২৬.
“আমি” আছে—জন্মতত্ত্ব থেকে পরব্রহ্ম পর্যন্ত সকল স্তরে। “আমি আছি”—এই জ্ঞানই জন্মতত্ত্ব। এ-ই সেই মূলবীজ, যা থেকে উদিত হয় সত্তা, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা, আত্ম-প্রকাশের লীলা। এই ‘আমি’ বোধই সকল সৃষ্টির কারিগর, এ চায় নিজেকে বার বার জানাতে—“আমি আছি”, “আমি আছি”, “আমি আছি”—যেন নিজের অস্তিত্বের প্রেমেই নিজে বার বার ডুবে যায়।
এই ‘আমি’ ছিল তোমার পিতামাতার ভেতরে, এবং তাদের পূর্বপুরুষদের চেতনার ধারাতেও—সেই চেতনার আকর্ষণেই তারা মিলেছিল, আর সেই মিলনের মধ্য দিয়ে তোমার ভেতরে জেগে উঠেছিল আরেকটি ‘আমি’। এভাবে ‘আমি’ নিজেই নিজের বিস্তার করে চলে প্রকৃতিতে—জন্ম দেয় দেহ, নাম, ইতিহাস, প্রেম, প্রজন্ম—এক আত্ম-প্রীতির নীরব বিস্তার।
উপনিষদ বলেন, “সোহমস্মি”—এই ‘আমি’ই সে (সঃ), এই ‘আমি’ই আমি—কিন্তু এই বোধ কেবল তখনই সত্য, যখন তুমি জানো ‘আমি’ একটি অনুভবমাত্র, আর তার পেছনে তুমি আছ—আলো, চেতন, অদ্বিতীয়।
অতএব, অন্বেষণ করো—এই ‘আমি’ কোথা থেকে এল? কবে প্রথম তুমি বুঝলে—“আমি আছি”? কীভাবে সে বোধ ধীরে ধীরে রূপ নিল—"আমি দেহ", "আমি পুত্র", "আমি স্ত্রী", "আমি কিছু"? এই অনুসন্ধানই ধীরে ধীরে ছিন্ন করবে ‘আমি’-র গোড়া, আর সেই শিকড় উপড়ে ফেললেই তুমি পৌঁছে যাবে সেই ভূখণ্ডে—যেখানে ‘আমি’ নেই, কেবল আছে পরম, অপরিবর্তনীয়, নিঃশব্দ চৈতন্য—পরব্রহ্ম।
‘আমি’ হলো প্রবাহ, ‘আমি’ হলো বিকাশ, ‘আমি’ হলো জন্মের তৃষ্ণা, আর সেই তৃষ্ণার কেন্দ্রেই আছে সত্তার প্রতিচ্ছবি। তাকে অন্বেষণ করো, তার জন্ম দেখো, আর একদিন—যখন সে আপন ভারেই মুছে যাবে, তখন তুমি থাকো স্থিত, চিরকালীন, পরব্রহ্ম স্বরূপে।
২৭.
‘আমি’-র ঘর নিঃশব্দের রাজ্যে। সব জ্ঞানই রূপহীন, এমনকি এই ‘আমি আছি’ বোধটিও—তার কোনও আকার নেই, গন্ধ নেই, গতি নেই—কেবল এক নিরাকার উন্মেষ, যা চেতনার পটভূমিতে উঠেছে এক শব্দহীন ঢেউ হয়ে।
উপনিষদ বলেন, “অরূপম্ রূপং”—রূপহীন রূপই সত্য—এবং ‘আমি’ সেই প্রথম রূপহীন ধ্যানবিন্দু, যেখান থেকে শুরু হয় মায়ার রেখাচিত্র। এই ‘আমি’ বোধই সকল জ্ঞানের মূল, এ থেকে জন্ম নেয়—‘আমি জানি’, ‘আমি বুঝি’, ‘আমি দেখি’। কিন্তু যতই সে বোধ জন্ম দিক, নিজে সে রূপহীনই থেকে যায়—এ এক অনির্বচনীয় উপস্থিতি।
এখন সাধনা—এই ‘আমি’-র বোধে ফিরে যাওয়া, তাকে ধরার চেষ্টা করা, আবার তাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া। তাকে যতই ধরতে চাও, সে সরে যাবে, যেন এক সাপের মতো নিসরিত হবে হাতের ফাঁক দিয়ে। তবু হাল ছেড়ো না—অভ্যাসে, স্থিত চেতনায়, বার বার ফিরে যাও ‘আমি’-তে, আর যখন একসময় সে নিজেই সরে যাবে, তখন যা রয়ে যাবে, তা হলো নিঃশব্দতা, নিস্তব্ধ চৈতন্য, আলোকহীন দীপ্তি।
উপনিষদ স্মরণ করান, “যত্র ন তজ্জ্ঞানং ন অজ্ঞানম্”—যেখানে নেই জ্ঞান, নেই অজ্ঞান—সেখানে কেবল সত্তা, কেবল তুমি। অতএব, ‘আমি’ বোধকে আবাহন করো, জানো এবং শেষে তারই ছায়া ছিন্ন করে স্থিত হও সেই নিঃসীম মৌন-বোধে—যেখানে চিন্তা নেই, চেতনার শব্দ নেই, কেবল আছে তোমার রূপহীন স্বরূপ।
২৮.
“আমি”-র অপসারণই পরব্রহ্মে স্থিতি।
জন্মের আগে কোথায় ছিল এই ‘আমি’? কী ছিলে তুমি, যখন ‘আমি’-র বোধও ছিল না? উপনিষদ বলেন, “অসীত্ ইদমগ্রে কেবলম্”—সৃষ্টির আগে কেবলমাত্র একটি অস্তিত্বই ছিল, যা ছিল নাম-রূপহীন, দ্বৈতহীন, পরম সত্তা—যাকে আমরা বলি ‘ব্রহ্ম’ বা আত্মা। তখন ছিলে শূন্য, অচিন্ত্য, নিরাকার—এক মৌন চেতন, যার কোনো ‘আমি’ ছিল না, কোনো ‘আমি’-র অভিজ্ঞতা ছিল না।
এই ‘আমি’-বোধ উদিত হয়েছে সেই শূন্য মৌনের উপর—ঠিক যেমন স্বপ্ন উঠে আসে নিদ্রার গভীরতা থেকে, কিন্তু এই ‘আমি’-র সঙ্গে—সাথে সাথেই এসে গেছে ভ্রম—“আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি পুরুষ”, “আমি নারী”। আর এখানেই ঘটেছে দূষণ। উপনিষদ বলেন, “দেহভাবেন মোহঃ”—এই দেহভাবই ভ্রান্তি, যা ‘আমি’-কে আবৃত করে রেখেছে।
এখন প্রয়োজন বিবেক, অন্বেষণ, অভ্যাস—'আমি'-কে শরীর ভাব থেকে মুক্ত করো, তাকাও তার উপর, কিন্তু চেনো—এই ‘আমি’ও তুমি নও। ‘আমি’কে মুক্ত করো তার মিথ্যা সম্বন্ধ থেকে, তারপর স্থিত হও এই বিশুদ্ধ ‘আমি’-তে, আর ধীরে ধীরে, যখন তা-ও গলে যাবে—তখন প্রকাশ পাবে তুমি নিজে, সেই পরম, অপরিবর্তনীয়, নিরাকৃতি, অদ্বিতীয় স্বরূপ।
উপনিষদ স্মরণ করান—“অহং ন মন্যেতে, অহং ন জানামি”—“আমি জানি না, আমি কিছু ভাবি না”—এই নিঃশব্দ স্বরূপেই স্থিত থাকে পরব্রহ্ম।
‘আমি’ ছিল না—‘আমি’ এল, ‘আমি’ দূষিত হলো। এখন ‘আমি’কে বিশুদ্ধ করো, তারপর তা-ও ফেলে দাও—আর যেটুকু রয়ে যাবে, সে-ই তোমার প্রকৃত সত্তা—আমি নই, আমি-এরও পূর্ববর্তী আমি—সেই ব্রহ্ম, সেই চিরন্তন তুমি।
২৯.
“আমি”-র অন্তে আসে পরম সত্য। ‘আমি আছি’—এই বোধ না থাকলে কিছুই চাওয়া লাগে না—না চাহিদা, না আকাঙ্ক্ষা, না অভাব—সব চাহিদার শুরু হয়েছে এই 'আমি'-র আবির্ভাবের সঙ্গে।
উপনিষদ বলেন, “যদ্ বৈ অতঃ পরং তৎ সত্যম্”—যা 'আমি'রও পরে থাকে, কেবল সেটিই সত্য। আর এই ‘আমি’ কী? এই তো দেহের পাঁচ উপাদানের নির্যাস—এক ক্ষণস্থায়ী চেতনার স্পন্দন, যা শরীরকে কেন্দ্র করেই জেগে উঠেছে—যেমন দীপ্তি জাগে প্রদীপে, আর প্রদীপ নিভলে দীপ্তিও মিলিয়ে যায়।
এই ‘আমি’-র কোনো স্থায়িত্ব নেই—দেহের মতোই সে ক্ষণিক—দেহ মরে, ‘আমি’ও যায়—কারণ সে শরীরনির্ভর। অতএব, যা দেহনির্ভর, যা সময়ের সঙ্গে যায়, তা কি সত্য হতে পারে? উপনিষদ জবাব দেন—“নৈতৎ, নৈতৎ”—এ-ও নয়, তা-ও নয়। যখন দেহ যাবে, ‘আমি’ যাবে, আর যেটা রয়ে যাবে—তা কিছু নয়, কিন্তু সব কিছু—নিরুপাধি, নিরবিকল্প, অচল, অদ্বিতীয়—পরব্রহ্ম।
জন্মের আগে ‘আমি’ ছিল না, মৃত্যুর পরে ‘আমি’ থাকবে না, আর মাঝখানে যা এসেছিল, তা কেবল সময়সীমায় গড়া এক ছায়া। কিন্তু তুমি—সেই ছায়ারও পূর্বে, সেই মায়ারও বাইরে—তুমি সেই আলো, যা চিরকাল নিজের মধ্যেই থেকে গেছে অপ্রকাশ্য, অক্ষয়, অচঞ্চল।
৩০.
“আমি”-তে স্থিতি ও “আমি”-র অতিচরণ—সাধনার এই দুই ধাপ। কেবল বিশ্বাস নয় যে "আমি আছি", বরং স্থাপন করো সেই অন্তর্দৃষ্টিও—তুমি ‘আমি’-রও অতীত, তুমি ‘আমি’ থেকে মুক্ত।
আত্মবোধের পথে দুটি স্পষ্ট ধাপ—প্রথম, ‘আমি আছি’ এই বোধকে উপলব্ধি করা, এবং তাতে স্থির হওয়া—যেমন উপনিষদ বলেন, “আত্মন্ তিষ্ঠ”—আত্মাতেই স্থিত হও। এই স্থিতি চাই গভীর বিশ্বাসে—“আমি আছি”—এই অনুভবকে কেন্দ্রে রেখে, মন, ক্রিয়া, এবং চিন্তা সব সেই কেন্দ্রে এনে একাগ্র করা। যখন এই একাগ্রতা পুষ্ট হয়, তখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় দ্বিতীয় ধাপ।
সেই দ্বিতীয় ধাপেই ঘটে উন্মোচন—তুমি উপলব্ধি করো—“এই ‘আমি’—যাকে আমি দেখছি, জানছি, অনুভব করছি—সেই তো আমি নই।” তুমি তো তার সাক্ষী, তুমি তারও আগে।
উপনিষদ বলেন, “দ্রষ্টাঃ দৃষ্টিমাত্রঃ”—তুমি দেখছ ‘আমি’-কে, তাই তুমি তার অন্তর্নিহিত নও—তুমি তার পূর্ববর্তী চৈতন্য। এই দুই ধাপ—১) ‘আমি’-তে স্থিতি, ২) ‘আমি’-কে পেরিয়ে যাওয়া—এই দুই-ই একত্রে গঠন করে সত্য সাধনা, চিরন্তন মুক্তির প্রকৃত পথ।
‘আমি’ হলো পথের দরজা, আর সেই পথেই এগিয়ে যাও, যতক্ষণ না বোঝো—তুমি পথ নও, তুমি পথচলারও পূর্বসূত্র। ‘আমি’-তে স্থিত হও—আর সেই স্থিতির গভীরতায় নিজেই মুছে যাবে সেই ‘আমি’-বোধ। আর তখন যা থাকবে, তা-ই তোমার প্রকৃত স্বরূপ—নির্মল, অচঞ্চল, অদ্বিতীয় ব্রহ্ম।