের জন্য এখানে কিছু কর।” নদীর এই বুদ্ধিকে সফি কোনওদিনই গুরুত্ব দেয়নি। বলতো, “আমার টাকা, এটা দিয়ে আমি যা ইচ্ছা, তা-ই করবো। তুমি এটা নিয়ে বলার কে? তোমার টাকা নাকি?” যে সংসারের টাকা স্বামীর টাকা আর স্ত্রীর টাকা—এই দুই ভাগে বিভক্ত, সেই সংসার স্বামীর সংসার আর স্ত্রীর সংসার—এই দুই ভাগে বিভক্ত।
স্বামীর মন পাওয়ার জন্য নদী অনলাইনে কাজ করা যায়, এরকম একটা প্রতিষ্ঠানে ফুলটাইম চাকরি নিল। বাসায় বসে-বসে চাকরি করার সুযোগ থাকায় আগের চাইতে আরও বেশি সময় ছেলেদের পেছনে দিতে পারত, ঘরের কাজগুলিও আরও গুছিয়ে করতে পারত। তবে এতে নদীর পরিশ্রমের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল। সফি যখন বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে থাকত, তখন নদী জেগে-জেগে অনলাইনে কাজ করতো। আয় বেড়ে যাওয়ায় আগের সব খরচকে ঠিক রেখে বাড়ির মর্টগেজের অন্তত অর্ধেক টাকা সে দিতে লাগল প্রতিমাসেই। সফি জীবনের সবকিছুই বিচার করতো টাকার পরিমাপে। জীবনে টাকাই সব—এটা ছিল সফির জীবনের একমাত্র মূলমন্ত্র। এমনকি যখন সে টিভি দেখত, তখন সে ভাবত, এই যে আমি সময় নষ্ট করে বিদ্যুৎবিল খরচ করে টিভি দেখছি, এতে আমার কী লাভ হচ্ছে? আমার এই সময়টা টিভির ওই অ্যাক্টরের পেছনে ইনভেস্ট করার কারণে ও তো প্রচুর টাকা পাচ্ছে, কিন্তু আমি কী পাচ্ছি? ও ক্রিকেট দেখত না। ওর যুক্তি ছিল, টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরি দেখে আমার কী লাভ? সেঞ্চুরি করলে ও টাকা পায়, কিন্তু আমি কী পাই? সফি কখনওই কোনও ভাল প্রোগ্রাম উপভোগ করতে পারত না। ওর পাশে বসে কোনও মুভিই শান্তিতে দেখা যেত না। ওর গল্প করার একমাত্র প্রসঙ্গই ছিল টাকা। গল্পের মধ্যে টাকার ব্যাপারটি কোনও না কোনওভাবে ও নিয়ে আসতোই! ও বলত, “লোকে কেন যে বলে মানি ইজ দ্য সেকেন্ড গড, আমার মাথায় ঢোকে না। আরে বাবা, গডের আবার ফার্স্ট সেকেন্ড কী? মানি ইজ গড! ব্যস্!” অথচ, জীবনের যে সুখগুলিকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না, সে সুখগুলিই সবচাইতে দামি। টাকার চাইতে দামি কোনওকিছুর প্রতিই সফির বিন্দুমাত্রও আগ্রহ ছিল না।
তেমন কোনও বোধগম্য কারণ ছাড়াই খুব দ্রুত সফির মুড-সুইং করতো। হঠাৎ-হঠাৎই রেগে উঠত। আর রেগে গেলেই কোন আগপাছ না ভেবেই যা করতে ইচ্ছে করে, তা-ই করতো। এটা নিয়ে নদী খুব ভয়ে-ভয়ে থাকতো। তবে মর্টগেজের অর্ধেক টাকা শেয়ার করার পর থেকে নদীকে ও এখন আর শারীরিকভাবে আঘাত করে না। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া নদী এবং দুইছেলে কখনওই সফির সাথে কোনও কথা বলে না। নদী ভাবে, সংসারটা টিকিয়ে রাখতে হলে এর চাইতে ভাল আর কোনও উপায় নেই। বোবার শত্রু নেই। বোবা থেকে দেখিই না সব ঠিক হয়ে যায় কি না? একদিন বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে ওরা দুইজন বসে-বসে টিভি দেখছিল। নদী কিছুই না বলে একটা সোয়েটার বুনে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই “কী ব্যাপার? কিছু বলছ না যে? সারাক্ষণ তোমার কোন বয়ফ্রেন্ডের কথা ভাবো? কত নাম্বারটা? সারাদিন বাসায় বসে-বসে চাকরি কর, নাকি বাচ্চা স্কুলে গেলে বয়ফ্রেন্ডের সাথে ফষ্টিনষ্টি কর?” এরকম আরও কিছু আজেবাজে কথা বলে নদীকে গালাগালি করা শুরু করে দিল। একটা পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে নদী বলল, “তোমার সাথে থাকা আর সম্ভব নয়। আমি তোমার সাথে ডিভোর্স করে ফেলতে চাচ্ছি।” এটা শোনামাত্রই সফি চিৎকার করে উঠল, “ওকে ফাইন! আমি কালকেই তোমাকে ডিভোর্সের কাগজপত্র এনে দেবো, সাইন করে দিয়ো। তোমার জন্যই তো সুবিধা। এখন থেকে যার সাথে খুশি তার সাথেই শুতে পারবে। তোমার কাজিন দুইদিন পর-পর কেন আসে, আমি কি বুঝি না মনে কর? দুনিয়ার ছেলেদের সাথে হেসে-হেসে কী বলতে চাও, সেটা একটা বাচ্চা ছেলেও বোঝে!” নদীর চাইতে দশ বছরের ছোট ওর খালাত ভাই স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়াশোনা করতে গিয়েছিল। সে মাঝেমধ্যে আপুর সাথে দেখা করতে আসত। অন্য ছেলেদের সাথে কথা বললে সফি ঈর্ষান্বিত হয়ে রেগে ওঠে বলে নদী ভয়ে অন্য ছেলেদের সাথে কথাই বলতো না। কখনও-কখনও কারও-কারও ‘হ্যালো’র উত্তরও এতো বাজেভাবে দিত যে ওরা ওকে উদ্ধত ভাবত।
গত ৫ বছরে সফি নদীকে কোনও মারধর করেনি। কিন্তু মানসিকভাবে যে পরিমাণ নির্যাতন করেছে, সেটা কয়েকটা মৃত্যুর চাইতেও বেশি যন্ত্রণার। শরীরে আঘাত করলে রক্ত ঝরে, ঝরতে-ঝরতে একটা সময়ে রক্তঝরা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মনে আঘাত করলে রক্ত ঝরতেই থাকে, ঝরতেই থাকে, আর বন্ধ হয় না। চোখে দেখা যায় না বলে তার খোঁজ কেউ কোনওদিনই জানতে পারে না। দেহের যন্ত্রণা ওষুধে সারে, কিন্তু মনে যন্ত্রণা সারে কীসে? নদী মাঝে-মাঝে ভাবে, “ইসস! সফি যদি আমাকে আগের মতো পিটাত, খুব ভাল হতো, সবাইকে দেখাতে পারতাম, বলতে পারতাম, দেখ, তোমাদের সবার চোখে ভাল মানুষটার আসল চেহারাটা দেখ! কিন্তু মনের ক্ষত তো আর কাউকে দেখানো যায় না। বলে বোঝানোটাও বেশ কঠিন।” বিশেষ করে, সফি যখন সবার সাথে অত্যন্ত দয়ালু আচরণ করে, বাইরের সবাইকে বিভিন্নভাবে হেল্প করে, পুরো পৃথিবীর সাথে হাসিমুখে কথা বলে, তখন নদীর মনে এই ইচ্ছেটা আরও বেশি করে চেপে বসে! নদীর সবকিছু জানতে পারলে বেশিরভাগ লোকই হয়তো ওকে বলবে, “বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে হলেও দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য ধরে সহ্য করে যাও।” নদী এখন তা-ই করছে। কিন্তু সে প্রায়ই ভাবে, “সে যা করছে, সেটা কি আসলেই ওর সন্তানদের জন্য ভাল হচ্ছে?” সম্প্রতি নদীর বড় বোনের ডিভোর্স হয়ে গেছে। ওকে নিয়ে ওর বাবা-মা অনেক কষ্টের মধ্যে আছেন। এখন যদি ওরও ওরকম কিছু হয়, তাহলে তো উনারা আর বাঁচবেনই না। অনেক ছেলেই মেয়ের বাবা-মা আর আত্মীয়স্বজনের সাথে এতো চমৎকারভাবে সম্পর্ক রেখে চলে যে, ওরা কল্পনাতেও আনতে পারে না, ওদের মেয়েটিকে ছেলেটা কী পরিমাণ কষ্ট দেয়! সফির বদমেজাজ আর মিথ্যে বলার অভ্যেস নিয়ে নদীর বাবা-মা’ও কিছু-কিছু জানেন, কিন্তু সফি ওর অসাধারণ ব্যবহার দিয়ে উনাদেরকেও মুগ্ধ করে ফেলে। বরং, কখনও-কখনও উনারা নদীকেই বলেন, “দেখ মা, সফি অনেক ভাল একটা ছেলে। ভাল মানুষের মেজাজ মাঝেমধ্যে ওরকম একটু গরম হয়। তুই ওর সাথে মানিয়ে চলতে চেষ্টা কর। ছেলে দুটোকে তো মানুষ করতে হবে।” এসব শুনলে নদী ওর বাবা-মা’র কাছে সফির সাথে ওর ডিভোর্সের কথা আর তুলতেই পারে না। ওর দুই ছেলেও বাবার প্রতি তেমন একটা টান অনুভব করে না। সফিও চায় না, যদি ডিভোর্স হয়েই যায়, তবে ছেলেদের নিজের কাছে রাখতে। আগে ছেলেদের সাথে সময় না কাটালেও ইদানিং সফি উইকএন্ডে ১০ মিনিটের মতো ওদের সাথে হাসিমুখে গল্প করে। এইটুকুই ওদের জন্য অনেক! ওরা বাবার কাছ থেকে এইটুকুও কোনওদিনই পায়নি। ছেলেরাও চায়, ওদের মা ওদের বাবার সাথে না থাকুক। এসব কারণে নদী আসলেই চাচ্ছে, ওদের মধ্যে ডিভোর্সটা হয়ে যাক। এটা নিয়ে ও এর মধ্যে একজন আইনজীবীর সাথেও পরামর্শ করে ফেলেছে। ব্যাপারটা জানতে পেরে সফি নদীর সাথে এক মাস কোনও কথাই বলেনি। এরপর এসে ওকে জিজ্ঞেস করেছে, “তুমি ঠিক আছ তো? তুমি আবারও ডিভোর্সের কথা ভাবছ কেন? আমার সাথে থাকতে তোমার সমস্যাটা কোথায়? আমি যদি কোনও ভুল করে থাকি, তবে সেটার জন্য আমি তোমাকে ‘সরি’ বলছি। তুমি সত্যিই জানো না যে, আমি তোমাকে এই পৃথিবীর যেকোনও কিছুর চাইতেও বেশি ভালোবাসি।” এইসব কথা নদী জন্য অভিনব কিছু নয়। এতোগুলি বছর এইসব শুনতে-শুনতে ওর মুখস্থ হয়ে গেছে। সফির ভালোবাসার মিথ্যে আশ্বাস বিশ্বাস করে ঠকতে-ঠকতে ইদানিং নদী সফির প্রতি আর তেমন একটা ভালোবাসা অনুভব করে না। এখন ওদের একসাথে থাকার পুরো ব্যাপারটাই স্রেফ অভ্যাস কিংবা আলাদা হয়ে যেতে পারার অপারগতা।
সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষকে বিয়ে করার পর ওর প্রতি ভালোবাসা একদিনে জন্মায় না, ওটা জন্মাতে সময় লাগে। বিয়ের পরপরই একজন অপরিচিত মানুষকে হুট করে ভালোবাসতে শুরু করে দেয়া অসম্ভব। অন্য দশটি মেয়ের মতোই নদীও সেই ভালোবাসার জন্মের আশ্চর্য মুহূর্তটা দেখার জন্য দিনের পর দিন প্রতীক্ষা করেছে। আর কতদিন প্রতীক্ষা করে থাকলে সেও অন্য সবার মতোই অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের ভালোবাসার জন্মটা অনুভব করতে পারবে? যে ভালোবাসা শুরু থেকেই নিম্নগামী হতে-হতে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, সেই ভালোবাসার অনিশ্চয়তা কোন অলৌকিক ইন্দ্রজালের কারসাজিতে সারাজীবন আশ্রয় দিয়ে রাখবে নদীকে? ওটা কি আদৌ ভালোবাসা? নদী আর বিশ্বাস করে না যে, সে সফিকে সুখী করতে পারবে। সফির জন্য নদীর মধ্যে আর কোনও মায়া কাজ করে না, কোনও ভালোবাসাও কাজ করে না। নদীর সাথে এরকম করে দিনের পর দিন একটা স্রেফ কাজচালানোর সম্পর্ক রেখে সফির নিজেরই বা কী লাভ হবে? সফি কখনওই বদলাবে না। আর কতদিন একটা মানুষকে বদলানোর জন্য সময় দেয়া যায়? নদী কী করবে, কেন করবে, ওর সামনের দিনগুলিতে ওর জন্য কী অপেক্ষা করছে, এসবের কিছুই সে ভাবতে পারে না। নদী প্রতিটি মুহূর্তেই ওর ভেতরে সেই দ্বিধাহীন মনটির জন্মের জন্য প্রতীক্ষা করে আছে, যেটি ওর ভেতরে জন্মে গেলে ও ওর বাবা-মা’কে ডিভোর্সের কথাটি বলে দিতে পারবে। বাবা-মা’র সাথে ফোনে কথা হলে ও কেমন আছে, সেটা কিছুতেই বুঝিয়ে বলতে পারে না। কাছের মানুষকে নিজের যন্ত্রণার কথা বোঝাতে না পারাটা আরও বেশি যন্ত্রণার।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে ‘নার্সিসিস্টিক অ্যাবিউজ’ বলে একটা টার্ম আছে। যারা নার্সিসিস্ট, তাদের মধ্যে শুধুই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার প্রবণতা দেখা যায়। অন্যের সম্মানবোধ আর আবেগগুলিকে উপেক্ষা করে ওরা এমন সব কাজ করে কিংবা আচরণ দেখায়, যেটাতে ওর আশেপাশের লোকজন যতক্ষণই ওর কাছাকাছি থাকে, ততক্ষণই ‘লো ফিল’ করতে থাকে। এইরকম নিজে ভাল অনুভব করে, অন্যের সাথে কথাবার্তা, আচারআচরণ, কাজকর্ম দিয়ে অন্যকে বাজে অনুভব করানোর ব্যাপারটিই হল ‘নার্সিসিস্টিক অ্যাবিউজ’। এইরকম লোকের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রাখলে নিজের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মানবোধ, দুটোই কমতে থাকে। এইরকম কারোর সাথে না থাকার সিদ্ধান্তই সবচাইতে ভাল সিদ্ধান্ত। সফির আচরণে নার্সিসিস্ট ব্যক্তির বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্য দেখা গেলেও, সে যে পুরোপুরি নার্সিসিস্ট, তাও নয়। এই যেমন, নদী কখনও অসুস্থ হয়ে গেলে, সে অফিসে না গিয়ে বাসায় থেকে নদীর সেবাযত্ন করে, ওর কী লাগবে, সে খোঁজখবর নেয়, ওকে ওষুধপত্র খাইয়ে দেয়। এই ব্যাপারগুলি নার্সিসিস্ট ক্যারেক্টারের লোকজনের সাথে যায় না। তাছাড়া, একজন ব্যক্তি নার্সিসিস্ট, শুধু এই যুক্তিতে ওর সাথে বিয়ের বন্ধন ছিন্ন করে দেয়াও ঠিক নয় বলেই মনে হয়। সফি বাইরের সবার কাছে খুবই চমৎকার একজন মানুষ। শুধু নিজের ফ্যামিলির লোকজনের সাথেই সে তার সমস্ত রাগ দেখায়, বাজে ব্যবহার করে, ওদের প্রতি দায়িত্বগুলি ঠিকমতো পালন করে না। মজার ব্যাপার হল, সে নিজে মনে করে, এরকম রাগারাগি সব ফ্যামিলিতেই হয়, এবং এর জন্য কোনওভাবেই একটা বিয়ের সম্পর্ককে শেষ করে দেয়া যায় না। বেশিরভাগ মেয়েই এইরকম একজন পুরুষের সাথে মুখ বুজে ঘর করে যায় শুধু সন্তানদের কথা ভেবে। নদী নিজেও ওরকম করে ভাবে, কিন্তু একইসাথে ও ইদানিং খেয়াল করছে, সফির আচরণ এবং কাজগুলি ওদের দুই ছেলের ভাবনা, কাজ ও আচরণকে খুবই বাজেভাবে প্রভাবিত করছে। প্রায়ই ওদের মেজাজ রুক্ষ থাকে, ওরা কারও সাথেই ভাল ব্যবহার করে না, খুব তুচ্ছ-তুচ্ছ বিষয় নিয়েও নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে। এই ব্যাপারগুলিকে দুই ভাইই খুবই স্বাভাবিকভাবে জীবনের অংশ হিসেবেই গ্রহণ করতে শিখে গেছে। নদী খুব ভাল করেই বোঝে, এখন ওদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেলে দুই ছেলেকে নিয়ে ওকে আলাদা থাকতে হবে এবং ওর দুই ছেলে বড় হবে একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির দুই সন্তান হিসেবে। কিন্তু সে এটাও চায় না যে, দুই ছেলে বড় হয়ে বাবার মতোই হোক। এসব ভাবতে-ভাবতে যখন নদীর মাথায় আর কিছুই কাজ করে না, তখন সে প্রার্থনা করতে বসে। হয়তো আল্লাহ্ ওর ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। কিন্তু আর কত? সফি নিজে দাবি করে, কয়েক বছর আগে হজ্ব করে আসার পর থেকে সে অনেকটাই বদলে গেছে, এবং সে আর আগের মতো রাগারাগি করে না, পরিবারের প্রতি সব দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু নদী আর ওর সন্তানরা জানে, সফি আগের মতোই আছে, এবং ও খুব সম্ভবত আর বদলাবেও না। নদী সফির জন্য প্রার্থনা করতেই থাকে, কারণ এই মুহূর্তে তার এর চাইতে বেশি কিছু করার নেই। কোনও কিছুতেই কোনও পরিবর্তন আসে না। সফি আগে নদীর আর দুই ছেলের গায়ে হাত তুলত, যেটা হজ্ব থেকে আসার পর বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু বাকি সবকিছুই ঠিক আগের মতোই আছে। সে এখনও হ্যাবিচ্যুয়াল লায়ারই রয়ে গেছে, প্রচুর মিথ্যে বলার পাশাপাশি প্রতি মুহূর্তেই বিভিন্ন ধরনের প্রমিজ করে আর সেগুলি ভাঙতে থাকে। সফির মতন যারা, তারা নিজেরা সাধারণত কখনওই বুঝতে পারে না যে, তাদের মধ্যে সমস্যা আছে। নদীকে সফির ব্যবসার প্রয়োজনে দরকার বিধায়, সে নদীকে ছাড়তেও চায় না। নদীর মনে হতে থাকে, আসলে সফি এরকম করে নদীকে ব্যবহার করছে। একদিন নদীর প্রয়োজন ফুরোলেই নদীকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে ব্যবহৃত টিস্যুর মতো। এসব ভাবলে নদীর দম বন্ধ হয়ে আসে। বিয়ের ১২ বছর পর এসেও নদী সফিকে চিনতে পারে না। এতকিছুর পরেও অন্য ১০টা বাঙালি মেয়ের মতন করে ওরও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখি না কী হয়…………’
নদী আর সফি—-দুটো পাড়, মাঝখানে ওদের দুই সন্তান—-একটি সেতু। যেখানে দুটো পাড়ই এক হতে চাইছে না, সেখানে সেতুর অস্তিত্বের দাবি অর্থহীন।