নেভেনি যে-আলো

এই হাসপাতালের জীবনটুকুই যে জীবনের শেষ অধ্যায়, সেটা রিমঝিম বুঝতে পেরেছিল।




বিকেল হলেই বাইরে এসে বসে। চমৎকার জায়গাটা হাসপাতালের। শান্ত, নিরিবিলি। শীতের আমেজ বয়ে নিয়ে আশ্বিনের বাতাস দীর্ঘদেহী ঝাউ আর ইউক্যালিপটাসের শীর্ষে মর্মরধ্বনি তুলছে। একজন মৃত মানুষের মতো সাদা, শীতল চোখে ও তাকাল হাওয়ার মাতন-লাগা পল্লবগুলোর দিকে। দিনশেষের লালচে রোদ্দুরের কণাগুলো তিরতির করছে ঝাউ আর পামশ্রেণীর পাতায় পাতায়।




রিমঝিমের দৃষ্টি দূরের দিগন্ত ছুঁয়ে এসে থামল মেঘের তলায়, তারপর এই হাসপাতালের ঝকঝকে মসৃণ মেঝেটার ওপর। হঠাৎ চমকে উঠল রিমঝিম। আলতো করে কে যেন শালটা জড়িয়ে দিল ওর গায়ে। ডা. সেলিম আহমেদ। মৃদু অনুযোগে স্নেহ মিশিয়ে কথা বললেন রোগিণীর সাথে।




- মিস রিমঝিম, আপনি কিন্তু আমার কথা মোটেই রাখছেন না। এত কীসের ভাবনা আপনার, বলুন তো?
- কই, ভাবনা করি কোথায়?
- তবে কেন এত চুপচাপ আর গল্প-কথা এড়িয়ে চলা? এভাবে কি থাকা উচিত?




ডা. সেলিম আহমেদের কথায় বিষণ্ন নীরবতা নামল রিমঝিমের চোখে। ধীরে ধীরে, ফিসফিসিয়ে বলল, সবই আমার ফুরিয়ে গেছে।
- কিন্তু আমি তো বলেছি, ফুরিয়ে যায়নি!




রিমঝিম বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল ডা. আহমেদের দিকে। আশ্চর্য মানুষ এই ডা. আহমেদ। তখুনি খুচখুচে অদম্য কাশির দমকে কেঁপে উঠল রিমঝিম। মুখে রুমাল চেপে ধরতেই একদলা রক্ত এসে লাগল তাতে। শ্রান্ত রিমঝিম চোখ বুজে ফেলল; কপালে অনুভূত হলো ডা. আহমদের স্নিগ্ধ হাতের স্পর্শ।




ওর হাত থেকে রুমালটা নিয়ে নিজেই মুছে দিলেন ঠোঁটের পাশের রক্তের দাগ। সস্নেহ নিবিড়তায় ডা. আহমেদ বললেন, রিমঝিম, ভেতরে চলো, ঠান্ডা পড়েছে। খুব কি অস্বস্তি লাগছে, রিমঝিম?




রিমঝিম দু-চোখ পুরে বিস্ময়ভরা নীরবতা নিয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর শিউরে উঠল ভয়ে, উৎকণ্ঠায়।




না-না-সে কথা আর কোনোদিনই ভাবা চলে না। সে…সে আমার সব কিছুর শেষ টেনে দিয়ে গেছে। সে আমার জীবন থেকে আমারই জীবনের প্রার্থিত বস্তুটি চুরি করে নিয়ে গেছে। যেটুকু রক্তমাংসের শরীর আছে, তা-ও তো টিবি'র দখলে।




গভীর প্রত্যাশা নিয়ে যে সামগ্রিক জীবনাবেগে সে কম্পিত, সেটিকে কেউ ধারণ করুক—এ-ই তো সে চেয়েছিল, কিন্তু খুঁজে পায়নি। আর সেই কবি-আত্মা, কবি-মন ছেলেটি, যাকে জীবনের প্রথম উপলব্ধির ক্ষণেই হৃদয় সমর্পণ করেছিল, সেই ছেলেটি কেন পারল না সেই সুন্দর মনটি নিয়ে বেঁচে থাকতে?




রিমঝিমের জীবনের বেদনাদায়ক সত্য ছিল কবি-প্রাণ মামুনকে হৃদয় দেওয়া। সত্যিই, যে-মেয়ে চাকরি করে পড়াশোনা চালাত, যে বাপ-মা-হারা মেয়েটি মামা-মামির তিক্ত ভালোবাসায় থেকেও লেখাপড়া করত, সে মেয়ের জীবনে ভালোবাসার বিলাসিতা করা উচিত হয়নি। কিন্তু মামুনও তো এই মেয়েটিকে দেখে ফিসফিসিয়ে বলে উঠেছিল, চোখ তোমার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!




অতীত আর ভবিষ্যৎকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত ছিল না দু-জনের কেউই। ওদের অতীতটা ছিল বড়ো দুঃখময়, বড় অভাবপূর্ণ। আর ভবিষ্যৎটার উপর সাদা চাপ চাপ কুয়াশার মতো নৈরাশ্যই বিছিয়ে ছিল।




তবু মামুন যখন স্বপ্ন দেখত। এই বিশাল পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে যখন বলত, “রিমঝিম, কবি মামুনের জীবনকাহিনিটা শুনবে না? আমি বলছি, তুমি শোনো।”, তখন মামুনের হাতে হাত রেখে রিমঝিম তন্ময় হয়ে যেত। উপলব্ধি করত, ও একটি অতিসাধারণ মেয়ে। সাধারণ জীবনের পিপাসাকে বর্জন করা ওর পক্ষে অসম্ভব।




তখন মনে মনে আহ্বান করত, চাইত অত্যন্ত প্রত্যহের একটি ছোট্ট ঘর। তখনই শুধু ক্ষণিকের জন্য অতীত আর ভবিষ্যতের বেড়াদুটো যেন ওদের জীবনের চারপাশ থেকে সরে যেত। আর রিমঝিম, সেই বর্তমানে, ওর নীলাম্বরী মনটা নিয়ে তাকাত আকাশের দিকে। রামধনু রঙের বর্ণালিটা বিদ্যুৎচমকের মতো উঁকি দিত মনে।




কিন্তু সেই মামুনই একদিন টাকার অভাবে, চিকিৎসার অভাবে শেষবারের মতো চোখ বুজল। যাবার আগে বলল, শোনো, রিমঝিম, এই কয়েদ‌ই আমার জন্য ভালো, এখানে শান্তিতে থাকব আমি।




মামুন মরেও রিমঝিমকে নিষ্কৃতি দিল না; বরং রিমঝিমকে ওর সমস্ত চিন্তায়, ভাবনায় প্রতিনিয়ত জাপটে-সাপটে ধরে রইল। তবুও ওকে এগিয়ে যেতেই হলো জীবনের বোঝাটাকে টেনে নিয়ে। নিজের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে হলো। ওভারটাইম খেটে খেটে একসময় ওভারটাইম ফিগারের ছায়া ওর চোখের রেটিনায় দপ্ দপ্ করে নিভে উঠল। কালচে দাগ পড়ল চোখের কোল ঘেঁষে।




সেই চোখ! যা দেখে ছেলেটি মুগ্ধ হয়েছিল। সেই চোখই কালো মণিটুকু ছাড়া সমস্ত সৌন্দর্য হারাল। কালো মণিটুকু এখনও ডাগর চোখদুটির মাঝে বড়ো সুন্দর, বড়ো মায়াময়ভাবে ঝিকঝিক করে। সর্বাঙ্গে ঘুসঘুসে জ্বরের মতোই ও বয়ে বেড়িয়েছে তার চিন্তা, তার কথা, তার কবিতা; কিন্তু চোখে শেষমেশ কালোদাগের সার্টিফিকেট মিলল।




সত্যি সত্যি জ্বরই থাকত ওর শরীরে। রোগ লুকিয়ে রেখে ও কাজ করে যেতে লাগল। কাজের শেষে একদিন টনটন করে উঠল বুক, কপালের পাশের রগদুটো দড়ির মতো ফুলে উঠল। আর তীব্র কাশির দমকে যখন টুকটুকে লাল রক্তের টুকরো বেরিয়ে এল, চাকরির জবাব তখন মিলল। ডাক্তারবাবু বললেন, টিবি—লাং দুটোই আক্রান্ত।




তারপর এই হাসপাতাল। সমস্ত জীবনটাকে অল্প সময়ের মধ্যেই একবার পরিদর্শন করল রিমঝিম।




- রিমঝিম!




ডা. আহমেদের গলার স্বরটা মৃদু, কিন্তু অগভীর নয়। রিমঝিম তাকাল ডা. আহমেদের দিকে। চুপচাপ শুনল।




- এভাবে নিজেকে কষ্ট দেবার মধ্যে কী লাভ, রিমঝিম? আজকাল কত জনেরই তো এই রোগ হয়। জানো তো, এমন নৈরাশ্যপূর্ণ চিন্তাভাবনা এই রোগটার বড়ো শত্রু! রিমঝিম, লক্ষ্মীটি আমার, একটা কথাও কি তুমি রাখবে না?
- কিন্তু আপনি কি...আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন!




রিমঝিম কোনোরকমে ডা. আহমেদকে কথাটা বলল।




- ও-কথা বলছ কেন, রিমঝিম? আমি ও সবই জানি। আর তুমি কি জানো না, মানুষের মনটা বড়ো এলোমেলো! অনেক অবিশ্বাস্য সত্যি ব্যাপারও এই মনটারই জন্য ঘটে যায়।




তখন পুঞ্জ পুঞ্জ কান্নার জল নেমে এল পা টিপে টিপে রিমঝিমের অন্তরের অনুভূতির সাথে তাল রেখে। অবাধ্য আকুল সেই কান্না।




ডা. আহমেদ রিমঝিমের মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা জানালেন। রিমঝিম ডা. আহমেদের হাতটা আস্তে করে সরিয়ে দিল—যেন ওর জীবনের শেষ ভরসার বিন্দুটুকু মুছে দিল নিজের হাতেই। মামুনের স্মৃতিটা একখণ্ড মেঘ হয়ে ওর সারা-অনুভূতির উপর বেদনার ধারা বর্ষণ করছে অহরহ। সে বেদনা ভোলার নয়, উপেক্ষা করার নয়।




রিমঝিম চোখভরা অশ্রু নিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। রিমঝিমের মুখে বিকেলের শেষ আলোটুকু এসে পড়েছিল। তারপর একসময় সেই নরম আলোটুকু নেমে গেল, হারিয়ে গেল দিগন্তরেখায়।




ডা. আহমেদ বেদনার্ত দৃষ্টিতে সেই আলোর হারিয়ে যাওয়াটুকুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
Content Protection by DMCA.com