এতটা সময় তোমার সামনে থাকলাম—অথচ তোমার অপছন্দের মানুষ হয়ে, তোমার অস্বস্তির কারণ হয়ে। হঠাৎই সময়টা যেন আরও দীর্ঘ হলো, তুমি পাশ ফিরে আছ ঘণ্টাখানেক। কতই-না বিরক্তির উদ্রেক তোমার চোখেমুখে, আমার কথা বলার কিংবা না-বলার ধরনের অভিপ্রায়ে তুমি মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছ—এমন অবস্থানের পুরো দায়ভারটা যদিও আমাকেই নিতে হবে।
আমি ভাবছি, তোমার থেকে পালিয়ে এই মুহূর্তে কোথায় যাবার পথ আছে—আদৌ যে কোনো পথ নেই, সে কথা জানতে পেরেছি অবশ্য সেইদিনই প্রথম। তুমি পাবে না কোনো কঠিন প্রশ্নের প্রত্যুত্তর, আমি খুব সম্ভবত তোমার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রস্তুত।
কোনো বোঝাপড়া নেই আমাদের মধ্যে, কখনও ছিলই না, থাকবেই-বা কী করে, আমাদের পরিচয়েরই তো মাত্র এই ক-দিন হয়েছে। তা ছাড়া অপ্রয়োজনীয় কোনো আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতন মানুষ তুমি নও। আমাকে ঘিরে তোমার মনে কোনো আবেগ, প্রত্যাশা এসব থাকবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।
যদিও আমাদের এর আগে আরও এক বার দেখা হয়েছিল, সেদিন অবশ্য তুমি আমাকে তোমার চেনা ছন্দের বাইরে গিয়ে খানিকটা অপ্রস্তুত হৃদয়ে গ্রহণ করেছিলে—ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ অবাক করেছিল। যদিও তোমার ধৈর্য যে সাধারণ মানুষের থেকে অনেক গুণ বেশি, সে কথা আমি বেশ আগে থেকেই জানি।
যা হোক, পরে অবশ্য আমার মনে হয়েছে, অতটা বাড়াবাড়ি ওইদিন না করলেও পারতাম। আমি চাই না, মনের বিরুদ্ধে গিয়েও তুমি আমাকে আর একমুহূর্তের জন্যও সহ্য করো। আশ্চর্যজনক ঘটনাটা ঘটেছিল পরক্ষণেই, যখন ফিরে আসার আগে তুমি বললে—আয়, তুই আমাকে জড়িয়ে ধরে থাক। আমাকে বুকের মধ্যে রেখে বলেছিলে— তুই যখন চোখ-মুখে পানি নিতে ব্যস্ত হয়ে ছিলি, আয়নায় তোকে দেখে ভীষণ মায়া লাগছিল।
'তুই' শব্দটার ভেতরও যে এত সুস্পষ্ট অনুভূতি লুকোনো থাকতে পারে, তা আমার আগে জানা ছিল না। জানা হতো কি কখনো, তুমি যদি আমায় সেই মুহূর্তে 'তুই' সম্বোধনে বুকে জড়িয়ে না নিতে!
জীবনে কিছু মানুষ আসে, যাদেরকে হয়তো নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজের কাছে জায়গা দিতে হয়—কথাটা কি খুউব সত্যি? সত্যিই যদি না হবে, তবে তুমি কী করে পারলে আমায় জায়গা দিতে তোমার নীরবতায়? আমার মনে আছে, তুমি বলেছিলে, আমাকে বুকের ভেতরটায় রাখতে অনেক শান্তি। তোমাকে শান্ত হয়ে যেতে দেখতে ভীষণ মায়াবী লাগছিল। সত্যি বলব? তোমাকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসতে মন চাইছিল।
আচ্ছা, তুমি এখনও সেই পাগলই রয়ে গেছ, তাই না? কেমন আছ তুমি? আজ শুক্রবার; পুরো সপ্তাহে এই একটা দিন এলেই মনটা বড়ো অশান্ত লাগে, গত দু-সপ্তাহ ধরে কিছুই হিসেব রাখতে পারছি না, কেমন যেন একটা ঘোরে আছি, শুধুই পুরোনো কথা মনে পড়ছে—তুমি যে আজকের দিনে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যাও, তোমার খোঁজ পাওয়া যায় না। জানো, আমার এই সময়টা শেষ হয় না যেন কিছুতেই।
তোমার মনে আছে? আমাদের দেখা হয়েছিল কোনো এক ছুটির দিনে, সেদিনও ছিল শুক্রবার। তুমি বলেছিলে, আমি তোমার প্রতি ভীষণ রকমের ডেডিকেটেড, এতটা দূর থেকে যে চলে আসব, তুমি ভাবোনি! আমার কাছে কিন্তু খুব বেশি দূরত্ব কখনোই মনে হয়নি, তোমার সাথে দেখা করতে আসব, তার জন্য রাতে একদমই ঘুম হয়নি; শুধু ভাবছিলাম, সব কিছু যদি ঠিকঠাক থাকে, কাল নিশ্চয়ই আমাদের দেখা হবে।
সত্যি বলতে, কিছুটা ভয় করছিল তোমার সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়াতে, তুমি যে সাধারণ কেউ নও, এটাও একটা অন্যতম কারণ। তোমার জনপ্রিয়তা মানুষের কাছে অনেক বেশি, তার ওপর আবার তুমি ছিলে আমার কাছে এমন একজন— যাকে কেবল দূর থেকেই নীরবে শ্রদ্ধা করা যায়।
আমার আবার একটা সমস্যা আছে, আমার বেশি পছন্দের মানুষদের ধারেকাছেও আমি ঘেঁষি না; যাকে দূর থেকে মনের উচ্চাসনে রাখা যায়, তাকে কী করে কাছে থেকে ছোঁব আমি! এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি, ফোনের স্ক্রিনে তোমার নাম্বারটা ভেসে উঠল। তুমি ধীরকণ্ঠে বলছ, আমার পৌঁছাতে আরও কতক্ষণ সময় লাগতে পারে। তুমি অপেক্ষা করছ।—বলেছি, বেশি সময় লাগবে না, আসছি। রাস্তায় যানজট কম থাকায় খুব দ্রুতই চলে এসেছ তুমি। আরও বেশ কয়েক বার ফোন করে জানতে চাইলে, আর কতক্ষণ?
এক ঘণ্টা লেইট। ট্রেন নেক্সট স্টপেজে এত সময় ধরে থামবে, তা কে জানত! ইস্, ফার্স্ট ইমপ্রেশনটাই খারাপ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
হ্যালো...! আমি স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছি। তুমি কোথায়? হুম, দেখতে পেয়েছি, তোমার গাড়িটা যে ব্যাংকের এ-পাশে থাকবে, এটা আগেই বলেছিলে, তাই খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি। তোমার পাশে এসে যখন বসলাম গাড়িতে, তুমি আমার হাতটা ধরেছিলে প্রথম, এই মুহূর্তটা পরই আমার হার্টবিট এত যে বেড়ে গিয়েছিল তোমাকে দেখে!
আমি তোমাকে সামনাসামনি দেখে একেবারেই চিনতে পারিনি। তুমি ভীষণ সুদর্শন এককথায়। আর তোমার ভয়েসটা তোমার পাশে বসে শুনছিলাম যখন, কতটা ভালো লাগছিল, ওটা তো তোমাকে এই মুহূর্তে বোঝানো সম্ভব নয়।
তোমাকে অনেক রাগিয়ে দিয়েছিলাম একবার, তুমি আমার চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে। বিশ্বাস করো, এতটা গভীরভাবে আমাকে কক্ষনো কেউ দেখেছে বলে আমার মনে পড়ে না। এই মুহূর্তটা জুড়ে আমার শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিল, তুমি সম্ভবত আমার উপর রাগ করে নেই, তুমি আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছ। তুমি যে এতটা অসাধারণ, তা তোমার কাছে না এলে কখনও জানাই হতো না।
এরপর সেই যে আবার এলাম তোমার কাছে, তারপর আমাদের আর কতদিন দেখা হয় না। তুমি ঘুমিয়ে আছ, আমি ঠিক কিছুটা দূরত্বে তোমার নিঃশ্বাসে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধতে চাইছি নিজেকে, দূরত্বটাই হয়তো আমাদের জন্য শ্রেয়। খুব সাহস করে তোমার হাতটা স্পর্শ করতেই—তোমার উষ্ণ আলিঙ্গনে নিজেকে আটকে রাখতে পারার সৌভাগ্য আমার কিছুক্ষণ হয়েছিল ঠিকই। জানো, তোমার গায়ের স্মেলটা ভীষণ অন্যরকম লাগছিল; মনে হচ্ছিল, তোমার শরীরটা ছুঁয়ে আমি নেই, আমি যেন তোমার আত্মাটা ছুঁয়ে থাকতেই এসেছি।
ওটাই যে আমাদের শেষদেখা হবে, সেই কথা অবশ্য আঁচ করতে পেরেছিলাম।