শ্রীরামকৃষ্ণ বড়ো সহজ করে বোঝান। ‘কথামৃত’ থেকে নিজের মতো করে ভেঙে লিখছি।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় (১২/৪) বলছেন:
সংনিয়ম্যেন্দ্রিয়গ্রামং সর্বত্র সমবুদ্ধয়ঃ।
তে প্রাপ্নুবন্তি মামেব সর্বভূতহিতে রতাঃ।।
শব্দার্থ: সর্বত্র (সবখানে) সমবুদ্ধয়ঃ (সমবুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে) সর্বভূতহিতে (সকল জীবের কল্যাণে) রতাঃ (নিযুক্ত বা নিরত) [হয়ে] চ ইন্দ্রিয়গ্রামং (এবং ইন্দ্রিয়সমূহকে) সংনিয়ম্য (সংযত করে) তে (তাঁরা) মাম্ এব (আমাকেই) প্রাপ্নুবন্তি (প্রাপ্ত হন)।
অনুবাদ: (কিন্তু) যাঁরা সবখানে সমবুদ্ধিযুক্ত এবং সকল প্রাণীর হিতপরায়ণ হয়ে ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় হতে প্রত্যাহার করে, [সেই অনির্দেশ্য, অব্যক্ত, অচিন্ত্য, কূটস্থ, সর্বব্যাপী, অচল, ধ্রুব, অক্ষরব্রহ্মের উপাসনা করেন,] তাঁরাও আমাকেই প্রাপ্ত হন।
ইন্দ্রিয়সংযম দ্বারা, সর্বজীবে হিতকামী আর
সর্বভূতে সমবুদ্ধি, তাঁরাও আমাকেই প্রাপ্ত হন।
(বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘মহাপয়ারামৃতগীতা’ থেকে সংগৃহীত)
মর্মার্থ:
জগদীশচন্দ্র ঘোষ: “নির্গুণ উপাসনায়ও আমাকেই পাওয়া যায়, কারণ আমি নির্গুণ-গুণী পুরুষোত্তম, সগুণ-নির্গুণ দুই-ই আমার বিভিন্ন বিভাবমাত্র।”
স্বামী অপূর্বানন্দ: “সগুণ বা নির্গুণভাবে শ্রীভগবানের উপাসনা করলেই তাঁকে পাওয়া যায়, সেকথা স্পষ্ট করে বোঝাবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ বলছেন যে, যাঁরা অক্ষরব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁরাও আমাকেই পেয়ে থাকেন।...কারণ তিনি সগুণ ও নির্গুণ দুই-ই; এবং তাঁরা সেই বাসুদেবকেই প্রাপ্ত হবেন।”
শ্লোকের এই অংশটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়: সর্বভূতহিতে রতাঃ, অর্থাৎ সকল প্রাণীর মঙ্গলের কাজে নিযুক্ত।
ঠাকুর সেদিন (২৭ অক্টোবর ১৮৮২) শ্রীযুক্ত কেশব সেনের সাথে নৌকাবিহার করছেন। ইঞ্জিনের নৌকা দ্রুতগতিতে কলকাতার দিকে ছুটছে। সকলে তন্ময় হয়ে ঠাকুরের কথা শুনছেন। সময় বয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কারও কোনো হুঁশ নেই।
মুড়ি-নারকেল খাওয়া হচ্ছে। সবাই আনন্দের সাথেই তা খাচ্ছেন। মুড়ির আয়োজন করেছেন কেশব সেন। কেশব আর বিজয় গুটিসুটি মেরে বসে আছেন। এই দুই অবোধ সন্তানের মধ্যে ভাব করিয়ে দিতে হবে ঠাকুরকেই।
শ্রীরামকৃষ্ণ কেশবের দিকে তাকিয়ে বলছেন: ওগো! এই যে বিজয় এসেছেন। তোমাদের ঝগড়া-বিবাদ—যেন শিব ও রামের যুদ্ধ। (ঠাকুর হাসছেন।)
রামের গুরু শিব। যুদ্ধও হলো, দু-জনে ভাবও হলো। কিন্তু শিবের ভূতপ্রেতগুলো আর রামের বানরগুলো . . . ওদের ঝগড়া-কিচকিচি আর মেটে না! (ঠাকুর উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।)
কাছের লোক তা এমনই হয়ে থাকে। লব-কুশ তো রামের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। আবার জানো, মায়ে-ঝিয়েও তো কত অমিল দেখি! ভাবো তো, ভগবান যখন নিজেই লীলা করছেন, তখন সেখানে জটিলা আর কুটিলার কী দরকার? আসলে কী, ওঁরা না থাকলে যে ভগবানের লীলাটাই আর হয় না! (শুনে সকলে হাসতে লাগলেন।) ওঁরা না থাকলে কি আর অমন রগড় (তামাশা) হয়? (ঠাকুর উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।)
আবার দেখো, রামানুজ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী। তাঁর গুরু ছিলেন অদ্বৈতবাদী। শেষে এসে দু-জনে অমিল। গুরু-শিষ্য পরস্পর মত খণ্ডন করতে লাগলেন। এমন তো হয়েই থাকে। যত যা-ই হোক, তবুও তো নিজেরই লোক!
আহা, কত চমৎকারভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের বোঝাচ্ছেন!
ভাবুন তো, কৃষ্ণে, রামকৃষ্ণে, অনুকূলে, স্বরূপানন্দে, নিগমানন্দে, জগদ্বন্ধুতে, রামঠাকুরে, হরিচাঁদে কোনো ঝগড়াঝাঁটি বা তর্কাতর্কি আছে কি না! থাকবে কীভাবে? সকলেই তো একই গন্তব্যের সন্ধান দিচ্ছেন!
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলছেন: ইন্দ্রিয়কে সংযত রাখো, সবার কল্যাণ করো (কারও কোনো ক্ষতি কোরো না), “অমুক আমার লোক, তমুক আমার লোক নয়”—এমন বুদ্ধি যেন মাথায় (মনে) ভুল করেও না আসে…এভাবে জীবনযাপন করলে তুমি আমাকে পাবে।
মূলকথা হলো, ভগবানের উপদেশ মেনে চললে তো এত বিভেদ কিংবা দূরত্বের সুযোগই নেই! মহাপুরুষগণ নিজেরাও তা করেননি, তাঁদের অনুসারীদেরও তেমন কিছু করতে বলেননি। অথচ দেখুন, কেমন আজব সার্কাস চলছে চারিদিকে! ওদিকে রামে-শিবে ঝামেলার কোনো নামগন্ধই নেই, আর এদিকে বানরে-ভূতে ঝামেলার যেন কোনো শেষই নেই!
এর নাম কি ভগবদ্প্রেম, না কি ব্যবসায়বৃত্তি, তা ভেবে না দেখলে মানুষ কিছুতেই হওয়া যাবে না, এরকম বানর-ভূতের মতন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আয়ু ফুরোতে হবে।
আমাদেরকে এমন বানর বানিয়ে নাচাচ্ছেন যাঁরা, ওঁরা কোনো গডম্যান নয়, স্রেফ মানিম্যান। আমরা গাছে গাছে লাফিয়ে ওঁদের জন্য কলা ছিঁড়ে আনব, ওঁরা মজা করে সেগুলি খাবেন, আর আমাদের জন্য কৃপা করে রাখবেন খোসা। সব দেখে-টেখে ভগবান মুচকি হেসে বলবেন, তোরা তবে বানরই থেকে যা! মানুষ হয়ে তোদের কাজ নেই!
যে-মানুষ অন্যদের বিচার করে ভগবানকে পেতে চায়, সে মূলত ভগবানেরই উপর খবরদারি করে। এমন মানুষ মানুষই নয়—হয় বানর, নয় ভূত। বানর লাফায়, ভূত চেঁচায়। লাফিয়ে আর চেঁচিয়ে ভগবানকে পেয়েছেন কে কবে কোথায়? প্রার্থনা সবসময়ই অপ্রকাশ্য, নীরব-নিভৃত।
যার নিজের প্রার্থনারই কোনো খোঁজ নেই,
সে-ও কিনা অন্যের প্রার্থনার খোঁজ নেয়!
এমন করলে হবে?