নীল কান্না

না, আর দেরি করা চলবে না। কাল দেরি হওয়ায় ওদের অনেক ধমকেছিল: “এত দেরি করিস কেন? এবার দেরি হলে তোদের কাগজ দেওয়া বন্ধ করে দেবো।” হারু কিছু বলেনি। শুধু ঘাড় বেঁকিয়ে একটু হেসেছিল। খুব সকালে হারু আর ওর বড়ো ভাই হকার্স অফিসে লাইন ধরে। ওখান থেকে পেপার বের করে আনতে দেরি হয়ে যায় মাঝে মাঝে।




আর দেরি করা চলবে না—মনে মনে ভেবে সে আর তার বড়ো ভাই জোরে পা চালায়।




কাকডাকা ভোর। রাস্তায় কেউ নেই। সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তেল-চিটচিটে চাদরের ভেতর হাত ঢুকিয়ে হারু হাঁটতে থাকে। প্রচণ্ড শীত পড়েছে আজ। শীতে ওর ভেতরে ভয়ানক কাঁপুনি শুরু হয়েছে। দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক করে কাঁপছে।




চারদিক নিঝুম। শুনশান। কুয়াশার দুধসাদা চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছে ঢাকা শহর। নিস্তব্ধতা চিরে কাকের কর্কশ ডাক ভেসে আসছে। ভোরের হালকা শিরশির-করা হিমেল হাওয়া বইছে। চারদিকের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে ভেঙে ওদের পাশ দিয়ে দৈত্যাকৃতির এক বিরাট ট্রাক চলে যায় সাঁই করে।




: তাড়াতাড়ি চল দেহি! পরে লাইন বড়ো অইয়া যাইব।




: আমাগো থাইক্যা অনেক চালাক সব্বাই। ক্যামনে যে অ্যাত্তো সকালে উডে!




হারু জবাব দেয়।




হারুর হাত-পা ঠান্ডায় বরফ হয়ে যায়। হাঁটতে ইচ্ছে করে না। স্টেডিয়ামের মোড়ে আসতেই হারু দেখে, একটা কুকুর রাস্তার ওপর মরে পড়ে রয়েছে। মনে হয়, কোনো গাড়ি চাপা দিয়ে গেছে। মুখ-পেট থেঁৎলানো। হারুর বুকের ভেতর একটা কষ্টের নদী বয়ে যায়। চাপাদুঃখে উথলে ওঠে কচি বুক। চোখের সামনে সেলুলয়েডের ফিতের মতো ভেসে ওঠে ভুলুর ছবি। জলোচ্ছ্বাস আর বন্যার সময় বাবা-মা’কে হারিয়ে ওরা যখন গ্রাম ছেড়ে চলে আসে শহরে, তখন হারুর সঙ্গে ছিল তার পোষা কুকুর ভুলু। হারু যেখানেই যেত, ভুলু হারুর পিছু ছাড়ত না।




সবসময়ই মনিবের সাথে সাথে থাকত। একদিন সকালে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বেশ পেছনে হঠাৎ কুঁই কুঁই কান্না শুনতে পায় সে। পেছন ফিরে দৌড়ে গিয়ে কিছু বলার আগেই দেখতে পায়, কয়েক জন মিলে ভুলুকে চেপে ধরে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলেছে। তারপর তারা গাড়িতে করে নিয়ে যায় ভুলুকে। হারু নিতে কত মানা করেছিল ওদের। ওরা শোনেনি। হারু নীরবে কেঁদেছে। অব্যক্ত যন্ত্রণা পুষে রেখেছে মনে।




ঢাকায় আসার পর বড়ো ভাই ওদের গ্রামের এক লোকের সঙ্গে কাগজ বিক্রির কাজ নেয়। তার সঙ্গেই ওরা ফুটপাথে ঘুমোত। কিন্তু হারু কোনো কাজ করত না। প্রথম প্রথম সে ঢাকা শহর ঘুরে-ফিরে দেখেছে। কী অদ্ভুত সুন্দর একটা শহর। রাস্তাঘাট, গাড়ি-বাড়ি কী ঝকঝকে তকতকে। শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে। এই শহরের সব কিছুর মতো মানুষগুলোকেও মনে হতো কত সুন্দর। হারু অবাক হয়ে যায়। চমৎকার রঙিন পোশাক-জুতো-মোজা-পরা সব মানুষ। লাল-নীল গাড়ি, অবাক-করা বাড়ি। কী ঝকঝকে! চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হারুর কাছে ঢাকাকে যেন এক স্বর্গরাজ্য মনে হয়।




নানা রং-বেরঙের বাতির ঝালর-দেওয়া দোকানগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটতে হারুর খুব ভালো লাগে। দোকানের জিনিসপত্র দেখে ও দারুণ খুশি হয়। এসব দেখে কিছু কিনতেও তার মন চায়। তাই একদিন একটা খেলনা-গাড়ি দেখে বলে ওঠে, এই যে মিয়াভাই, এইটার দাম কয় ট্যাহা?




দোকানদার ওকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে গর্জন করে, যা যা, শিগ্‌গির এখান থেকে ভাগ। যত্তসব। হারু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এমন তেতো কথায় ওর মন খারাপ হয়ে যায়। ও কল্পনাও করতে পারেনি, দোকানি দাম বলার বদলে উলটো এমন দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে ওকে। হারুর হাসিখুশি উজ্জ্বল ভাবটা নিমিষেই উবে যায়। ধীরে ধীরে হারুর ধারণাও পালটে যায়। মনটা কেমন বিষিয়ে ওঠে। আসলে মানুষগুলো দেখতেই সুন্দর, কিন্তু কথাবার্তায় অন্যরকম।




ভাই ও হারু হকার্স অফিসের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওরা দু-জন পেপার নিতে লাইনে দাঁড়ায়। “আইজকা ভালা বেচা অইবো। জব্বর খবর আছে।” লাইনে-দাঁড়ানো সবার কাছে শুনতে পায়। হারুর মুখে খুশি ঝিলিক দিয়ে ওঠে, তার চোখের তারায় আনন্দ।




লাইন ধরে দু-ভাই অনেক পেপার বের করে আনে। হারুর ভাই ওকে বুঝিয়ে পেপার দেয়। হারুর সব পেপারের নাম মুখস্থ। একশ্বাসে বলতে পারে সব নাম। পেপারের উপরে নাম লেখার স্টাইল দেখেই বলে দিতে পারে কোনটার কী নাম। তাই লেখাপড়া না জানলেও কোনো অসুবিধে হয় না।




বাসায় বাসায় কাগজ বিলিয়ে বাড়তি কাগজ আজ অনেক বিক্রি হয়েছে ওর। খুশির বন্যায় ভেসে যায় হারু। আর মাত্র সাতটা বাকি। বাজারের মোড়ে দাঁড়ালেই সব হু-হু করে বিক্রি হয়ে যাবে।




হারু পেপারের পাতা মেলে ধরে। সব পেপারে বিরাট বিরাট ছবি দেখতে পায় ও। ছবি দেখে বুঝতে চেষ্টা করে। এগুলো গ্রামের ছবি। কিষান-কিষানি’র হাসি হাসিমুখ। ধানের ছড়া। ছবির নিচের লেখাগুলো পড়তে চেষ্টা করে। পারে না। অনেক লেখার ভিড়ে হারু দুইটা অক্ষর আবিষ্কার করে: অ আর আ। গ্রামে থাকতে নাইট স্কুলে যেত। ওখানেই শিখেছিল দু-তিনটে অক্ষর। হারু নিজের নাম লিখতে পারে বটে। কিন্তু অনুমান করে লেখে। সে বানান করেও পড়তে পারে না।




আজ হঠাৎ লেখাগুলো পড়তে না পেরে হারুর কেন জানি মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করে। ক্যান পড়বার পারতাছি না? এ ধরনের একটা প্রশ্ন ওকে অক্টোপাশের মতো ঘিরে ধরে। হারুর বুকের ভেতর অব্যক্ত যন্ত্রণা তোলপাড় করে। মোচড় দেয়। বুকের ভেতর চিনচিনে অস্বস্তিকর ব্যথা অনুভব করে।




বেশ বেলা হয়ে গেছে। চারদিকে ঝলমলে সোনালি রোদ। আঁধার নেই কোখাও, কিন্তু হারুর হৃদয়টা যেন আঁধারে ঢাকা। সেখানে ঝলমলে সোনালি সূর্য ওঠেনি। সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে শুধু নীল কান্না।
Content Protection by DMCA.com