নীরবতাই প্রার্থনা

কখনো কখনো নীরবতা প্রার্থনার সমান ফল দেয়। যে-মুহূর্তে আমাদের সকল কথার তীব্রতা ব্যর্থ হয়ে আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে, সেসময় নীরবতার সমুদ্র সাঁতরে আমরা শান্তির খোঁজ করতে পারি, নৈঃশব্দ্য একসময় স্বস্তি ও সুখের বারতা বয়ে আনে। এই নৈঃশব্দ্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক, চুপ থাকার চাইতে কঠিন কাজ আর হয় না; কিন্তু শব্দহীনতায় সুন্দরতম মুহূর্তগুলি রচিত হয়। আমাদের হৃদয় এমন কিছু দেখতে পায়, যা আমরা দেখতে পাই না; এমন কিছু শুনতে পায়, যা আমরা শুনতে পাই না।

আমরা এখন যেমন আছি, তা মূলত আমরা আগে যেমন ছিলাম, তার ফলাফল। আমাদের হৃদয়ের শস্যক্ষেত্রে আমরা যে-ফসলের বীজ বুনেছি, চাষ করেছি, সে ফসলই গ্রহণ করে আমাদের জীবন এগোচ্ছে। আমরা যা ভাবি, আমাদের ভাববার ক্ষমতা তার চাইতে বেশি। আমরা যা জানি, আমাদের জানবার ক্ষমতা তার চাইতে বেশি। আমাদের প্রতিমুহূর্তের ভাবনা ও কাজ আমাদের যা আছে, সেটাকে বাড়িয়ে তুলছে বা কমিয়ে দিচ্ছে। যে-মুহূর্তে আমরা আমাদের সকল অবচেতনকে চৈতন্যের সাথে যুক্ত করতে পারব, সে মুহূর্তে আমাদের সকল নীরবতা জীবনের জয়গান গেয়ে উঠবে। আমরা যা-কিছু আমাদের অবচেতনায় করি, যারা আমাদের চাইতে এগিয়ে, তারা সেসব কাজ সম্পূর্ণ চৈতন্যেই করেন।

মওলানা জালালুদ্দিন রুমি প্রায়ই একটা বই পড়তেন। বইটা তিনি কারও সামনে পড়তেন না, লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন। এই বইটার প্রথম ক্রেতা ছিলেন তিনিই। বইটা নিয়ে তাঁর শিষ্যদের আগ্রহ আর কৌতূহলের কোনো সীমা ছিল না। তাদের ঔৎসুক্য বেড়ে গিয়েছিল, কারণ মওলানা সাহেব বইটা কখনোই কারও সামনে পড়তেন না। সবাই চলে গেলে, তিনি বইটা তাঁর বালিশের নিচ থেকে বের করে নীরবে পড়তে থাকতেন। স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যাপারটা অসীম কৌতূহলের জন্ম দেয়। সবাই ভাবত, “এই রহস্যময় বইতে এমন কী লেখা আছে?” এটা জানার জন্য অনেকেই খুব চেষ্টা করত। কেউ কেউ মওলানা রুমির ছাদে গিয়ে ছাদের টালি সরিয়ে দেখার চেষ্টা করত, রুমি কী পড়ছেন। কিন্তু কেউ কখনও জানতে পারেনি, ওই বইতে আসলে কী আছে। যেদিন জালালুদ্দিন রুমি মারা গেলেন, সেদিন উৎসাহী শিষ্যরা রুমির চাইতে বইটা নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁরা মওলানা রুমিকে ভালোবাসতেন। আর কোনো সুফিসাধক এমন ভালোবাসা পেয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। 'মওলানা' শব্দটির অর্থ হচ্ছে, প্রাণপ্রিয় শিক্ষক। রুমি ছাড়া আর কাউকে এই নামে ডাকা হয় না। রুমিকে যারা এতটাই ভালোবাসতেন, তাঁরাও রুমির মৃত্যুর পর ভুলেই গিয়েছিলেন যে, রুমি আর নেই। রুমির মৃতদেহের চাইতে তাঁদের কৌতূহল নিবৃত্ত করাই তাঁদের কাছে বড়ো হয়ে উঠেছিল। ব্যক্তি রুমির চাইতেও তাঁদের কাছে বড়ো ছিল—যে-কোনো উপায়েই হোক, তাঁদের কৌতূহল মেটানো। তাঁরা রুমির বালিশের নিচ থেকে বইটা টেনে বের করলেন, এবং অবাক হয়ে দেখলেন, সেই বইতে কিছুই লেখা নেই। পাতার পর পাতা উলটে দেখা গেল, কিছুই নেই ওতে; সেই বইতে পড়ার মতো কিছুই পেলেন না তাঁরা।

রুমির ভক্তদের মধ্যে যাঁরা ছিলেন তাঁর খুব কাছের, তাঁরা বুঝেছিলেন, সেই আপাত অর্থহীন বইয়ের প্রকৃত অর্থটা কী। যখন ঠোঁট কথা বলে না, তখন হৃদয় কথা বলে ওঠে। হৃদয় যখন কথা বলতে থাকে, তখন পৃথিবীর সব কথাই হৃদয়প্রভুর বিশ্বস্ত অনুগামী হয়ে সঠিক পথে অনুগমন করে। কেউ যখন কোনো কিছু বলতে বা বোঝাতে অনেক বেশি শব্দ ব্যবহার করে, তখন সেটার গুরুত্ব কমে যায়। শব্দের বাহুল্য যত বাড়তে থাকে, কথার ওজন তত কমতে থাকে। লোকে পয়সা বাঁচানোর জন্য কত সময় নিয়ে বুদ্ধি বের করে, অথচ কথা বাঁচানোর বুদ্ধি নিয়ে একমুহূর্ত ভাবা দূরে থাক, এটা লোকের মাথায়ই আসে না। হৃত ধন পুনরুদ্ধার করা সম্ভব, কিন্তু হৃত কথার পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।

মুক্তোর খোলসকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, “তোমার ভেতরে এত দামি জিনিস এল কোত্থেকে?” নিশ্চিতভাবেই উত্তর পাবেন, “নীরবতা থেকে—যত কষ্টই হোক, বুকের ভেতরে যত যন্ত্রণাই হোক, এই এতগুলি বছর ধরে আমি কখনোই আমার ওষ্ঠযুগল উন্মুক্ত করিনি।” চুপ করে থাকার সময়ে নিজের সাথেই নিজের অবিরাম যুদ্ধ চলতে থাকে, নিজের মতামত প্রকাশ করার ক্রমাগত তাড়না মানুষকে উন্মাদ করে দেয়, কিছুতেই ঠোঁটদুটো বন্ধ রাখা যায় না। কিন্তু একটা সময়ে এই নীরবতাই অসীম শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে থাকে। আমরা যত নীরবতার অনুশীলন করব, ততই আমাদের প্রার্থনাগুলি সুন্দর ও নিখুঁত হবে, ততই আমরা স্রষ্টার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারব। আমাদের সবচাইতে যৌক্তিক কথাটির চাইতেও নৈঃশব্দ্য অনেক বেশি কিছু শেখাতে পারে।